মুবাহালার অর্থ এবং এর বিধান

প্রশ্ন: মুবাহালার অর্থ এবং এর বিধান কী? মুবাহালার শর্ত কি? কাদের সাথে মুবাহালা করা যাবে? এটা কি শুধু রাসূল (ﷺ) এর জন্য খাছ ছিল?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মুবাহালার শব্দটি আরবী মূলশব্দ ‘বাহলাহ’ হতে এসেছে, যার শাব্দিক অর্থ পারস্পরিক অভিশাপ দেওয়া বা ‘অভিশম্পাত’ করা। এর অন্য অর্থগুলো হলো কামনা করা, ইচ্ছে করা, আশা করা, আকাঙ্খা করা, চাওয়া বা নিজেদের ধ্বংসের জন্য দোয়া করা।
.
আর পারিভাষিক অর্থ সম্পর্কে লিসানুল আরবের লেখক ইমাম মুনজিরি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত্যু: ৭১১ হি.] তার বিখ্যাত লিসানুল আরব অভিধানে বলেন, মুবাহালা হচ্ছে, যখন কোন সম্প্রদায় বিতর্কিত কোন বিষয়ের জন্য একত্রিত হয়ে বলতে থাকে: আমাদের মধ্যে যে জালিম তার উপর আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হউক। (লিসানুল আরব ১১/৭২)
.
শাফিঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, আভিধানিক অর্থে ‘মুবাহালা’ মানে একে অপরকে লা’নত করা। অর্থাৎ উভয় পক্ষের লানতকারী মিথ্যুকদের উপর যেন আল্লাহর অভিসম্পাত নাযিল হয় এই বদ দুয়া করা। (তাহরীরু আলফাজিত তাম্বীহ, নববী ১/২৪৭)
.
শরীয়তের পরিভাষায়, মুবাহালা হলো, যখন দুটি দল নিজেদের বক্তব্যকেই সঠিক ও অপরের বক্তব্যকে মিথ্যা বলে দাবি অতঃপর সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তবে তারা সকলে মিলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আল্লাহর লানতের অধিকারী হয়। মূলত: লা’নত অৰ্থ আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়া। আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়া মানেই আল্লাহর ক্রোধে পড়া। এর সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর ক্রোধ বর্ষিত হোক। এরূপ করার পর যে পক্ষ মিথ্যাবাদী, সে তার প্রতিফল ভোগ করবে। সে সময় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর পরিচয় অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়। এতে বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করলেই চলে। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু একত্রিত করলে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। কুরআন সুন্নাহ ও সালাফদের থেকে এই মুবাহালা প্রমাণিত।
.
🔸কুরআন থেকে মুবাহালার দলিল:
__________________________________
আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে নবী আপনার কাছে যে জ্ঞান এসেছে, তা নিয়ে যারা আপনার সঙ্গে ঝগড়া করে তাদেরকে বলুন; এসো, আমরা আমাদের ও তোমাদের পুত্রদের, আমাদের ও তোমাদের নারীদের এবং স্বয়ং আমাদেরকে ও স্বয়ং তোমাদেরকে মুবাহালার জন্য আহ্বান করি। তারপর প্রার্থনা করি যে, মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক। (সূরা আলে ইমরান; ৩/ ৬১)। এই আয়াত নাজিলের পেক্ষাপট; নবম/দশম হিজরীতে মহানবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ইয়েমেনের নাজরান এলাকায় একদল মুসলমানকে পাঠিয়েছিলেন। এর জবাবে নাজরানের খ্রিস্টানরাও মহানবীর সাথে বিতর্কের জন্য একদল খ্রিস্টানকে মদীনায় পাঠায়। তারা মদীনায় রাসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র সাথে নবী ঈসা (আ.)’র ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করতে থাকে। কিন্তু তারা যুক্তি ও সত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে। এরপর আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পারস্পরিক অভিশাপের প্রস্তাব দেন। তিনি খ্রিস্টানদের বললেন, তোমরা তোমাদের কয়েকজন পুত্র, নারী ও ঘনিষ্ঠজনকে নিয়ে আস। আর আমরাও একই কাজ করে জনসমাবেশে এসে মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষণের জন্য প্রার্থনা করব। নাজরানের খ্রিস্টানরা এই প্রস্তাব শুনে নিজেদের মধ্যে পরামর্শের জন্য সময় চায়। খ্রিস্টানদের প্রধান তাদেরকে বলল, প্রস্তাব মেনে নাও। কিন্তু যদি দেখ, মুহাম্মদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জনসমক্ষে তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠজনকে নিয়ে পারস্পরিক অভিশাপ কামনা বা মুবাহালার জন্য উপস্থিত হয়, তবে তা করা থেকে বিরত থাকবে এবং কোনভাবে আপোষ করবে।নির্দিষ্ট দিনে খ্রিস্টানরা দেখলো মহানবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাত্র চারজনকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। এই চারজন হলেন, রাসূল কন্যা ফাতেমা (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), জামাতা আলী (আ.) এবং তাঁদের দুই পুত্র হাসান ও হোসাইন (আ.)। খ্রিস্টানদের প্রধান অন্যান্য খ্রিস্টানদের বললেন, আমি এমন কিছু চেহারা দেখতে পাচ্ছি, যদি তাঁরা দোয়া করেন, তাহলে পাহাড় টলে যাবে এবং যদি আমাদের ওপর অভিশাপ দেন, তাহলে আমরা একজনও জীবিত থাকব না। এ অবস্থায় তারা পারস্পরিক অভিশাপ বা মুবাহালায় যোগ দিতে অস্বীকার করল। (সীরাতে ইবনু হিশাম ২/৪১২; তাফসীরে ইবনু কাসীর ১/৩৭৪; তাফসীরে বাগাবী ২/৪৮; “তাফসির আল-সাদী” ১/৯৬৮)
.
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন, যার হাতে আমার প্রাণ ঐ সত্ত্বার শপথ, নিশ্চয়ই নাজরান বাসীদের উপর আযাব খুব নিকটে চলে এসেছিল। যদি তারা অভিসম্পাত করত তাহলে তারা বানর, শূকরে পরিণত হত! এবং অবশ্যই তাদের উপর অনবরত আগ্নেয়গিরির ঝটকা লাগত, এবং অবশ্যই নাজরান ও তার বাসিন্দাদের এমনকি গাছে থাকা পাখিদেরও আল্লাহ তা’আলা সমূলে মূলোৎপাটন করতেন। আর যদি তাদের উপর এসব আযাব অতিবাহিত হত তাহলে খ্রিষ্টানরা সকলে ধ্বংস হয়ে যেত। (মুস্তাদরাকে হাকেম ২/৫৯৪; দালায়েল,আবু নুয়াইম ২/২৯৮; তারীখে তাবারী ৬/৪৭৮; আসবাবুন নুযূল,ওয়াহেদী পৃ. ৭৪-৭৫; তাফসীরে ইবনু কাসীর ১/৩৬৮; তাফসীরে বাগাবী ২/৪৮; কানযুল উম্মাল ২/৩৭৯-৩৮০- ইমাম হাকেম এই হাদীসকে সহীহ মুসলিমের শর্তে সহীহ বলেছেন)
.
অনুরূপভাবে যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসেছিল, তারা যদি মুবাহালার জন্য প্রস্তুত হত তবে তারা ফিরে গিয়ে তাদের পরিবারবর্গ এবং ধন-সম্পদের নাম-নিশানাও দেখতে পেত না। (মুসনাদ আহমাদ হা: ২২২৫, সনদ বিশুদ্ধ)

🔸মুবাহালার শর্ত:
____________________
মুবাহালার কিছু শর্ত রয়েছে তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো: আল্লাহ তায়ালার জন্য নিয়তটাকে একনিষ্ঠ করা। মুবাহালার উদ্দেশ্য হলো সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সত্যবাদীদের কে সহযোগিতা করা আর বাতিলকে দূরভিত করা । সুস্থতার জন্য বিজয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা, বাহ্যিকভাবে ভালোবাসা এবং কুপ্রবৃত্তিকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি তার উদ্দেশ্য নয়। মুবাহালাটা হয়ে থাকে বিরোধীকারীদের উপর দলিল সাব্যস্ত এবং অকাট্যভাবে সুস্পষ্ট দলিল প্রকাশিত হওয়ার পরে। স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে যে সীমালংঘনকারী ব্যক্তি বাতিলের উপরে জেদ করে আছে, সত্যটাকে অমান্য করে এবং প্রবৃত্তিকে সহযোগিতা করে। এটা দ্বীনের একটি অন্যতম বিষয়ের ক্ষেত্রে হবে । এর দ্বারা আশা করা যায় যে মুসলমানদের কোন উপকারে আসবে অথবা ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন কাজে আসবে। আর সেটা ওই ইজতেহাদী মাসআলার ক্ষেত্রে জায়েজ নয়; যেই মাসালার ক্ষেত্রে ইখতেলাফ করা বৈধ রয়েছে। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৫৯৫৮১)
.
শাইখ আহমদ বিন ইব্রাহিম শারহু কাসিদাতি ইবনিল কাইয়েম (شرح قصيدة ابن القيم) গ্রন্থে বলেন, কতিপয় আলেম কুরআন, সুন্নাহ, বিভিন্ন আসার (সাহাবি-তাবেঈদে মতামত ও কর্মনীতি) এবং ইমামতের বক্তব্য বিশ্লেষণ পূর্বক মুবাহালার শর্তাদি বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার সারাংশ হলো:
শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদি এমন জটিল সংশয় ও গোঁড়ামি সৃষ্টি হয় যা মুবাহালা ব্যতিরেকে দূর করা সম্ভব না হয় তাহলেই কেবল মুবাহলা করা বৈধ; অন্যথায় তা জায়েজ নয়।
.
🔸এ অবস্থায় মুবাহালার শর্ত হলো,
১) অকাট্য দলিল উপস্থাপন করা (হুজ্জত কায়েম)।
২) সংশয় দূরভীত করার চেষ্টা করা।
৩) নসিহত করা।
৪) সাবধান করা।
এ সকল প্রচেষ্টার পরও যদি কোন কাজ না হয় এবং মুবাহালা করা জরুরি বলে মনে হয় তাহলে মুবাহালা করা যাবে। অন্যথায় যাবেনা। (শারুহ কাসিদাতি ইবনিল কাইয়েম খন্ড:১ পৃষ্ঠা:৩৭ নোট: আমার ওস্তাদ আব্দুল্লাহিল হাদী হাফি: থেকে)
.
🔸মুবাহালা কি শুধু রাসূল (ﷺ)-এর জন্য খাছ ছিল?
_______________________________________
মুবাহালা ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক অনুমোদিত একটি বিষয়। এটা শুধু রাসূল (ﷺ)-এর জন্য খাছ নয়। বরং উম্মতে মুহাম্মাদীর সকলের জন্য বৈধ। অনেক সাহাবী মুবাহালার আহ্বান করেছেন। যেমন ইবনু মাসঊদ, ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমুখ। (ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়্যাহ, প্রশ্ন নং- ১৫০৯৮, ৪২০১৪ আল ইখলাস)।
.
এ ব্যাপারে সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খ্রিষ্টানদের সাথে যে মুবাহালা করেছিলেন সেটা শুধু তাঁর জন্যই খাছ ছিল না। বরং খ্রিষ্টান এবং অন্যদের সাথে মুবাহালা করার এ হুকুম তাঁর এবং তাঁর উম্মতের জন্য সর্বজনীন। যদিও নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময়ে যে মুবাহালা হয়েছিল তা আয়াতের আংশিক উদাহরণ হলেও এর অর্থ এই নয় যে, এই মুবাহালা কেবল খ্রিস্টানদের সাথেই প্রযোজ্য। (ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ৪র্থ খণ্ড,পৃষ্ঠা:২০৩-২০৪)।
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেন, ‘বাতিলপন্থীদের সাথে বিতর্কের সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট হুজ্জত প্রমানিত হলে কিন্তু তারা (তাদের বাতিল মতবাদ থেকে) ফিরে না এসে যদি গোঁড়ামির উপর স্থির থাকে, তাহলে সুন্নাত হলো- তাদেরকে মুবাহালার আহ্বান করা। কেননা মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলকে এর নির্দেশ দিয়েছেন।আল্লাহ একথা বলেননি যে, তোমার পরে তোমার উম্মতের জন্য এই বিধান প্রযোজ্য হবেনা বা তা করার অনুমতি নেই। (যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৪৩)।
.
ইমাম ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন;
অকাট্যভাবে সত্য প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পরেও বিরোধীপক্ষ যখন গোড়ামি করে তখন মুবাহালার ডাক দেওয়া শরীয়তসম্মত। এভাবে মুবাহালার ডাক দিয়েছিলেন ইবনু আব্বাস, এরপর ইমাম আওযাঈ। এছাড়াও একদল উলামাদের সাথেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। আর অভিজ্ঞতা বলে, যেসব বাতিলপন্থীরা মুহাবাহালায় অংশগ্রহণ করেছে তারা মুবাহালার প্রভাব বাস্তবায়ন হতে ঐদিন থেকে নিয়ে একটি বছরও সময় নেয়নি। এমন একজন ঘাড়ত্যাড়া যে মুলহিদদের পক্ষাবলম্বন করেছিল তার সাথে আমারও মুবাহালা হয়েছিল, অতঃপর দুই মাস যেতে না যেতেই ওদের উপর মুবাহালার প্রভাব পড়েছে। (ফাতহুল বারী ৮/৯৫ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৯৮৩৯৮) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: