প্রশ্ন: আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও”(সহিহ বুখারী হা/৩৪৬১) এই হাদীসের বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা কী? যে কেউ কুরআন হাদীসের বানী পৌঁছে দিতে পারবে?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর নিকট একমাত্র মননীত দ্বীন। কুরআন হচ্ছে সর্বশেষ আসমানী কিতাব। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল। আল্লাহ তাঁকে এ ধর্ম সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন: “এ কুরআন আমার নিকট ওহী করা হয়েছে যেন তোমাদেরকে এবং যার নিকট তা পৌঁছবে তাদেরকে এর দ্বারা সতর্ক করতে পারি।”[সূরা আনআম, আয়াত: ১৯] আল্লাহ তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইসলাম দিয়ে সকল মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন: “আপনি বলুন, হে মানুষ! নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহ্র রাসূল”[সূরা আরাফা, আয়াত: ১৫৮] ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া একটি উত্তম আমল। যেহেতু এই দাওয়াত দানের মাধ্যমে মানুষ সরল পথের দিশা পায়। এর মাধ্যমে মানুষকে তার দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তির পথ দেখানো হয়।“ঐ ব্যক্তির চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে। আর বলে অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।”[সূরা ফুস্সিলাত, আয়াত: ৩৩]। ইসলামের দিকে আহ্বান করা একটি মর্যাদাপূর্ণ মিশন। এটি নবী-রাসূলদের কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর মিশন এবং তাঁর অনুসারীদের মিশন হচ্ছে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন: “বলুন, এটাই আমার পথ, আমি জেনে-বুঝে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারা। আর আল্লাহ্ কতই না পবিত্র এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।”[সূরা ইউসূফ, আয়াত: ১০৮]
আমভাবে সকল মুসলমান এবং খাসভাবে আলেমসমাজকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; আর তারাই সফলকাম।”[সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১০৪] আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃبَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً وَحَدِّثُوا عَنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَا حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ “আমার পক্ষ হতে (মানুষের কাছে) একটি বাক্য হলেও পৌঁছিয়ে দাও। বনী ইসরাঈল হতে শোনা কথা বলতে পারো, এতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করবে, সে যেন তার বাসস্থান জাহান্নামে প্রস্তুত করে নেয়।(সহীহ বুখারী হা/৩৪৬১)
.
▪️হাদীসটির ব্যাখ্যা: হাদীসটি থেকে তিনটি বিষয় জানা যায়:
(১) প্রথমত: হাদীসের বাক্য,بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً “আমার পক্ষ হতে (মানুষের কাছে) একটি বাক্য হলেও পৌঁছিয়ে দাও। এই বাক্যটি ইঙ্গিত করে কারো যদি কুরআনের ছোট্ট একটি আয়াতও জানা থাকে তাহলে তা প্রচার করতে হবে। আর কুরআন স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যা তিনি আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন। যে কুরআন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, তার ধারক-বাহক অধিক হওয়া এবং স্বয়ং আল্লাহ তার সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়া সত্ত্বেও তা আরো প্রচারের জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। অতএব হাদীস প্রচারের দায়িত্ব সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে শর্ত হলো যা পৌঁছাবে যদিও সেটা একটি আয়াত কিংবা হাদীস হয় হবে তা ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করা ও জানা জরুরি। ব্যক্তির ওপর কুরআন হাদিসের বানী পৌঁছানোর এ নির্দেশ তখনই ওয়াজিব যখন সেটা তার ওপর একান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে যাবে। আর যদি তার ওপর পৌঁছানো ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত না হয়, যেমন দেশে মানুষকে দ্বীন শিক্ষা ও দীনের ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দেওয়ার মতো আরও বেশ কিছু একনিষ্ঠ দা‘ঈ লোক থাকে তাহলে পৌঁছানো তার ওপর ওয়াজিব নয়; বরং তখন তার জন্যে মুস্তাহাব।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন,
دلت الأدلة من الكتاب والسنة على وجوب الدعوة إلى الله عز وجل، وأنها من الفرائض، وصرح العلماء أن الدعوة إلى الله عز وجل فرض كفاية، بالنسبة إلى الأقطار التي يقوم فيها الدعاة، فإن كل قطر وكل إقليم يحتاج إلى الدعوة وإلى النشاط فيها، فهي فرض كفاية إذا قام بها من يكفي سقط عن الباقين ذلك الواجب، وصارت الدعوة في حق الباقين سنة مؤكدة،
“কিতাব ও সুন্নাতের দলীলসমূহ প্রমাণ করে যে, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া ওয়াজিব ও ফরয। বিদ্বানগণ আরো সুস্পষ্ট করেছেন যে, দাঈদের দাওয়াত প্রদানের অঞ্চলভেদে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া ফরযে কিফায়া। কারণ প্রত্যেক দেশ ও অঞ্চল দাওয়াতী কর্মতৎপরতার মুখাপেক্ষী। সুতরাং দাওয়াতী কাজে নিযুক্ত লোক পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে অন্যদের উপর থেকে এর ফরযিয়াত রহিত হয়ে যাবে। তখন অন্যদের ক্ষেত্রে এটা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদায় পরিণত হবে” (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/১ পৃষ্ঠা: ৩৩০ ও খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৪০৯)
.
(২) দ্বিতীয়ত: হাদিসের বাক্য وَحَدِّثُوا عَنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ “আর বনী ইসরাঈল হতে শোনা কথা বলতে পারো” অর্থাৎ বনী ইসরাঈলদের বর্ণিত সত্য ঘটনাবলী তাদের থেকে বর্ণনা করাতে কোনো দোষ নেই। বানী ইসরাঈলের মাঝে যেসব আশ্চর্যজনক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তা যদিও এ উম্মাতের মাঝে তা ঘটা অসম্ভব মনে হয় তথাপিও তা বর্ণনা করা যাবে। যেমন কুরবানীকে গ্রাস করার জন্য আকাশ হতে আগুন নেমে আসার বিষয়কে আমরা মিথ্যা বলে জানি না এবং এ ধরনের তাদের আরো ঘটনাবলী যেমন বানী ইসরাঈল গোবৎসের উপাসনা করার পর অনুশোচনায় নিজেদেরকে হত্যা করা এবং কুরআনে বিবৃত ঘটনাবলী যাতে শিক্ষণীয় কিছু আছে, তা বর্ণনা করাতে কোন দোষ নেই।
.
মুহাম্মাদ মুখতার বিন মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
المعلوم أن ما يروى عن بني إسرائيل من الأخبار المعروفة بالإسرائيليات له ثلاث حالات في واحدة منها يجب تصديقه وهي ما إذا دل الكتاب أو السنة الثابتة على صدقه ، وفي واحدة يجب تكذيبه وهي إذا ما دل القرآن والسنة على كذبه ، وفي الثالثة لا يجوز التكذيب ولا التصديق … وهي ما إذا لم يثبت في كتابٍ ولا سنَّة صدقه ولا كذبه
ইস্রাঈলী বর্ণনা সম্পর্কে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। (১). কিছু বর্ণনা আছে যেগুলোকে কুরআন ও সহীহ হাদীস সমর্থন করে, সেগুলো বিশ্বাস করা ওয়াজিব।
(২). যেসব বর্ণনা ইসলামী আক্বীদা বিরোধী বা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়, সেগুলো মিথ্যা হিসাবে জানা ওয়াজিব।
(৩). আর কিছু বর্ণনা রয়েছে যেগুলোর ব্যাপারে কুরআন বা সহীহ হাদীসে কিছুই বর্ণিত হয়নি, সেগুলোকে সত্য বা মিথ্যা হিসাবে নির্ধারণ না করে চুপ থাকতে হবে (শানক্বীতী,আযওয়াউল বায়ান; খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৪৬)।
.
(৩) তৃতীয়ত: হাদীসের শেষাংশে وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ “আর যে ব্যক্তি (ইচ্ছাকৃতভাবে) আমার ওপর মিথ্যারোপ করল সে যেনো জাহান্নামে তার নিজের ঠিকানা নির্ধারিত করে নিলো”। এই বাক্য দ্বারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর যে কোন ধরনের মিথ্যারোপ করাকে নিষেধ করা হয়েছে, কারন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যারোপ করা সাধারণ মানুষের ওপর মিথ্যারোপ করার মতো নয়। বরং রাসূল ﷺ) এর ওপর মিথ্যারোপ মানে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করা। অতঃপর আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ তার শরী‘আতের ওপর মিথ্যারোপের নামান্তর। কেননা রাসূল (ﷺ) অহীর মাধ্যমে যা কিছু আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন তাই আল্লাহর শরী‘আত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যারোপ করার শাস্তি অধিক কঠিন। অতএব যারা দীনের প্রতি উৎসাহ দেয়ার জন্য এবং আল্লাহর প্রতি ভয় দেখানোর উদ্দেশে মিথ্যা হাদীস তৈরি করা জায়িয বলে থাকে তাদের এ ধরনের দাবীকে এই হাদীস দ্বারা খণ্ডন করা হয়েছে। সুতরাং সর্বাবস্থায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে মিথ্যা ছড়ানো হারাম। অন্য হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “নিশ্চয় সত্য নেকীর পথ দেখায়। নেকী জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। নিশ্চয় ব্যক্তি সত্য বলতে থাকে এক পর্যায়ে অতিশয় সত্যবাদী হয়ে যায়। নিশ্চয় মিথ্যা পাপের পথ দেখায়। পাপ জাহান্নামে নিয়ে যায়। নিশ্চয় ব্যক্তি মিথ্যা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে তাকে আল্লাহ্র কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়।”(সহিহ বুখারী হা/৫৬২৯ ও সহিহ মুসলিম হা/৪৭১৯) আরেক বর্ননায় আলী ইবনু আবী তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমরা আমার প্রতি মিথ্যারোপ করো না। কেননা যে লোক আমার উপর মিথ্যারোপ করবে সে জাহান্নামে যাবে।(তিরমিজি হা/২৬৬০) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন: مَنْ حَدَّثَ عَنِّي بِحَدِيثٍ يُرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذِبِينَ“যে ব্যক্তি আমার নামে এমন কোন উক্তি বর্ণনা করে, তার ধারণা হয় যে, উক্তিটি মিথ্যা; তাহলে সে মিথ্যাবাদীদের একজন”(সহিহ মুসলিম এর মুকাদ্দিমা (১/৭)]
.
উক্ত হাদীসের ব্যাখায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
” فِيهِ تَغْلِيظُ الْكَذِبِ وَالتَّعَرُّض لَهُ ، وَأَنَّ مَنْ غَلَبَ عَلَى ظَنِّهِ كَذِبُ مَا يَرْوِيهِ فَرَوَاهُ كَانَ كَاذِبًا , وَكَيْف لَا يَكُون كَاذِبًا وَهُوَ مُخْبِرٌ بِمَا لَمْ يَكُنْ ؟ ” .
“এ হাদিসে মিথ্যা ও মিথ্যা বলার ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। যে ব্যক্তির প্রবল ধারণা হচ্ছে যে, তার বর্ণিত কথা মিথ্যা এরপরও সে উক্ত কথাটি বর্ণনা করে সে মিথ্যাবাদী। সে মিথ্যাবাদী হবে না কেন সে তো এমন একটি সংবাদ দিচ্ছে বাস্তবে যা ঘটেনি?[নববী শরহে মুসলিম; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা:৬৫)
.
▪️এখন প্রশ্ন হল রাসূল ﷺ এর বানী: “আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও” এটি আলেমদের জন্য খাস নাকি আমভাবে সবার জন্য?
.
