শারঈ দৃষ্টিকোন থেকে সালাতের মধ্যে নড়াচড়া করার বিধান কি

ভূমিকা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। যিনি তাঁর সুস্পষ্ট গ্রন্থ পবিত্র কুরআনে বলেন, وَ قُوۡمُوۡا لِلّٰہِ قٰنِتِیۡنَ ‘তোমরা বিনীতভাবে আল্লাহর জন্য দণ্ডায়মান হও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩৮)। আল্লাহ তা‘আলা সালাত সম্পর্কে বলেন,لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ وَ اِنَّہَا “নিশ্চয় বিনয়ীগণ ছাড়া সালাত অন্যদের উপর কঠিন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৪৫)। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুত্তাক্বীদের ইমাম ও বিনয়ীদের সরদার মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবীর উপর। অতঃপর নিশ্চয় সালাত দ্বীন-ইসলামের কার্যগত রুকনসমূহের মাঝে সবচেয়ে বড় রুকন। সালাতে একাগ্রতা ও বিনয়াবনত অর্জন করা মুখ্য উদ্দেশ্য এবং ইসলামী শরী‘আতের প্রকৃত চাহিদা। পক্ষান্তরে আল্লাহর শত্রু ইবলীস বানী আদমকে পথভ্রষ্ট ও বিপদগ্রস্ত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে অঙ্গীকার করেছে যে,ثُمَّ لَاٰتِیَنَّہُمۡ مِّنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مِنۡ خَلۡفِہِمۡ وَ عَنۡ اَیۡمَانِہِمۡ وَ عَنۡ شَمَآئِلِہِمۡ” অতঃপর আমি পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাদের সম্মুখ দিয়ে, পেছন দিয়ে, ডান দিক দিয়ে এবং বাম দিক দিয়ে আসব’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৭)।যে কোনো কাজে সফলতার মূল শর্ত হলো মনোযোগ ও একনিষ্ঠতা; আর সালাতের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক। কারণ ইবাদতের আসল স্বাদ আস্বাদনের জন্য একাগ্রতার কোনো বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো এই ব্যস্ত ও যান্ত্রিক যুগে মনোযোগ সহকারে সালাত আদায় ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ একাগ্রতা বিহীন সালাত প্রায়শই দায়সারা একটি শারীরিক ব্যায়ামে পরিণত হয় যা হৃদয়ে সঞ্চারিত করে না প্রভুর সান্নিধ্যের প্রশান্তি, জাগায় না নেকীর পথে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা, এবং বাধা হয়ে দাঁড়ায় না অশ্লীলতা ও অন্যায়ের পথে।এমন পরিস্থিতি আজ আমাদের মাঝে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এই হাদীসকে এক কঠিন বাস্তবে পরিণত করেছে—أَوَّلُ شَيْءٍ يُرْفَعُ مِنْ هذِهِ الأُمَّةِ الْخُشُوعُ، حَتَّى لَا تَرَى فِيهَا خَاشِعًا“এই উম্মতের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম যে জিনিস উঠিয়ে নেওয়া হবে তা হলো খুশূ‘ (সালাতের একাগ্রতা), এমনকি তুমি তাদের মধ্যে কোনো একাগ্রচিত্ত মুছল্লি খুঁজে পাবে না।”(ত্বাবারাণী; সহীহুল জামে‘ হা/২৫৬৯) তাছাড়া শয়তানের মূল চক্রান্ত ও উদ্দেশ্য হল মানুষকে যেকোন উপায়ে অন্য মনষ্ক করে সালাত থেকে দূরে রাখা এবং মুছল্লির মাঝে বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করে সালাতের মত মহান ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ ও বিশাল সওয়াব থেকে বঞ্চিত রাখা। যাতে করে সালাত আদায়ের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়।তাই এইবিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক।আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ, الَّذِیۡنَ ہُمۡ فِیۡ صَلَاتِہِمۡ خٰشِعُوۡنَ “অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। যারা নিজেদের ছালাতে একনিষ্ট’ (সূরা আল-মুমিনূন: ১-২)। অর্থাৎ যারা ভীত-সন্ত্রস্ত এবং প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে সালাতে স্থির থাকে। আর সালাতে খুশূ‘ বা একাগ্রতার অর্থ হল- প্রশান্ত থাকা, নিশ্চিন্ত থাকা, ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা, সুস্থির থাকা, বিনয়ী থাকা এবং গাম্ভীর্যতা অবলম্বন করা। মূলত আল্লাহর ভয় ও তাঁর সম্পর্কে যথাযথ সচেতনতা বান্দাকে সালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করতে উৎসাহ যোগায় এবং খুশূ‘-একাগ্রতা অর্জনে সহযোগিতা করে। আর খুশূ‘ বা একাগ্রতার প্রকৃত রূপ হল- মহান আল্লাহর সামনে বান্দার অন্তরকে বিনম্র, হীন ও অপমানিত অবস্থায় দাঁড় করানো।
.
শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা করলে সালাতের মধ্যে নড়াচড়া বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে; নড়াচড়ার ধরন ও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই এর হুকুম নির্ধারিত হবে।”
.
সালাতের মধ্যে নড়াচড়ার হুকুম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] উল্লেখ করেন যে প্রয়োজন ছাড়া নামাযে নড়াচড়া করার মূলবিধান মাকরূহ। তবে এই নড়াচড়া পাঁচ ভাগে বিভক্ত:
القسم الأول : حركة واجبة.
القسم الثاني : حركة محرمة.
القسم الثالث : حركة مكروهة.
القسم الرابع : حركة مستحبة.
القسم الخامس : حركة مباحة.
فأما الحركة الواجبة : فهي التي تتوقف عليها صحة الصلاة ، مثل أن يرى في غترته نجاسة ، فيجب عليه أن يتحرك لإزالتها ويخلع غترته ، وذلك لأن النبي صلى الله عليه وسلم أتاه جبريل وهو يصلي بالناس فأخبره أن في نعليه خبثاً فخلعها صلى الله عليه وسلم وهو في صلاته واستمر فيها [ رواه أبو داود 650 ، وصححه الألباني في الإرواء 284 ] .
ومثل أن يخبره أحد بأنه اتجه إلى غير القبلة ؛ فيجب عليه أن يتحرك إلى القبلة .
وأما الحركة المحرمة : فهي الحركة الكثيرة المتوالية لغير ضرورة ؛ لأن مثل هذه الحركة تبطل الصلاة ، وما يبطل الصلاة فإنه لا يحل فعله ؛ لأنه من باب اتخاذ آيات الله هزواً .
وأما الحركة المستحبة : فهي الحركة لفعل مستحب في الصلاة ، كما لو تحرك من أجل استواء الصف ، أو رأى فرجة أمامه في الصف المقدم فتقدم نحوها وهو في صلاته ، أو تقلص الصف فتحرك لسد الخلل ، أو ما أشبه ذلك من الحركات التي يحصل بها فعل مستحب في الصلاة ؛ لأن ذلك من أجل إكمال الصلاة ، ولهذا لما صلى ابن عباس رضي الله عنهما مع النبي صلى الله عليه وسلم ، فقام عن يساره أخذ رسول الله صلى الله عليه وسلم برأسه من ورائه فجعله عن يمينه . [ متفق عليه ]
وأما الحركة المباحة : فهي اليسيرة لحاجة ، أو الكثيرة للضرورة ، أما اليسيرة لحاجة فمثلها فعل النبي صلى الله عليه وسلم حين كان يصلي وهو حامل أمامة بنت زينب بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو جدها من أمها فإذا قام حملها ، وإذا سجد وضعها [ البخاري 5996 ومسلم 543 ]
وأما الحركة الكثيرة للضرورة : فمثالها الصلاة في حال القتال ؛ قال الله تعالى : (حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ* فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالاً أَوْ رُكْبَاناً فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ) البقرة/238-239 ؛ فإن من يصلي وهو يمشي لا شك أن عمله كثير ولكنه لما كان للضرورة كان مباحاً لا يبطل الصلاة .
وأما الحركة المكروهة : فهي ما عدا ذلك وهو الأصل في الحركة في الصلاة ، وعلى هذا نقول لمن يتحركون في الصلاة إن عملكم مكروه ، منقص لصلاتكم ، وهذا مشاهد عند كل أحد فتجد الفرد يعبث بساعته ، أو بقلمه ، أو بغترته ، أو بأنفه ، أو بلحيته ، أو ما أشبه ذلك ، وكل ذلك من القسم المكروه إلا أن يكون كثيراً متوالياً فإنه محرم مبطل للصلاة .
وقد ذكر رحمه الله أيضا أن الحركة المبطلة للصلاة ليس لها عدد معين ، وإنما هي الحركة التي تنافي الصلاة ، بحيث إذا رؤى هذا الرجل فكأنه ليس في صلاة ، هذه هي التي تبطل؛ ولهذا حدده العلماء رحمهم الله بالعرف ، فقالوا : ” إن الحركات إذا كثرت وتوالت فإنها تبطل الصلاة ” ، بدون ذكر عدد معين ، وتحديد بعض العلماء إياها بثلاث حركات ، يحتاج إلى دليل ؛ لأن كل من حدد شيئاً بعدد معين ، أو كيفية معينة ، فإن عليه الدليل ، وإلا صار متحكماً في شريعة الله .
প্রথম প্রকার: ওয়াজিব নড়াচড়া
দ্বিতীয় প্রকার: হারাম নড়াচড়া
তৃতীয় প্রকার: মাকরূহ নড়াচড়া
চতুর্থ প্রকার: মুস্তাহাব নড়াচড়া
পঞ্চম প্রকার: জায়েয নড়াচড়া
ওয়াজিব নড়াচড়া: যে নড়াচড়ার উপর সালাতের বিশুদ্ধতা নির্ভর করে। যেমন: (সালাতে শুরু করার পর) সে যদি তার মাথার রুমালে নাপাকি দেখতে পায় তাহলে সেটি খুলে ফেলার জন্য নড়াচড়া করা ওয়াজিব। এর দলীল হচ্ছে: একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (জুতা পায়ে) সালাতের ইমামতি করছিলেন। এমন সময়ে জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে তাঁকে সংবাদ দিলেন, তাঁর জুতায় নাপাকী রয়েছে। তিনি সালাত পড়া অবস্থাতেই জুতা খুলে ফেললেন এবং সালাতে চালিয়ে গেলেন।(হাদীসটি আবু দাউদ হা/৬৫০) বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী ইরওয়া গ্রন্থে হা/২৮৪) এটিকে সহিহ বলে গণ্য করেছেন) অনুরূপভাবে কেউ যদি তাকে জানায় যে সে কিবলার দিকে নয়; অন্য দিকে মুখ করে আছে, তাহলে তার জন্য কিবলার দিকে মুখ ফেরানো ওয়াজিব।
.
হারাম নড়াচড়া: প্রয়োজন ছাড়া লাগাতার অধিক পরিমাণে নড়াচড়া করা। কারণ এ ধরনের নড়াচড়া সালাত বিনষ্ট করে দেয়। আর যা সালাত নষ্ট করে দেয় তা করা জায়েয নেই। কারণ এটি আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার নামান্তর।
.
মুস্তাহাব নড়াচড়া: সালাতে মুস্তাহাব কিছু করার জন্য নড়াচড়া করা। যেমন: কাতার সোজা করার জন্য নড়াচড়া করা। সালাতরত অবস্থায় সামনের কাতারে ফাঁকা স্থান দেখতে পেয়ে সেটি পূর্ণ করার জন্য সামনের কাতারে চলে যাওয়া অথবা কাতারে ফাঁকা স্থান সৃষ্টি হলে সেটি পূরণ করতে নড়াচড়া করা। এ ধরণের অন্য যে কোন নড়াচড়া যার মাধ্যমে নামাযের কোন একটি মুস্তাহাব আমল সম্পাদিত হয়। কারণ এই নড়াচড়া সালাতেকে পরিপূর্ণ করার জন্য। তাই ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত পড়ছিলেন তখন তিনি বামপাশে দাঁড়ালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মাথা ধরে তাকে পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে ডানপাশে নিয়ে এলেন।[বুখারী ও মুসলিম]
.
জায়েয নড়াচড়া: আর এটি হলো প্রয়োজনে সামান্য নড়াচড়া অথবা জরুরী কারণে বেশি নড়াচড়া করা। প্রয়োজনে সামান্য নড়াচড়ার উদাহরণ হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উমামা বিনতে যাইনাব বিনতে রাসূলুল্লাহকে বহন করে সালাত পড়তেন। তিনি উমামার নানা ছিলেন। দাঁড়ানো অবস্থায় তিনি তাকে বহন করতেন। আর সিজদায় গেলে তাকে নামিয়ে রাখতেন।[হাদীসটি বুখারী হা/৫৯৯৬; ও মুসলিম হা/৫৪৩) বর্ণনা করেন) আর জরুরী কারণে বেশি নড়াচড়ার উদাহরণ হলো যুদ্ধরত অবস্থায় সালাত পড়া। আল্লাহ তাআলা বলেন:“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে; বিশেষতঃ মধ্যবর্তী সালাতের প্রতি। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে। তোমরা যদি ভয় করো তাহলে হেঁটে কিংবা আরোহী অবস্থায় সালাত আদায় করবে। যখনই নিরাপদ হবে তখন তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করবে ঠিক যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিখিয়েছেন, যা তোমরা পূর্বে জানতে না।”(সূরা বাকারা: ২৩৮-২৩৯) হেঁটে সালাত পড়া নিঃসন্দেহে সালাতে বেশি নড়াচড়ার অন্তর্ভুক্ত। তবে সেটি জরুরী প্রয়োজনের কারণে হওয়ায় বৈধ এবং এতে সালাত বাতিল হবে না।
.
মাকরূহ নড়াচড়া: উপর্যুক্ত নড়াচড়া ছাড়া সব ধরনের নড়াচড়া মাকরূহ। সালাতে নড়াচড়ার এটাই মূল বিধান। সুতরাং যারা সালাতে নড়াচড়া করে তাদেরকে আমরা বলব: আপনাদের কাজটি মাকরূহ তথা অপছন্দনীয়। এটি আপনাদের সালাতে ঘাটতি সৃষ্টি করে। এমনটি প্রত্যেকের মাঝে দেখা যায়। দেখবেন কেউ তার ঘড়ি নিয়ে, কলম নিয়ে, মাথার রুমাল নিয়ে, নাক নিয়ে, দাড়ি নিয়ে বা এরূপ অন্য কিছু নিয়ে অযথা খেলতামাশা করছেন। এগুলো সবই অপছন্দনীয় নড়াচড়ার অন্তর্ভুক্ত। তবে যদি লাগাতার ও অতিরিক্ত হয়ে যায় তাহলে সেটি হারাম হবে এবং সালাতকে নষ্ট করে দিবে। এছাড়া তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে সালাতকে বাতিলকারী নড়াচড়ার কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। বরং সেটা এমন নড়াচড়া যা সালাতের পরিপন্থী। যে নড়াচড়া দেখলে মনে হবে এই ব্যক্তি সালাতে নেই, এ ধরণের নড়াচড়া নামাযকে বাতিল করে দেয়। তাই আলেমরা উরফ তথা প্রথার মাধ্যমে বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন। তারা বলেছেন: ‘নড়াচড়া বেশি পরিমাণে এবং লাগাতার হলে সালাত বাতিল হয়ে যায়।’ তারা কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করেননি। কিছু আলেমগণ যে, এটাকে ‘তিন’ সংখ্যায় সীমাবদ্ধ করেছেন এর পক্ষে দলীল প্রয়োজন। কারণ যে কেউ কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বা নির্দিষ্ট ধরন নির্ধারণ করলে এর সপক্ষে দলীল প্রদান করা তার উপর আবশ্যক। নতুবা সে আল্লাহর শরীয়তে স্বেচ্ছাচারিতাকারী বলে গণ্য হবে।”(ইবনু উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩০৯-৩১১)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে নামাযে বেশি বেশি নড়াচড়া করে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে কিনা? এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী? তিনি উত্তর দেন:
( السنة للمؤمن أن يقبل على صلاته ويخشع فيها بقلبه وبدنه ، سواء كانت فريضة أو نافلة ، لقول الله سبحانه : ( قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ * الَّذِينَ هُمْ فِي صَلاتِهِمْ خَاشِعُون ) المؤمنون/1-2 ، وعليه أن يطمئن فيها ، وذلك من أهم أركانها وفرائضها ، لقول النبي صلى الله عليه وسلم للذي أساء في صلاته ولم يطمئن فيها : ( ارجع فصلِّ فإنك لم تصل ) ، فعل ذلك ثلاث مرات ، فقال الرجل : يا رسول الله ، والذي بعثك بالحق لا أحسن غير هذا فعلمني ، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : ( إِذَا قُمْتَ إِلَى الصَّلاةِ فَأَسْبِغْ الْوُضُوءَ ، ثُمَّ اسْتَقْبِلْ الْقِبْلَةَ فَكَبِّرْ ، وَاقْرَأْ بِمَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنْ الْقُرْآنِ ، ثُمَّ ارْكَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ رَاكِعًا ثُمَّ ارْفَعْ رَأْسَكَ حَتَّى تَعْتَدِلَ قَائِمًا ، ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا ، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَسْتَوِيَ وَتَطْمَئِنَّ جَالِسًا ، ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا ، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَسْتَوِيَ قَائِمًا ، ثُمَّ افْعَلْ ذَلِكَ فِي صَلاتِكَ كُلِّهَا ) متفق عليه ، وفي رواية لأبي داود قال فيها : ( ثم اقرأ بأم القرآن ، وبما شاء الله ) .
وهذا الحديث الصحيح يدل على أن الطمأنينة ركن في الصلاة ، وفرض عظيم فيها ، لا تصح بدونه ، فمن نقر صلاته فلا صلاة له ، والخشوع هو لب الصلاة وروحها ، فالمشروع للمؤمن أن يهتم بذلك ، ويحرص عليه .
أما تحديد الحركات المنافية للطمأنينة وللخشوع بثلاث حركات فليس ذلك بحديث عن النبي صلى الله عليه وسلم ، وإنما ذلك كلام لبعض أهل العلم ، وليس عليه دليل يعتمد .
ولكن يكره العبث في الصلاة ، كتحريك الأنف واللحية والملابس والاشتغال بذلك ، وإذا كثر العبث أبطل الصلاة ، وأما إذا كان قليلا عرفا ، أو كان كثيرا ولم يتوال ، فإن الصلاة لا تبطل به ، ولكن يشرع للمؤمن أن يحافظ على الخشوع ، ويترك العبث ، قليله وكثيره ، حرصا على تمام الصلاة وكمالها .
ومن الأدلة على أن العمل القليل والحركات القليلة في الصلاة لا تبطلها ، وهكذا العمل والحركات المتفرقة غير المتوالية ، ما ثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم ، أنه فتح الباب يوما لعائشة وهو يصلي [ أبو داود 922 والنسائي 3/11 والترمذي 601 ، وحسنه الشيخ الألباني في صحيح الترمذي 601] .
وثبت عنه من حديث أبي قتادة رضي الله عنه أنه صلى ذات يوم بالناس ، وهو حامل أمامة بنت ابنته زينب ، فكان إذا سجد وضعها ، وإذا قام حملها
“মুমিনের জন্য সুন্নাহ হলো সালাতে শরীর ও মন নিয়ে প্রবেশ করা; হোক সেটা ফরয সালাত কিংবা নফল সালাত। কারণ আল্লাহ বলেছেন:“অবশ্যই মুমিনরা সফল হয়েছে, যারা তাদের সালাতে বিনয়াবনত।”(সূরা মুমিনূন: ১-২) তার উচিত সালাতে প্রশান্ত ও স্থির হওয়া। কারণ এই স্থিরতা সালাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ও ফরয কাজ। যে ব্যক্তি ধীরস্থিরতা ছাড়া সালাত পড়েছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন: “তুমি ফিরে গিয়ে সালাত পড়ো; কারণ তুমি সালাত পড়োনি।” তিনি এই কথা তিন বার বলেছিলেন। লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ: আমি এর চেয়ে ভালোভাবে সালাত পড়তে জানি না। আমাকে শিখিয়ে দিন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যখন তুমি সালাতে দাঁড়ানোর ইচ্ছা করবে তখন প্রথমে তুমি পূর্ণভাবে অযু করবে। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে তাকবীর বলবে। তারপর কুরআন থেকে যতটুকু তেলাওয়াত করা তোমার পক্ষে সহজ হয় তিলাওয়াত করবে। তারপর তুমি রুকূ করবে এবং রুকুতে গিয়ে স্থির হবে। তারপর মাথা উঠাবে এবং ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর সিজদাহ করবে এবং সিজদায় গিয়ে স্থির হবে। তারপর আবার মাথা তুলবে এবং স্থিরভাবে বসবে। এরপর আবার সিজদা দিবে এবং সিজদায় গিয়ে স্থির হবে। এরপর উঠে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। এরপর ঠিক এভাবেই তোমার সালাতের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করবে।”(হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন। আবু দাউদের বর্ণনায় আছে: ‘তারপর ফাতিহা এবং আল্লাহ যতটুকু চান ততটুকু তেলাওয়াত করবে’) এই সহিহ হাদীস প্রমাণ করে যে ধীরস্থিরতা সালাতের স্তম্ভ ও গুরুত্বপূর্ণ ফরয। এটি ছাড়া সালাত শুদ্ধ হয় না। যে ব্যক্তি সালাতে ঠোকর দেয় তার সালাত হয় না। সালাতে খুশু-খুযু সালাতের সারবস্তু ও প্রাণ। সুতরাং মুমিনের উচিত এটাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং এ ব্যাপারে সচেতন থাকা। তবে ধীরস্থিরতা ও মনোযোগ নষ্টকারী নড়াচড়াকে তিন সংখ্যাতে সীমাবদ্ধ করা এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো হাদীস নেই। এটি কিছু আলেমের বক্তব্য। এর পক্ষে নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল নেই। তবে সালাতে অনর্থক কাজ করা মাকরূহ। যেমন: নাক, দাড়ি, কাপড়-চোপড় নাড়াচাড়া করা এবং তা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। অনর্থক কাজ বেশি হলে সালাত বাতিল হয়ে যায়। আর যদি কম পরিমাণে হয় অথবা বেশি হলেও লাগাতার না হয় তাহলে সালাত বাতিল হয় না। তবে মুমিনের উচিত খুশু-খুযু রক্ষা করা এবং কম হোক বা বেশি হোক অনর্থক কাজ ছেড়ে দেওয়া; সালাত পরিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে। অল্প কাজে, সামান্য নড়াচড়ায় বা বিচ্ছিন্ন নড়াচড়ায় যে সালাত বাতিল হয় না এর দলীল হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীস: তিনি একদিন সালাতরত অবস্থায় আয়েশার জন্য দরজা খুলে দিয়েছিলেন।[আবু দাউদ হা/৯২২; তিরমিযী হা/৬০১)। শাইখ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) সহীহুত তিরমিযীতে হা/৬০১) হাদীসটি হাসান বলেছেন) আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, একদিন তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষদের নিয়ে সালাত পড়ার সময়ে তার মেয়ের মেয়ে (নাতনি) উমামা বিনতে যাইনাবকে বহন করেছিলেন। সিজদায় গেলে নামিয়ে রাখতেন, আর উঠে দাঁড়ালে বহন করতেন।”(ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম ১৬২-১৬৪) পরিশেষে বলব, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যেন সালাতের ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন এবং সাথে সাথে সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমাদেরকে জান্নাতে দাখিল করে নেন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।
Share: