আক্বীদাহ সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাহ (পর্ব-৩)

আবদুল্লাহিল হাদী বিন আবদুল জলীল

২১. প্রশ্নঃ আল্লাহ তা‘আলা নাবী ও রাসূলগণকে দুনিয়ায় কী জন্য পাঠিয়েছিলেন?

উত্তর: আল্লাহ তা‘আলা নাবী ও রাসূলগণকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের মাধ্যমে মানুষদেরকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে তথা আল্লাহর একত্ববাদের দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্য। আর আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার স্থাপন করা থেকে মানুষদেরকে বিরত রাখার জন্য। আল্লাহ তাআলার কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন:

﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُوْا اللهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوْتَ﴾

অর্থ:‘আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্যে আমি তো প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি (আন্ নাহল:৩৬)।

২২. প্রশ্ন: ইবাদতের অর্থ কি ? এবং ‘ইবাদত কালিমা, নামায, রোযা, হাজ্জ ও যাকাত এ কয়টির মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ?

উত্তর: ইবাদতের অর্থ: প্রকাশ্য এবং গোপনীয় ঐ সকল কাজ ও কথা যা আল্লাহ তা‘আলা ভালবাসেন বা যার দ্বারা আল্লাহর সস্তুষ্টি অর্জন করা যায় তাকে ইবাদত বলা হয় ‘ইবাদত কালেমা, নামায, রোযা, হাজ্জ ও যাকাত এ কয়টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।  আল্লাহ তা‘আলার কথাই এর দলীল, যেমন তিনি বলেন :

﴿قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ﴾

অর্থঃ ‘(হে রাসূল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার উম্মাতদেরকে) আপনি বলে দিন যে, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবাণী, এবং আমার জীবন ও মরণ সব কিছুই সেই আল্লাহর জন্য যিনি সারা বিশ্বের প্রতিপালক (আনআম: ১৬২)।

উক্ত আয়াত দ্বারা এটাই প্রমাণিত হল যে, কালেমা, নামায, রোযা, হাজ্জ ও যাকাত ছাড়াও মানুষের জীবনের প্রতিটি ভাল কথা ও কাজ ইবাদতের মধ্যে গণ্য। যেমন দুআ করা, বিনয় ও নম্রতার সাথে ইবাদত করা, হালাল উপার্জন করা ও হালাল খাওয়া, দান-খয়ারাত করা, পিতা-মাতার সেবা করা, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করা, এবং সর্ব কাজে ও কথায় সত্যাশ্রয়ী হওয়া, এবং মিথ্যা বর্জন করা ইত্যাদি।

২৩. প্রশ্ন: আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় পাপের কাজ কোনটি ?

উত্তর: আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় পাপের কাজ হলো: ‘বড় শিরক। আল্লাহ তা‘আলার কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন,

﴿وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِإِبْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ﴾ (لقمان:13 )

অর্থ:‘হযরত লোকমান (আ:) তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিতে যেয়ে বলেছিলেন, হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করবে না। কেননা শিরক হলো সবচেয়ে বড় যুলুম। (অর্থাৎ বড় পাপের কাজ)

২৪. প্রশ্ন: ‘বড়শির্ক কাকে বলা হয়? এবং বড়শির্ক কয়টি?

উত্তর: ‘বড়শিরক হলোঃ বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের মধ্য হতে কোন ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টির জন্যে নির্ধারণ করা। যেমন আল্লাহ ছাড়া কোন পীর-ফকীর বা অলী- আউলিয়াদের কাছে সন্তান চাওয়া, ব্যবসা বানিজ্যে আয়-উন্নতির জন্যে বা কোন বিপদ থেকে মুক্তির জন্যে কোন পীর-ফকীরের নামে মান্নত দেয়া, কোন জানোয়ার যবেহ করা ইত্যাদি। আল্লাহর কথাই এর দলীল, যেমন তিনি বলেন:

﴿وَلاَ تَدْعُ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَنْفَعُكَ وَلاَ يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِّنَ الظَّالِمِيْنَ﴾ (يونس:106)

অর্থ:‘(হে মুহাম্মাদ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি আল্লাহ ব্যতীত এমন আর কোন জিনিসের ইবাদত করবেন না, যা আপনার কোন প্রকার ভাল ও মন্দ করার ক্ষমতা রাখে না। কাজেই হে নবী! আপনি যদি এমন কাজ করেন, তাহলে আপনিও যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। (ইউনূস: ১০৬)

‘বড় শিরক এর কোন সংখ্যা নির্ধারিত নেই তবে বড়শিরকের শাখা প্রশাখা অনেক, তার মধ্য হতে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

  • ১. আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে ডাকা, অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া।
  • ২. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে খুশী করার জন্য যবেহ করা।
  • ৩. আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে মান্নত মানা।
  • ৪. কবরবাসীর সন্তুষ্টির লাভের জন্য তার কবরের চারি পার্শ্বে তাওয়াফ করা।
  • ৫. বিপদে-আপদে পতিত হলে আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করা।

২৫. প্রশ্ন: বড়শির্কের দ্বারা মানুষের কি ক্ষতি হয় ?

উত্তরঃ বড়শির্কের দ্বারা মানুষের সৎ আমল সব নষ্ট হয়ে যায়, জান্নাত হারাম হয়ে যায়। চিরস্থায়ী ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারিত হয়। আর তার জন্যে পরকালে কোন সাহায্যকারী থাকেনা। আল্লাহর কথাই এর দলীল যেমন তিনি বলেন,

﴿لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ﴾ (الزمر:65)

অর্থ: ‘(হে নবী! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি যদি শিরক করেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। আর আপনি অবশ্যই ক্ষতিগ্র¯’দের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। (যুমার: ৬৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

﴿إِنَّهُ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ﴾ (المائدة:72)

অর্থ:‘নিশ্চয়ই যিনি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার বানায়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন, তার চিরস্থায়ী বাসস্থান হবে জাহান্নাম। এবং যালেম বা মুশরিকদের জন্য কেয়ামতের দিন কোন সাহায্যকারী থাকবে না। (মায়িদাহ: ৭২)

২৬. প্রশ্নঃ শির্ক মিশ্রিত সৎ আমল আল্লাহর নিকট গ্রহণ যোগ্য হবে কী?

উত্তরঃ না, শিরক মিশ্রিত সৎ আমল সবই নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে তা আল্লাহর নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে না। উল্লেখিত সূরা যুমারের ৬৫ নং আয়াত এর স্পষ্ট দলীল।

২৭. প্রশ্নঃ মৃত অলী-আওলিয়াদের দ্বারা এবং অনুপস্থিত জীবিত অলী-আওলিয়াদের দ্বারা অসীলা করে দু‘আ করা এবং বিপদে-আপদে পড়ে সাহায্য চাওয়া জায়েয কি না?

উত্তরঃ জায়েয নয়,আল্লাহর কথাই এর দলীল, যেমন তিনি বলেন

﴿إِنَّ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ ﴾ (الأعراف:194)

অর্থ: ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তো সবাই তোমাদের মতই বান্দা। (আরাফ: ১৯৪)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿أَمْوَاتٌ غَيْرُ أَحْيَآءٍ وَمَا يَشْعُرُوْنَ أَيَّانَ يُبْعَثُوْنَ﴾

অর্থ: ‘তারা তো মৃত, প্রাণহীন, এবং তাদেরকে কবে পুণরুত্থান করা হবে তারা তাও জানে না। (নাহল: ২১) এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচাতভাই আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,

“إِذَا سَأَلْتَ فَاسْئَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ “(الترمزي)

অর্থ: ‘যখন তুমি কোন কিছু চাইবে- তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন তুমি কোন সাহায্য চাইবে, তখন একমাত্র মহান আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। (তিরমিযী)।

২৮. প্রশ্ন: উপস্থিত জীবিত ব্যক্তিদের কাছে সাহায্য চাওয়া জায়েয কি ?

উত্তর: হা, জায়েয, উপস্থিত জীবিত ব্যক্তি তিনি যে সমস্ত বস্তু সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন, সে সমস্ত বস্তু তার কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে। এতে কোন অসুবিধা নেই। আল্লাহর কথাই এর দলীল, যেমন তিনি বলেন:

﴿فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِيْ مِنْ شِيْعَتِهِ عَلَى الَّذِيْ مِنْ عَدُوِّهِ فَوَكَزَهُ مُوْسَى فَقَضَى عَلَيْهِ﴾ (القصص:১৫)

অর্থ:‘হযরত মূসা (আঃ)-এর দলের লোকটি তার শত্রুর বিরুদ্ধে মূসা (আঃ) এর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করল, তখন মূসা (আঃ) তার ঐ শত্রুকে ঘুষি মারলেন, এভাবে তিনি তাকে হত্যা করে ফেললেন। (ক্বাছাছ: ১৫)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

﴿وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِِرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُوْا عَلَى الإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ﴾

অর্থ:‘তোমরা পরস্পরকে সাহায্য কর নেক কাজ করতে এবং পরহেজগারীর ব্যাপারে। তবে পাপ কাজে ও শত্রুতার ব্যাপারে তোমরা একে অপরকে সাহায্য করো না। (মায়িদাহ: ২) এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

وَاللهُ فِيْ عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِيْ عَوْنِ أَخِيْهِ). (مسلم))

অর্থ:‘কোন বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকবে ততক্ষণ আল্লাহ সেই বান্দার সাহায্যে নিয়োজিত থাকবেন। (মুসলিম)

২৯. প্রশ্নঃ আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা কি জায়েয?

উত্তর: না, যে সমস্ত বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেহই সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না, সে সমস্ত বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া না জায়েয তথা শিরক। আল্লাহর কথাই এর দলীল, যেমন তিনি বলেন,:

﴿إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ﴾ (الفاتحة:৫)

অর্থ:‘(হে আল্লাহ!) আমরা একমাত্র তোমরাই ইবাদত করি আর একমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। (ফা-তিহা: ৫(

৩০. প্রশ্ন: আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে মান্নত করা জায়েয কি?

উত্তর: না, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে মান্নত করা জায়েয নয়। আল্লাহ তা‘আলার কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন:

﴿رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِيْ بَطْنِيْ مُحَرَّرًا﴾

অর্থ:‘(এমরানের স্ত্রী বিবি হান্নাহ) আল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেন, হে আমার রব্ব ! আমার পেটে যে সন্তান আছে তা আমি মুক্ত করে তোমার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দিয়েছি। (আলু এমরান: ৩৫)