প্রশ্ন: সফর এবং কসর কাকে বলে? সফর কত প্রকার ও কি কি? কতটুকু দূরত্বে সফর করলে সালাত কসর করা বৈধ?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি। অতঃপর: سفر আরবী এক বচনের শব্দ। বহুবচনে أسفار। আভিধানিক অর্থ হল- ভ্রমণ, যাত্রা, প্রস্থান, রওয়ানা ইত্যাদি। আর যিনি সফর করেন তাকে বলা হয় মুসাফির। ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে সফরের সংজ্ঞা: সফর বলতে একজন ব্যক্তি যখন তার শহরের সীমানা ছেড়ে ৮৮.৭ কিলোমিটার (প্রায় ৮৯ কিমি) বা তার চেয়ে বেশি দূরত্বের ভ্রমণে যায়, তখন তাকে শরীয়ত অনুযায়ী মুসাফির (ভ্রমণকারী) বলা হয়। এ অবস্থায় তার জন্য কিছু বিধান সহজ করা হয়, যেমন: চার রাকাতের ফরজ নামাজ কসর করে দুই রাকাআত পড়া। রোজা রাখা না রাখার অনুমতি ইত্যাদি।
.
সফর বা ভ্রমণের প্রকারভেদ: সফর বা ভ্রমণকে কুরআন-হাদীছের আলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।
(১).হারাম বা নিষিদ্ধ সফর। (২).মাকরূহ বা অপসন্দনীয় সফর। (৩). মুবাহ বা জায়েয সফর।(৪). মুস্তাহাব বা পসন্দনীয় সফর। (৫). ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় সফর।
.
(১).হারাম বা নিষিদ্ধ সফর: এটি এমন সফর যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদেশ-নিষেধের বিরোধিতা করে কিংবা শরিয়তে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে করা হয়। যেমন: কুরআন ও সহীহ হাদীসে যেসব কাজ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, সেগুলো করতে কোনো স্থানে গমন করা; অথবা এমন কোনো স্থানে সফর করা, যেখানে মহামারী (plague) শুরু হয়েছে যা শরীয়তে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।রাসূল (ﷺ) বলেন: “যদি তোমরা শুনতে পাও (কোন স্থানে মহামারী আক্রান্ত হয়েছে) তাহ’লে সেখানে যেয়ো না। আর তোমরা যেখানে আছ সেখানে আক্রান্ত হ’লে সেখান থেকে বের হয়ো না”।(বুখারী হা/৫৭২৮-৩০) এছাড়া কোন মহিলার মাহরাম ছাড়া সফর করা। রাসূল (ﷺ) বলেন,”মহিলারা মাহরাম (যার সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ) ব্যতীত অন্য কারো সাথে সফর করবে না। মাহরাম কাছে নেই এমতাবস্থায় কোন মহিলার নিকট কোন পুরুষ গমন করতে পারবে না”।(বুখারী হা/১৮৬২; মুসলিম হা/১৩৪১)
.
(২).মাকরূহ বা অপসন্দনীয় সফর: এটি সেই সফর, যা ইসলামী আদর্শ অনুসরণ না করে সম্পাদিত হয়। যেমন রাতের বেলা একা সফর করা, অথবা তিন জনের বেশি হলে তাদের মধ্য থেকে কাউকে আমীর (দলনেতা) নিযুক্ত না করা।ইবনু ওমর (রাঃ) নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন:”যদি লোকেরা একা সফরে কি ক্ষতি আছে তা জানত, যা আমি জানি, তবে কোন আরোহী রাতে একাকী সফর করত না”।(সহীহ বুখারী হা/২৯৯৮)
.
(৩).মুবাহ বা বৈধ সফর: এমন সফর যা দুনিয়ার বৈধ ও হালাল কাজের উদ্দেশ্যে করা হয় যেমন বিশ্রাম বা মানসিক প্রশান্তির জন্য ভ্রমণ, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সফর, কিংবা কোনো দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে সফর ইত্যাদি।
.
