সালাতের শর্তাবলি,স্তর বা রুকন,ওয়াজিব এবং সুন্নাহ

প্রশ্ন: সালাতের শর্তাবলি, স্তর বা রুকন, ওয়াজিব এবং সুন্নাত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনাসহ জানতে চাই?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সালাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর উপরেই অন্যান্য ইবাদত কবুল হওয়া বা না হওয়া নির্ভর করে। সালাত সঠিক হ’লে অন্যান্য সব ইবাদত সঠিক হবে। আর সালাত বাতিল হ’লে অন্যান্য সব ইবাদত বাতিল হবে। তাই সালাতকে মানদন্ড বলা যায়। সালাত সম্পাদনের কতিপয় শর্তাবলি, স্তর বা রুকন, ওয়াজিব এবং সুন্নাত কুরআন ও হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে। যেগুলি প্রতিপালন করলে সালাত সঠিক হবে এবং কাঙ্ক্ষিত ছওয়াব অর্জিত হবে। পক্ষান্তরে এগুলি প্রতিপালন না করলে সালাত যেমন সঠিক হবে না, তেমনি কাঙ্ক্ষিত সওয়াবও অর্জিত হবে না। নিম্নে তা উল্লেখ করা হ’ল:

• এক: সালাতের রুকন ১৪টি।
• দুই: সালাতের ওয়াজিব ৮টি।
• তিন: সালাতের বাচনিক সুন্নত ১১টি।
• চার: কর্মকেন্দ্রিক সুন্নতসমূহ।

প্রথমেই কিছু বিষয় জেনে রাখা ভাল।
রুকন ও ওয়াজিব এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- নামাযের কোন রুকন ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভুলক্রমে বাদ পড়তে পারবে না। বরং রুকনটি অবশ্যই পালন করতে হবে।বাদ দিলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে। আর ওয়াজিব ভুলক্রমে ছুটে গেলে সাহু সেজদার মাধ্যমে সেটা শোধরে নেয়া যায়।এখানে আমরা ধারাবাহিক ভাবে নামাযের আরকান ও ওয়াজিবগুলো উল্লেখ করাকে প্রাসঙ্গিক মনে করছি; এরপর আমরা ‘দলিলুত ত্বালেব’ গ্রন্থ থেকে বেশ কিছু সুন্নত উল্লেখ করব। এ বইটি হাম্বলি মাযহাবের প্রসিদ্ধ পুস্তিকা:

🔲[সালাতের শর্তাবলি ৯ টি]
_______________________________
▪️(১) মুসলিম হওয়া, [সুরা আলে ইমরান: ৮৫]
▪️(২) জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, [ইবনু মাজাহ, হা/২০৪১]
▪️(৩) ভালো-মন্দের বিবেচনাবোধসম্পন্ন হওয়া,[আবু দাউদ, হা/৪৯৫; সনদ: হাসান]
▪️(৪) ওজু নষ্টের কারণগুলো দূরীভূত করা,
▪️(৫) অপবিত্রতা দূর করা, [সুরা মুদ্দাসসির: ৪]
▪️(৬) আবরণীয় অঙ্গকে আবৃত রাখা, [সুরা আরাফ: ৩১]
▪️(৭) সময় হওয়া, [সূরা নিসা: ১০৩]
▪️(৮) কিবলামুখী হওয়া এবং [সুরা বাকারা: ১৪৪]
▪️(৯) নিয়ত করা। [সহিহ বুখারি, হা/১]

🔲[সালাতের স্তম্ভ বা রুকন সমূহ ১৪ টি]
____________________________________
▪️(১) সামর্থ্য থাকলে দাঁড়ানো,[সুরা বাকারা: ২৩৮]
▪️(২) তাকবিরাতুল ইহরাম তথা নামাজ আরম্ভের তাকবির দেওয়া, [তিরমিজি, হা/২৩৮; সনদ: সহিহ]
▪️(৩) ফাতিহা পাঠ করা, [সহিহ বুখারি, হা/৭৫৬; সহিহ মুসলিম, হা/৩৯৪] সুরা ফাতিহা কুরআনের মূল।]
▪️(৪) রুকু করা, [সুরা হজ: ৭৭]
▪️(৫) রুকু থেকে ওঠা, [সহিহ বুখারি, হা/৮১২]
▪️(৬) সাতটি অঙ্গের ওপর সিজদা দেওয়া, [সুরা হজ: ৭৭ সহিহ বুখারি, হা/৮১২]
▪️(৭) সিজদা থেকে সোজা হওয়া, [সুরা হজ: ৭৭
সহিহ বুখারি, হা/৮১২]
▪️(৮) দু সিজদার মাঝে উপবেশন করা, [সুরা হজ: ৭৭
সহিহ বুখারি, হা/৮১২]
▪️(৯) সকল স্তম্ভের কার্য সম্পাদনে ধীরস্থির থাকা, [সহিহ বুখারি, হা/৭৫৭; সহিহ মুসলিম, হা/৩৯৭]
▪️(১০) পর্যায়ক্রম বজায় রাখা, [সহিহ বুখারি, হা/৭৫৭; সহিহ মুসলিম, হা/৩৯৭]
▪️(১১) শেষ তাশাহহুদ, [সহিহ বুখারি, হা/৮৩১; সহিহ মুসলিম, হা/৪০২]
▪️(১২) শেষ তাশাহহুদের জন্য বসা,
▪️(১৩) নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাত (দরুদ) পাঠ করা,
▪️(১৪) দুই সালাম।

🔲[নামাজের ওয়াজিবসমূহ ৮ টি]
__________________________________
নামাজের ওয়াজিব আটটি:
▪️(১) নামাজ আরম্ভের তাকবির ব্যতীত বাকি সকল তাকবির,
▪️(২) রুকুতে ‘সুবহানা রব্বিয়াল আজিম (আমার সুমহান রবের পবিত্রতা বর্ণনা করছি)’ বলা,
▪️(৩) ইমাম ও একাকী নামাজরত ব্যক্তির জন্য ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ (আল্লাহ তার দোয়া কবুল করুন,যে তাঁর প্রশংসা করে)’ বলা,
▪️(৪) সকলের জন্য ‘রব্বানা ওয়া লাকাল হামদ (হে আমাদের রব, যাবতীয় প্রশংসা কেবল আপনার জন্যই নিবেদিত) বলা,
▪️(৫) সিজদায় ‘সুবহানা রব্বিয়াল আলা (আমার সমুচ্চ রবের পবিত্রতা ঘোষণা করছি)’ বলা,
▪️(৬) দুই সিজদার মাঝে ‘রব্বিগফিরলি (প্রভুগো, আমায় ক্ষমা করুন)’ পাঠ করা,
▪️(৭) প্রথম তাশাহহুদ পড়া এবং
▪️(৮) প্রথম তাশাহহুদের জন্য উপবেশন করা।

🔲[সালাতের সুন্নাতসমুহ]
__________________________
সালাতের সুন্নত অনেক। এর মধ্যে কোন কোন সুন্নত বাচনিক এবং কোন কোন সুন্নত কর্মকেন্দ্রিক। সুন্নত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে-সালাতের আরকান ও ওয়াজিব ছাড়া অন্য যা আছে সেসব।

কোন কোন ফিকাহবিদ নামাযের ১৭ টি বাচনিক সুন্নত ও ৫৫ টি কর্মকেন্দ্রিক সুন্নত উল্লেখ করেছেন। কোন সুন্নত ছুটে যাওয়ার কারণে নামায বাতিল হয় না; এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দিলেও নামায বাতিল হয় না। তবে, আরকান ও ওয়াজিবগুলোর বিধান এমন নয়।

◾নামাযের বাচনিক সুন্নত ১১টি; সেগুলো হচ্ছে:
_______________________________________
▪️১। তাকবীরে তাহরীমার পর ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বি হামদিকা,ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা,ওয়া লা ইলাহা গায়রুক’ (অর্থ- হে আল্লাহ! আপনি পাক-পবিত্র,সকল প্রশংসা আপনারই জন্য। আপনার নাম মহিমান্বিত। আপনার মর্যাদা সমুন্নত। (আপনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোন উপাস্য নেই) এই দোয়া বলা।
▪️২। আউযুবিল্লাহ পড়া।
▪️৩। বিসমিল্লাহ পড়া।
▪️৪। ‘আমীন’ বলা।
▪️৫। সূরা ফাতিহার পর অন্য একটি সূরা পড়া।
▪️৬। ইমামের জন্য উচ্চস্বরে ক্বিরাত পড়া।
▪️৭। ইমাম ছাড়া অন্যদের জন্য ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলার পর এই দোয়াটি পড়া ‘মিলআল সামাওয়াতি, ওয়া মিলআল আরযি, ওয়া মিলআ মা শি’তি বাদ।’অর্থ- হে আল্লাহ! আপনার জন্য ঐ পরিমাণ প্রশংসা যা আসমান ভর্তি করে দেয়, যা জমিন ভর্তি করে দেয় এবং এগুলো ছাড়া অন্য যা কিছু আপনি চান সেটাকে ভর্তি করে দেয়।তবে,সঠিক মতানুযায়ী এ দোয়াটি পড়া মোক্তাদির জন্যেও সুন্নত।
▪️৮। রুকুর তাসবীহ একবার পড়ার পর অতিরিক্ত যতবার পড়া হয়। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার,তৃতীয়বার কিংবা আরও যত বেশি বার পড়া হোক না কেন।
▪️৯। সেজদার তাসবীহ একবারের বেশি যতবার পড়া হোক।
▪️১০। দুই সেজদার মাঝখানে একবারের বেশি যতবার ‘রাব্বিগ ফির লি’ পড়া যায়।
▪️১১। শেষ বৈঠকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর দরুদ পড়া এবং এরপর দোয়া করা।

🔲[চার: কর্মকেন্দ্রিক সুন্নতসমূহ]
_________________________________
▪️১। তাকবীরে তাহরীমার সময় হাতদ্বয় উত্তোলন করা।
▪️২। রুকুর সময় হাতদ্বয় উত্তোলন করা।
▪️৩। রুকু থেকে উঠার সময় হাতদ্বয় উত্তোলন করা।
▪️৪। হাত উঠিয়ে সাথে সাথে নামিয়ে ফেলা।
▪️৫। বাম হাতের ওপর ডান হাত রাখা।
▪️৬। সেজদার স্থানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা।
▪️৭। দাঁড়ানো অবস্থায় দুই পায়ের মাঝখানে খালি রাখা।
▪️৮। রুকু অবস্থায় হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁকা রেখে দুই হাত দিয়ে হাঁটু আঁকড়ে ধরা,পিঠ প্রসারিত রাখা এবং পিঠ ও মাথা এক বরাবরে রাখা।
▪️৯। সেজদা অবস্থায় হাঁটুদ্বয় ছাড়া সেজদার অন্য অঙ্গগুলোকে ভূমির সাথে সেঁটে রাখা।
▪️১০। দুই পার্শ্ব থেকে হাতের বাহুদ্বয়,দুই উরু থেকে পেট,দুই উরু থেকে পায়ের গোছা ফাঁকা করে রাখা। দুই হাঁটুর একটি অপরটি থেকে দূরে রাখা। দুই পা খাড়া করে রাখা। পায়ের আঙ্গুলগুলো ফাঁকা করে ভূমির ওপর রাখা। দুই হাত কাঁধ বরাবর রেখে আঙ্গুলগুলো একটি অপরটির সাথে মিলিয়ে জমিনের ওপর বিছিয়ে রাখা।
▪️১১। দুই সেজদার মাঝখানে ও প্রথম বৈঠকের সময় পায়ের পাতার ওপর বসা। আর দ্বিতীয় বৈঠকের সময় পাছার ওপর বসা।
▪️১২। দুই সেজদার মাঝখানে বসার সময় উরুর ওপর হাতের তালু বিছিয়ে রাখা,হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে রাখা। তাশাহুদের বৈঠকের সময়েও একই পদ্ধতিতে রাখা। তবে,তাশাহুদের সময় কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙ্গুল গুটিয়ে রাখা,মধ্যমা ও বৃদ্ধা অঙ্গুলি দিয়ে বৃত্তাকার আকৃতি তৈরী করা এবং তর্জনী অঙ্গুলি দিয়ে ‘আল্লাহকে স্মরণ’ করার সময় ইশারা করা।
▪️১৩। সালাম দেয়ার সময় ডান দিকে ও বাম দিকে ফিরে তাকানো।(ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং ৬৫৮৪৭)

উল্লেখিত এ সুন্নতগুলোর কোন কোনটির ব্যাপারে ফিকাহবিদগণের মতানৈক্য রয়েছে। কোন কোন ফিকাহবিদের ওয়াজিব এবং কোন কোন ফিকাহবিদের কাছে সুন্নত। ফিকাহ’র গ্রন্থগুলোতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।তবে সালাতে কোন সুন্নত ত্যাগ করলে সালাতের কোন ক্ষতি হয়না তবে সওয়াব কম হয়। আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী।
_______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: