আক্বীদাহ সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাহ (পর্ব-১)

আবদুল্লাহিল হাদী বিন আবদুল জলীল

প্রণয়নেঃ আবুল কালাম আযাদ সম্পাদনায়: আব্দুন নূর আব্দুল জব্বার

১. প্রশ্ন: মহান আল্লাহ কোথায় অবস্থান করেন?

উত্তর: মহান আল্লাহ আরশে আযীমের উপর অবস্থান করেন। আল্লাহর কথাই এর দলীল। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

﴿الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى﴾

অর্থ: ‘(তিনি আল্লাহ বলেন) পরম দয়াময় আরশের উপর সমুন্নীত রয়েছেন। [সূরা ত্বা-হা:৫] মহান আল্লাহ আসমানের উপর বা আরশে আযীমের উপর সমুন্নত আছেন, এই অর্থে কুরআন মাজীদের ৭টি আয়াত রয়েছে।  অতএব যারা দাবী করেন যে, মহান আল্লাহ সর্ব জায়গায় বিরাজমান, অথবা তিনি মুমিন বান্দার ক্বলবের ভিতর অব্স্থান করেন, আর মু‘মিন বান্দার ক্বলব বা অন্তর হলো আল্লাহর আরশ বা ঘর। তাদের এ সমস্ত দাবী সবই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

২. প্রশ্ন: মহান আল্লাহর চেহারা অর্থাৎ মূখমন্ডল আছে কি? থাকলে তার দলীল কী?

উত্তর: হাঁ, মহান আল্লাহর চেহারা অর্থাৎ মূখন্ডল আছে। আল্লাহর কথাই এর দলীল ।

﴿كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ ـ وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ﴾

অর্থ: ‘[কিয়ামতের দিন] ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে (হে রাসূল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালন কর্তার চেহারা মুবারক অর্থাৎ আল্লাহর সত্তাই একমাত্র বাকী থাকবে। (আর-রাহমান: ৩৬-৩৭)

৩. প্রশ্নঃ মহান আল্লাহর কি হাত আছে? থাকলে তার দলীল কী?

উত্তরঃ মহান আল্লাহর হাত আছে, আল্লাহর কথাই এর দলীল।

﴿قَالَ يَا إِبْلِيْسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ﴾ (ص:৭৫)

অর্থ: ‘আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস ! আমি নিজ দুহাতে যাকে সৃষ্টি করেছি, তাকে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাঁধা দিল? (ছোয়াদ:৭৫(

৪. প্রশ্ন: মহান আল্লাহর কি চক্ষু আছে? থাকলে তার দলীল কী?

উত্তরঃ হাঁ, মহান আল্লাহর চক্ষু আছে। আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি হযরত মূসা (আঃ) কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন:

﴿وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِّنِّيْ وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِيْ﴾ (طـه :৩৯)

অর্থ:‘আমি আমার নিকট হতে তোমার উপর ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম, যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও। (ত্বা-হা: ৩৯) এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে শান্তনা দিতে যেয়ে বলেন:

﴿وَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا ﴾ (الطور:৪৮ )

অর্থ:‘(হে রাসূল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি আপনার পালন কর্তার নির্দেশের অপেক্ষায় ধৈর্যধারণ করুন, আপনি আমার চোখের সামনেই রয়েছেন। (আত-তূর: ৪৮)

৫. প্রশ: মহান আল্লাহ শুনেন এবং দেখেন, এর দলীল কী?

উত্তর: মহান অল্লাহ শুনেন এবং দেখেন। আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন,

﴿ إِنَّ اللهَ سَمِيْعٌ بَصِيْرٌ﴾ (المجادلة:১)

অর্থ:‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা শ্রবণ করেন ও দেখেন। (আল-মুজাদালাহ: ১)

৬. প্রশ্ন: মানুষের শ্রবণ শক্তি ও দর্শন শক্তি, অপর দিকে মহান আল্লাহর শ্রবণ শক্তি ও দর্শন শক্তি, এ দুয়ের মাঝে কোন পার্থক্য আছে কী?

উত্তর: হাঁ, মানুষেরা কানে শুনে ও চোখে দেখে, অপর দিকে মহান আল্লাহ শুনেন ও চোখে দেখেন, এ দুয়ের মাঝে অবশ্যই বিরাট পার্থক্য রয়েছে। মহান আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন,

﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ﴾ (الشورى: ১১)

অর্থ:‘আল্লাহর সাদৃশ্য কোন বস্তুই নাই এবং তিনি শুনেন ও দেখেন (শূরা:১১)।

বাস্তবতার আলোকে চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি যে, নি:সন্দেহে মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির একটা নির্ধারিত আয়তন, সীমা বা দুরত্ব আছে যার ভিতরের বস্তু গুলি মানুষেরা সহজে চোখে দেখতে পায় এবং আওয়ায বা শব্দ সমূহ সহজে কানে শুনতে পায়। তবে ঐ নির্ধারিত সীমা বা দূরত্বের বাইরে চলে গেলে তখন মানুষ আর কিছুই চোখে দেখতেও পায় না আর শুনতে পায় না। অপর দিকে মহান আল্লাহর দর্শনশক্তি ও শ্রবন শক্তির জন্য নির্ধারিত কোন সীমা বা দুরত্ব বলতে কিছুই নেই। যেমন মানুষেরা ২/৩ হাত দূর থেকে বইয়ের ছোট অক্ষরগুলি দেখে পড়তে পারে, কিন্তু ৭/৮ হাত দূর থেকে ঐ অক্ষরগুলি আর পড়া সম্ভব হয় না।

এমনিভাবে মানুষের চোখের সামনে যদি সামান্য একটা কাপড় বা কাগজের পর্দা ঝুলিয়ে রাখা হয় তাহলে ঐ কাপড় বা কাগজের ওপাশে সে কিছুই দেখতে পায় না। এমনিভাবে মানুষেরা গভীর অন্ধকার রাতে কিছুই দেখতে পায় না। অপর দিকে মহান আল্লাহ তা‘আলা অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার রাতে কাল পাহাড় বা কাল কাপড়ের উপর দিয়ে কাল পিঁপড়া চলাচল করলেও সেই পিঁপড়াকে দেখতে পান এবং তার পদধ্বনি শুনতে পান।

৭.প্রশ্ন: একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ গায়েবের খবর রাখে কী?

উত্তর: না, একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ গায়েবের খবর রাখে না। আল্লাহ তাআলার কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন:

﴿إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُوْنَ وَمَا كُنْتُمْ تَكْتُمُوْنَ﴾ (البقرة:৩৩)

অর্থ:‘নিশ্চয়ই আমি আাল্লহ আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত আছি এবং সে সব বিষয়েও আমি জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন রাখ। (বাক্বারাহ: ৩৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

﴿وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ﴾  (الأنعام :৫৯)

অর্থ: “সেই মহান আল্লাহর কাছে অদৃশ্য জগতের সমস্ত চাবি রয়েছে। সেগুলো একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেহই জানেন না।” (আনআম: ৫৯)

৮.প্রশ্নঃ দুনিয়ার জীবনে মুমিন বান্দাদের পক্ষে স্বচক্ষে অথবা স্বপ্নযোগে মহান আল্লাহর দর্শন লাভ করা অর্থাৎ আল্লাহকে দেখা কি সম্ভব?

উত্তরঃ না, দুনিয়ার জীবনে মু‘মিন বান্দাদের পক্ষে স্বচক্ষে অথবা স্বপ্ন যোগে মহান আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন?

   ﴿قَالَ رَبِّ أَرِنِي أَنْظُرْ إِلَيْكَ قَالَ لَنْ تَرَانِيْ .. ﴾ (الأعراف :১৪৩)

অর্থ: “তিনি (হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহকে লক্ষ্য করে) বলেছিলেন, হে আমার প্রভূ! তোমার দীদার আমাকে দাও, যেন আমি তোমাকে দেখতে পাই।  উত্তরে মহান আল্লাহ (হযরত মূসা (আঃ) কে) বলেছিলেন, হে মূসা! তুমি আমাকে কক্ষনো দেখতে পাবে না। (আ‘রাফ: ১৪৩) উক্ত আয়াত ও আরো অন্য আয়াত দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, সৃষ্টিজিবের কোন চক্ষু এমনকি নাবী ও রাসূলগণের কেহই দুনিয়ার জীবনে মহান আল্লাহকে দেখতে পায় নাই আর কেউ পাবেও না। অতএব যারা বা যে সমস্ত নামধারী পীর সাহেবরা দাবী করে যে, তারা সপ্নে আল্লাহকে দেখতে পায়। প্রকৃতপক্ষে তারা ভন্ড ও মিথ্যুক, এতে কোন সন্দেহ নেই।

৯.প্রশ্ন: আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কি মাটির তৈরি? না নূরের তৈরি?

উত্তর: আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মাটির তৈরী। আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন,

﴿قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوْحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَـهُكُمْ إِلهٌ وَّاحِدٌ﴾

অর্থ:‘আপনি (হে রাসূল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার উম্মাতদেরকে) বলে দিন যে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানূষ। আমার প্রতি অহী নাযেল হয় যে, নিশ্চয় তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য। (আল-কাহফ: ১১০)

উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৈহিক চাহিদার দিক দিয়ে আমাদের মতই মানুষ ছিলেন। তিনি খাওয়া-দাওয়া, পিশাব-পায়খানা,বাজার-সদাই,বিবাহ-শাদী, ঘর-সংসার সবই আমাদের মতই করতেন। পার্থক্য শুধু এখানেই যে, তিনি আল্লাহর প্রেরীত রাসূল ও নবী ছিলেন, তাঁর কাছে আল্লাহর তরফ থেকে দুনিয়ার মানুষের হিদায়েতের জন্য অহী নাযিল হত, আর অমাদের কাছে অহী নাযিল হয় না। অতএব যারা রাসূলের প্রশংসা করতে যেয়ে নূরের নাবী বলে অতিরঞ্জিত করল, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর প্রতি মিথ্যার অপবাদ দিল।

১০. প্রশ্ন: অনেক বই পুস্তকে লেখা আছে, এ ছাড়া আমাদের দেশের ছোট-খাট বক্তা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বক্তাদের অধিকাংশই বলে থাকেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যমীন, আরশ-কুরসী কিছুই সৃষ্টি করতেন না। এ কথাটি সঠিক?      

উত্তর: উল্লিখিত কথাগুলি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানাওয়াটি ও মিথ্যা। কারণ কুর‘আন ও ছহীহ হাদীছ থেকে এর স্বপক্ষে কোন দলীল নেই। অপরদিকে কুরআন মাজীদের সূরা আয-যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, ‘আমি জ্বিনজাতি এবং মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদাত করার জন্য।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)