(৪).মুস্তাহাব বা পছন্দনীয় সফর: এটি এমন একটি সফর, যা মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী এবং মসজিদে আকসা-এ সফর করার উদ্দেশ্যে করা হয়। রাসূল (ﷺ) বলেন:”মসজিদুল হারাম, মসজিদুর রাসূল (ছাঃ) এবং মসজিদুল আক্বছা (বাইতুল মাক্বদিস) তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না”।(বুখারী হা/১১৮৯; মুসলিম হা/৮২৭) ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”উপদেশ গ্রহণের জন্য, পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ ও তাদের স্মৃতিসমূহ দেখার জন্য সফর করা মুস্তাহাব”।(তাফসীরে কুরতুবী, সূরা আন‘আম-১১ নং আয়াতে তাফসীর দ্রষ্টব্য)
.
(৫).ওয়াজিব বা অবশ্যিক সফর: এটি সেই সফর, যা আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে করা হয়। যেমন হজ্জ আদায়ের জন্য মক্কায় সফর করা, কিংবা মুসলিম শাসক যদি জিহাদের নির্দেশ দেন, তবে তার নির্দেশনা পালনার্থে জিহাদের ময়দানে রওনা হওয়া ইত্যাদি। যেমন আল্লাহ বলেন,وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوْكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَّأْتِيْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيْقٍ- ‘আর তুমি জনগণের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা প্রচার করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সকল প্রকার (পথশ্রান্ত) কৃশকায় উটের উপর সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হ’তে’ (সূরা হজ্জ: ২২/২৭)। ফরয ইলম অর্জন করার জন্য যে কোন স্থানে ভ্রমণ করা।রাসূল (ﷺ) বলেন,”কোন ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য কোন পথ অবলম্বন করলে,আল্লাহ এই অসীলায় তার জন্য জান্নাতের একটি পথ সুগম করে দেন”।(ইবনু মাজাহ হা/২২৩; তিরমিযী হা/২৬৪৬; সহীহুল জামি‘ হা/৬২৯৮)
.
অপরদিকে ক্বসর (قصر) আরবী শব্দ। এর অর্থ সংক্ষিপ্ত করা, কমানো ইতাদি। পারিভাষিক অর্থে চার রাক‘আত বিশিষ্ট সালাত দু’রাক‘আত করে পড়াকে ক্বসর বলে। অর্থাৎ যোহর, আসর ও এশার এই তিন ওয়াক্ত ফরজ সালাত ৪ রাক‘আতের পরিবর্তে ২ রাক‘আত আদায় করা। ফজর ও মাগরিবের সালাতে কছর নেই। সফরে সালাত ক্বসর করা জায়েজ এটি কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফদের ইজমা (সম্মিলিত ঐক্যমত) রয়েছে। কুরআন সুন্নাহ থেকে দলিল হচ্ছে,আল্লাহ তা‘আলা বলেন:وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَقْصُرُواْ مِنَ الصَّلاَةِ إِنْ خِفْتُمْ أَن يَفْتِنَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُواْ إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُواْ لَكُمْ عَدُوّاً مُّبِيناً-“যখন তোমরা সফর কর, তখন তোমাদের সালাতে ক্বছর করায় কোন দোষ নেই। যদি তোমরা আশংকা কর যে, কাফেররা তোমাদেরকে উত্যক্ত করবে। নিশ্চয়ই কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”।(সূরা নিসা/১০১)। উক্ত আয়াত থেকে যদিও এই কথা বুঝা যায় যে, কেবল ভয়ের সময় সালাত কসর করা বৈধ, তবুও ভয় ছাড়া নিরাপদ সময়েও কসর করা যায়। মহানবী (ﷺ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-গণ ভয়-অভয় উভয় অবস্থাতেই কসর করেছেন বলে প্রমাণিত। প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৭৩ হি.] বলেন,صَحِبْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَكَانَ لاَ يَزِيدُ فِي السَّفَرِ عَلَى رَكْعَتَيْنِ، وَأَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ كَذَلِكَ- رضى الله عنهم “আমি রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলাম,তিনি সফরে দু’রাক‘আতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। আবূ বকর, ওমর ও উসমান (রাঃ)-এরও এই রীতি ছিল।”(সহীহ বুখারী হা/১১০২) অপর বর্ননায় যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ,মুফাসসিরকুল শিরোমণি, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] বলেন:فَرَضَ اللَّهُ الصَّلَاةَ عَلَى لِسَانِ نَبِيِّكُمْ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْحَضَرِ أَرْبَعًا وَفِي السَّفَرِ رَكْعَتَيْنِ وَفِي الْخَوْف رَكْعَة “আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নবী (ﷺ)-এর যবানীতে মুক্বীম অবস্থায় চার রাক‘আত, সফরকালে দু’রাক‘আত এবং ভয়ের সময় এক রাক‘আত সালাত ফরয করেছেন”।(সহীহ মুসলিম হা/৬৮৭; নাসাঈ হা/১৫৩২; মুসনাদে আহমাদ হা/২২৯৩; মিশকাত হা/১৩৪৯)
.
সফর অবস্থায় কসরের বিধান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা কছর করতেন। তাই কছর করাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কসর হলো সাদাক্বা, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য সাদাক্বা করেছেন। সুতরাং তোমরা তার সাদাক্বা গ্রহণ করো’ (সহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬)। আর আল্লাহর দেওয়া ছাড় গ্রহণ করাই উত্তম। কিন্তু কেউ কসর না করলে সে সুন্নাত পরিত্যাগ করল, তবে সে গুনাহগার হবে না। আর সফরে সালাত কসর করা জায়েজ এই মর্মে ইজমা বর্ননা করেছেন শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:قصر الصلاة للمسافر سنة مؤكدة لا ينبغي تركها ، باتفاق الأئمة ، إلا ما يُحكى عن الشافعي في أحد قوليه : أن الإتمام أفضل ، ولكن الصحيح من مذهبه : أن القصر أفضل .وانظر”মুসাফিরের জন্য সালাত কসর করা (চার রাকাআতের সালাত দুই রাকাআত পড়া) একটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যা পরিত্যাগ করা উচিত নয় এ বিষয়ে ইমামগণের ঐকমত্য রয়েছে। তবে ইমাম শাফেয়ীর একটি বক্তব্যে ব্যতিক্রম পাওয়া যায়, যেখানে তিনি বলেছেন: পূর্ণভাবে সালাত আদায় করাই উত্তম। তবে তাঁর মাজহাব অনুযায়ী সঠিক মত হচ্ছে কসর করাই উত্তম।”(ইমাম নববী আল-মাজমু‘ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২১৮-২২৩) হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,ولا خلاف بين الأئمة في قصر الصلاة في السفر”সফরে সালাত কসর করার ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই।”(ইবনু কুদামা, আল-মুগনি, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৭৪)।
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রশ্ন: কতটুকু দূরত্বে সফর করলে সালাত কসর করা বৈধ এবং এর সময়সীমা কতদিন?
.

.
সফরে সালাত কসর করে আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্ব কত হওয়া উচিত এই বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে কোনো সুস্পষ্ট পরিমাণ বা দূরত্ব উল্লেখিত হয়নি।তাই এ বিষয়ে উলামায়ে কিরামের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। সাধারণভাবে তাঁদের মতামত দুটি প্রধান অভিমত হিসেবে পরিগণিত।
.
(১).একদল আলেমের মতে শরিয়তে অনুমোদিত সফর হলো প্রচলিত অর্থে ভ্রমণ, যার দূরত্ব অন্তত প্রায় ৮০ কিমি (৪৮ মাইল)। এই দূরত্ব বা তার বেশি ভ্রমণে মুসাফিরের জন্য রুখসত (ছাড়) গুলো বৈধ যেমন, তিনদিন তিনরাত মোজার উপর মাসেহ, চার রাকাআত বিশিষ্ট সালাত দুই রাকাতে (কসর) আদায়, দুই ওয়াক্তের সালাত একত্রে জমা করে আদায় করা, এবং রমজানের রোযা ভঙ্গ করা।সুতরাং মুসাফির ব্যক্তি যে স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করেছেন সে স্থানে পৌঁছে যদি সেখানে চারদিনের বেশি সময় অবস্থান করার নিয়ত করেন তাহলে তিনি সফরকালীন ছাড়গুলো গ্রহণ করবেন না,বরং পরিপূর্ণ সালাত আদায় করবেন। কিন্তু যদি চারদিন বা তার চেয়ে কম সময় অবস্থান করার নিয়ত করেন তাহলে তিনি সফরকালীন ছাড়গুলো গ্রহণ করতে পারেন।আর যে মুসাফির কোন একটি স্থানে অবস্থান করছেন; অথচ তিনি জানেন না যে, কখন তার প্রয়োজন শেষ হবে এবং তিনি সেখানে অবস্থানের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন সময় নির্ধারণ করেননি; এভাবে তিনি যদি দীর্ঘদিন সেখানে থেকে যান তবুও তিনি সফরকালীন ছাড়গুলো গ্রহণ করতে পারবেন।সাহাবাদের মধ্যে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। তবে প্রখ্যাত সাহাবী ইবনে আব্বাস ও ইবনে উমার (রাঃ) ৪৮ মাইল দূরে গিয়ে কসর করতেন এবং সিয়াম রাখতেন না। জেনে রাখা ভাল যে,এই সফর পায়ে হেঁটে হোক অথবা উটের পিঠে, সাইকেলে হোক বা বাসে-ট্রেনে, পানি-জাহাজে হোক অথবা এরোপ্লেনে, কষ্টের হোক অথবা আরামের, বৈধ কোন কাজের জন্য হলে তাতে কসর বৈধ।পাশাপাশি দূরবর্তী সফর থেকে যদি একদিনের ভিতরেই ফিরে আসে অথবা নিকটবর্তী সফরে ২/৩ দিন অবস্থান করে তবুও তাতে কসর-জমা চলবে।(মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্; খণ্ড: ২০; পৃষ্ঠা: ১৫৭; এবং ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৯৯)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,مَذْهَبُ أَبِي عَبْدِ اللَّهِ (يعني الإمام أحمد) أَنَّ الْقَصْرَ لا يَجُوزُ فِي أَقَلِّ مِنْ سِتَّةَ عَشَرَ فَرْسَخًا، وَالْفَرْسَخُ: ثَلاثَةُ أَمْيَالٍ، فَيَكُونُ ثَمَانِيَةً وَأَرْبَعِينَ مِيلا. وَقَدْ قَدَرَهُ ابْنُ عَبَّاسٍ، فَقَالَ: مِنْ عُسْفَانَ إلَى مَكَّةَ، وَمِنْ الطَّائِفِ إلَى مَكَّةَ، وَمِنْ جُدَّةَ إلَى مَكَّةَ.فَعَلَى هَذَا تَكُونُ مَسَافَةُ الْقَصْرِ يَوْمَيْنِ قَاصِدَيْنِ. وَهَذَا قَوْلُ ابْنِ عَبَّاسٍ وَابْنِ عُمَرَ. وَإِلَيْهِ ذَهَبَ مَالِكٌ، وَاللَّيْثُ، وَالشَّافِعِيُّ ا“আবু আব্দুল্লাহ (অর্থাৎ ইমাম আহমাদ) এর মত হল ১৬ ফারসাখ এর কম দূরত্বে ক্বসর (সালাত সংক্ষিপ্ত করা) জায়েয নয়। এক ফারসাখ হল তিন মাইল। সুতরাং ১৬ ফারসাখ দূরত্ব হল ৪৮ মাইল। ইবনু আব্বাস (রা.) এই দূরত্ব নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেছেন: এই দূরত্ব উসফান থেকে মক্কা পর্যন্ত, তায়েফ থেকে মক্কা পর্যন্ত, জেদ্দা থেকে মক্কা পর্যন্ত। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, ক্বসর (সালাত সংক্ষিপ্ত করা) বৈধকারী দূরত্ব হল সেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে দুই দিনের ভ্রমণ। এটি হল ইবনু আব্বাস ও ইবনু উমর এর মত। এই মতটি গ্রহণ করেছেন ইমাম মালেক, আল-লাইস ও শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ।’’(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৮)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,”যে সফরের মধ্যে সফরের ছাড়গুলো গ্রহণ করা শরিয়তসম্মত সেটা হচ্ছে প্রচলিত প্রথায় যেটাকে সফর বলা হয়। এর পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৮০ কিঃমিঃ। যে ব্যক্তি এ পরিমাণ বা এতোর্ধ দূরত্ব অতিক্রমের উদ্দেশ্য নিয়ে সফরে বের হবে সে ব্যক্তি সফরের ছাড়গুলো গ্রহণ করতে পারবেন; যেমন- মোজার ওপর তিন দিন তিন রাত মাসেহ করা, দুই ওয়াক্তের সালাত একত্রে আদায় করা ও নামাযগুলো কসর (সংখ্যাহ্রাস) করে আদায় করা, রমযানের রোযা না রাখা। এ মুসাফির ব্যক্তি যদি কোন স্থানে চারদিনের বেশি সময় অবস্থান করার নিয়ত করেন তাহলে তিনি আর সফরের ছাড়গুলো গ্রহণ করতে পারবেন না। যদি তিনি চারদিন বা এর চেয়ে কম সময় অবস্থানের নিয়ত করেন তাহলে সফরের ছাড়গুলো গ্রহণ করতে পারবেন। আর যে মুসাফির কোন এক স্থানে অবস্থান করছেন কিন্তু তিনি জানেন না যে, কখন তার প্রয়োজন শেষ হবে এবং অবস্থানের জন্য কোন সময় তিনি নির্দিষ্ট করেননি তিনিও সফরের ছাড়গুলো গ্রহণ করতে পারবেন; এমনকি সে অবস্থান অনেক দীর্ঘ হলেও। এক্ষেত্রে স্থলপথে সফর ও জল পথে সফরের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৯৯)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] সফরের দূরত্ব সম্পর্কে বলেন:الذي عليه جمهور أهل العلم أن ذلك يقدر بنحو ثمانين كيلو تقريبا بالنسبة لمن يسير في السيارة، وهكذا الطائرات، وفي السفن والبواخر، هذه المسافة أو ما يقاربها تسمى سفرا، وتعتبر سفرا في العرف فإنه المعروف بين المسلمين، فإذا سافر الإنسان على الإبل، أو على قدميه، أو على السيارات، أو على الطائرات، أو المراكب البحرية، هذه المسافة أو أكثر منها فهو مسافر“অধিকাংশ আলেম যে মতের উপর রয়েছেন তা হচ্ছে- যারা গাড়িতে, প্লেনে, জাহাজে, স্টিমারে ভ্রমণ করে তাদের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার ধরে হিসাব করা।এই দূরত্ব বা তার কাছাকাছি দূরত্বে ভ্রমণকে (শরিয়তের দৃষ্টিতে) সফর বলা হবে এবং মুসলিমদের মাঝে প্রচলিত প্রথা অনুসারেও তা সফর হিসেবে বিবেচিত। অতএব কেউ যদি উটে করে অথবা পায়ে হেঁটে অথবা গাড়িতে অথবা প্লেনে অথবা সামুদ্রিক যানে করে এই দূরত্ব বা তার বেশি অতিক্রম করে তবে সে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ২৬৭)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে প্রশ্ন করা হয় :ক্বসর (সালাত সংক্ষিপ্ত করা) বৈধকারী দূরত্ব সম্পর্কে এবং ভাড়ায়চালিত গাড়িচালক ৩০০ কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করলে সে কি সালাত ক্বসর (সালাত সংক্ষিপ্ত) করবে? তাঁরা উত্তরে বলেন:مقدار المسافة المبيحة للقصر ثمانون كيلو متر تقريبا على رأي جمهور العلماء، ويجوز لسائق سيارة الأجرة أو غيره أن يصليها قصرا؛ إذا كان يريد قطع المسافة التي ذكرناها في أول الجواب أو أكثر منها.“অধিকাংশ ‘আলেমের রায় অনুসারেক্বসর (সালাত সংক্ষিপ্ত করা) বৈধকারীদূরত্বের পরিমাণ হল প্রায় ৮০ কিলোমিটার। তাই ভাড়ায়চালিত গাড়িচালক অথবা অন্যদের জন্য এক্ষেত্রে সালাত সংক্ষিপ্ত করা জায়েয। যদি সে এ উত্তরের প্রথমে উল্লেখিত দূরত্ব বা তার চেয়ে বেশি পথ অতিক্রমের নিয়তে বের হয়।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৯০)
.
