তিন রাকাআত বিতিরের সালাত আদায়ের সহীহ নিয়ম

প্রশ্ন: তিন রাকাআত বিতিরের সালাত আদায়ের সহীহ নিয়ম কি? বিতিরের সালাতে দু’আয় কুনূত পড়ার স্থান কোনটি?
▬▬▬▬▬▬▬◖🌻◗▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: বিতর (وتر) শব্দটি একটি আরবি শব্দ। ‘বিতর’ শব্দের অর্থ বেজোড়। বিতর সালাত আদায় করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। (ফিকহুস সুন্নাহ ১/১৪৩; নাসাঈ হা/১৬৭৬; মির‘আত ২/২০৭)। যা এশার ফরয সালাতের পর হতে ফজর পর্যন্ত সুন্নাত ও নফল সালাত সমূহের শেষে আদায় করতে হয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে একটি অতিরিক্ত নামায প্রদান করেছেন। আর তা হলো বিতরের নামায। সুতরাং তোমরা তা এশা ও ফজরের মধ্যবর্তী সময়ে পড়ে নাও।(সিলসিলাহ সহীহাহ ১০৮, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৪; সহীহ আত-তারগীব হা/৫৯২-৯৩)। বিতরের সালাত ১,৩,৫,৭,৯ ইত্যাদি রাকআত পড়া যায়। সবগুলোর পক্ষে বিশুদ্ধ দলিল রয়েছে। (সহীহ বুখারী হা/৪৭৩, সহীম মুসলিম ৭৪৭, ৭৫২)
.
এখন একজন ব্যক্তি যদি তিন রাকআত বিতর আদায় করতে চায় তাহলে তা দুটি উপায়ে করা যেতে পারে এবং উভয়টিই শরীয়তে নির্ধারিত। যেমন:
.
(১). ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরে দিতে হবে। অতঃপর উঠে পুনরায় নতুন করে আরো এক রাকআত পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (ইবনে আবী শাইবা, ইর: ২/১৫০)। নাফি’ (রহঃ) থেকে বর্ণিত; আবদুল্লাহ্ ইব্‌নু উমর (রাঃ) বিতর সালাতের দু’ রাক’আতের মাঝে সালাম ফিরাতেন। অতঃপর কাউকে কোন প্রয়োজনীয় কাজের নির্দেশ দিতেন। (সহিহ বুখারী, হা/৯৯১)। ইবনে উমর (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করতেন। (ইবনে হিব্বান হা/২৪৩৫) ইবনে হাজার রহ: বলেছেন: এর সনদ কাওয়ী (শক্তিশালী) আল-ফাতহ, ২/৪৮; ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৬৫৪৪)
.
(২). ৩ রাকআত একটানা পড়ে তাশাহহুদে বসতে হবে। এবং আত-তাহিয়্যাত ও দরুদ-দুআ পড়ে সালাম ফিরাতে হবে। (মুস্তাদরাক হাকেম,১/৩০৪, বায়হাকী ৩/২৮, ৩/৩১)। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। তিনি শেষের রাক‘আতে ব্যতীত বসতেন না। (মুস্তাদরাক হাকেম হা/১১৪০; বায়হাক্বী হা/৪৮০৩, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪১; সনদ সহীহ)। আত্বা (রহ:) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন কিন্তু মাঝে বসতেন না এবং শেষ রাক‘আত ব্যতীত তাশাহহুদ পড়তেন না। (মুস্তাদরাক হাকেম হা/১১৪২)। অপর বর্ননায় উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। প্রথম রাক‘আতে ‘সাবিবহিসমা রাবিবকাল আ‘লা’ দ্বিতীয় রাক‘আতে ‘কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরূন’ এবং তৃতীয় রাক‘আতে ‘কুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ’ পড়তেন এবং তিনি রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন। অতঃপর যখন তিনি শেষ করতেন তখন শেষে তিনবার বলতেন ‘সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস’। শেষবার টেনে বলতেন। (সুনানে নাসাঈ হা/১৬৯৯, ১/১৯১ পৃঃ, সনদ সহীহ)। উক্ত হাদীসও প্রমাণ করে রাসূল (ﷺ) একটানা তিন রাক‘আত পড়েছেন, মাঝে বৈঠক করেননি।
.
জেনে রাখা ভালো,তিন রাকাআত বিতর আদায়ের ক্ষেত্রে উল্লেখিত দু’টি পদ্ধতি ছাড়াও আরো একটি পদ্ধতি আছে। তা হলো- বিতরকে মাগরিবের সালাতের মত করে পড়া। অর্থাৎ দু’রাকআত পড়ে তাশাহুদ পড়ে সালাম না ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আরো এক রাকাআত পড়া। দুঃখজনক হলেও সত্যি মাযহাবী গোঁড়ামির কারনে এই পদ্ধতিটি আমাদের সমাজে বেশি প্রচলিত। অথচ এই মর্মে রাসূল ﷺ থেকে বিশুদ্ধ কোন হাদীস প্রমাণিত নয়। বরং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বিতরকে মাগরিবের মত পড়তে নিষেধ করেছেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান হা/২৪২০, হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩০৪, বায়হাকী ৩/৩১, দারাক্বুত্বনী, সুনান ১৬৩৪)। আর মাগরিবের মত পড়ার আরো যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলোই যঈফ।(আলবানী ইওয়াউল গালীল হা/৪২১, ২/১৫০ পৃঃ;মুসনাদে আহমাদ হা/২৫২৬৪)
.
প্রচলিত হানাফিরা যে বর্ননাটি সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে সেটি হলো: আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, রাতের বিতর তিন রাকাত, উহা হল দিনের বিতর মাগরিবের মত। (দারাকুৎনী হা/১৬৩৭,বায়হাকী ৪৮১২)তাহক্কীক: এ হাদীসটি ইমাম দারাকুতনী বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি সহীহ নয় সনদ যঈফ।কারন উক্ত বর্ণনাতে ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া কূফী ইবনু আবিল হাওয়াজিব নামে দুর্বল রাবী আছেন। ইমাম বাইহাক্বী বলেন,হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হলেও তা মূলতঃ ইবনে মাসউদের নিজস্ব কথা হিসেবে প্রমাণিত।(নাসবুর রায়া ২/১১৬)। ভারতবর্ষে হাদীসশাস্ত্রের দিকপাল,
মিশকাতুল মাসাবীহ’র বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ মির‘আতুল মাফাতীহ’র সম্মানিত মুসান্নিফ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, আল-আল্লামাহ, ইমাম উবাইদুল্লাহ আব্দুস সালাম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪১৪ হি./১৯৯৪ খ্রি.] বলেছেন, عِنْدَ الْإِيْتَارِ بِثَلاَثٍ ‘তিন রাক‘আত বিতরে দ্বিতীয় রাক‘আতে বৈঠক করার পক্ষে আমি কোন মারফূ সহীহ দলীল পাইনি।(মির‘আতুল মাফাতীহ হা/১২৬২-এর আলোচনা দ্রঃ)
.
🔸বিতিরের সালাতে দু’আয় কুনূত পড়ার স্থান কোনটি?
_______________________________________
বিতিরে দুআ কুনুত পড়া মুস্তাহাব। মাঝে মাঝে না পড়লেও কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ।বিতরের সালাতে দু’আ কুনুত শেষ রাকআতে রুকুর আগে অথবা পরে অর্থাৎ রুকু থেকে দাঁড়িয়ে পড়া যায়। উভয় স্থানই কুনুত পড়া বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমানিত। হুমাইদ বলেন,আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-কে কুনূত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকূ‘র পর দু‘আ কুনূত পড়তেন। আর অন্য এক সূত্রে আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দু‘আ কুনূত পড়তেন কখনো রুকূ‘র পূর্বে, আর কখনো রুকূ‘র পরে। (সহীহ বুখারী হা/ ১০০২, ৪০৯৬, ইবনু মাজাহ হা/ ১১৮৪, দারাকুত্বনী ১৬৬৬ মিশকাত হা /১২৯৪)। অপর বর্ননায় উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন বিতর পড়তেন তখন রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন। (ইবনু মাজাহ হা/১১৮২, পৃঃ ৮৩, আলবানী ইরওয়াউল গালীল হা/৪২৬ সনদ সহীহ)। তবে সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীস এবং জমহুর ওলামাদের মতে রুকূ‘র পরে কুনূত পড়া উত্তম।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] কুনুত সম্পর্কে বলেছেন: এখানে দুটি চরম দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি মধ্যম দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কেউ বলেন যে কুনূত শুধুমাত্র রুকু করার আগে পড়তে হবে। আবার কেউ বলেন যে এটি শুধুমাত্র রুকু করার পরে পড়তে হবে।হাদীসের আলোকে মুহাদ্দিসগণ ও ফাক্বীহগণ, যেমন ইমাম আহমদ এবং অন্যান্যরা বলেন যে উভয়ই অনুমোদিত, কারণ উভয়ই সহীহ সুন্নাহতে উল্লেখ আছে, তবে তারা রুকু করার পরে কুনুত পাঠ করা উত্তম মনে করতেন। (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ খন্ড:২৩ পৃষ্ঠা:১০০)
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন; অধিকাংশ হাদীস অনুযায়ী এবং অধিকাংশ আলেমের মতানুযায়ী কুনূত রুকু’র পরে পড়া উচিত, কিন্তু কেউ যদি রুকু’র পূর্বে তা পাঠ করে তবে তার ইখতিয়ার আছে। তিনি যখন কিরাআত শেষ করেন, তখন রুকু করা পছন্দ করেন এবং রুকু থেকে উঠে দাঁড়িয়ে “রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ” বলেন, তখন সে কুনূত পাঠ করতে পারে, যেমনটি নবী (ﷺ) থেকে অধিকাংশ বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে এবং অধিকাংশ আলেম এটাই বলেছেন। অথবা তিনি সালাতে কিরাআত শেষ করার পর কুনুত প্রথমে পাঠ করতে পারেন, তারপর আল্লাহু আকবার বলে রুকু করতে পারেন। উভয় পথই সুন্নাতে বর্ণিত হয়েছে। (ইবনে উসাইমিন আল-শারহুল মুমতি, খন্ড:৪ পৃষ্ঠা:২৫)
.
#বিশেষ_দ্রষ্টব্য: বিতরের প্রসিদ্ধ কুনুত হচ্ছে, আল্লা-হুম্মাহ্ দিনী ফীমান হাদাইতা, ওয়া ‘আ-ফিনী ফীমান ‘আ-ফাইতা…উক্ত কুনুত পাঠের সময় হাত তোলা ও না তোলা উভয় প্রকার আমলই সালাফদের থেকে প্রমাণিত রয়েছে। (তুহফাতুল আহওয়াযী ১/৪৬৪)।যেমন: ওমর ইবনুল খাত্তাব, আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ, আনাস ইবনে মালিক,আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) প্রমুখ সাহাবী থেকে কুনূতে বুক বরাবর হাত উঠিয়ে দো‘আ করা প্রমাণিত আছে। মুহাদ্দিসগণ এর দ্বারা কুনূতে বিতর বুঝেছেন (বায়হাক্বী ২/২১১-১২, মির‘আত ৪/৩০০; তুহফাতুল আহওয়াযী ২/৫৬৭, ইরওয়াউল গালীল ২/১৮১)। শায়খ বিন বায বলেন, বিতরের কুনূতে হাত উত্তোলন করা শরী‘আত সম্মত। কেননা তা কুনূতে নাযেলার মতই (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, ৩০/৫১)।ইমাম উসাইমীন বলেন, ওমর (রাঃ) হ’তে সহীহ সূত্রে বিতরের সালাতে হাত উঠানোর বর্ণনা রয়েছে (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,১৪/৮১)।তবে হাত তুলে দু’আ করার পরে মুখে হাত বুলানো সুন্নাত নয়। কারণ,এ ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে সবগুলোই দুর্বল। (আবুদাঊদ হা/১৪৮৫;বায়হাকী, মিশকাত হা/২২৫৫; ইরওয়া হা/৪৩৩ ,উসাইমীন আশ শারহুল মুমতে খন্ড:৪/৫৫) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।