আপনার ইবাদত কখন সুন্নত সম্মত এবং কখন বিদআত যুক্ত

প্রিয় পাঠক, আপনার ইবাদত কখন সুন্নত সম্মত এবং কখন বিদআত যুক্ত এটি বুঝতে নিম্নলিখিত মূলনীতি মনোযোগ সহকারে পড়ে মৃত্যু পর্যন্ত মুখস্থ করে ফেলুন।
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
রাসূল (ﷺ)-এর ইত্তেবা বা অনুসরণ বাস্তবায়নের শর্তসমূহ। হে আমার প্রিয় মুসলিম ভাই বোনেরা! একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনাদের অবশ্যই জানতে হবে। আর তা হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো আমল শরী‘আতের ছয়টি বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে আমলের মধ্যে রাসূল (ﷺ)-এর অনুকরণ ও অনুসরণ করা বাস্তবায়িত হবে না।বরং বিদআত হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে সুন্নাত অনুযায়ী আমল করতে গেলে ছয়টি বিষয়ে সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে যেমন:
.
(১)- السبب তথা কারণ বা উদ্দেশ্য: অর্থাৎ কেউ যদি এমন কোন কারণে বা উদ্দেশ্যে আল্লাহর জন্য ইবাদত করে যা পবিত্র কুরআন ও রাসূল (ﷺ)-এর সহীহ হাদীস পরিপন্থী, তাহলে তা সুন্নাত বিরোধী আমল হিসাবে গণ্য হবে, যা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন না। এ ধরনের ইবাদাত হবে বিদআত এবং তার আমলটি হবে প্রত্যাখ্যাত। যেমন- তাহাজ্জুদের সালাত একটি উত্তম ইবাদত। কিন্তু কেউ যদি ১৫ই শাবানের রাতে প্রচলিত শবেবরাতের নিয়তে অথবা রজব মাসের ২৭ তারিখ শবে মে‘রাজের উদ্দেশ্যে রাতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে তাহলে তা বিদ‘আত হবে। কেননা উল্লিখিত কারণ বা উদ্দেশ্যে সালাত আদায়ের বিধান কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ ইবাদতটিকে এমন একটি উপলক্ষ কে সামনে রেখে সে করেছে, যা শরীআতে উপলক্ষ্য হিসেবে প্রমাণিত নয়। এ বিষয়টি (ইবাদতের কারণটি শরীআত সম্মত হওয়া) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দ্বারা অনেক আমল যেগুলোকে সুন্নাত মনে করা হয় অথচ তা সুন্নাত নয়; সেগুলো বিদআত হিসেবে চিহ্নিত হবে।
.
(২) الجنس তথা শ্রেণী বা প্রকার : অর্থাৎ কেউ যদি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এমন শ্রেণী বা প্রকারের ইবাদত করে যা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন- আমরা জানি উট, গরু, ছাগল অথবা ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু উল্লিখিত পশুর পরিবর্তে কেউ যদি ঘোড়া দ্বারা কুরবানী করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে, যা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন না।
.
(৩) القدر তথা পরিমাণ: অর্থাৎ যে পরিমান বা যতটুকু ইবাদত কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কেবল ততটুকুই পালন করতে হবে। এর অতিরিক্ত করলে তা সুন্নাত পরিপন্থী বিদআতি আমল হিসাবে গণ্য হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন- কেউ যদি যোহরের চার রাক‘আত ফরয সালাতের স্থানে পাঁচ রাক‘আত আদায় করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী নব আবিষ্কৃত বিদআত,কারণ,তা পরিমাণের ক্ষেত্রে শরীআতের নির্ধারিত সংখ্যার সম্পূর্ণ বিরোধী।অনুরূপভাবে তারাবীহ-এর সালাত বিতিরসহ রাসূল (ﷺ) কখনো ১১ বা ১৩ রাক‘আতের বেশী আদায় করেননি। কিন্তু যদি কেউ এই সুন্নাতকে উপেক্ষা করে ২০ রাক‘আত আদায় করাই সুন্নত কম বেশি নয়, এমনটি মনে করে নিদিষ্ট করে তারাবীহ ২০ রাকআত আদায় করে তাহ’লে তা সুন্নাত পরিপন্থী ইবাদতে পরিণত হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। কারন তারাবীহ ২০ রাকআত আদায় করা সুন্নত এটি বিশুদ্ধ দলিল দ্বারা প্রমানিত নয়। (তবে হা সুন্নত মনে না করে স্বাভাবিক ভাবে কেউ ২০ রাকআত পড়লে বিদআত হবেনা)।
.
৪) الكيفية তথা ধরন বা পদ্ধতি: অর্থাৎ রাসূল (ﷺ) যে ইবাদত যে পদ্ধতিতে আদায় করেছেন সে ইবাদত ঠিক সে পদ্ধতিতে আদায় করলেই কেবল সুন্নাতের অনুসরণ করা হবে। কিন্তু যদি কেউ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে নিজের মস্তিস্কপ্রসূত পদ্ধতিতে ইবাদত করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না। যেমন- দো‘আ বা মুনাজাত একটি উত্তম ইবাদত। কিন্তু তা হতে হবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন যে পদ্ধতিতে মুনাজাত করেছেন, তখন ঠিক সেই পদ্ধতিতে মুনাজাত করতে হবে। কিন্তু ফরয সালাতের পরে, ঈদের সালাতের পরে, মৃত মানুষকে দাফন করার পরে, বিবাহ বৈঠকে বর্তমানে প্রচলিত দলবদ্ধ মুনাজাত রাসূল (ﷺ)-এর পদ্ধতির বিপরীত হওয়ায় তা স্পষ্ট বিদ‘আত। আবার যদি কোনো ব্যক্তি অযু করতে গিয়ে শুরুতে পা ধোয়া আরম্ভ করল, তারপর মাথা মাসেহ করল, তারপর দুই হাত ধৌত করল এবং তারপর চেহারা ধৌত করল, আমরা বলব, তার অযু অবশ্যই বাতিল। কারণ, তার অযু ধরন ও পদ্ধতিগত দিক দিয়ে শরীআত অনুমোদিত পদ্ধতির পরিপন্থী।
.
(৫) الزمان তথা সময় বা কাল: অর্থাৎ যে সময় যে ইবাদত কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, ঠিক সে ইবাদত সে সময় পালন করতে হবে। সময়ের ব্যতিক্রম করলে সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে, যা আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না। যেমন- কেউ যদি ফযীলতের মাস হিসাবে রামাযান মাসে পশু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করতে চায়, তাহ’লে তা বিদ‘আত হবে। কেননা পশু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল শুধুমাত্র কুরবানী ও আক্বীকাহ দ্বারাই হবে, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। তাই রমযান মাসে জবেহ করা দ্বারা কুরবানীর ঈদের দিন জবেহ করার মত সাওয়াব পাওয়া যাবে এ ধরনের বিশ্বাস করা বা সাওয়াবের আশা রাখা সম্পূর্ণ বিদআত। তবে হা শুধুমাত্র গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে রমযান মাসে জবেহ করা সম্পূর্ণ বৈধ।
.
৬) المكان তথা জায়গা বা স্থান: অর্থাৎ যে স্থানে যে ইবাদত কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত, ঠিক সে ইবাদত সে স্থানেই পালন করতে হবে। স্থান পরিবর্তন করলে সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে, যা আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। যেমন- রামাযানের শেষ দশকে মসজিদে ই‘তিকাফ করা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু কোন পুরুষ বা মহিলা যদি মসজিদের পরিবর্তে বাড়িতে ই‘তিকাফ করে তাহলে তা সুন্নাত পরিপন্থী আমলে পরিণত হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার নিকট কবুল হবে না।কারণ, ইতিকাফের স্থানের নির্ধারণের ক্ষেত্রে শরীআত পরিপন্থী কাজ করেছে। এর আরও দৃষ্টান্ত- কোনো ব্যক্তি তাওয়াফ করতে গিয়ে দেখে মাতাফে জায়গা নেই। তার আশপাশে মানুষের ভিড়। তখন সে নিরুপায় হয়ে মসজিদের চার পাশে তাওয়াফ করা আরম্ভ করল। তার তাওয়াফ করা কোনো ক্রমেই শুদ্ধ হবে না। কারণ, তাওয়াফের স্থান হলো আল্লাহর ঘর। আল্লাহ তা‘আলা ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে বলেন, এবং আমার ঘরকে পাক- সাফ রাখবে তাওয়াফকারী, রুকূ-সিজদা ও দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারীর জন্য। (সূরা আল-হাজ্জ; ২২/২৬,বিস্তারিত জানতে শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন, আল-ইবদা ফী কামালিশ শারঈ ওয়া খাতারিল ইবতিদা, পৃঃ ২১-২৪ দেখুন)।
.
বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রিয় পাঠক, উপরে দুই একটি করে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে এরকম হাজারো উদাহরণ রয়েছে, ৬টি বৈশিষ্ট্যের নির্ধারিত বিষয়ের সাথে মিলিয়ে আপনারা নিজেরাই নিজেদের ইবাদত শরীয়ত সম্মত নাকি শরীয়ত বহির্ভূত বা সুন্নাহসম্মত নাকি বিদআত হচ্ছে সেটি নির্ধারন করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।