কোন সন্ত্রাসী যদি অন্যায় ভাবে আক্রমণ করে হত্যা করতে চায় তাহলে তার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য তাকে হত্যা করা যাবে কি এবং রাষ্ট্রীয় আইন-আদালত ও প্রশাসন থাকা অবস্থায় এটা জায়েয হবে কি? এই সম্পর্কে ইসলামের বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
প্রথম কথা হল, দেশে প্রচলিত মানব রচিত আইনে পরিচালিত শৃংখলা বাহিনীকে চাকরি করার সময় কুরআনের নিম্নলিখিত মূলনীতি মাথায় রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, তোমরা নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর এবং গুনাহ ও অন্যায়ের কাজে সাহায্য করো না’ (সূরা মায়েদাহ ৫/২)। অতএব কোন দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে যদি শরীআ‘তের উপরোক্ত নির্দেশনা মেনে দায়িত্ব পালন করতে হবে ইসলাম বহির্ভূত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহ’লে ঐরূপ চাকুরী থেকে বিরত থাকাই কর্তব্য।কারন মহান আল্লাহ বলেন, আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফের। (সূরা মায়েদাহ,৫/৪৪)
.
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, অবশ্যই তোমাদের উপরে এমন শাসকদের আগমন ঘটবে, যারা নিকৃষ্ট লোকদের কাছে টানবে এবং উত্তম লোকদের পিছনে সরিয়ে দিবে। তারা ছালাতকে তার ওয়াক্ত থেকে পিছিয়ে দেবে। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে পাবে, তারা যেন কখনোই তাদের গুপ্তচর, পুলিশ, কর আদায়কারী এবং রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত না হয়’ (সহীহ ইবনু হিববান হা/৪৫৮৬; মুসনাদে আবী ইয়া‘লা হা/১১১৫; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৬০)। শাইখুল ইসলাম, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৭২৮হি.) বলেছেন, যদি তাতে মুসলমানদের জন্য কল্যাণ থাকে এবং সে তা করতে সক্ষম হয়, তাহ’লে তার জন্য চাকুরী ত্যাগ করা সমীচীন হবে না বরং সাধ্যমত অন্যায় থেকে বেঁচে থাকবে। তবে দ্বীন পালন করা সম্ভব না হ’লে বা তার যুলুমে সহযোগিতা করা ছাড়া কোন উপায় না থাকলে উক্ত চাকুরী করা যাবে না (মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৮/২৬, ২৮৩; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১/৭৯৩-৯৪ পৃ.)।
.
দ্বিতীয় কথা হল,ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। একজন মুসলিম নিজেকে এবং তার পরিবারকে যেকোনো আগ্রাসী থেকে রক্ষা করতে বাধ্য। ইসলাম যে কারো ওপর অন্যায়, অবিচার, আক্রমণ ও জুলুমকে হারাম করেছে। একই সঙ্গে ইসলাম আত্মরক্ষার অধিকারও দিয়েছে। নিজের শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী আত্মরক্ষা করার অনুমতি ইসলামে রয়েছে। শুধু তাই নয় বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা উৎসাহিত করা হয়েছে। অন্যায় আক্রমণের শিকার হলে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিহত করতে হবে। তবে যদি আক্রমণকারীকে হত্যা ব্যতীত ন্যূনতম উপায়ে নিবারণ করতে সক্ষম হয় তবে সেটাই করতে হব। কিন্তু যদি আক্রমণ কারীকে হত্যা ব্যতীত নিজেদের রক্ষা করা না যায়,তাহলে যার উপর হামলা করা হচ্ছে তার জন্য তাকে অর্থাৎ আক্রমণ কারীকে হত্যা করা জায়েয এবং এই হত্যার জন্য কোন (কিসাস) নেই। কোন রক্তের মূল্য (দিয়াহ) দিতে হবে না অথবা কোন কাফফারা দিতে হবে না। কারণ, এই ক্ষেত্রে শরীআত তাকে হত্যা করার অনুমতি দিয়েছে এবং নিহত হানাদার বা আক্রমণ কারীকে জাহান্নামের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এবার আক্রমণকারী ব্যক্তি মুসলিম না কাফির তাতে কোনো পার্থক্য নেই। এবং আক্রমণ কারীর সাথে লড়াই করা মজলুম ব্যক্তি যদি আগ্রাসনের শিকার হয়ে নিহত হয় তাহলে সে একজন শহীদ হবেন ইনশাআল্লাহ। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৪২৬৪ ই.ফা. ৪২২৫, ই.সে. ৪২২৫ মিশকাত হা/৩৫১৩, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭৮৯৭৮)
.
পবিত্র কুরআনে কারো ক্ষতি করা হলে সে ক্ষতিকারীর অনুরূপ ক্ষতি করতে পারে মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, সুতরাং যে তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছে, তোমরা তার ওপর আক্রমণ করো, যেরূপ সে তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। আর আল্লাহকে ভয় করো এবং জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা বাকারা,২/১৯৪)। অন্য আয়াতে ধ্বংস ও ক্ষতির হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছে, তোমরা নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে ফেলো না।’(সূরা বাকারা, ২/১৯৫)
.
হাদীসে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি কেউ আমার সম্পদ ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয় তবে আমি কি করব? রাসূল (ﷺ) বললেন, তুমি তাকে তোমার সম্পদ নিতে দিবে না। লোকটি বলল, যদি সে আমার সাথে এ নিয়ে লড়াই করে? রাসূল (ﷺ) বললেন, তুমিও তার সাথে লড়াই করবে। লোকটি বলল, যদি সে আমাকে হত্যা করে? রাসূল (ﷺ) বললেন, তাহলে তুমি শহীদ বলে গণ্য হবে। লোকটি বলল, আর যদি আমি তাকে হত্যা করি? রাসূল (ﷺ) বললেন, তাহলে সে জাহান্নামী। (সহীহ মুসলিম হা/১৪০; মিশকাত হা/৩৫১৩)।
.
অপর বর্ননায়, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে লোক তার ধন-সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ। (সহীহ বুখারী ২৪৮০, মুসলিম ১৪০, নাসায়ী ৪০৮৬, তিরমিযী ১৪১৯, সহীহ আল জামি‘ ৬৪৪৪ মিশকাত,৩৫১২)। উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো ধন-সম্পদ হরণ করে তার সাথে লড়াই করা বৈধ। এটা জুমহূর উলামার মত। কিন্তু যারা ওয়াজিব বলেছেন তাদের সংখ্যা খুবই কম। মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেন অল্প জিনিস নিতে চাইলে তার সাথে লড়াই করা জায়িয নয়। ইমাম কুরতুবী বলেন, এর হুকুম নিয়ে মতভেদের কারণ হল হত্যার অনুমতি যদি ঘৃণ্য কাজকে পরিবর্তন করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে এক্ষেত্রে অল্প বা বেশি জিনিসের মাঝে কোনো তফাৎ নেই। কিন্তু যদি ক্ষতিসাধনকে প্রতিহত করা উদ্দেশ্য হয় তবে এর অবস্থা বিভিন্ন রকম হয়। (মিশকাতুল মাসাবিহ, ৩৫১২ হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.
ইবনুল মুনযির শাফিঈ-এর উদ্ধৃতি বর্ণনা করে বলেন- যার ধন-সম্পদ, জান ও সম্মান কেড়ে নেয়া হয় তার স্বাধীনতা রয়েছে। ইচ্ছা করলে সে তাকে আঘাত করতে পারে অথবা ইচ্ছা হলে সাহায্য প্রার্থনা করতে পারে। এতে সে যদি নিবৃত্ত হয় তবে তার সাথে লড়াই করা ঠিক নয়। অন্যথায় তাকে জীবন দিয়ে হলেও প্রতিহত করবে। তার ওপর কোনো গ্রেফতারী পরওয়ানা, রক্তমূল্য ও কাফফারাহ্ নেই। কিন্তু তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য তার থাকবে না। ইবনুল মুনযির আরো বলেন- তফসিল ছাড়াই বিদ্বানগণের মত হলো মানুষের দায়িত্ব প্রতিরোধ করা, যখন অন্যায়ভাবে তার জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর ইত্যাদির ক্ষতিসাধন করা হয়। ইসলাম ধর্মকে সাহায্য করা কিংবা রক্ষা করতে বাধা প্রদান করতে হবে। কিন্তু যালিম শাসক এই হুকুম থেকে পৃথক। যেহেতু তার কৃতকর্মের উপর সবর করা অর্থাৎ তার অত্যাচারে ধৈর্যধারণ করা ও তার বিদ্রোহ না করার জন্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৪৮০)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৭২৮হি) বলেন- আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ঐক্যমত হল যে, যদি একজন মুসলিম আক্রমণকারীকে হত্যা ছাড়া প্রতিহত করা না যায়, তবে তাকে হত্যা করা যেতে পারে, যদিও সে যে সম্পদ নিতে চায় তা অল্প পরিমাণে হয়। যেমন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদীসে বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের মাল রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ, যে নিজের পরিবার রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ, যে তার নিজের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সেও শহীদ এবং যে নিজের দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ। (আবু দাঊদ ৪৭৭৪, তিরমিযী ১৪২১, নাসাঈ ৪০৯৫, মাজমু আল-ফাতাওয়া, ২৮ তম খন্ড ৫৪০-৫৪১)।
.
আল-রাউদ আল-মুরাব্বি’ এ বলা হয়েছে: যদি কোনো ব্যক্তি বা তার কোনো একজন নারী, যেমন তার মা, মেয়ে, বোন বা স্ত্রীকে আক্রমণ করা হয় বা তার সম্পত্তি, সে দাস হোক বা পশু হোক, আক্রমণ করা হয়, তাহলে উক্ত আক্রমনকারী থেকে আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। যদি সে আক্রমণকারীকে ন্যূনতম উপায়ে নিবারণ বা প্রতিহত করতে সক্ষম হয় তবে এর চেয়ে বেশি করা তার জন্য হারাম। কারণ, এর কোন প্রয়োজন নেই। যদি সে তাকে অর্থাৎ আক্রমণকারীকে হত্যা করা ছাড়া তাড়াতে না পারে, তবে সে তা করতে পারে। অর্থাৎ আক্রমণকারীকে হত্যা করতে পারে এবং সে এর জন্য দায়ী নয়, কারণ সে তাকে হত্যা করেছে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য (আল-রাউদ আল-মুরাব্বি; ৬৭৭ পৃষ্ঠা, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭৮৯৭৮)
.
বিগত শতাব্দীতে সৌদি আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, আত্মরক্ষা বা ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার। সকল ধর্ম ও সকল আইনে এটা সিদ্ধ। অতএব কেউ যদি কারো সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চায়, অপমান করে অথবা হত্যা করতে উদ্যত হয়, সেক্ষেত্রে আত্মরক্ষার্থে তৎক্ষণাৎ তার উপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করায় কোন বাধা নেই। তবে এক্ষেত্রে পূর্ণ ইনসাফ বজায় রাখা আবশ্যক। (আল-মাওসূআতুল ফিক্বহিয়াহ ৩২/৩১৮; উসাইমীন, লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ; ১৩/৮২)।
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, অন্যায় আক্রমণের শিকার হলে স্বাভাবিক ভাবে হত্যা না করে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে হবে কেননা স্বাভাবিকভাবে প্রতিহত করতে পারলে হত্যা করা জায়েজ নয়। কিন্তু সেটা সম্ভব না হলে এবং নিজের প্রাণনাশের সম্ভাবনা থাকলে পাল্টা আক্রমণ করে আক্রমণকারী সন্ত্রাসীকে হত্যা করা যাবে। তবে কেউ যদি জুলমের শিকার হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ধৈর্য্যধারণ করে তাহলে উক্ত ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিকটে উত্তম প্রতিদান লাভ করবে। (সূরা শূরা ৪২/৩৯-৪৩, ফুসসিলাত ৪১/৩৪)। যেমন ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেন, যদি কেউ আমার ঘরে ঢুকে আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন আমি কি করব? জওয়াবে রাসূল (ﷺ) বললেন, كُنْ كَخَيْرِ ابْنَىْ آدَمَ তুমি আদমের দুই ছেলের মধ্যে উত্তমটির মত হও।(আবুদাঊদ হা/৪২৫৭, তিরমিযী হা/২১৯৪; মিশকাত হা/৫৩৯৯)। অর্থাৎ হাবিলের মত হও যাকে হত্যা করা হয়েছিল। আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।