প্রশ্ন: বিদআত কাকে বলে? বিদআত কত প্রকার ও কি কি? বিদআত সৃষ্টির কারণ কি? বিদআতের পরিণতি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: বর্তমানে বিদআতের পরিচয় সম্পর্কে সমাজের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকলের মাঝে একটা ভ্রষ্টতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়টি পরিস্কার ভাবে বুঝতে হলে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।কারন ইসলামের প্রচার-প্রসার ও তা বাস্তবায়নে যতগুলো মাধ্যম সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে তন্মধ্যে বিদ‘আত অন্যতম। কেননা মানুষ ভাল মনে করে ও নেকী অর্জনের প্রত্যাশায় বহু কষ্ট স্বীকার করে এমন অনেক ইবাদত সম্পাদন করে থাকে, যে ব্যাপারে ইসলামের কোন দিক-নির্দেশনা বর্ণিত হয়নি। তাইতো বিদ‘আত হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার পরেও সেটা পরিত্যাগ করে না, বরং তার পক্ষে পূর্বের চেয়েও দৃঢ়তা অবলম্বন করে। অন্যদিকে বিদ‘আত সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান না থাকার কারণে তারা জাগতিক জীবনের প্রয়োজনীয় নিত্য-নতুন আবিষ্কারকে বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করে থাকে। যা সঠিক নয়। এছাড়া কোন্টা বিদ‘আত আর কোনটা বিদ‘আত নয় সে ব্যাপারেও রয়েছে যথেষ্ট ভ্রান্তি। ফলে বিদ‘আত চিহ্নিত করতে তারা যেমন সক্ষম হচ্ছে না, তেমনি বিদ‘আতকে বিদ‘আত হিসাবে চিহ্নিতকারীদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিনিয়ত বিষোদ্গার করছেন। তদুপরি স্বল্পশিক্ষিত ও অতি আবেগী একশ্রেণীর ব্যক্তি মহোদয় যত্রতত্র যেকোন কিছুকে বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করছেন। এ সকল বিষয় বর্তমানে দাওয়াতী কার্যক্রমকে যেমন বাধাগ্রস্ত করছে, তেমনি দাঈদেরকে যারপরনাই বিভিন্নভাবে হয়রানী ও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। যা সত্যিই দুঃখজনক বিষয়।এজন্য সর্বাগ্রে বিদআতের আভিধানিক ও শারঈ অর্থ সম্পর্কে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
.
বিদ‘আত (بِدْعَةٌ) শব্দটি আরবী। এর অর্থ: আরম্ভ করা, সৃষ্টি করা, আবিষ্কার করা ইত্যাদি। যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে তাঁর নিজের সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, আসমান ও যমীনের নতুন উদ্ভাবনকারী। (সূরা বাক্বারাহ; ২/১১৭)। বিদ‘আতের শাব্দিক অর্থ বর্ণনায় অভিধান বেত্তাগণের দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নরূপ: প্রখ্যাত অভিধানবেত্তা ইবনু মালিক আত-ত্বা-ই আল-জিয়ানী (৫৯৮-৬৭২ হি.) বলেন, প্রত্যেক নতুনভাবে প্রবর্তিত বিষয়ই বিদআত। (সা‘দ ইবনু হামদান আল-গামিদী, ১ম খণ্ড পৃ. ৬১)। লিসানুল ‘আরব’ প্রণেতা ইবনুল মানযুর (৬৩০-৭১১ হি./১২৩২-১৩১১ খ্রি.) বলেন, বিদআত হলো- পরিপূর্ণ হওয়ার পর দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করা; মোটকথা তিনি প্রত্যেক জিনিসের প্রথম ও নতুন সৃষ্টিকেও বিদআত বলে আখ্যায়িত করেছেন। (লিসানুল আরব, ৮ম খণ্ড; পৃষ্ঠা: ৬)। ইমাম নববী বলেন, কোন পূর্ব নমুনার অনুসরণ করা ছাড়া যে কোন কৃত আমলকেই বিদ‘আত বলা হয়।’(শারহি সহীহিল মুসলিম, ৬ষ্ঠ খ-পৃ. ১৫৪)। ইমাম ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মুজাহিদ ও সুদ্দী বলেন, বিদআত তথা নব আবিষ্কারকে এজন্য বিদ‘আত নামে নামকরণ করা হয়েছে যে, কেননা এর কোন পূর্ব নমুনা নেই।’(ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৩য় খ- দারু তাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি., পৃ. ৩০৮)। ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হি./১৩৭২-১৪৪৯ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিদ‘আতের মূল অর্থ হলো- কোন পূর্ব নমুনার অনুসরণ ব্যতীত যে কোন নতুন উদ্ভাবিত বিষয়। (ফাৎহুল বারী শারহু সহীহিল বুখারী, ৪র্থ খ- বৈরূত: দারুল মা‘আরিফাহ, ১৩৭৯ হি.; পৃ. ২৫৩)আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব’ গ্রন্থকার ইবরাহীম মুছত্বফা (১৮৮৮-১৯৬২ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, পূর্ব কোন দৃষ্টান্ত ছাড়াই নতুন করে কিছু সৃষ্টি করা’। তিনি আরো বলেন,বিদ‘আত হল- দ্বীন ও অন্য কোন বিষয়ের নতুন সৃষ্ট বিষয়’। (আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, ১ম খন্ড: পৃ. ৪৩) শাইখ ইবনে উসাইমীন( রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিদআত হচ্ছে নতুন কিছু সৃষ্টি’। (মাজমূ‘ঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ২৩) ইমাম ইবনু সিক্কীত (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিদ‘আত হল প্রত্যেক নতুন সৃষ্টি’। (তাজুল ‘ঊরূস মিন জাওয়াহিরিল ক্বামূস, ২০ তম খ- পৃ. ৩০৯)
.