এই হাদীসটিতে আমভাবে সকল মুসলমানকে এবং খাসভাবে আলেমসমাজকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই হাদীসের আলোকে কুরআন সুন্নার বানী প্রচার করার জন্য আলেম হওয়া শর্ত নয় কিংবা এটি আলেমদের জন্য খাস করা হয়নি বরং একজন সাধারণ মানুষও যিনি কুরআন হাদীসের একটি ছোট্ট আয়াতও মুখস্থ করেছেন কিংবা বিশুদ্ধ আক্বীদা মানহাজের কোন আলেম থেকে শিখেছেন তিনি সেটা অন্যের নিকট পৌঁছে দিতে পারবেন তবে শর্ত হচ্ছে,যা পৌঁছাবে যদিও সেটা একটি আয়াত কিংবা হাদীস হয় হবে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হতে হবে এবং সর্বপ্রথম ভালোভাবে নিজের আয়ত্ত্ব করা এবং তিনি যা প্রচার করছেন সেই “বানী” শরীয়ত সম্মত বিধি বিধান সম্পর্কে জানা জরুরি।কারন এ বিষয়ের জ্ঞান না থাকলে সে হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল, ওয়াজিবকে সুন্নাত ও সুন্নাতকে ওয়াজিব মনে করবে এবং সেদিকেই মানুষকে আহবান করবে। ফলে সে নিজে পথভ্রষ্ট হবে ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করবে। যেহেতু আল্লাহ্র দিকে দাওয়াত দেওয়া একটি মহান মিশন ও গুরু দায়িত্ব। কারণ দাওয়াত মানে- মানুষকে এক আল্লাহ্র ইবাদতের দিকে ডাকা, তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসা, অনিষ্টের জায়গায় কল্যাণ বপন করা, বাতিলের বদলে হক্ককে স্থান করে দেয়া। তাই যিনি দাওয়াত দিবেন তার ইলম, ফিকহ, ধৈর্য, সহনশীলতা, কোমলতা, দয়া, জান-মালের ত্যাগ, নানা পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানুষের আচার-অভ্যাস সম্পর্কে অবগতি ইত্যাদি গুণ থাকা প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও উত্তম ওয়াযের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে তর্ক করুন উত্তম পদ্ধতিতে। নিশ্চয় আপনার রব, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়েছে, সে সম্বন্ধে তিনি বেশী জানেন এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি ভালভাবেই জানেন।”[সূরা নাহল, আয়াত: ১২৫] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি কোন হেদায়েতের দিকে আহ্বান করে সে ব্যক্তির জন্য রয়েছে এমন প্রতিদান যে প্রতিদান এ হেদায়েতের অনুসরণকারীগণও পাবেন; কিন্তু অনুসারীদের প্রতিদান হতে বিন্দুমাত্রও কমানো হবে না। আর যে ব্যক্তি কোন ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করে সে ব্যক্তির জন্য রয়েছে এমন গুনাহ যে গুনাহ এ ভ্রষ্টতাতে লিপ্ত ব্যক্তিরা পাবে; কিন্তু অনুসারীদের গুনাহ থেকে বিন্দুমাত্রও কমানো হবে না”(সহিহ মুসলিম হা/২৬৭৪) সুতরাং সে যা জানে তাই মানুষকে প্রচার করবে, যা জানে না সে সম্পর্কে কোন কথা বলবে না।আর এমনটি হলে চোট্টা একটি আয়াত প্রচারের বিনিময়ে তিনি আল্লাহ্র দিকে দাওয়ার দেয়ার মহান মর্যাদা ও অফুরন্ত প্রতিদান পাবেন ইনশাআল্লাহ।এর জন্য তাকে বিজ্ঞ আলেম হওয়া শর্ত নয়।
.
রাসূল ﷺ এর বানী: “আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও” হাদীসটির ব্যাখায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি, (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেন:
و قال في الحديث : ( ولو آية ) ، أي : واحدة ، ليسارع كل سامع إلى تبليغ ما وقع له من الآي ، ولو قَلَّ ، ليتصل بذلك نقل جميع ما جاء به صلى الله عليه وسلم”
“এবং হাদিসে উল্লেখিত (ولو آية) বাক্যের ক্ষেত্রে তিনি বলেন: (যদিও এটি একটি আয়াত হয়) যাতে করে প্রত্যেক শ্রবণকারী ব্যক্তি কুরআনের আয়াত সমূহের যতটুকু শিখবে ততটুকুই পোঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে উদগ্রীব থাকে। যদিও তা অল্প হয়।এর কারণ হলো, যাতে করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সকল আনিত বিষয় এর মাধ্যমে সকলের নিকট পোঁছে যায়”।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৯৯০৪২)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী “আমার পক্ষ হতে পৌঁছে দাও, যদিও তা একটি আয়াত হয়” এটি কি তালিবুল ইলমদের সাথে নির্দিষ্ট/খাস?
শাইখ উত্তরে বলেন,لا، حتى غيره، كل مؤمن يستطيع يبلغ ولو آية، طالب العلم وكل مؤمن “না, শুধু তাদের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যেক মুমিন পৌঁছে দিবে,যদিও একটি আয়াত হয়। তালিবুল ইলম ও সকল মুমিন এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।(বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-২২৯৬৮)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,
إذا كان الإنسان على بصيرة فيما يدعو إليه فلا فرق بين أن يكون عالماً كبيراً يشار إليه ، أو طالب علم مُجِدٍّ في طلبه ، أو عامياً لكنه علم المسألة علماً يقيناً .. فإن الرسول صلى الله عليه وسلم يقول : ( بلغوا عني ولو آية ) ولا يشترط في الداعية أن يبلغ مبلغاً كبيراً في العلم ، لكنه يشترط أن يكون عالماً بما يدعو إليه ، أما أن يقوم عن جهل ويدعو بناء على عاطفة عنده فإن هذا لا يجوز .ولهذا نجد عند الإخوة الذين يدعون إلى الله وليس عندهم من العلم إلا القليل نجدهم لقوة عاطفتهم يحرمون ما لم يحرمه الله ، ويوجبون ما لم يوجبه الله على عباده ، وهذا أمر خطير جداً ، قال الله تعالى : ( وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمْ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ * مَتَاعٌ قَلِيلٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ) النحل/116،117 ،
“যখন কোন মানুষ স্পষ্ট দলিল সহকারে কোন দিকে দাওয়াত দিবে, তখন বিজ্ঞ আলেম, পরিশ্রমী ইলম অর্জনকারী ছাত্র ও সর্বসাধারন মানুষ এদের কারো মাঝে কোন পার্থক্য নেই।তবে মাসআলা-মাসায়েলের ইলমটা সুনিশ্চিত/সন্দেহাতীত হওয়া জরুরী।কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও প্রচার করো। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কোন শর্ত করেননি যে, তাকে ইলমের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আলেম হতে হবে। তবে তিনি এটি শর্ত করেছেন যে, যে বিষয়ে তিনি দাওয়াত দিবে তা জানা অতীব জরুরী। অতঃপর মূর্খ হওয়া সত্ত্বেও আবেগ ও অনুভূতির উপর ভিত্তি করে দাওয়াত দেওয়া; অবশ্যই এটি নাজায়েজ। আর এ জন্যই এমন কতিপয় দ্বীনি ভাইদের আমরা দেখতে পাই যারা আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়। অথচ তাদের স্বল্প পরিমান ইলম ছাড়া কিছুই নেই। এমনকি তাদের আবেগ ও অনুভূতির উপর থাকার কারণে তারা আল্লাহর হালালকৃত বিষয়কে হারাম করে দেয়। অপরপক্ষে হারামকৃত বিষয়কে তারা হালাল করে দেয়। অথচ বিষয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: “(আর তোমাদের জিহ্বা মিথ্যা আরোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা রটনা করার জন্য বলো না, এটা হালাল এবং এটা হারাম। নিশ্চয় যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটায়, তারা সফলকাম হবে না। ইহকালে)” তাদের সামান্য সুখ-সম্ভোগ রয়েছে এবং (পরকালে) তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি”।(সুরা নাহল: ১১৬-১১৭)।(ফাতাওয়া উলামায়িল বালাদিল হারাম: পৃষ্ঠা:৩২৯)।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে,আল্লাহর পথে মানুষকে দা‘ওয়াত দেওয়ার পূর্বে কয়েকটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। যেমন:
(ক) যে বিষয়ে দা‘ওয়াত দিবে সে সম্পর্কে ইসলামী শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কেননা এ বিষয়ের জ্ঞান না থাকলে সে হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল, ওয়াজিবকে সুন্নাত ও সুন্নাতকে ওয়াজিব মনে করবে এবং সেদিকেই মানুষকে আহবান করবে। ফলে সে নিজে পথভ্রষ্ট হবে ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করবে।
(খ) যাদেরকে দা‘ওয়াত দিবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। যেমন তাদের দ্বীন, আক্বীদা, আমল ও তাদের অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং তাদের অবস্থার উপর ভিত্তি করে দা‘ওয়াতী কার্যক্রম চালাতে হবে।
(গ) দা‘ওয়াতে সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هَذِهِ سَبِيْلِيْ أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيْرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِيْ وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ- “বলুন, এটাই আমার পথ, আমি জেনে-বুঝে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারা। আর আল্লাহ্ কতই না পবিত্র এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।”[সূরা ইউসূফ, আয়াত: ১০৮] অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা عَلَى بَصِيْرَةٍ বলতে উল্লিখিত বিষয় সমূহের জ্ঞান অর্জনকেই বুঝিয়েছেন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।