ইসলামে গণতন্ত্রের বিধান

প্রশ্ন: ইসলামে গণতন্ত্রের বিধান কি? গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোন ব্যক্তিকে ভোট দেয়া ও নির্বাচিত করার হুকুম কি? গণতন্ত্র যদি হারাম হয়, তাহলে হারাম প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের আনুগত্য করা যাবে কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইংরেজী Democracy শব্দের অর্থ ‘গণতন্ত্র’। গণতন্ত্র (Democracy) শব্দটি আরবী নয়। এটি গ্রিক ভাষার শব্দ। গ্রীক শব্দমূল Demos ও Kratia থেকে এর উৎপত্তি। Demos শব্দের অর্থ সাধারণ মানুষ বা জনগণ আর Kratia শব্দের অর্থ শাসন বা ক্ষমতা। সুতরাং উভয় শব্দের মিলিত অর্থ দাঁড়ায় সাধারণ মানুষ বা জনগণের শাসন ক্ষমতা। অতীতে ও মধ্যযুগে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে এ অর্থেই গণতন্ত্র শব্দটি ব্যবহৃত হতো। আধুনিক যুগে এটি কেবল সরকার ব্যবস্থাই নয়, বরং একটি সমাজ ব্যবস্থাকে বুঝায়। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি একটি শাসনব্যবস্থা। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গের এক জনসভায় ‘গণতন্ত্র’-এর আধুনিক সংজ্ঞা দেন এভাবে: “Democracy is the government of the people by the people and for the people.” অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যা মানুষের উপর মানুষের দ্বারা পরিচালিত মানুষের প্রভুত্বভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা বুঝায়।’ (সৈয়দ মকসুদ আলী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ৩য় সংস্করণ, জুন ১৯৮৩ খৃ. পৃষ্ঠা: ২৮৫)।
.
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও তার বাস্তব অবস্থার কারণে এটি ইসলাম সমর্থন করে না। কারন এটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক একটি মতবাদ। এই তন্ত্রে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জনগণের হাতে অথবা তাদের নিযুক্ত প্রতিনিধি (পার্লামেন্ট সদস্য) এর হাতে অর্পণ করা হয়। তাই এ তন্ত্রের মাধ্যমে গায়রুল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়; জনগণ ও জনপ্রতিনিধির শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ তন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের সকলে একমত হওয়ার দরকার নেই। বরং অধিকাংশ সদস্য একমত হওয়ার মাধ্যমে এমন সব আইন জারী করা যায়- জনগণ যেসব আইন মেনে চলতে বাধ্য; এমনকি সে আইন যদি মানব প্রকৃতি, ধর্ম, বিবেক ইত্যাদির সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবুও। উদাহরণতঃ এই তন্ত্রের অধীনে গর্ভপাত করা, সমকামিতা, সুদি মুনাফার বিধান ইত্যাদি জারী করা হয়েছে। ইসলামি শাসনকে বাতিল করা হয়েছে। ব্যভিচার ও মদ্যপানকে বৈধ করা হয়েছে। বরং এই তন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদেরকে প্রতিহত করা হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে জানিয়েছেন, হুকুম বা শাসনের মালিক একমাত্র তিনি এবং তিনিই হচ্ছেন উত্তম হুকুমদাতা বা শাসক। পক্ষান্তরে অন্যকে তাঁর শাসনে অংশীদার করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং জানিয়েছেন তাঁর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা কেউ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন; “অতএব, হুকুম দেওয়ার অধিকার সুউচ্চ ও সুমহান আল্লাহর জন্য।” (সূরা গাফের, আয়াত: ১২)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন ; “আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান দেওয়ার অধিকার নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৪০)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: “আল্লাহ কি হুকুমদাতাদের শ্রেষ্ঠ নন?” (সূরা ত্বীন, আয়াত: ০৮)। তিনি আরও বলেন; “বলুন, তারা কতকাল অবস্থান করেছে- তা আল্লাহই ভাল জানেন। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের গায়েব বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে। তিনি কত চমৎকার দেখেন ও শোনেন! তিনি ব্যতীত তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। তিনি নিজ হুকুমে কাউকে অংশীদার করান না।” (সূরা কাহাফ, আয়াত: ২৬)। তিনি আরও বলেন; “তারা কি জাহেলিয়াতের হুকুম চায়? বিশ্বাসীদের জন্যে আল্লাহর চেয়ে উত্তম হুকুমদাতা আর কে?” (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৫০)।
.
আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা। তিনি জানেন, কোন বিধান তাদের জন্য উপযুক্ত; কোন বিধান তাদের জন্য উপযুক্ত নয়। সব মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, আচার-আচরণ ও অভ্যাস এক রকম নয়। নিজের জন্য কোনটা উপযোগী মানুষ সেটাই তো জানে না; অন্যের জন্য কোনটা উপযুক্ত সেটা জানবে। এ কারণে যে দেশগুলোতে জনগণের প্রণীত আইনে শাসন চলছে সে দেশগুলোতে বিশৃঙ্খলা, চারিত্রিক অবক্ষয়, সামাজিক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। তবে কিছু কিছু দেশে এ তন্ত্রটি নিছক একটি শ্লোগান ছাড়া আর কিছু নয়; যার কোনরূপ বাস্তবতা নেই। এ শ্লোগানের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দেয়া উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার সহযোগীরাই হচ্ছে- আসল শাসক এবং জনগণ হচ্ছে তাদের করদ। এর চেয়ে বড় প্রমাণের আর কি প্রয়োজন আছে, শাসকবর্গ যা অপছন্দ করে ডেমোক্রেসিতে যদি এমন কিছু থাকে তখন তারা সেটাকে পায়ের নীচে পিষ্ট করে। নির্বাচনে কারচুপি, স্বাধীনতা হরণ, সত্য কথা বললে টুটি চেপে ধরা ইত্যাদি এমন কিছু বাস্তবতা যা সকলের জানা; এগুলো সাব্যস্ত করার জন্য কোন দলিলের প্রয়োজন নেই। দিনের অস্তিত্ব সাব্যস্ত করার জন্য যদি দলিল লাগে তাহলে বিবেকে আর কিছু ধরবে না।
.
মাউসুআতুল আদইয়ান ওয়াল মাযাহেব আল-মুআসেরা গ্রন্থ (২/১০৬৬) তে এসেছে- পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি: এটি এমন একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যাতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গের নির্বাচনে গঠিত পরিষদের মাধ্যমে জনগণ শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। এ ব্যবস্থায় জনগণ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু প্রক্রিয়ায় শাসনকার্যে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে। সে প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে:
.
(১). ভোট দেওয়ার অধিকার: জনগণের কতিপয় ব্যক্তিবর্গ কোন একটি আইনের বিস্তারিত বা সংক্ষিপ্ত বিল উত্থাপন করে। এরপর পার্লামেন্ট কমিটি সেটার উপর আলোচনা করে ও ভোট দেয়।
.
(২). গণভোট দেওয়ার অধিকার: কোন একটি আইন পার্লামেন্টের অনুমোদনের পর জনগণের রায় প্রকাশ করার জন্য পেশ করা।

(৩). না ভোট দেওয়ার অধিকার: কোন একটি আইন প্রকাশ করার নির্দিষ্ট কিছু সময়ের মধ্যে সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক লোকের পক্ষ থেকে এ আইনের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর অধিকার। যাতে করে এ আপত্তির ফলে গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। যদি হ্যাঁ-এর পক্ষে বেশি ভোট পড়ে তাহলে আইনটি কার্যকর করা হয়। আর যদি না-এর পক্ষে বেশি ভোট পড়ে তাহলে সেটি বাতিল করা হয়। বর্তমানে প্রায় সকল সংবিধান এ নিয়মে চলছে। কোন সন্দেহ নেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আল্লাহর আনুগত্য ও আইনপ্রণয়ন অধিকারের ক্ষেত্রে একটি নব্য শিরকের স্বরূপমাত্র। যেহেতু এ প্রক্রিয়ায় স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহর আইন প্রণয়ন করার একক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হয় এবং মাখলুককে এ অধিকার প্রদান করা হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন: مَا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِهٖۤ اِلَّاۤ اَسۡمَآءً سَمَّیۡتُمُوۡهَاۤ اَنۡتُمۡ وَ اٰبَآؤُکُمۡ مَّاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ بِهَا مِنۡ سُلۡطٰنٍ ؕ اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰهِ ؕ اَمَرَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ “তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কিছু নামের ইবাদত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেওয়ার অধিকার নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”। (সূরা ইউসুফ: ৪০ ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-৯৮১৩৪)।
.
দুঃখজনক হলেও সত্যি অনেক মানুষ ধারণা করে, ডেমোক্রেসি মানে- স্বাধীনতা, মুক্ততা! এটি একটি ভুল ধারণা। যদিও ‘স্বাধীনতা’ ডেমোক্রেসির উদ্ভাবিত একটি পণ্য। আমরা এখানে স্বাধীনতা বলতে বুঝাতে চাই: বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চারিত্রিক স্খলনের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ইসলামী সমাজের উপর এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব অনেক। এ প্রভাব মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে রাসূলগণ, তাদের রিসালাত, কুরআন, সাহাবায়ে কেরামের উপর দোষারোপ করার পর্যায়ে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। স্বাধীনতার নামে বেপর্দা, বেহায়াপনা, খারাপ ছবি ও ফিল্ম অনুমোদন দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এভাবে এর তালিকা লম্বা হতেই থাকে। এ সবগুলো উম্মতের দ্বীনদারিত্ব ও চরিত্র ধ্বংস করার অপচেষ্টা। পৃথিবীর নানা রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক শাসনের আড়ালে যে স্বাধীনতার দিকে আহ্বান জানায়, সে স্বাধীনতা আবার সবক্ষেত্রে নয়। বরং স্বার্থ ও প্রবৃত্তির শিকলে এ স্বাধীনতা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে তারা মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনকে দোষারোপ করা অনুমোদন করে; কিন্তু ‘নাৎসিদের ইহুদি নিধন’ নিয়ে কথার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিষেধ। বরং যে ব্যক্তি এ হত্যাযজ্ঞকে অস্বীকার করে তাকে শাস্তি দেয়া হয়, জেলে পুরা হয়। অথচ এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা; এটাকে যে কেউ অস্বীকার করতেই পারে। যদি আসলেই তারা স্বাধীনতার আহ্বায়ক হতো, তাহলে তারা ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরকে নেয়ার সুযোগ দিল না কেন?! কেন তারা মুসলমানদের দেশগুলোকে উপনিবেশ বানালো, তাদের ধর্ম ও বিশ্বাস পরিবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করল? ইতালিয়ানরা যখন লিবিয়ার জনগণকে হত্যা করছিল তখন এ স্বাধীনতা কোথায় ছিল? ফ্রান্স যখন আলজেরিয়াতে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল অথবা ইতালিয়ানরা মিশরে গণহত্যা চালাচ্ছিল বা আমেরিকানরা যখন আফগান ও ইরাকে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল তখন এ স্বাধীনতা কোথায় ছিল?
.
এসব স্বাধীনতার দাবীদারদের নিকটেও স্বাধীনতা কতগুলো নিয়ম-কানুন দ্বারা শৃঙ্খলিত। যেমন-ম:
.
১- আইন: কোন মানুষের এ অধিকার নেই যে, সে রাস্তাতে সাধারণ চলাচলের বিপরীত দিকে চলবে বা গাড়ী চালাবে। অথবা লাইসেন্স ছাড়া কোন দোকান-পাট খুলবে। যদি সে বলে আমি স্বাধীন; কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করবে না।
.
২- সামাজিক প্রথা: উদাহরণতঃ কোন নারী সাগর যাপনের পোশাক পরে কোন মৃতব্যক্তির শোকাহত বাড়ীতে যেতে পারে না! যদি বলে আমি স্বাধীন, মানুষ তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে, তাড়িয়ে দিবে। কারণ এটি প্রথার বিপরীত।
.
৩- সাধারণ রুচিবোধ: উদাহরণতঃ কোন ব্যক্তি মানুষের সামনে বায়ু ত্যাগ করতে পারে না! এমনকি ঢেকুর তুলতে পারে না। যদি সে বলে, আমি স্বাধীন, তাহলে মানুষ তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে।
.
এখন আমরা বলতে চাই: তাহলে আমাদের ধর্মের কেন এ অধিকার থাকবে না যে, আমাদের স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করবে। যেমন- তাদের স্বাধীনতা বেশ কিছু বিষয় দ্বারা শৃঙ্খলিত হয়েছে; যে বিষয়গুলোকে তারা অস্বীকার করতে পারে না?! কোন সন্দেহ নেই ইসলাম ধর্ম যা নিয়ে এসেছে এর মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ ও মানুষের জন্য উপকার। নারীকে বেপর্দা হতে নিষেধ করা, মদপানে বারণ করা, শুকুর খেতে নিষেধ করা ইত্যাদি সব মানুষের শারীরিক, মানসিক ও জৈবনিক কল্যাণেই। কিন্তু ধর্ম যদি তাদের স্বাধীনতাকে বিধিবদ্ধ করে তখনি তারা সেটা প্রত্যাখ্যান করে। আর যদি তাদের মত অন্য কোন মানুষ বা অন্য কোন আইনের পক্ষ থেকে আসে তখন তারা বলে “শুনলাম ও মানলাম।” ( ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯৪১৩৪)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, ‘ইসলাম ও গণতন্ত্র দু’টি বিপরীতমুখী ব্যবস্থা। যা কখনো এক হবার নয়। একটি আল্লাহর উপর ঈমান ও আল্লাহ নির্দেশিত পন্থায় জীবন পরিচালনার নির্দেশ দেয়, অপরটি ত্বাগুতের (আল্লাহ বিরোধী অনুশাসন) প্রতি ঈমান ও তদনুযায়ী জীবন পরিচালনার উপর নির্ভরশীল (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, রেকর্ড নং-৩৫৩)। যে ব্যক্তি গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির প্রকৃত অবস্থা জানে, ইসলামে গণতন্ত্রের হুকুম কি সেটা জানে, তারপরও এ পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে নির্বাচিত করে সে ব্যক্তি ভয়াবহ শংকার মধ্যে আছে। কারণ ইতিপূর্বেই আমি উল্লেখ করেছি যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে ইসলাম বিরোধী।ঈমানদারেরা সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে,আল্লাহর আইনের চেয়ে উত্তম কোন আইন নেই। আল্লাহর আইন বিরোধী সকল বিধান জাহেলী বিধান। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তারা কি তবে জাহিলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?”(সূরা মায়েদা, ০৫:৫০) আল্লাহর উপর ঈমান ও রাসূলদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি ঈমান আনার পর আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন গ্রহণ করার প্রবণতাকে আল্লাহ তাআলা ‘বিস্ময়কর’ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি। তারা তাগূতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে।”(সূরা নিসা ০৪:৬০) ইমাম শানকিতি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য আইনে শাসন করে আল্লাহ তাদের ঈমানের দাবীর প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ তাগুতের কাছে বিচার ফয়সালা চাওয়ার পরেও ঈমানের দাবী- মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এমন মিথ্যা সত্যিই বিস্ময়কর।
.
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে না তাকে নির্বাচিত করা হারাম। কারণ এই নির্বাচনের মাধ্যমে এই হারামের প্রতি সন্তুষ্টি ও এই হারাম কাজে সহযোগিতা করা হলো। কিন্তু কোন মুসলমানকে যদি ভোট দিতে যেতে বাধ্য করা হয় তাহলে সে যেতে পারেন গিয়ে এই প্রার্থীর বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন অথবা সম্ভব হলে তার ভোট নষ্ট করে দিতে পারেন। যদি এর কোনটাই তার পক্ষে করা সম্ভবপর না হয় এবং এই প্রার্থীর পক্ষে ভোট না দিলে সে নির্যাতিত হওয়ার আশংকা করে তাহলে আমরা আশা করছি এমতাবস্থায় তার কোন গুনাহ হবে না। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত” [সূরা নাহল ১৬:১০৬] এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমার উম্মতকে ভুল, বিস্মৃতি ও জবরদস্তির গুনাহ হতে নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে।”(সুনানে ইবনে মাজাহ হা/২০৪৫ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া-১০৩০৪০)
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দেয়া ও ভোট দেয়া জায়েয আছে কি? উল্লেখ্য, আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা আল্লাহর নাযিলকৃত আইনে নয়।
.
জবাবে তাঁরা বলেন; “لا يجوز للمسلم أن يرشح نفسه رجاء أن ينتظم في سلك حكومة تحكم بغير ما أنزل الله ، وتعمل بغير شريعة الإسلام ، فلا يجوز لمسلم أن ينتخبه أو غيره ممن يعملون في هذه الحكومة إلا إذا كان من رشح نفسه من المسلمين ومن ينتخبون يرجون بالدخول في ذلك أن يصلوا بذلك إلى تحويل الحكم إلى العمل بشريعة الإسلام ، واتخذوا ذلك وسيلة إلى التغلب على نظام الحكم ، على ألا يعمل من رشح نفسه بعد تمام الدخول إلا في مناصب لا تتنافى مع الشريعة الإسلامية”” .যে সরকার আল্লাহর নাযিলকৃত আইন দিয়ে শাসন করে না, শরিয়া আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে না কোন মুসলমানের জন্য সে সরকারে যোগ দেয়ার প্রত্যাশায় নিজেকে মনোনীত করা জায়েয নয়। তাই এ সরকারের সাথে কাজ করার জন্য কোন মুসলমানের নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে নির্বাচিত করা জায়েয নেই। তবে কোন মুসলমান যদি এ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয় কিংবা অন্যকে নির্বাচিত করে যে, এর মাধ্যমে এ শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে, নির্বাচনে অংশ গ্রহণকে তারা বর্তমান শাসনব্যবস্থার উপর আধিপত্যবিস্তার করার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে সেটা জায়েয। তবে, সে ক্ষেত্রেও যে ব্যক্তি প্রার্থী হবেন তিনি এমন কোন পদ গ্রহণ করতে পারবেন না, যা ইসলামী শরিয়ার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ২৩ পৃষ্ঠা: ৪০৬-৪০৭, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৭১৬৬)।
.
স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ-কে আরও জিজ্ঞেস করা হয় যে- আপনারা জানেন, আমাদের আলজেরিয়াতে “আইনসভার নির্বাচন” অনুষ্ঠিত হয়। কিছু কিছু দল আছে যারা ইসলামী হুকুমত কায়েমের দিকে আহ্বান করে। আর কিছু কিছু দল আছে যারা ইসলামী হুকুমত চায় না। এখন যে ব্যক্তি এমন কাউকে ভোট দেয় যে প্রার্থী ইসলামী হুকুম চায় না সে ব্যক্তির হুকুম কি হবে; তবে এ ব্যক্তি নামায আদায় করে?
.
জবাবে তাঁরা বলেন: يجب على المسلمين في البلاد التي لا تحكم الشريعة الإسلامية ، أن يبذلوا جهدهم وما يستطيعونه في الحكم بالشريعة الإسلامية ، وأن يقوموا بالتكاتف يدا واحدة في مساعدة الحزب الذي يعرف منه أنه سيحكم بالشريعة الإسلامية ، وأما مساعدة من ينادي بعدم تطبيق الشريعة الإسلامية فهذا لا يجوز ، بل يؤدي بصاحبه إلى الكفر ؛ لقوله تعالى : (وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ * أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ) المائدة/49-50 ، ولذلك لما بَيَّن اللهُ كفر من لم يحكم بالشريعة الإسلامية ، حذر من مساعدتهم أو اتخاذهم أولياء ، وأمر المؤمنين بالتقوى إن كانوا مؤمنين حقا ، فقال تعالى : (يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاءَ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ) المائدة/57 যে সব দেশে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু নাই সেসব দেশের মুসলমানদের উপর ফরজ ইসলামী হুকুমত ফিরিয়ে আনার জন্য তাদেরকে সর্বোচ্চ চেষ্টায় নিয়োজিত করা এবং যে দল ইসলামী হুকুমত বাস্তবায়ন করবে বলে তারা ধারনা করেন সে দলকে একজোটে সবাই মিলে সহযোগিতা করা। পক্ষান্তরে, যে দল ইসলামী শরিয়া বাস্তবায়ন না করার প্রতি আহ্বান জানায় সে দলকে সহযোগিতা করা নাজায়েয। বরং এ ধরনের সহযোগিতা ব্যক্তিকে কুফরের দিকে ধাবিত করে। দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী; “আর আমি আদেশ করছি যে, আপনি তাদের মাঝে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী বিধান দিন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, যাতে করে আল্লাহ আপনার প্রতি যা নাযিল করেছেন তারা এর কোন কিছু হতে আপনাকে বিচ্যুত করতে না পারে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখুন, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু পাপের শাস্তি দিতে চান। নিশ্চয় মানুষের মধ্যে অনেকেই ফাসেক। তারা কি জাহেলিয়াতের বিধান কামনা করে? যারা (আল্লাহর প্রতি) একীন রাখে তাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা কে?” (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৯-৫০)। এ কারণে যারা ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে না, আল্লাহ তাদেরকে কাফের হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাদের সাথে সহযোগিতা করা থেকে, তাদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করা থেকে সাবধান করেছেন। যদি মুমিনগণ প্রকৃত ঈমানদার হয়, তাদেরকে তাকওয়া অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন; “হে মুমিনগণ, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে তাদেরকে এবং অন্য কাফেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।” (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৫৭)। আল্লাহই তাওফিকদাতা, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। (গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি: শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, শাইখ আব্দুল্লাহ গুদইয়ান। ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৭৩ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৭১৬৬)।
.
তবে হ্যাঁ! যে ব্যক্তি এ পদ্ধতির অধীনে নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে এ জন্য নির্বাচিত করে যাতে করে এ আইনসভাতে ঢুকে এর বিরোধিতা করা যায়, এ পদ্ধতির বিপক্ষে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়, সাধ্যানুযায়ী অকল্যাণ ও দুর্নীতি রোধ করা যায় এবং যেন গোটা ময়দান দুর্নীতিবাজ ও নাস্তিকদের হাতে চলে না যায়, যারা জমিনে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেয়, মানুষের দ্বীন ও দুনিয়ার সমূহ কল্যাণ নস্যাৎ করে দেয়— তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কল্যাণের দিক বিবেচনা করে ইজতিহাদ করার তথা বিবেক-বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বরং কোন কোন আলেম মনে করেন, এ ধরনের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা ফরজ।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে নির্বাচনে অংশ নেয়ার হুকুম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাবে বলেন:
أنا أرى أن الانتخابات واجبة ، يجب أن نعين من نرى أن فيه خيراً ، لأنه إذا تقاعس أهل الخير ، مَنْ يحل محلهم ؟ سيحل محلهم أهل الشر ، أو الناس السلبيون الذين ما عندهم خير ولا شر ، أتباع كل ناعق ، فلابد أن نختار من نراه صالحاً .
فإذا قال قائل : اخترنا واحداً لكن أغلب المجلس على خلاف ذلك .قلنا : لا مانع ، هذا الواحد إذا جعل الله فيه البركة وألقى كلمة الحق في هذا المجلس سيكون لها تأثير ولا بد ، لكن الذي ينقصنا الصدق مع الله ، نعتمد على الأمور المادية الحسية ولا ننظر إلى كلمة الله عز وجل …. فَرَشِّحْ مَنْ ترى أنه خير ، وتوكل على الله
আমি মনে করি এ নির্বাচনগুলোতে অংশ নেয়া ফরজ। আমরা যাকে ভাল মনে করি তাকে সহযোগিতা করা ফরজ। কারণ ভাল লোকেরা যদি ঢিলেমি করে তাহলে এ স্থানগুলো কে দখল করবে? খারাপ লোকেরাই দখল করবে কিংবা এমন লোকেরা দখল করবে যাদের কাছে না আছে ভাল; না আছে খারাপ; যারা সুবিধাবাদী। তাই আমাদের উচিত যাকে যোগ্য মনে করি তাকে নির্বাচিত করা। যদি কেউ বলেন; আমরা যাকে নির্বাচিত করলাম আইনসভার অধিকাংশ সদস্য তার বিপক্ষে। আমরা জবাবে বলব- কোন অসুবিধা নেই। এই একজনের মধ্যে আল্লাহ বরকত দিতে পারেন। তিনি যদি আইনসভার সামনে হক কথা বলতে পারেন তাহলে অবশ্যই এর প্রভাব থাকবে, প্রভাব থাকতেই হবে। তবে যে ক্ষেত্রে আমাদের কসুর হয় সেটা হচ্ছে- আল্লাহর সাথে বিশ্বস্ত হওয়া। আমরা শুধু বৈষয়িক বিষয়ের উপর নির্ভর করি; আল্লাহর বাণী এর দিকে তাকাই না। সুতরাং আপনি যাকে ভাল মনে করেন তাকে নির্বাচিত করুন; এরপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন।(উসাইমীন লিকাআতুল বাব আল-মাফতুহ থেকে সংক্ষেপিত ও ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৭১৬৬)।
.
▪️গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের আনুগত্য করা যাবে কি?
.
“যে ব্যক্তি শাসন ক্ষমতায় পৌঁছেছে,ক্ষমতাসীন হয়েছে, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব তার অধীন হয়েছে এবং তাকে আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ (বিজ্ঞ ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ) শাসক হিসেবে মেনে নিয়েছে, যদিও সে নাজায়েজ পদ্ধতিতে ক্ষমতায় পৌঁছে থাকে, তবুও শার‘ঈভাবে তার বেলায়েত (আনুগত্য পাওয়ার মতো কর্তৃত্ব) সাব্যস্ত হবে। অর্থাৎ বৈধ কাজে তার আনুগত্য করতে হবে। তবে শাসকের কোন অন্যায় কাজের আনুগত্য করা বা সহযোগিতা করা যাবে না। এমনকি তার অন্যায় কাজের প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না। বরং যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি মূলনীতি মাথায় রাখতে হবে, ইসলামী শরিয়ার একটি সূত্র হচ্ছে- “মন্দকে মন্দতর দিয়ে প্রতিরোধ করা যাবে না। বরং যা দিয়ে মন্দকে নির্মূল করা যাবে, কিংবা কমানো যাবে তা দিয়ে মন্দকে প্রতিরোধ করতে হবে।” শাসকের সামনে হক্ব কথা বলতে হবে, সঠিক পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করতে হবে এবং হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করতে হবে। ইমাম আহমাদ যিনি হলেন আহলুস সুন্নাহ’র ইমাম তিনি বলেছেন, “আমি যদি জানতাম, আমার কোনো কবুলযোগ্য দু‘আ আছে, তাহলে অবশ্যই আমি সে দু‘আ শাসকের জন্য করতাম।”(ইবনে তাইমিয়াহ মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ৩৯১)।
.
শাসকের অবৈধ কাজে আনুগত্য করা যাবেনা এই মর্মে দলিল হল: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَاطَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِىْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা করে সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই।’ (শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৩৬৯৬ ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়)। অন্য হাদীসে আছে; ‘তোমাদের মধ্যে অনেক আমীর হবে, যাদের কোন কাজ তোমরা ভাল মনে করবে, কোন কাজ মন্দ মনে করবে। এক্ষণে যে ব্যক্তি ঐ মন্দ কাজের প্রতিবাদ করবে, সে মুক্তি পাবে। যে ব্যক্তি ঐ কাজকে অপছন্দ করবে, সেও নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি ঐ মন্দ কাজে সন্তুষ্ট থাকবে ও তার অনুসরণ করবে (সে মুক্তিও পাবে না, নিরাপত্তাও পাবে না)। সাহাবীগণ বললেন, তাহলে কি আমরা তখন ঐ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন; না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করে। (সহীহ মুসলিম, হা/১৮৫৪; মিশকাত, হা/৩৬৭১ ‘নেতৃত্ব ও পদ মর্যাদা’ অধ্যায়; বঙ্গানুবাদ মিশকাত ৭/২৩৩ পৃ.)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আর তোমরা যখন তোমাদের শাসকদের নিকট থেকে এমন কিছু দেখবে, যা তোমরা অপছন্দ কর, তখন তোমরা তার কাজকে অপছন্দ কর; কিন্তু তাদের থেকে আনুগত্যের হাত ছিনিয়ে নিয়ো না।’ (সহীহ মুসলিম, হা/১৮৫৫)। দাওরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে ইবনু তীন বর্ণনা করেন, ‘স্বৈরাচার শাসকদের সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা হলো, বিশৃংখলা- বিপর্যয় এবং সীমালংঘন ছাড়াই যদি তার থেকে আনুগত্যের বন্ধন ছিন্ন করা যায়, তাহলে তা অবশ্যই করা যাবে। অন্যথা ধৈর্যধারণ করা ওয়াজিব।’ (ফাৎহুল বারী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১০)। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اَلصَّبْرُ عَلَى جَوْرِ الْأَئِمَّةِ أَصْلٌ مِّنْ أُصُوْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ ‘স্বৈরাচার শাসকদের উপর ধৈর্যধারণ করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি মূলনীতি।(মিনহাজুস সুন্নাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫২৭)।
.
বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, আশ-শাইখ, আল-আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: “যে শাসক আল্লাহ’র কিতাব এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী শাসন করে না, তার আনুগত্য করার বিধান কী?”
.
উত্তরে শাইখ বলেন: “যে শাসক আল্লাহ’র কিতাব এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী শাসন করে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। একারণে তার সাথে যুদ্ধ করা ওয়াজিব নয়, বরং তা না-জায়েজ। তবে সে কুফরের সীমানায় পৌঁছে গেলে তার বিরোধিতা করা ওয়াজিব। মুসলিমদের ওপর তার কোনো আনুগত্য (পাওয়ার অধিকার) নেই। আল্লাহ’র কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহ’য় যা আছে, তা ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা কুফরের পর্যায়ে পৌঁছবে দুটি শর্তে।

এক. আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিধান সম্পর্কে তার জানা থাকতে হবে। পক্ষান্তরে সে যদি সেই বিধান সম্পর্কে না জানে, তবে সে এর (এই বিধানের) বিরোধিতা করার দরুন কাফির হবে না।

দুই. আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করতে তাকে যখন উদ্বুদ্ধ করে এই বিশ্বাস যে, আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান যুগোপযোগী নয়, বরং অন্য বিধান তার চেয়ে অধিক উপযোগী এবং বান্দাদের জন্য অধিক কল্যাণকর। এই দুই শর্তের ভিত্তিতে আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা ইসলাম থেকে খারিজকারী কুফর হিসেবে গণ্য হবে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, সে অনুযায়ী যারা বিচার ফায়সালা করে না তারাই কাফির।” (সূরাহ মাইদাহ: ৪৪)। এই শাসকের আইনসম্মত কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা বাতিল হয়ে যাবে। লোকদের উপর তার কোনো আনুগত্য (পাওয়ার অধিকার) নেই। তার সাথে যুদ্ধ করা এবং তাকে শাসনক্ষমতা থেকে বিতাড়ন করা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে সে যখন আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করে, সাথে সাথে সে এই বিশ্বাসও পোষণ করে যে, আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান দিয়ে শাসন করা ওয়াজিব এবং এই বিধানই (আল্লাহ’র নাজিলকৃত বিধান) বান্দাদের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর। কিন্তু সে স্বীয় প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে বা শাসিতের ওপর জুলুম করার মানসে সেই বিধানের বিরোধিতা করে; তাহলে সে কাফির নয়, বরং সে একজন ফাসিক্ব, কিংবা একজন জালেম। তার আইনসম্মত কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা বহাল আছে। এমনকি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। তার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া অথবা বলপ্রয়োগ বা বিদ্রোহ করার মাধ্যমে তাকে শাসনক্ষমতা থেকে অপসারণ করা জায়েজ নয়। কেননা নাবী (ﷺ) শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেছেন, যতক্ষণ না আমরা সুস্পষ্ট কুফর দেখতে পাই, যে ব্যাপারে আমাদের কাছে মহান আল্লাহ’র পক্ষ থেকে স্পষ্ট দলিল রয়েছে। (তথ্যসূত্র: ইমাম উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৪৭-১৪৮; দারুল ওয়াত্বান, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৩)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! প্রত্যেক মুসলমানদের আবশ্যক কর্তব্য হচ্ছে- তাদের ধর্ম অর্থাৎ আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলাম নিয়ে গৌরববোধ করা, তাদের রবের পক্ষ থেকে দেয়া বিধানের প্রতি আস্থা রাখা; এ বিধান তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে যথেষ্ট এবং আল্লাহর শরিয়ত বিরোধী সকল তন্ত্র-মন্ত্র থেকে নিজের মুক্ততা ঘোষণা করা। শাসক ও শাসিত সকল মুসলমানের কর্তব্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলা। কেননা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন তন্ত্র বা জীবনপদ্ধতি গ্রহণ করা হারাম। আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে ধর্ম হিসেবে ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসেবে গ্রহণ করার দাবী হচ্ছে প্রকাশ্যে ও গোপনে ইসলামকে আঁকড়ে ধরা, আল্লাহর শরিয়তকে সম্মান করা,নবীর আদর্শের অনুসরণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন; ‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি। কিন্তু তারা তাগুতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায়, তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে।’ (সূরা আন-নিসা: ৬০)। তাই প্রচলিত গণতন্ত্রসহ সব ধরনের ইসলাম বিরোধী কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থাকা এবং অবৈধ কাজে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকা ঈমান ও তাকওয়ার পরিচয়। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: