মেয়ের জামাই তার শাশুড়ীর সাথে যিনা করলে স্ত্রী কি তার জন্য হারাম হয়ে যাবে

উত্তর: যিনা-ব্যভিচার কাবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে অন্যতম। মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বার বার এই জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।(সূরা বানী ইসরাঈল: ৩২; সূরা আন-নূর: ২)। ইসলামে ব্যভিচার যেহেতু বড়ই অপরাধমূলক কাজ; এত বড় অপরাধ যে, কোন বিবাহিত পুরুষ অথবা মহিলার দ্বারা এ কাজ হয়ে গেলে, ইসলামী সমাজে তার জীবিত থাকার অধিকার থাকে না। আবার তাকে তরবারির এক আঘাতে হত্যা করাও যথেষ্ট হয় না, বরং নির্দেশ হল, পাথর মেরে মেরে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। যাতে সে সমাজে (অন্যদের জন্য) শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে যায়। সেহেতু এখানে বলা হয়েছে,যিনার কাছেও যেয়ে না” অর্থাৎ, তাতে উদ্বুদ্ধকারী উপায়-উপকরণ থেকেও দূরে থাক।এ হুকুম ব্যক্তির জন্য এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র সমাজের জন্যও প্রযোজ্য।
.
প্রশ্ন অনুযায়ী মেয়ের জামাই তার শাশুড়ীর সাথে যিনা করলে শরীয়তের দৃষ্টিতে এখানে তিনটি বিষয় লক্ষনীয়। যথা:
.
(১). কাউকে যিনাকার সাব্যস্ত করতে হলে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে। কারণ প্রমাণ ছাড়া কারো উপর যিনার অপবাদ দেওয়া হারাম। মহান আল্লাহ বলেন; আর যারা সচ্চরিত্রা নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর তারা চারজন সাক্ষী নিয়ে না আসে, তাদেরকে তোমরা আশিটি বেত্রাঘাত কর এবং তোমরা কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না; এরাই তো ফাসেক। তবে যারা এরপর তাওবা করে ও নিজেদেরকে সংশোধন করে, তাহলে আল্লাহ্‌ তো অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা নূর; ২৪/৪-৫)। সুতরাং যে ব্যক্তি অন্যের বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ আনে, সে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নিজের অভিযোগ প্রমাণ করবে। আর যদি প্রমাণ করতে না পারে তাহলে তাকে আশি ঘা বেত্ৰাঘাত করো, যাতে ভবিষ্যতে আর সে কখনো এ ধরনের কোন কথা বিনা প্রমাণে নিজের মুখ থেকে বের করার সাহস না করে। আর তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।
.
(২). সুস্পষ্ট দলিলের আলোকে যদি প্রমাণিত হয় আপনার স্বামী আপনার মায়ের সাথে যিনার গুনাহ করেছে, তাহলে তারা উভয়েই এতে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। যেহেতু আপনার স্বামী এবং আপনার মা উভয়ই বিবাহিত তাই উভয়কে পাথর মেরে হত্যা করা উচিত।কেননা ইসলামী শরী‘আতে যিনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই ইসলামী বিধান অনুযায়ী অবিবাহিত কোন পুরুষ যদি ব্যভিচার করে, তাহলে তাকে একশ বেত্রাঘাত করা হবে এবং এক বছরের জন্য এলাকা থেকে বিতাড়িত করতে হবে। (সূরা আন-নূর : ২; সহীহ মুসলিম, হা/১৬৯০: আবু দাঊদ, হা/৪৪১৫; তিরমিযী হা/১৪৩৪)। আর বিবাহিত নারী-পুরুষ যিনায় লিপ্ত হলে তাকে রজম করতে হবে অর্থাৎ পাথর দিয়ে মেরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে।(সহীহ বুখারী, হা/৫২৭০-৫২৭১, ৬৮২৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৬৯১)। উপরোক্ত এগুলো দুনিয়াবী শাস্তি। এতদ্ব্যতীত একনিষ্ঠ তওবা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করলে ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করবে। (সহীহ বুখারী, হা/৭০৪৭; সহীহ মুসলিম, হা/২২৭৫)
.
জেনে রাখা ভাল, এই শাস্তির বিধান কার্যকর করবেন দেশের মুসলিম শাসক বা সরকার। সাধারণ কোনো মানুষ নয়। (ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৩৫)। যেহেতু আমাদের দেশে ইসলামী শাসক নেই,আর যিনা- ব্যভিচার যেহেতু কাবীরা গুনাহ, সেহেতু তওবা ব্যতীত এ গুনাহ মাফ হয় না। ব্যভিচারী ব্যক্তি ঐ গর্হিত কর্ম থেকে ফিরে আসার জন্য অনুতপ্ত হয়ে খালেছ অন্তরে তওবা করলে আল্লাহ চাইলে তার তওবা কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ। সুতরাং এমতাবস্থায় কর্তব্য হলো- দ্রুত উত্তম তওবাহ করা। আর তা হচ্ছে, এ জন্য লজ্জিত হওয়া, অনুতপ্ত হওয়া এবং এই জঘন্যকর্ম পরিত্যাগ করা। এবং ভবিষ্যতে কখনো এ ধরনের হারাম কর্মে জড়িত না হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। যে ব্যক্তি স্বচ্ছ ও পবিত্র অন্তরে একনিষ্ঠ ও একাগ্রতার সাথে খালেছ তওবা করে আল্লাহ তাঁর তওবা কবুল করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন; ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু। (সূরা আয-যুমার: ৫৩; সূরা তওবা-৮২; ফুরকান: ৬৮-৭০)
.
(৩). যিনা এমনিতেই মারাত্মক গুনাহের কাজ। আর মাহরাম কোন নারীর সাথে এমন কাজ করা তো আরো জঘন্য অপরাধ। সুতরাং শাশুড়ীর সাথে যিনা করার কাজটি অত্যন্ত গর্হিত হলেও উক্ত স্ত্রী তার স্বামীর জন্য হারাম হবেনা। উক্ত মাসয়ালায় মতানৈক্য থাকলেও এটাই বিশুদ্ধ মত। কারণ কোন হারাম সম্পর্ক কোন হালাল সম্পর্ক স্থাপনে বাধা হতে পারে না। যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] বলেছেন, যিনা বৈবাহিক বন্ধনকে হারাম করে না। (মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, বায়হাক্বী, ইরওয়া হা/১৮৮১, ৬/২৮৭ পৃঃ)। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম ১৫০ হি./৭৬৭ খ্রি] বলেন, কোন লোক যেনায় লিপ্ত হলে তার মেয়ে বা মায়ের সাথে হালাল সম্পর্ক স্থাপনে কোন বাধা নেই। (কিতাবুল উম্ম ৭/২০৬)
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন; সঠিক মত হলো, যে মেয়ের সাথে একজন পুরুষ যিনা করেছে সেই মেয়ের মা ঐ পুরুষের জন্য হারাম নয়। এবং যে মহিলার সাথে সে যিনা করেছে তার মেয়েও তার জন্য হারাম নয়। কারণ,বিবাহ হারাম এমন নারীদের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন; উল্লিখিত নারীগণ ব্যতীত আর সকলকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো। (সূরা নিসা; ৪/২৪)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এমন কোন মহিলার মা বা মেয়ের কথা উল্লেখ করেননি যার সাথে যিনা করা হয়েছে অথচ সে তাদের অন্তর্ভুক্ত যাদের সাথে বিবাহ হারাম। আল্লাহ অপর আয়াতে বলেছেন; আর(বিবাহ করা হারাম করা হয়েছে) তোমাদের শাশুড়িগণকে ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সহবাস হয়েছে,তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত কন্যাগণ, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে, তবে যদি তাদের (কন্যাদের মাতার) সাথে সহবাস না হয়ে থাকে, তাহলে তোমাদের (বিবাহে) কোন দোষ নেই। (সূরা নিসা; ৪/২৩)। একথা সর্বজনবিদিত যে নারীর সাথে একজন পুরুষ যিনা করেছে সে তার স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেহেতু সে তার স্ত্রীদের একজন নয়, তাই বৈধ বিবাহের সাথে ব্যভিচারের তুলনা করা বৈধ নয়। যদি সে যিনা থেকে তওবা করে থাকে তবে তার জন্য এমন কোন মহিলার মা বা মেয়েকে বিয়ে করা জায়েয যার সাথে সে যিনা করেছে। (ইমাম উসামীন আল-শারহ আল-মুমতি’ খন্ড:৭ পৃষ্ঠা:৩৮-৩৯, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭৮৫৯৭)
.
পরিশেষে, প্রশ্নকারী বোনের প্রতি কয়েকটি উপদেশ:
আমরা বুঝতে পারছি আপনার উপর কী ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। একজন নারীর দুঃখ কত বড়, এবং তার স্বামী যিনা করলে তা সহ্য করা তার পক্ষে অনেক কঠিন, এবং যখন নিজ মায়েরই সাথে যিনা করে তখন তা সহ্য করা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কঠিন। সুতরাং তার স্বামী যদি সে হয় তবে কেমন হবে যে তার মায়ের সাথে যিনা করছে? এটা আসলেই একটা মারাত্মক বিপর্যয়! একজন স্ত্রী হয়ে এখন আপনার যা করতে হবে তা হলো:
.
(১). আপনার কাছে যদি এই যিনার নিশ্চিত প্রমাণ না থাকে তাহলে এই বিষয়ে কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত নেবেন না।
.
(২). আপনার মাকে উপদেশ দিন যদি যিনার অভিযোগ প্রমাণিত হয়; তাহলে তার জন্য আন্তরিক ভাবে অনুতপ্ত হয়ে বিশুদ্ধ তওবা করা অপরিহার্য।
.
(৩). আপনার মায়ের সাথে আপনার স্বামীর যিনা প্রমানিত হলে আপনার স্বামীকে আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়ে বিশুদ্ধ তওবা করার পরামর্শ দিন। এবং এই কাজের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেজন্য তাকে আপনার মায়ের কাছে থেকে দূরে থাকার ব্যবস্থা করুন। যদি সে এই কাজ থেকে তওবা না করে তাহলে তাকে তালাক দিতে চাপ প্রয়োগ করা উচিত এবং একনিষ্ঠভাবে তওবা না করলে তার সাথে থাকা আপনার জন্য জায়েজ নয়। কেননা আল্লাহ একজন সতী মুমিন নারীর সাথে যিনাকার পুরুষের বিবাহ হারাম করেছেন। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আপনার কষ্ট দূর করেন এবং আপনাকে ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দান করেন। (আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭৮৫৯৭) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: