প্রশ্ন: সালাতের জায়নামাজে যদি বিভিন্ন ধরনের ছবি যেমন; কাবাঘর, চাঁদ, তারা অথবা কোন গাছ, লতা-পাতা ইত্যাদির ছবি থাকে, তাহলে উক্ত জায়নামাজে সালাত আদায় করা যাবে কি?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে মক্কার পবিত্র কাবাঘর কিংবা মদিনার মসজিদে নববীর নকশা আঁকা অথবা চাঁদ, তাঁরা, গাছ ইত্যাদির ছবিযুক্ত করে জায়নামাজ তৈরি করা কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ। যারা এই ধরনের জায়নামাজ গুলো তৈরি করে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে মহান আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েত দান করুন। একজন সচেতন মুসলিম ক্রেতার জন্য জেনে-বুঝে এই ধরেনর ছবিযুক্ত জায়নামাজ ক্রয় করা উচিত নয়। বরং সাদাসিধা এবং মনোযোগ নষ্ট করে না এমন ছবিমুক্ত জায়নামাজ ক্রয় করা উচিত। এর কারণ, অনেক আলেমের মতে- নকশাকৃত ও কারুকাজ খচিত এসব জায়নামাযে সালাত আদায় করা মাকরুহ। কেননা বিভিন্ন ছবি বা নকশাকৃত জায়নামাজগুলোতে সালাত আদায়ের সময় সাালত আদায়কারী ব্যক্তির মনোযোগে বাধা সৃষ্টি করে। যেমনটি হাদীসে আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলন; নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা একটি চাদরে সালাত আদায় করেন, যাতে নকশা ছিল। তিনি উক্ত নকশার দিকে একবার দৃষ্টি দেন। যখন তিনি সালাত শেষ করলেন তখন বললেন, তোমরা আমার এই চাদরটি আবু জাহামের নিকট নিয়ে যাও এবং আম্বেজানিয়াহ কাপড়টি নিয়ে এসো। কারণ, এটা এখনই আমাকে আমার সালাত থেকে বিরত রেখেছিল। সহীহ বুখারীর অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমি সালাত অবস্থায় এর নকশার দিকে তাকাচ্ছিলাম। কারণ, উহা আমাকে ফেৎনার মধ্যে ফেলে দিবে বলে আশংকা করছিলাম। (সহীহ বুখারী, হা/৩৭৩, ইফাবা হা/৩৬৬, ২/২১৩ পৃ. সহীহ মুসলিম হা/৫৫৬; সহীহ আল জামি ৮৬৪, মিশকাত হা/৭৫৭)। উক্ত হাদীসে সালাতে আত্মমনোযোগ এবং সালাতে ব্যস্ত বা অমনোযোগী করে এমন সকল কাজ পরিত্যাগ করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। কুরআন ভীত-সন্ত্রস্ত মুসল্লীকে সফলতার সাক্ষ্য দিয়েছে। আর সফলতা হচ্ছে পরকালীন সৌভাগ্যের অপর নাম।
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে এমন জায়নামাযে নামায পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়; যেগুলোতে মসজিদের ছবি আছে।
.
জবাবে তিনি বলেন; আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে ইমামের জায়নামাযে মসজিদের ছবি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। যেহেতু হতে পারে এটি ইমামের মনোযোগ বিঘ্নিত করবে, তার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করবে। এভাবে নামাযে ত্রুটি ঘটাবে। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নকশাবিশিষ্ট কাপড়ে নামায পড়েছিলেন এবং একবার নকশার দিকে তাঁর দৃষ্টি পড়ে যায় তখন নামায শেষে তিনি বলেন; “আমার এ কাপড়টি আবু জাহমের কাছে নিয়ে যাও এবং আবু জাহমের আনবিজানী (শামের একটি স্থানে উৎপাদিত) কাপড়টি নিয়ে আস। কারণ একটু আগে এ কাপড়টি আমার নামাযে মনোযোগ নষ্ট করতে যাচ্ছিল।” আয়েশা (রাঃ)-এর হাদিস হিসেবে সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে বর্ণিত। যদি ধরে নেয়া হয় যে, এর দ্বারা ইমামের মনোযোগ নষ্ট হবে না; যেহেতু ইমাম অন্ধ কিংবা বহুবার দেখতে দেখতে তার কাছে এটি উল্লেখযোগ্য কিছু নয় ও নজর দেয়ার মত কিছু নয়— সেক্ষেত্রে আমরা এতে নামায পড়ায় কোন অসুবিধা দেখছি না। আল্লাহ্ই তাওফিকদাতা। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড: ১২ পৃষ্ঠা: ৩৬২)।
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণকে প্রশ্ন করা হয়ছিল যে- কার্পেটগুলোর উপর ইসলামী স্থাপনার আকৃতি অংকিত আছে; ঠিক বর্তমানে মসজিদগুলোর কার্পেটগুলোর মতো, সেগুলোর উপর নামায পড়ার হুকুম কি? যদি কার্পেটের উপর ক্রশের ছবি থাকে এমন কার্পেটে নামায পড়ার হুকুম কি? ছবিটিকে ক্রশ হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য দুই পাশের রেখাদ্বয় সমান এবং নীচের রেখা লম্বা ও উপরের রেখা খাটো হতে হবে; নাকি ক্রশ আকৃতির যে কোন রেখাদ্বয়ই ক্রশ। আশা করি আপনারা এ বিষয়টি আমাদেরকে অবহিত করবেন; যেহেতু এ মুসিবত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আল্লাহ আপনাদেরকে হেফাযত করুন। জবাবে স্থায়ী কমিটির আলেমগন বলেছেন;
.
(১). প্রথমত মসজিদগুলো আল্লাহ্র ঘর। যে ঘরগুলোতে নামায আদায় করা এবং সকাল-সন্ধ্যায় মনোযোগ, অনুনয়-বিনয় ও আল্লাহর ভয়ভীতি নিয়ে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করা (তাসবিহ পাঠ)-র জন্য নির্মিত। মসজিদের কার্পেট ও দেয়ালে নকশা করলে সেটা আল্লাহ্র স্মরণে বিঘ্ন ঘটায়, মুসল্লিদের মনোযোগের অনেকটুকু নষ্ট করে। তাই সালফে- সালেহীনদের অনেকে নকশা করাকে অপছন্দ করতেন (মাকরুহ জানতেন)। তাই মুসলমানদের উচিত মহা পুরস্কার ও অধিক সওয়াব পাওয়ার আশায় এমন নকশা থেকে তাদের মসজিদগুলোকে মুক্ত রাখা; যাতে করে রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জনের স্থানসমূহ থেকে মনোযোগ নষ্টকারী জিনিসগুলো দূর করে পরিপূর্ণ ইবাদতের পরিবেশ বজায় রাখা যায়। তবে এ ধরণের কার্পেটের উপর নামায পড়া শুদ্ধ।
.
(২). দ্বিতীয়ত ক্রশ হচ্ছে খ্রিস্টানদের প্রতীক। তাদের উপাসনালয়ে তারা এ প্রতীকটি রাখে, এটাকে সম্মান করে এবং এ প্রতীককে একটি মিথ্যা ঘটনা ও বাতিল বিশ্বাসের চিহ্ন গণ্য করে। সে বিশ্বাসটি হলো- মরিয়ম তনয় ঈসা আলাইহিস সালামের ক্রশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তাআলা ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে মিথ্যাবাদী ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন; “অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রশবিদ্ধও করেনি; বরং তারা ধাঁধায় পড়েছিল।” তাই মুসলমানদের জন্য তাদের নামাযের কার্পেটে বা এ ধরণের কিছুতে ক্রশ রাখা জায়েয নয়; ক্রশকে থাকতে দেয়া উচিত নয়। বরঞ্চ তাদের উপর আবশ্যক এটিকে মুছে ফেলে, এর রেখাগুলো নিশ্চিহ্ন করা; যাতে করে নিন্দনীয় বিষয় থেকে দূরে থাকা যায় এবং খ্রিস্টানদের সাথে সাধারণ সাদৃশ্য গ্রহণ থেকে; এবং তাদের সম্মানযোগ্য বিষয়গুলোর সাথে বিশেষ সাদৃশ্য গ্রহণ থেকে ঊর্ধ্বে থাকা যায়। এক্ষেত্রে আড়াআড়ি রেখাটি লম্বালম্বি রেখার চেয়ে দীর্ঘ হওয়া বা সমান হওয়া কিংবা উপরের অংশের রেখা নীচের অংশের রেখার চেয়ে খাটো হওয়া বা সমান হওয়ার মধ্যে কোন তফাৎ নাই। (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, খন্ড:৬ পৃষ্ঠা: ১৮১ ও ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯০০৯৭)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, কালিমায়ে শাহাদাতের স্বীকৃতি দেওয়ার পর একজন মুসলিমের জন্য দ্বিতীয় রুকন বা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো সালাত। সুতরাং সেই সালাতে একজন ব্যক্তিকে বাঁধা প্রদান করে বা অমনোযোগী করে; এমন সকল কাজ বা জিনিসপত্র পরিত্যাগ করতে হবে। যারা এমন ছবি যুক্ত জায়নামাজ ক্রয় করে ফেলেছেন; তারা সেগুলোর উপরে ছবিমুক্ত কোন কাপড় বিছিয়ে সালাত আদায় করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি বিভিন্ন জড় বস্তু বা কাবাঘরের ছবিযুক্ত জায়নামাজে সালাত আদায় করে; তাহলে তার সালাতের কোন সমস্যা হবেনা ইনশাআল্লাহ। তার সালাত আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু এসব ছবি থাকার কারণে কেউ যদি সালাতে অমনোযোগী হয়, তাহলে এর জন্য তিনি পরিপূর্ণ নেকি লাভ থেকে বঞ্চিত হবে।পাশাপাশি আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, অনেকে মনে করে জায়নামাজে কাবাঘরের ছবি থাকলে এবং সেখানে পা দিলে গুনাহ হবে বা কাবাঘরকে অসম্মানিত করা হবে; কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এমন নয়। কেউ যদি অসম্মানের উদ্দেশ্যে এমনটি না করে তাহলে কোন সমস্যা নেই, ইনশাআল্লাহ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।