প্রিয় পাঠক! বিশ্বের বিখ্যাত সব আরবী অভিধানবিদ ও বিদ্বানগণের নিকটে বিদআতের ভাষাগত অর্থ হলো- নতুন কিছু সৃষ্টি, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না। এই অর্থে প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিকে বিদআত বলা যায়। তাই আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির নিত্য-নতুন আবিষ্কার যেমন: বাস, ট্রাক, ট্রেন, বিমান, ঘড়ি, চশমা, মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি শাব্দিক অর্থে বিদআত। কেননা এগুলোর উদ্ভাবনের পূর্ব কোন দৃষ্টান্ত ছিল না। কিন্তু ইসলামী শরীআতের দৃষ্টিতে এগুলো বিদআত, না-কি বিদআত নয়- এ ব্যাপারে দু’টি মত পরিলক্ষিত হয়। এক দলের মতে, সকল বিদআত মন্দ নয়; বরং কিছু বিদআত ভালো আর কিছু বিদআত মন্দ। এমনকি তারা বিদআতকে ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম, মাকরূহ প্রভৃতি ভাগেও বিভক্ত করে থাকেন। অপর দলের মতে, বিদআত হলো- সুন্নাতের বিপরীত এবং তা কেবল মন্দ বিষয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই বিদআতের মধ্যে ভাল-মন্দের বিভাজন সঠিক নয়, বরং সবটাই ভ্রষ্ট।’(শাইখ আলী মাহমূয, আল-ইবদা ফী মুযাররিল ইবতিদা; রিয়াদ: মাকতাবাতুর রুশদ, ১ম সংস্করণ ২১৪২১ হি./২০০০ খ্রি., পৃ. ৪৪-৭২।)। সুতরাং, এটি বিশ্লেষণের দাবী রাখে। মূলত বিদআত সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এটি সমাজে টিকে আছে। বিষয়টি জানতে হলে ‘বিদআত’-এর শারঈ অর্থ জানা আবশ্যক।
.
বিদআতের শারঈ সংজ্ঞা: বিদআত হলো- এমন আমল, যা শরীআত মনে করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, যার প্রমাণে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে কোন সহীহ দলীল নেই। বিদআতের প্রামাণ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো: (১). শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, শরীআতের মধ্যে বিদআত হলো; নব আবিষ্কার, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যামানায় ছিল না। (ইমাম নববী (রহঃ), তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত ৩/২২ পৃঃ)অর্থাৎ এখানে ইমাম নববী কেবল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগের সাথে সম্পর্কিত করেছেন, যা তিনি করেননি, করতে নির্দেশ দেননি কিংবা কোন রকম মৌন সম্মতিও দেননি, এমন প্রত্যেক নব আবিষ্কার বিষয়ই হল বিদ‘আত।তিনি দলিল হিসেবে বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, নিশ্চয় সবচেয়ে সত্য বাণী হল আল্লাহর কিতাব আর সর্বোত্তম হেদায়াত হল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হেদায়াত। নব আবিষ্কার বিষয় সবই মন্দ। প্রত্যেক নতুন আবিষ্কারই বিদ‘আত। প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্ট এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টই জাহান্নামী’।(সুনানুন নাসাঈ, হা/১৫৭৮; আত-ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৮৫২১)সুতরাং এমন কিছু বিষয়, যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়নি এবং যা তাঁর যুগে ছিল না, তাই-ই বিদ‘আত। যেমন: শবেবরাত, ঈদে মীলাদুন্নবী, শবে মি‘রাজ ইত্যাদি।
(২). আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের একজন মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন, মে সকল কাজ দ্বীনের মধ্যে মিশ্রিত হয়েছে অথচ আল্লাহ তা‘আলা তা বৈধ করেননি, সেটাই বিদ‘আত, যদিও তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হয়।’ (ইবনে তাইমিয়া, আল-ইসতিক্বামাহ ১/৪২ পৃঃ) তিনি আরো বলেন, বিদআত হলো- ইবাদত এবং বিশ্বাসের মধ্যে যা কিতাব (কুরআন), সুন্নাহ অথবা বিগত উম্মতের ইজমার বিপরীত।’(মাজমূ‘ ফাতাওয়া, খন্ড;৮ পৃষ্ঠা:৩৪৬)। তিনি আরো বলেন, দ্বীনের মধ্যে বিদআত হচ্ছে এমন আমল, যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামে প্রবর্তন করেননি এবং মুস্তাহাব বা ওয়াজিব হিসেবেও এর কোন অনুমোদন দেননি। (মাজমূ ফাতাওয়া, খন্ড:৪, পৃষ্ঠা:১০৭)।ইবনে তাইমিয়া এখানে বিদ‘আত বলতে কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী বিষয়কে এবং সাথে সাহাবীগণের ইজমার বিপরীত কাজকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন।যেমন ‘আক্বীদার ক্ষেত্রে খারিজী, রাফিযী, ক্বাদারিয়া এবং জাহমিয়ারা বিভিন্ন ভ্রান্ত বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। অনুরূপভাবে ‘আমলের ক্ষেত্রে ছালাত, ছাওম, হজ্জ ও যাকাত কেন্দ্রিক ‘আমলের বিপর্যয়, যিকির-আযকার, কুরআন তিলাওয়াতে বিদ‘আতের ছড়াছড়ি, মসজিদে নাচ-গানের মাধ্যমে ‘ইবাদত করা, দাড়ি কামানো ইত্যাদি। এগুলো বিদ‘আতের প্রকারসমূহের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধীদের একটি দল এভাবে তাদের ‘ইবাদত করে থাকে
(ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ১৮তম খ-, পৃ. ৩৪৬)(৩). আল্লামা জুরজানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, বিদআত হলো য সুন্নাতের বিপরীত কাজ। একে বিদআত নামকরণ করা হয়েছে। কেননা বক্তা ইমামের (রাসূল) কথার বিপরীত কথা সৃষ্টি করেছে। আর এটাই নব আবিষ্কৃত কাজ; যার উপর সাহাবী ও তাবেঈগণ ছিলেন না এবং যা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয়। (জুরজানী, আত-তা‘রীফাত খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৬২)। অর্থাৎ এখানে তিনি গোটা সুন্নাতের কোন একটির পরিপন্থী বিষয়কে বিদ‘আত বলেছেন। অর্থাৎ তিনি বিদ‘আতকে সুন্নাতের সরাসরি বিপরীত ও তার সাথে সাংঘর্ষিক বলতে চেয়েছেন। অতঃপর বিদ‘আতকে ছাহাবী ও তাবি‘ঈগণের বিপরীত কাজ করা পর্যন্ত সীমায়িত করেছেন। (৪). ‘মিশকাতুল মাসাবীহ’-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিরআতুল মাফাতীহ’-এর গ্রন্থ প্রণেতা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী [১৩২৭-১৪১৪ হি.] (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিদআত হলো- যা দ্বীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কার; শরীআতের দলীল হিসাবে যার কোন অস্তিত্ব নেই। (মিরআতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাসাবীহ, ১ম খ- বানারস, ভারত: ইদারাতুল বুহূছিল ইলমিয়্যাহ ওয়াদ দাওয়াতি ওয়াল ইফতা, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৪ হি./১৯৮৪ খ্রি., পৃ. ২৬৪)। (৫). ইবনু রাজব (৭৩৬-৭৯৫ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিদআত দ্বারা ঐ সকল নতুন উদ্ভাবিত কাজ উদ্দেশ্য, যে কাজের ইসলামী শরীআতে কোন ভিত্তি নেই। তবে যেসব কাজের শরীআতে ভিত্তি আছে সেগুলো বিদআতে শার‘ঈ নয়, যদিও শাব্দিক অর্থে এগুলো বিদআত। (জামি‘উল ঊলূম ওয়াল হিকাম, ২য় খন্ড পৃ. ১২৭)। (৬). মুহাম্মাদ ইবনু সালেহ আল-উসাইমীন [১৩৪৭-১৪২১ হি.] (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর বিপরীতে দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর আবিষ্কার করাকে বিদআত বলা হয়। (মুহাম্মাদ ইবনু সালেহ আল-উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৫ম খন্ড, পৃ.২৪)।
.
প্রিয় পাঠক! উক্ত বিশ্লেষণে প্রমাণিত হলো যে, বিদআতের উল্লিখিত শারঈ সংজ্ঞায় একটি অপরটির সাথে কোন রকম দ্বন্দ্ব নেই। বরং সবটাই পরস্পর পরিপূরক। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে কোন বিধান এবং আমল বা ইবাদত থাকা কিংবা না থাকার উদ্দেশ্য হলো- শারঈভাবে থাকা ও না থাকা। বাস্তবে থাকা ও না থাকা এখানে উদ্দেশ্য নয়। আর কোন কিছু শারঈভাবে থাকার উদ্দেশ্য হলো সেটা তার বৈধতার প্রমাণ। আর না থাকা অবৈধতার প্রমাণ। অতএব সহজ কথা হলো- নবাবিষ্কৃত ধর্মীয় কোন বিধান কিংবা আমল বা ইবাদতের স্বপক্ষে যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের কোন প্রমাণ পাওয়া না যায়, তখন সেটাই শারঈ বিদআত হবে। তবে যে সমস্ত বিষয়ের ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যাবে, সেগুলো বিদআতে শারঈ তথা ভ্রষ্ট বিদআত নয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে ছিল না। বরং তাঁর পরবর্তী সময়ে অস্তিত্ব লাভ করেছে। যেমন; আবু বকর ও উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কর্তৃক কুরআন একত্রিতকরণ, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক রাষ্ট্রীয় নীতিমালার প্রয়োজনীয় পদ্ধতির উদ্ভাবন, হাদীসের সংকলন ও লিপিবদ্ধকরণ ইত্যাদি।
সারকথা: মূলনীতি হলো, ইবাদতের নিয়তে যেকোন আমল করতে হলে অবশ্যই ঐ আমলের পক্ষে কুরআন সুন্নায় দলিল থাকতে হবে। কিন্তু যদি দলিল না থাকে তাহলে ইবাদতের নিয়তে সেটি করলে বিদআত হবে। অপরদিকে ইবাদত ছাড়া বাকিসব কিছু মৌলিক ভাবে বৈধ যতক্ষণ না নিষেধের বা
হারামের দলিল পাওয়া যায়।
.
▪️বিদআতের প্রকারভেদ: বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিদআত কয়েক ভাগে বিভক্ত। নিম্নে দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী কয়েকটি প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো;
_______________________________________
(১). প্রথম দৃষ্টিকোণ: শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া অথবা না হওয়ার দিক থেকে বিদআত দুই প্রকার। যথা: (ক). আল-বিদআতুল হাক্বীকিয়্যাহ, তথা প্রকৃত বিদ‘আত। বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ইমাম শাত্বিবী (রহঃ) আল-ইতিছাম নামক গ্রন্থে বলেছেন, প্রকৃত বিদআত হলো, যার সমর্থনে শরীআতের কোন দলীল নেই। না আল্লাহর কিতাব, না তাঁর রাসূলের সুন্নাত, না ইজমার কোন দলীল, না এমন কোন দলীল পেশ করা যায় যা জ্ঞানীদের নিকট গ্রহণযোগ্য। না মোটামুটিভাবে, না বিস্তারিত ও খুটিনাটি ভাবে। এজন্য এর নাম দেওয়া হয়েছে বিদআত। কেননা তা পূর্ব দৃষ্টান্তহীন নতুন আবিষ্কৃত বিষয়।’ (আল-ই‘তিছাম; ১/২৮৬ পৃঃ)। উদাহরণ: (১). আযানের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা বিদআতে হাক্বীকী। কেননা তা কুরআন, সহীহ হাদীস ও ইজমায়ে সাহাবা দ্বারা সাব্যস্ত নয়। (২). বর্তমান সমাজে প্রচলিত ‘শবেবরাত’ বিদআতে হাক্বীক্বী-এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা কুরআন ও সহীহ হাদীসে এর কোন অস্তিত্ব নেই। রাসূল (ﷺ), সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের কেউ কখনো ‘শবেবরাত’ পালন করেননি। কিন্তু মানুষ অফুরন্ত সওয়াব হাসিলের আশায় ‘শবেবরাত’ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের ইবাদতে লিপ্ত হয়। (৩). ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’, ইসলামে যার কোন অস্তিত্ব নেই। রাসূল (ﷺ), সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের কেউ কখনো ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ উদযাপন করেননি। কিন্তু মানুষ তা সওয়াবের আশায় করে থাকে। এরূপ অসংখ্য বিদআত রয়েছে; যার কোন অস্তিত্ব ইসলামী শরীআতে নেই। কিন্তু সমাজে নেকীর কাজ হিসাবে প্রচলিত আছে। আর এরূপ অস্তিত্বহীন বিদআতকেই বিদআতে হাক্বীক্বী বলা হয়। (খ). আল-বিদআতুল ইযাফিয়্যাহ বা বাড়তি বিদ‘আত: এর দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এক দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি এমন ইবাদত, যা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং অপর দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি বিদআত, যা মূলতঃ কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলেও এর স্থান, সময় ও পদ্ধতি সুন্নাহ পরিপন্থী। উদাহরণ: (১) আযানের পরে রাসূল (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা শরী‘আত সম্মত। কিন্তু উচ্চৈঃস্বরে দরূদ পাঠ করা সুন্নাত পরিপন্থী, যা বিদআতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত। (২). জুম‘আর খুৎবা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে আযান দেওয়া সুন্নাত। পক্ষান্তরে মসজিদের ভেতরে খতীবের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্ন স্বরে আযান দেওয়া সুন্নাত পরিপন্থী, যা বিদআতে ইযাফী-এর অন্তর্ভূক্ত। (৩). পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পূর্বে ও পরে সর্বমোট ১২ রাক‘আত সালাত, যাকে ‘সুনানুর রাওয়াতেব’ বলা হয়। তা জামাআতবদ্ধ ছাড়াই একাকী আদায় করা শরী‘আত সম্মত। পক্ষান্তরে উল্লিখিত সালাতগুলো জামা‘আতবদ্ধভাবে আদায় করা সুন্নাহ পরিপন্থী, যা বিদআতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত। (৪). কুরআন তেলাওয়াত একটি উত্তম ইবাদত, যার প্রতিটি হরফের বিনিময়ে দশটি করে নেকী অর্জন করা যায়। কিন্তু সালাতে রুকূ এবং সিজদা অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত সুন্নাত পরিপন্থী, যা বিদ‘আতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত। (৫). মৃত ব্যক্তির জন্য শোক পালন করা শরীআত সম্মত। কিন্তু শোক পালনের নামে দাঁড়িয়ে এক বা দু’মিনিট নীরবতা পালন করা অথবা কিছু সংখ্যক মানুষ মৃতের বাড়িতে একত্রিত হয়ে সকলে মিলে শোক পালন করা সুন্নাত পরিপন্থী, যা বিদআতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত। (৬). শাবান মাস বেশী বেশী সিয়াম পালনের মাস। যে মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সবচেয়ে বেশী নফল সিয়াম পালন করেছেন। কিন্তু মধ্য শাবানে শবে-বরাতের উদ্দেশ্যে দিনে সিয়াম ও রাতে সালাত আদায় করা ইসলামী শরীআত পরিপন্থী, যা বিদআতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত। (৭). ফরয সালাতের পরে একাকী দোআ বা মুনাজাত করা শরীআত সম্মত। এ সময় দোআ করার জন্য রাসূল (ﷺ) অনেকগুলো দোআ আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন, যা পাঠ করতে ১০-১৫ মিনিট সময় লাগবে। কিন্তু উক্ত সময় ইমাম ও মুক্তাদীর সম্মিলিত মুনাজাত, যা রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত নয়, তা বিদ‘আতে ইযাফী-এর অন্তর্ভুক্ত। অতএব, বিদআতে হাক্বীকী এবং বিদআতে ইযাফী-এর মধ্যে পার্থক্য হলো, ইসলামে যার কোন ভিত্তি নেই এমন কিছুকে নেকীর কাজ মনে করে পালন করা বিদআতে হাক্বীকী। পক্ষান্তরে যে ইবাদত মৌলিকভাবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, কিন্তু স্থান, সময় ও পদ্ধতি কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী তাকে বিদআতে ইযাফী বলা হয়।
.
(২). দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি: কর্মে বাস্তবায়ন এবং বর্জনের দিক থেকে বিদআত দু’প্রকার। তথা- (ক). কর্মগত বিদআত: এটা এমন কর্মকে বলা হয়, যা ইসলামী শরীআত সমর্থিত নয়। অথচ উক্ত কর্মের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চায়। বিদআতীরা এই প্রকার বিদআত সবচেয়ে বেশী করে থাকে। যেমন- শবেস-বরাতের নিয়তে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করা; শবে মেরাজের নিয়তে ২৭ রজবের রাতে ইবাদত করা; ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা সহ বিভিন্ন দিবস পালন করা ইত্যাদি; যা কুরআন ও সহীহ হাদীস বিরোধী। (খ). বর্জনমূলক বিদআত: বর্জনমূলক ইসলামী শরীআতে বৈধ অথবা ওয়াজিব কোন বিষয়কে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে বর্জন করা এ শ্রেণীভুক্ত বিদআত। যেমন- আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে হালাল কোন পশুর গোশত না খাওয়া; যেমনভাবে হিন্দুরা গরুর গোশত খায় না। আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে বিবাহ না করা: যেমনভাবে খ্রীষ্টান পাদ্রীরা বিবাহ করে না।
.
(৩). তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গি: বিশ্বাস ও কর্মে বাস্তবায়নের দিক থেকে বিদআত দু’প্রকার। (ক). বিশ্বাসগত বিদআত: তা হলো- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত, প্রসিদ্ধ বিষয়ের বিপরীত কোন বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, যদিও সে তার বিশ্বাস অনুযায়ী আমল না করে। (আলী মাহফূয, আল-ইবদা‘ ফী মাযাররিল ইবতিদা, পৃঃ ৪৬)। যেমন: খারেজী, শীআ, মুতাযেলা, মুরজিয়া, জাহমিয়া ক্বাদারিয়া সহ বিভিন্ন পথভ্রষ্ট দলগুলির আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা বা বিশ্বাস। (খ). তথা কর্মগত বিদআত: তা হলো- এমন কোন কাজকে ইবাদত হিসাবে পালন করা, যা ইসলামী শরীআত সমর্থিত নয়। (আলী মাহফূয, আল-ইবদা ফী মাযাররিল ইবতিদা, পৃঃ ৪৬)। অর্থাৎ সুন্নাত পরিপন্থী আমল করা। রাসূল (ﷺ)-এর ইত্তেবা বা অনুসরণ বাস্তবায়নের শর্তসমূহ। হে আমার প্রিয় মুসলিম ভাই বোনেরা! একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনাদের অবশ্যই জানতে হবে। আর তা হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো আমল শরী‘আতের ছয়টি বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে আমলের মধ্যে রাসূল (ﷺ)-এর অনুকরণ ও অনুসরণ করা বাস্তবায়িত হবে না।বরং বিদআত হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে সুন্নাত অনুযায়ী আমল করতে গেলে ছয়টি বিষয়ে সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে যেমন:
.
(১)- السبب তথা কারণ বা উদ্দেশ্য : অর্থাৎ কেউ যদি এমন কোন কারণে বা উদ্দেশ্যে আল্লাহর জন্য ইবাদত করে যা পবিত্র কুরআন ও রাসূল (ﷺ)-এর সহীহ হাদীস পরিপন্থী, তাহলে তা সুন্নাত বিরোধী আমল হিসাবে গণ্য হবে, যা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন না। এ ধরনের ইবাদাত হবে বিদআত এবং তার আমলটি হবে প্রত্যাখ্যাত। যেমন: তাহাজ্জুদের সালাত একটি উত্তম ইবাদত। কিন্তু কেউ যদি ১৫ই শাবানের রাতে প্রচলিত শবেবরাতের নিয়তে অথবা রজব মাসের ২৭ তারিখ শবে মে‘রাজের উদ্দেশ্যে রাতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে তাহলে তা বিদ‘আত হবে। কেননা উল্লিখিত কারণ বা উদ্দেশ্যে সালাত আদায়ের বিধান কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ ইবাদতটিকে এমন একটি উপলক্ষ কে সামনে রেখে সে করেছে, যা শরীআতে উপলক্ষ্য হিসেবে প্রমাণিত নয়। এ বিষয়টি (ইবাদতের কারণটি শরীআত সম্মত হওয়া) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দ্বারা অনেক আমল যেগুলোকে সুন্নাত মনে করা হয় অথচ তা সুন্নাত নয়; সেগুলো বিদআত হিসেবে চিহ্নিত হবে।
.
(২) الجنس তথা শ্রেণী বা প্রকার: অর্থাৎ কেউ যদি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এমন শ্রেণী বা প্রকারের ইবাদত করে যা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন- আমরা জানি উট, গরু, ছাগল অথবা ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু উল্লিখিত পশুর পরিবর্তে কেউ যদি ঘোড়া দ্বারা কুরবানী করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে, যা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন না।
.
(৩) القدر তথা পরিমাণ: অর্থাৎ যে পরিমান বা যতটুকু ইবাদত কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কেবল ততটুকুই পালন করতে হবে। এর অতিরিক্ত করলে তা সুন্নাত পরিপন্থী বিদআতি আমল হিসাবে গণ্য হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন: কেউ যদি যোহরের চার রাক‘আত ফরয সালাতের স্থানে পাঁচ রাক‘আত আদায় করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী নব আবিষ্কৃত বিদআত, কারণ তা পরিমাণের ক্ষেত্রে শরীআতের নির্ধারিত সংখ্যার সম্পূর্ণ বিরোধী। অনুরূপভাবে তারাবীহ-এর সালাত বিতিরসহ রাসূল (ﷺ) কখনো ১১ বা ১৩ রাক‘আতের বেশী আদায় করেননি। কিন্তু যদি কেউ এই সুন্নাতকে উপেক্ষা করে ২০ রাক‘আত আদায় করাই সুন্নত কম বেশি নয়, এমনটি মনে করে নিদিষ্ট করে তারাবীহ ২০ রাকআত আদায় করে তাহ’লে তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদতে পরিণত হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না।কারন তারাবীহ ২০ রাকআত আদায় করা সুন্নত এটি বিশুদ্ধ দলিল দ্বারা প্রমানিত নয়। (তবে হা সুন্নত মনে না করে স্বাভাবিক ভাবে কেউ ২০ রাকআত পড়লে বিদআত হবেনা)।
.
৪) الكيفية তথা ধরন বা পদ্ধতি: অর্থাৎ রাসূল (ﷺ) যে ইবাদত যে পদ্ধতিতে আদায় করেছেন সে ইবাদত ঠিক সে পদ্ধতিতে আদায় করলেই কেবল সুন্নাতের অনুসরণ করা হবে। কিন্তু যদি কেউ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে নিজের মস্তিস্কপ্রসূত পদ্ধতিতে ইবাদত করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন- দো‘আ বা মুনাজাত একটি উত্তম ইবাদত। কিন্তু তা হতে হবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন যে পদ্ধতিতে মুনাজাত করেছেন, তখন ঠিক সেই পদ্ধতিতে মুনাজাত করতে হবে। কিন্তু ফরয সালাতের পরে, ঈদের সালাতের পরে, মৃত মানুষকে দাফন করার পরে, বিবাহ বৈঠকে বর্তমানে প্রচলিত দলবদ্ধ মুনাজাত রাসূল (ﷺ)-এর পদ্ধতির বিপরীত হওয়ায় তা স্পষ্ট বিদ‘আত। আবার যদি কোনো ব্যক্তি অযু করতে গিয়ে শুরুতে পা ধোয়া আরম্ভ করল, তারপর মাথা মাসেহ করল, তারপর দুই হাত ধৌত করল এবং তারপর চেহারা ধৌত করল, আমরা বলব, তার অযু অবশ্যই বাতিল। কারণ, তার অযু ধরন ও পদ্ধতিগত দিক দিয়ে শরীআত অনুমোদিত পদ্ধতির পরিপন্থী।
.
(৫) الزمان তথা সময় বা কাল: অর্থাৎ যে সময় যে ইবাদত কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, ঠিক সে ইবাদত সে সময় পালন করতে হবে। সময়ের ব্যতিক্রম করলে সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে, যা আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না। যেমন: কেউ যদি ফযীলতের মাস হিসাবে রামাযান মাসে পশু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করতে চায়, তাহ’লে তা বিদ‘আত হবে। কেননা পশু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল শুধুমাত্র কুরবানী ও আক্বীকাহ দ্বারাই হবে, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। তাই রমযান মাসে জবেহ করা দ্বারা কুরবানীর ঈদের দিন জবেহ করার মত সাওয়াব পাওয়া যাবে এ ধরনের বিশ্বাস করা বা সাওয়াবের আশা রাখা সম্পূর্ণ বিদআত। তবে হা শুধুমাত্র গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে রমযান মাসে জবেহ করা সম্পূর্ণ বৈধ।
.
৬) المكان তথা জায়গা বা স্থান : অর্থাৎ যে স্থানে যে ইবাদত কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত, ঠিক সে ইবাদত সে স্থানেই পালন করতে হবে। স্থান পরিবর্তন করলে সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে, যা আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। যেমন- রামাযানের শেষ দশকে মসজিদে ই‘তিকাফ করা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু কোন পুরুষ বা মহিলা যদি মসজিদের পরিবর্তে বাড়িতে ই‘তিকাফ করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না।কারণ, ইতিকাফের স্থানের নির্ধারণের ক্ষেত্রে শরীআত পরিপন্থী কাজ করেছে। এর আরও দৃষ্টান্ত- কোনো ব্যক্তি তাওয়াফ করতে গিয়ে দেখে মাতাফে জায়গা নেই। তার আশপাশে মানুষের ভিড়। তখন সে নিরুপায় হয়ে মসজিদের চার পাশে তাওয়াফ করা আরম্ভ করল। তার তাওয়াফ করা কোনো ক্রমেই শুদ্ধ হবে না। কারণ, তাওয়াফের স্থান হলো আল্লাহর ঘর। আল্লাহ তা‘আলা ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে বলেন, এবং আমার ঘরকে পাক- সাফ রাখবে তাওয়াফকারী, রুকূ-সিজদা ও দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারীর জন্য। (সূরা আল-হাজ্জ; ২২/২৬,বিস্তারিত জানতে শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন, আল-ইবদা ফী কামালিশ শারঈ ওয়া খাতারিল ইবতিদা, পৃঃ ২১-২৪ দেখুন)।
চতুর্থ দৃষ্টিভঙ্গি: হুকুমের দিক থেকে বিদআত দু’প্রকার।(ক). কুফরী বিদআত: তা হলো, কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ইসলামী শরীআতের অকাট্য কোন বিষয়কে অস্বীকার করা। যেমন: কোন ফরযকে অস্বীকার করা, কোন হালাল বস্ত্তকে হারাম ও হারাম বস্ত্তকে হালাল মনে করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ-নিষেধের ব্যতিক্রম বিশ্বাস করা ইত্যাদি। (খ). কুফরী নয় এমন বিদআত: ইহা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ইসলামী শরীআতের কোন বিষয়কে অস্বীকার করা নয়। যেমন- মারওয়ানিয়্যাহদের বিদআত; যারা সাহাবীগণের ফযীলত অস্বীকার করে। তারা কোন সাহাবীকে মর্যাদাবান বলে স্বীকার করে না এবং কোন সাহাবীকে কাফেরও বলে না।
.
▪️ইসলামে বিদআত সৃষ্টির কারণ:
________________________________
ইসলামে বিদআত বহু কারন রয়েছে কয়েকটি হলো: (১). অজ্ঞতা: আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত অহি-র বিধান তথা কুরআন ও সহীহ হাদীস সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকাই সমাজে বিদআত সৃষ্টির প্রধান কারণ। (২). প্রবৃত্তিপূজা: প্রবৃত্তিপূজা তথা নিজের মন যে কাজকে ভাল মনে করে তার অনুসরণ করা। (৩). তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণ। (৪). শারঈ বিষয়ে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি। (৫). যঈফ ও জাল হাদীসের অনুসরণ। (৬). বিধর্মীদের অনুকরণ: মুসলমানরা বিধর্মীদের অনুকরণে মুসলিম সমাজে অনেক বিদআত চালু করেছে। যেমন- কবরপূজা, পীরপূজা, ঈদে মীলাদুন্নবী, কবরে ও শহীদ মীনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ইত্যাদি। (৭). নিজের জ্ঞানকে কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর প্রাধান্য দেওয়া। (৮). পীর-দরবেশের মিথ্যা কাশ্ফ ও স্বপ্নের প্রবঞ্চনা। ছূফী মতবাদে বিশ্বাসী একশ্রেণীর পীর, দরবেশ ও ফকীরেরা তাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে কাশফের মিথ্যা দাবী করে। (৯). আলিমগণের নীরবতা, স্বার্থপরতা ও তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ইত্যাদি কারণে সমাজে বিদআত সৃষ্টি হয়েছে। একনজরে সমাজে প্রচলিত রমাযান কেন্দ্রিক কিছু বিদ‘আত। (১) রামাযানকে তিন ভাগে ভাগ করা (২) যে কোন আমলে ৭০ গুণ সওয়াব হওয়ার আশা করা।(৩) সেহেরীতে মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি করা। (৪) সাহারীর সময় মুখে নিয়ত করা। (৫) ইফতারের সময় দলবদ্ধভাবে দুই হাত তুলে দুআ করা। (৬) রামাযান মাসে শেষ শুক্রবার দলবদ্ধভাবে কবরস্থানে কবর যিয়ারত করা। (৭) মৃত ব্যক্তির নামে ইফতার মাহফিল করা। (৮) ইফতারের সময় দেরী করে ইফতার করা।(৯) তারাবী সালাতের শেষে দলবদ্ধভাবে দুআ করা। (১০) ২৭ রামাযানে কুরআন খতম ও বিশেষ দু‘আ বা মুনাজাত করা। (১১) জুম‘আতুল বিদা পালন করা। (১২) ঈদের মাঠে কয়েকটি খুৎবা দেওয়া। (১৩) ঈদের সালাতের পর কয়েকজন মিলে হাত তুলে মুনাজাত করা। (১৪) নির্দিষ্টভাবে ঈদের দিন দলবদ্ধ হয়ে কবর যিয়ারত করা ইত্যাতি। এছাড়াও আরো অনেক বিদ‘আত রয়েছে, যেগুলো রামাযান মাসে করা হয়। অথচ এগুলো পরিত্যাগ করা আবশ্যক। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের এদিনে নতুন উদ্ভবন করেছে যা এতে নেই তা প্রত্যাখ্যাত (সহীন বুখারী, হা/২৬৯৭; মুসলিম, হা/১৭১৮)
.
▪️বিদআতী আমলের ক্ষতি ও পরিনাম:
_____________________________________
(১). আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ: বিদআত করলে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা হয়। (দেখুন সূরা নাহল; ১৬/১১৬)। (২). বিদআত করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর খিয়ানতের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়। কারণ, রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশাতেই দ্বীন-ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে (সূরা-মায়েদাহ; ৫/৩)। (৩). বিদআত করলে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করা হয়। যেমন: (ক). সাহাবায়ে কেরামকে অলস ও ইবাদতের ক্ষেত্রে গাফেল মনে করা হয়। অর্থাৎ বিদআতীরা যখন ইসলামী শরীআত বহির্ভূত কাজকে নেকীর উদ্দেশ্যে পালন করে থাকে, তখন বিশ্বাস করা হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম ঐ সমস্ত কাজগুলি ইবাদত হিসাবে পালন না করে তাঁদের অলসতা ও গাফেলতির পরিচয় দিয়েছেন। (খ). সাহাবায়ে কেরামকে অপূর্ণাঙ্গ ইবাদতকারী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম যেহেতু যাবতীয় বিদআতী কর্মকান্ড থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রেখেছিলেন, সেহেতু বিদআতীদের নিকট সাহাবায়ে কেরাম অপূর্ণাঙ্গ ইবাদতকারী হিসাবে বিবেচিত হয়। (গ). অনুসরণীয় ইমাম ও বুযুর্গানে দ্বীনকে সাহাবায়ে কেরামের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ, সাহাবায়ে কেরামের কথা কিংবা আমল যাই থাক না কেন, বিদআতীদের নিকট তাদের অনুসরণীয় ইমাম অথবা বুযুর্গানে দ্বীনের কথাই প্রণিধানযোগ্য হয়। অথচ রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমাদের উপর আমার সুন্নাত এবং আমার পরে হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা ওয়াজিব। তোমরা তা মাঢ়ির দাঁত দিয়ে শক্তভাবে আকড়ে ধরবে। (তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫)। (৪). বিদআত করলে ইসলামের উপর অপূর্ণাঙ্গতার অপবাদ আরোপ করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা অহি-র মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশাতেই দ্বীন-ইসলামকে পূর্ণতা দান করেছেন। রাসূল (ﷺ)-এর মৃত্যুর তিন মাস পূর্বে ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জে আরাফার ময়দানে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে যখন তিনি বিদায় হজ্জ পালন করেছিলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম।’ (সূরা মায়েদা; ৫/৩)। (৫). বিদ‘আত ইসলামী শরী‘আতকে ধ্বংস করে। (ইবনুল কাইয়িম, মাদারিকুছ সালেলেহীন ১/২২৩ পৃঃ) (৬) বিদ‘আতীর আমল আল্লাহর নিকট কবুল হয় না (সূরা কাহফ ১৮/১০৩-১০৪ বুখারী হা/২৬৯৭;মিশকাত হা/১৪০) (৭). বিদ‘আত ত্যাগ না করা পর্যন্ত বিদ‘আতীর তওবা কবুল হয় না (তবারানী,সহীহ তারগীব হা/৫৪; সিলসিলা সহীহা হা/১৬২০) (৮). বিদ‘আতী হাউযে কাউছারের পানি পান ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হবে। (সহীহ বুখারী হা/৬৫৮৩-৮৪; মুসলিম হা/২২৯০; মিশকাত হা/৫৫৭১) এবং (৯). বিদ‘আতের দিকে আহবানকারী অন্যের পাপের অংশীদার হবে।(সূরা নাহল ১৬/২৫ মুসলিম হা/২৬৭৪; মিশকাত হা/১৫৮) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হামদ ও সালাতের পর বলেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হলো মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হলো দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হলো ভ্রষ্টতা।’
(মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১)। আর নাসাঈতে রয়েছে, ‘প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম।’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮)। হাসসান বিন আত্বিয়াহ মুহারেবী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। ‘যখনই কোন সম্প্রদায় তাদের দ্বীনের মধ্যে কোন বিদআত সৃষ্টি করে, তখনই আল্লাহ তাদের মধ্য হতে সেই পরিমাণ সুন্নাত উঠিয়ে নেন। অতঃপর ক্বিয়ামত অবধি তা আর তাদের মধ্যে ফিরে আসে না।’ (সুনানে দারেমী, মিশকাত হা/১৮৮)। মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিদআত থেকে হেফাজত করুক আমীন। (কিছু নোট আল ইখলাস থেকে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।