প্রশ্ন: মুসলিম নারীর চুল সংক্রান্ত হুকুম জানতে চাই। মুসলিম নারী কি তার চুলকে কাঁধ পর্যন্ত ছোট করতে পারবে; নাকি পারবে না?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে স্বাভাবিক ভাবে একজন মুসলিম নারীর চুল ছোট্ট করার দুইটি অবস্থা হতে পারে; যার মধ্যে একটি নিষিদ্ধ এবং অপরটি কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে জায়েজ।
.

.
আলেমগণ নারীর চুল ছোট করার ব্যাপারে যেটাকে হারাম বলেছেন তা হচ্ছে নিম্নে উল্লেখিত অবস্থাসমূহ:
(ক)।যদি এ চুল নিয়ে গাইরে মাহরাম পুরুষের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করা হয়।
(খ)।যদি কাফের কিংবা ফাসেক নারীদের স্টাইল অনুকরণের উদ্দেশ্য থেকে চুল ছোট করা হয়।
(গ)। যদি পুরুষের চুলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ স্টাইলে চুল ছোট করা হয়।
(ঘ)। যদি কোন গাইরে মাহরাম পুরুষ দ্বারা চুল কাটানো হয়; যা অনেক পাপাচারপূর্ণ সেলুনে ঘটে থাকে।
(ঙ)। যদি স্বামীর বিনা অনুমতিতে করা হয়।
উল্লেখিত অবস্থাসমূহে যে কারণগুলো চুল ছোট করাকে হারাম করেছে; সেগুলো সুস্পষ্ট এবং এসব অবস্থায় হারাম হওয়ার গূঢ় রহস্যও সুস্পষ্ট।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
قص شعر المرأة أعني قص شعر رأسها : كرهه بعض العلماء ، وحرَّمه بعض العلماء ، وأباحه بعض العلماء .وما دام الأمر مختلفا فيه فالرجوع إلى الكتاب والسنة ، ولا أعلم إلى ساعتي هذه ما يدل على تحريم قص المرأة شعر رأسها ، وعلى هذا : فيكون الأصل فيه الإباحة ، وأن يتبع فيه العادة ، ففيما سبق كانت النساء ترغب طول الرأس وتفتخر بطول الرأس ، ولا تقصه إلا عند الحاجة الشرعية أو الحسية ، وتغيرت الأحوال الآن ، فالقول بالتحريم ضعيف ولا وجه له ، والقول بالكراهة يحتاج إلى تأمل ونظر ، والقول بالإباحة أقرب إلى القواعد والأصول ، وقد روى مسلم في صحيحه ( أن نساء النبي صلى الله عليه وسلم بعد موته كن يقصصن رؤوسهن حتى تكون كالوفرة ) لكن إذا قصته المرأة قصا بالغا حتى يكون كرأس الرجل فهذا حرام لا إشكال فيه ؛ لأن النبي صلى الله عليه وعلى آله وسلم لعن المتشبهات من النساء بالرجال .وكذلك لو قصته قصا يماثل رؤوس الكافرات والعاهرات : فإن من تشبه بقوم فهو منهم .أما إذا قصته قصا خفيفا لا يصل إلى حد يشبه شعور الرجال ، ولا يكون مشابها لرؤوس العاهرات والكافرات فلا بأس به “
“নারীর চুল ছোট করা অর্থাৎ নারীর মাথার চুল ছোট করা: আলেমদের কেউ কেউ এটাকে মাকরুহ বলেছেন। কেউ কেউ হারাম বলেছেন। কেউ কেউ জায়েয বলেছেন।যেহেতু বিষয়টি মতবিরোধপূর্ণ তাই এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ –এর দিকে প্রর্ত্যবর্তন করা বাঞ্ছনীয়। আমি আমার এই মুহূর্ত পর্যন্ত নারীর চুল ছোট করা হারাম হওয়ার পক্ষে কোন দলিল জানি না। হারাম হওয়ার দলিল না থাকলে এটি বৈধ হওয়াই হচ্ছে মূলবিধান এবং এক্ষেত্রে প্রথার অনুসরণ করা হবে। আগের দিনে নারীরা চুল লম্বা করা পছন্দ করত এবং এ নিয়ে গর্ব করত। কোন শরয়ি কারণ ছাড়া কিংবা যৌক্তিক কারণ ছাড়া তারা মাথার চুল কাটত না। কিন্তু, এখন মানুষের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই এটাকে হারাম বলা দুর্বল অভিমত; যার পক্ষে কোন দলিল নেই। মাকরুহ বলতে গেলে গভীর চিন্তাভাবনার দরকার আছে। জায়েয বলাটা ফিকহি সূত্রাবলি ও মূলনীতিগুলোর অধিক নিকটবর্তী। তাছাড়া সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর তাঁর পত্নীগণ তাদের মাথার চুল ছোট করতেন; যাতে করে ‘ওয়াফরা’ স্টাইল হয় (কাঁধের একটু নীচ পর্যন্ত কিংবা কানের লতি পর্যন্ত প্রলম্বিত)।তবে,কোন নারী যদি তার চুল এত ছোট করে যে, তার মাথা পুরুষের মাথার মত দেখায় তাহলে সেটা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন আপত্তি নেই। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদের সাথে সাদৃশ্যগ্রহণকারী নারীদের প্রতি লানত করেছেন। কিংবা কোন নারী যদি কাফের কিংবা চরিত্রহীন নারীদের মত করে চুল ছোট করে সেটাও হারাম। কেননা যে ব্যক্তি যাদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদেরই দলভুক্ত।আর যদি কোন নারী সামান্য চুল ছাটাই করে যেটা পুরুষের চুলের সাথে সাদৃশ্যের পর্যায়ে পৌঁছে না; কিংবা চরিত্রহীন নারী বা কাফের নারীদের মাথার সাথে সাদৃশ্যের পর্যায়ে পৌঁছে না- তাহলে তাতে কোন সমস্যা নেই।”(ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব (ফাতাওয়ায যিনাহ ওয়াল মারআ/কাস্সু শা’র) (ক্যাসেট নং ৩৩৬, দ্বিতীয় সাইড)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেন:لا يجوز للمرأة أن تقص شعر رأسها من الخلف وتترك جوانبه أطول ؛ لأن هذا فيه تشويه وعبث بشعرها الذي هو من جمالها ، وفيه أيضاً تشبه بالكافرات ، وكذا قصه على أشكال مختلفة وبأسماء كافرات أو حيوانات ، كقصة ( ديانا ) اسم لامرأة كافرة ، أو قصة ( الأسد ) ، أو ( الفأر ) ؛ لأنه يحرم التشبه بالكفار والتشبه بالحيوانات ، ولما في ذلك من العبث بشعر المرأة الذي هو من جمالها”নারীর জন্য পেছনের চুল ছোট করে পাশের চুল লম্বা রেখে দেওয়া জায়েয নেই। কারণ এটি তার চুলের বিকৃতি ও অযথা কাজ; অথচ চুল তার সৌন্দর্যের অংশ। এতে করে কাফেরদের সাদৃশ্যও গ্রহণ করা হয়। এছাড়া নানান আকৃতিতে চুল ছোট করা এবং কাফের নারী অথবা প্রাণীর নামের কাটিং দেওয়া হারাম। যেমন: ‘ডায়ানা’ নামের এক কাফের নারীর নামের কাটিং দেওয়া। অথবা ‘সিংহ’ বা ‘ইঁদুর’ কাটিং দেওয়া। কারণ কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ এবং প্রাণীর সাদৃশ্য গ্রহণ করা হারাম। তাছাড়া এটি চুলের অযথা বিকৃতি; অথচ চুল নারীর সৌন্দর্যের অংশ।”(ফাতাওয়াল মারআতিল মুসলিমা; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫১৬-৫১৭)
.

.
যদি চুল ছোট করার উদ্দেশ্য হয়: স্বামীর জন্য নিজেকে সাজানো ও স্বামীর কাছাকাছি যাওয়া, কিংবা উদ্দেশ্য হয় যে, লম্বা চুলের যত্ন নেয়ার খরচ ও কষ্ট কিছুটা লাঘব করা, কিংবা অন্য কোন যৌক্তিক বৈধ উদ্দেশ্য হয় তাহলে আলেমদের সঠিক মতানুযায়ী এতে গুনাহ হবে না। কেননা, ইবাদতশ্রেণীয় নয় এমন বিষয়সমূহের মূলবিধান হল বৈধতা; যতক্ষণ পর্যন্ত না হারাম হওয়ার পক্ষে কোন দলিল উদ্ধৃত হয়। ইসলামী শরিয়তে নারীর চুল ছোট করার নিষেধাজ্ঞাসূচক কোন দলিল নেই। নারীর চুল কিয়ামতের দিন তার জন্য আচ্ছাদন হবে’ এ ধরণের যে কথাটি বলা হয় হাদিসে বা আছারে এমন কোন দলিল নেই। আলেমদের বক্তব্যেও আমরা এমন কিছু পাইনি। সুতরাং এ ধরণের কথা সঠিক কিনা, শরিয়তে সাব্যস্ত কিনা- সেটা নিশ্চিত হওয়ার আগে তা প্রচার করা ও বিশ্বাস করা থেকে সাবধান থাকা উচিত।বরং এমন কিছু দলিল রয়েছে যাতে জায়েয হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। সে দলিলটি হচ্ছে- সহীহ মুসলিমে আবু সালামা বিন আব্দুর রহমান (রহঃ) বলেন:كَانَ أَزْوَاجُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْخُذْنَ مِنْ رُءُوسِهِنَّ حَتَّى تَكُونَ كَالْوَفْرَةِ “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ এমনভাবে তাদের মাথার চুল কাটতেন যে, তা কাঁধ থেকে একটু নিচে যেত বা কান বরাবর হত।”।(সহীহ মুসলিম হা/৩২০) ওয়াফরা হচ্ছে- কারো কারো মতে, যে চুল কাঁধের একটু নীচে থাকে। কারো কারো মতে, যে চুল কানের লতি পর্যন্ত পৌঁছায়। হাদীসটির আলোকে ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:وفيه دليل على جواز تخفيف الشعور للنساءএ হাদিসে মহিলাদের চুল ছোট করার পক্ষে দলিল রয়েছে।”(শারহে মুসলিম; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:قص شعر المرأة لا نعلم فيه شيئاً المنهي عنه الحلق ، فليس لك أن تحلقي شعر رأسك لكن أن تقصي من طوله أو من كثرته فلا نعلم فيه بأساً ، لكن ينبغي أن يكون ذلك على الطريقة الحسنة التي ترضيها أنت وزوجك ، بحيث تَتَّفِقِين معه عليها من غير أن يكون في القص تشبُّه بامرأة كافرة ، ولأن في بقائه طويلاً فيه كلفة بالغسل والمشط ، فإذا كان كثيراً وقصَّت منه المرأة بعض الشيء لطوله أو كثرته فلا يضرُّ ذلك أو لأن في قصِّ بعضه جمالاً ترضاه هي و يرضاه زوجها فلا نعلم فيه شيئاً أما حلقه بالكلية فلا يجوز إلا من علة ومرض ، وبالله التوفيق”নারীর চুল ছোট করার ব্যাপারে কোনো আপত্তি রয়েছে বলে জানি না। তবে মাথা মুণ্ডন করা নিষিদ্ধ। আপনি আপনার মাথা মুণ্ডন করতে পারবেন না। তবে চুলের দৈর্ঘ্য ও আধিক্য থেকে কিছুটা কমিয়ে ফেলতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেটা হতে হবে এমন উত্তম পন্থায় যাতে আপনি এবং আপনার স্বামী তুষ্ট থাকেন। আপনি তার সাথে চুল ছোট করার ব্যাপারে একমত হবেন। আর এক্ষেত্রে কোনো কাফের নারীর সাদৃশ্য গ্রহণ করা যাবে না। কেননা চুল লম্বা হলে ধোয়া ও আঁচড়ানোর মত কষ্টের কাজ করতে হয়। যদি চুলের পরিমাণ বেশি হয় এবং নারী চুলের কিয়দংশ দৈর্ঘ্য অথবা আধিক্যের কারণে ছোট করে তাহলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। অথবা যদি চুল ছোট করলে সুন্দর হয় যেটা তিনি এবং তার স্বামী পছন্দ করেন, তাহলে তাতে কোনো নিষেধ আছে বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু অসুস্থতা ছাড়া পুরোপুরি মাথা মুণ্ডন করা জায়েয নেই। আর আল্লাহই তৌফিকদাতা।”(দেখুন:ফাতাওয়াল মারআতিল মুসলিমাহ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫১৫)
.
পরিশেষে আলোচনার সারমর্ম হলো একজন নারী প্রয়োজনে মাথার চুল ছোট করতে চাইলে, নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে তা ছাঁটা বা কাটার অনুমতি রয়েছে। তবে উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কেবল সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা বা লম্বা চুলের ঝামেলা ও কষ্ট লাঘব করা। এর মাধ্যমে কোনো কাফের-ফাসেক নারী, চলচ্চিত্র বা ফ্যাশন জগতের তথাকথিত মডেলদের অনুকরণ করা উদ্দেশ্য হওয়া যাবে না। আবার এতটা ছোটও করা যাবে না, যাতে পুরুষদের সঙ্গে সাদৃশ্য সৃষ্টি হয়। উল্লেখযোগ্য যে, চিকিৎসা-সংক্রান্ত জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত নারীর মাথার চুল সম্পূর্ণ মুণ্ডন করা শরীয়তে হারাম। (ফাতওয়া গৃহীত; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৭৪৪; ১৩৯৪১৪)(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।