ইসলামী গজলের নামে আধুনিক নাশিদে হারামের সংমিশ্রণ এবং নাশিদ জায়েজ হওয়ার শর্ত সম্পর্কে সালাফদের মানহাজ কি

ভূমিকা: বর্তমান বাংলাদেশে দাওয়াত ও তাবলীগের ময়দানে যুবক ও তরুণ ছাত্রদের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের এই প্রচেষ্টা দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য খুবই কল্যাণকর। ভবিষ্যৎ শিরক-বিদআত ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এটা আনন্দের বার্তা বহন করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ আবেগ আর মানহাজ বিহীন চেতনা অনেক ক্ষেত্রে সেই স্বপ্নকে বিনাশ করে দিচ্ছে। শারঈ বিশুদ্ধ জ্ঞানের অভাব ও মানহাজগত ত্রুটির কারণে মুখরোচক মিথ্যা কথা আর আক্বীদা বিরোধী নতুন নতুন উদ্ভট তথ্য ও ব্যাখ্যার কুপ্রভাবে বেলুনের মত হাওয়ায় ভাসছে তারা। অন্যদিকে সাধারণ জনতা মাকাল ফলের মত বিদ‘আতী, মূর্খ ও মানহাজ গোপনকারী-মুখোশধারী বক্তাদের ধোঁকায় পড়ে প্রকৃত সালাফী আলেমদের গালমন্দ করছে। বিবেকশূন্য হওয়ার কারণে এরা নিজেরা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হচ্ছে এবং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করছে। ভিতরে ভিতরে কেউ খারেজী চেতনা লালন করছে, কেউ শী‘আ, হুতি, কিংবা হিজবুল্লাহর জ্বরে আক্রান্ত, আবার কেউ ইখওয়ানী,কেউ সূফী ইলিয়াসী তাবলীগের কুপ্রভাবে কাতরাচ্ছে, কেউ পীর-ফকীরী এবং প্রচলিত মাযহাবের প্রতারণার জালে আবদ্ধ। এর ভবিষ্যৎ পরিণাম যে যন্ত্রণাদায়ক ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ হয়তোবা তা অচিরেই উপলব্ধি করবে। ততক্ষণে জীবনের স্বর্ণালি সময় চলে যাবে।
.
প্রিয় পাঠক! বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামিক গজলের নামে নাশিদ বা ইসলামি সংগীত, ইসলামি গান, কবিতা, ইত্যাদি এক শ্রেণীর তরুণ যুবকদের অন্তরের খোরাকে পরিণত হয়েছে। এই সকল কথিত নাশিদ বা ইসলামী গান এক শ্রেণীর ইসলামপন্থী যুবকদের মন-মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে। পবিত্র কুরআনের একটি সূরার বিশুদ্ধ তেলোয়াত সেসব যুবক-যুবতীরা না জানলেও প্রচলিত বহু নাশিদ ঠিকই মুখস্ত বলতে পারবে। কথিত ইসলামি সঙ্গীত ও গান ছাড়া যেন তাদের জীবন শুষ্ক মরুভূমি। অপরদিকে শ্রোতাদের এই আবেগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেনীর যুবকদের মধ্যে এটিকে রীতিমত একটি শিল্প বা প্রফেশন হিসেবে গ্রহণ করার হিড়িক পরিলক্ষিত হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে নানা কলরব শিল্পীগোষ্ঠী। বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠান এমন কি ওয়াজ-মাহফিল গুলোতেও প্রধান আকর্ষণ হিসাবে আনা হচ্ছে ভাড়া করা কথিত এই নাশিদ শিল্পী। বর্তমানে নাশিদ এর ব্যান্ড দলের মাধ্যমে কনসার্ট পরিবেশিত হচ্ছে! ফেসবুক ইউটিউবে এইসব গান-গজলের ভিউ সংখ্যা অকল্পনীয়। অনেক ক্ষেত্রে কণ্ঠকে পরিবর্তন করে নাশিদ এর সাথে ভিডিও ক্লিপ, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার ও গায়কের ছবি লাগিয়ে ফেসবুক, ইউটিউবে monetization on রেখে প্রচার করা হচ্ছে কথিত এই ইসলামিক গান। ফলে মাস শেষে গায়কদের ইনকাম হচ্ছে হাজার থেকে লক্ষ টাকা। অথচ এভাবে অনলাইন থেকে উপার্জন করা হালাল নাকি হারাম সেটা দেখার কোন সময় নেই তাদের। এজন্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলে গিয়েছেন, يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ.অর্থাৎ মানুষের সম্মুখে এমন এক যুগ আসবে যে, কেউ পরওয়া করবে না কি উপায়ে মাল লাভ করল; হারাম না হালাল উপায়ে। (সহীহ বুখারী, মিশকাত হা/২৭৬১)। বর্তমানে আমরা নানামুখী ফিতনার সমুদ্রে সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি; কোথাও প্রকৃত শান্তি নেই। অনিয়মই হয়ে যাচ্ছে নিয়ম। আল্লাহভীরুতা বাহ্যিক বেশ-ভূষাতে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ভিতরে নানা সমস্যা।ছোট থেকে বড় সকল পাপের কাজগুলো অহরহ হয়ে যাচ্ছ। (আল্লাহ আমাদেরকে সকল ফিতনা থেকে হেফাজত করুন)।
.
যাইহোক, এ পর্যায়ে এই সব নাশিদ বা ইসলামি সংগীত বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি তা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। প্রথমত বলব, একজন সচেতন ও কর্তব্য পরায়ণ মুমিনের জন্য এইসব কথিত সংগীত, গজল ও নাশিদ থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। কারণ এগুলো মূলত শিয়া, বিদআতি ও সুফিদের মাধ্যমে উৎপত্তি হয়েছে, কাল পরিক্রমায় বর্তমান যুগে এই আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। ইসলামের প্রথম যুগে এগুলোর কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এগুলো শোনার নানা ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন: কুরআন তেলাওয়াত বা শোনার প্রতি অন্তরে গাফিলতি বা অমনোযোগিতা সৃষ্টি হওয়া, দুআ এবং জিকির-আজকার পাঠে অলসতা সৃষ্টি হওয়া, দ্বীনের ইলম চর্চায় অবহেলা করা ইত্যাদি। এসব কথিত নাশিদ বা ইসলামি সংগীত চর্চা করা ও পরিবেশনার জন্য শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করা বা এ কাজকে প্রফেশন হিসেবে গ্রহণ করা এবং শোনার প্রতি নেশা সৃষ্টি হওয়া গর্হিত কাজ। বিশেষ করে যেগুলোতে নারী কণ্ঠ, বিভিন্ন মিউজিক্যাল বা সিনেমার গানের সুর নকল, শিরক-বিদআত, অতিরঞ্জন ও শরিয়তে বিকৃতি মূলক কথাবার্তা হয়েছে। সেই সাথে যদি তাতে বাদ্যযন্ত্রের সংযোগ ঘটে তাহলে তা হারাম হওয়ার দিকটি আরও জটিল হবে-তাতে কোন সন্দেহ নেই।বাস্তবতা হচ্ছে, এ নাশিদ শিল্পীদের মন-মস্তিষ্কে সার্বক্ষণিক সঙ্গীত, নাশিদ, গান, সূর, তাল, লয়, ভোকাল, গায়কি ইত্যাদি বিষয়গুলো ঘুরপাক খায়। তাদের চিন্তা জগতে যে বিষয়টা কাজ করে তা হলো, কিভাবে নাশিদ বা সঙ্গীত পরিবেশন করে মানুষের চিত্ত রঞ্জন করা যায়, গলার সুর দ্বারা কিভাবে শ্রোতা- দর্শককে মুগ্ধ করা যায়, কিভাবে আরও বেশি আকর্ষণ সৃষ্টি করা যায়, কিভাবে প্রশংসা ও বাহ্বা কুড়ানো যায়, কিভাবে আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায় ইত্যাদি। আর যারা নাশিদের সুরকার বা সুর ডিজাইনার তারা সাধারণত: সুর সৃষ্টির জন্য হারমোনিয়াম, সারেগামা এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকে। অন্যথায় আকর্ষণীয় সুর সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। (নোট ওস্তাদ আব্দুল্লাহিল হাদী (হাফি:) থেকে)।
.
❑ তথাকথিত ইসলামী গজলের নামে প্রচলিত নাশিদ শোনার ব্যাপারে চলুন দেখি ইসলামি স্কলারদের অভিমত কি:
.
প্রচলিত ইসলামিক গজল বা নাশিদ শোনা যাবে কি না এই মাসআলায় আহালুল ইমামগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে মতামত গুলো পর্যালোচনা করলে দুই ধরণের অভিমত পাওয়া যায়। কতিপয় আলেম কিছু শর্ত সাপেক্ষে সেগুলো শোনা যাবে বলে মতামত দিয়েছে। যেমন: যেসব সঙ্গীত বা নাশিদে চরিত্র গঠন, ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান, মানব কল্যাণে উদ্দীপনা সৃষ্টি, তাওহিদ ও সুন্নাহর দিকে আহ্বান, শিরক-বিদআত ও অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধাচরণ, অন্যায়ের প্রতিবাদ, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিকারী বা শিক্ষা মূলক ইসলামি কথাবার্তা আছে; এগুলো যদি মিউজিক, দফ বা হারাম বিষয়াদি থেকে মুক্ত হয় তাহলে তা সীমিত পরিসরে কখনো শুনলে গুনাহ হবে না ইনশাআল্লাহ। তবে তাদের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট যে, এগুলো শোনা পছন্দনীয় কাজ নয়। পক্ষান্তরে কোনও কোনও আলেম, এগুলোকে বিদআতি ও হিজবীদের আলামত হিসেবে উল্লেখ করে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য কবিতা আবৃত্তি করা বা শোনা শরিয়তে অনুমোদিত। কবিতা ও নাশিদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। নাশিদ বা ইসলামি সঙ্গীত বিষয়ে আধুনিক বিশ্বের কয়েকজন ইসলামি স্কলারের মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, এই গানগুলোকে ইসলামিক গান বলাটা জায়েজ রয়েছে যখন এ গানগুলোর মধ্যে উপদেশ থাকবে শরীয়তের, কোন বিধি-বিধান থাকবে দ্বীনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করবে, ইসলামের প্রতি সম্পর্ক করার দিকে উপকার সাধিত করবে, খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে, ভালো কাজের প্রতি আহ্বান জানাবে এবং আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের কথা শোনাবে, কাফের মুশরিকদের বিরোধী কথাবার্তা থাকবে। ‌ আর যদি দেখা যায়, এর মাধ্যমে কোন অনুষ্ঠানের নাচ-গান, অনৈতিক আচার-আচরণ, খারাপ কাজের প্রতি আহ্বান জানানো ইসলাম বিরোধী কথা থাকে, আল্লাহ বিমুখতা করে দেয়, তাহলে এগুলো জায়েজ নাই। (ফাতাওয়ায়ে ইসলামিয়া: খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ৫৩৩)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, ইসলামি নাশিদ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। যদি সেগুলো দোষমুক্ত হয়- যেগুলোতে কল্যাণের পথে আহ্বান, ভালো কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য, শত্রুদের চক্রান্ত থেকে দেশ রক্ষা ও শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি গ্রহণের প্রতি উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ছাড়া অন্য কিছু না তাকে তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যদি তাতে এসব ছাড়া পাপাচারের দিকে আহ্বান, নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা, পর্দা হীনতা অথবা কোনও ধরণের খারাপ বিষয় থাকে তাহলে সেগুলো শোনা জায়েজ নাই। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৪৩৭)। তিনি আরো বলেন: ইসলামী গান কবিতার মতো; যদি এটি ভালো হয়, তবে এটি নিরাপদ , এটাতে সমস্যা নাই এবং যদি এতে আপত্তিকর কিছু থাকে বা খারাপের দিকে আহ্বান করে তবে এটি নিরাপদ নয়। (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯১১৪২)।
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন: আমি মনে করি, ইসলামি নাশিদগুলো আগের থেকে পরিবর্তিত হয়েছে। আগে সেগুলি এমন কণ্ঠ দিয়ে করা হয়েছিল যা মন্ত্রমুগ্ধকর বা অতিরঞ্জন মূলক ছিল না, কিন্তু এখন সেগুলি মন্ত্রমুগ্ধকর কণ্ঠ দিয়ে করা হয়েছে, আস্তে আস্তে মানুষ এইগুলো সাথে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা শুরু করে, হারাম গানের মতো করে সুন্দর করে গাওয়ার প্রতিযোগিতা চালু হয়। তাই, আমি এই নাশিদগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট নই!কিন্তু যদি একজন মানুষ আমাদের কাছে এসে নাশিদ গান গায় যার একটি শ্রুতিমধুর অর্থ আছে, এবং যার মধ্যে কোন বাজে কথা নেই এবং কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই তার কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে, তাতে দোষের কিছু নেই।হাসান ইবনে সাবিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মসজিদে কবিতা পাঠ করতেন। (দুরূস ওয়া ফাতাওয়া আল-হারাম আল-মাদানী, হিজরী ১৪১৬ প্রশ্ন নং-১৮)। শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেছেন; “কারও পক্ষে ফাতওয়া দেওয়া সম্ভব নয় যে, এটি সর্বাবস্থায় জায়েজ অথবা সর্বাবস্থায় হারাম। তবে আমি যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি (দফ ব্যবহার, ফিতনা সৃষ্টি করে, ফিতনা সৃষ্টিকারী সুন্দর কণ্ঠস্বর, হারাম গানের সুর ইত্যাদি) যদি সেগুলো থেকে মুক্ত হয় তাহলে তা জায়েজ। কিন্তু যদি তাতে দফ বাজানো হয়, ফিতনা সৃষ্টিকারী সুন্দর কণ্ঠ নির্বাচন করা হয় অথবা নিকৃষ্ট গানের সূরে পরিবেশন করা হয় তাহলে সেগুলো শ্রবণ করা জায়েজ নাই। (আস সাহওয়াহতুল ইসলামিয়াহ, ইসলামিক জাগরণ, ১৬৮ পৃষ্ঠা)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, যদি এই নাশিদগুলো ইসলামিক অর্থবোধক হয় এবং তাতে কোনও মিউজিক ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার-যেমন: দফ, তবলা/ড্রাম ইত্যাদি না থাকে তাহলে এতে সমস্যা নেই। তবে তা জায়েজ হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত অবশ্যই স্পষ্ট করা উচিত। তা হলো, শরিয়ত বিরোধী বিষয়াদি থেকে মুক্ত হওয়া। যেমন: অতিরঞ্জন মূলক কথাবার্তা ইত্যাদি। আরেকটি শর্ত হলো, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা যাবে না। কারণ শ্রোতাদেরকে এগুলো কুরআন তেলাওয়াত থেকে দূরে সরিয়ে দেয় অথচ কুরআন শোনাার প্রতি সুন্নাতে নববীতে উৎসাহিত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে তা তাদেরকে উপকারী জ্ঞান অন্বেষণ এবং আল্লাহ পথে দাওয়াত থেকেও দূরে সরিয়ে দেয়। (আল আসালা ম্যাগাজিন, সংখ্যা ২, তারিখ: ১৫/৬/১৪১৩)।
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] নাশিদের বিষয়ে বলেছেন; ইসলামে নাশিদ বলে কিছু নেই। এটি একটি বিদআতি নাম। প্রধানত নাশিদ সুফিদের। কারণ তারা নাশিদ দ্বারা ইবাদত করে অথবা হিজবিদের (দল পন্থীদের)- যাদের বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। তারা এ নাশিদগুলোর মাধ্যমে তাদের অনুসারীদেরকে তাদের অনুসরণ করতে উৎসাহিত করে। সুতরাং তা হয় সুফিদের অথবা হিজবিদের আলামত। (আল-বায়ান লি আখতা বাদ আল-কুত্তাব পৃষ্ঠা: ৩৪২)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, প্রচলিত ইসলামিক গজল বা নাশিদ শোনা যাবে কিনা এই বিষয়ে ইতিহাস বিখ্যাত আলেমগণ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তারা বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে এগুলো শোনা জায়েজ বলেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি সালাফগণ নাশিদ শোনার বৈধতার পক্ষে যে সকল শর্ত দিয়েছেন তা বর্তমান নাশিদে প্রায় অনুপস্থিত। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রচলিত নাশিদ এর শব্দের মধ্যে শিরক+বিদআতী কথা, অপ্রয়োজনীয় শব্দের ব্যবহার এমনকি নাটক সিনেমার গান, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং একজন সচেতন ইসলাম প্রিয় মানুষ এ সকল সংশয় মূলক নতুন ফিতনা থেকে দূরে থাকবে। প্রচলিত নাশিদ শোনার পরিবর্তে কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াত শুনবে। কেননা কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমেই অন্তর প্রশান্ত হয়,নেকি হয়। কিন্তু কথিত ইসলামী নাশিদ শুনার মধ্যে কোন নেকি বা কল্যান নেই। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছিলেন, ‘‘হে আল্লাহ, আপনি কুরআনকে আমার হৃদয়ের বসন্ত বানিয়ে দিন।’’ [ইমাম ইবনু হিব্বান, আস-সহিহ: ৯৭২; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৩৭১২; হাদিসটি সহিহ] তাছাড়া যে সকল কাজের কল্যাণ নেই মমিনগণ সে সকল কাজ থেকে বিরত থাকে কেননা মহান আল্লাহ সূরা মুমিনুনে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন:وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ عَنِ اللَّغۡوِ مُعۡرِضُوۡنَ অর্থাৎ আর যারা অসার বা অনর্থক কর্মকাণ্ড থেকে থাকে বিমুখ (সূরা মুনিমুন,২৩/৩) এর মানে এমন প্রত্যেকটি কথা ও কাজ যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ও যাতে কোন ফল লাভও হয় না। শির্কও এর অন্তর্ভুক্ত, গোনাহের কাজও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হতে পারে [ইবনে কাসীর] আমরা মহান আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সব ধরনের যাবতীয় ফিতনা থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করেন এবং আমাদেরকে ঈমানের সাথে মৃত্যবরণ করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।