(২).অন্যদিকে কিছু ‘আলেম এই মত ব্যক্ত করেন যে, ইসলামি শরীয়তে সফরের কোন নির্দিষ্ট দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়নি। বরং এ ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথার উপরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রচলিত প্রথায় একজন মানুষ যতদূর গমন করলে সফর হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেটাই সফর হিসেবে বিবেচিত হবে। যার উপর ভিত্তি করে একজন মুসাফিরের জন্য দুই সালাত জমা করে আদায়,ক্বসর (সালাত সংক্ষিপ্ত) করাও সিয়াম ভঙ্গ করা ইত্যাদি বিধিবিধান প্রযোজ্য হয়। এই মতটি অধিক বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ। এমনকি এ মতটি বহু গবেষক আলেম বেছে নিয়েছেন; তাঁদের মধ্যে আছেন ইবনু কুদামাহ আল-মাকদিসি ও শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ)সহ আরও অনেকে।আহালুল আলেমদের মধ্যে ইমাম ইবনে হাযম (রাহিমাহুল্লাহ), ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ), শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ), ইমাম ইবনে ক্বুদামাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ), ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ), ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ), আল্লামাহ্ শানক্বিত্বী (রাহিমাহুল্লাহ),ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী যে কোন ধরনের সফরে ক্বছর করা জায়েয, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে সফর বলা হবে, চাই সে সফর দীর্ঘায়িত হোক বা সংক্ষিপ্ত, এর কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। কেননা কুরআন ও সহীহ হাদীসের মধ্যে সফরের কোন নির্দিষ্ট দূরত্ব ও সময় নির্ধারণ করা হয়নি। তাই এ ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথার উপরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রচলিত প্রথায় একজন মানুষ যতদূর গমন করলে সফর হিসাবে বিবেচনা করা হয় সেটাই সফর হিসাবে বিবেচিত হবে। যার উপর ভিত্তি করে একজন মুসাফিরের জন্য দুই সালাত জমা ও ক্বসর করবে (আল-মাহাল্লা, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৬-২১; বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৬৮; আল-মাজমূঊ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩২৫; মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২৪তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৫, ৩৫, ৪৮, ৪৯; আল-ইখতিয়ারাতুল ফিক্বহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৪৩৪; আল-মুগনী, ২য় খণ্ড,পৃষ্ঠা: ১৯০; যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৬৩; আস-সাইলুল জারার, পৃষ্ঠা: ১৮৮; আযওয়াউল বায়ান, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৩; আশ-শারহুল মুমতি‘, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৫১-৩৫৩; সিলসিলা সহীহাহ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩১১)।
.
এই মতের পক্ষে দলিল হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা যখন দেশ-বিদেশে সফর করবে, তখন যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফিররা তোমাদেরকে বিপন্ন করবে, সেক্ষেত্রে সালাত ক্বসর করাতে তোমাদের কোন দোষ নেই। নিশ্চয় কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু (সূরা আন-নিসা: ১০১)। ঈসা বিন হাফস বিন ‘আসিম (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলাম, তিনি সফরে দু’ রাক‘আতের অধিক আদায় করতেন না। আবূ বাকর, ‘উমার ও ‘উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর একই রীতি ছিল (সহীহ বুখারী, হা/১১০২; সহীহ মুসলিম, হা/৬৮৯)।ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”এখানে সফরকে কোন নির্দিষ্ট দূরত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়নি। বরং সাধারণ সফরের কথা বলা হয়েছে (আল-মাজমূঊ, ৪র্থ খণ্ড: পৃষ্ঠা: ৩২৬)।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:وَالْحُجَّةُ مَعَ مَنْ جَعَلَ الْقَصْرَ وَالْفِطْرَ مَشْرُوعًا فِي جِنْسِ السَّفَرِ وَلَمْ يَخُصَّ سَفَرًا مِنْ سَفَرٍ. وَهَذَا الْقَوْلُ هُوَ الصَّحِيحُ“যারা যে কোন ধরনের সফরে ক্বসর (সালাত সংক্ষিপ্ত) করা ও সিয়াম ভঙ্গ করাকে শরিয়তসম্মত মত দিয়েছেন, বিশেষ কোন সফরের সাথে নির্দিষ্ট করেননি দলীল তাঁদের পক্ষেই এবং এটাই সঠিক মত।”(ইবনু তাইমিয়া; আল-ফাতাওয়া খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ১০৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: মুসাফির ব্যক্তি কতটুকুদূরত্বের ক্ষেত্রে সালাত ক্বসর (সংক্ষিপ্ত করা) করতে পারবে এবং ক্বসর না করে দুই সালাত একত্রিত করা জায়েয কিনা। তিনি উত্তরে বলেন:
المسافة التي تقصر فيها الصلاة حددها بعض العلماء بنحو ثلاثة وثمانين كيلو مترا، وحددها بعض العلماء بما جرى به العرف أنه سفر وإن لم يبلغ ثمانين كيلو مترا، وما قال الناس عنه: إنه ليس بسفر، فليس بسفر ولو بلغ مائة كيلو متر. وهذا الأخير هو اختيار شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله ، وذلك لأن الله تعالى لم يحدد مسافة معينة لجواز القصر وكذلك النبي صلى الله عليه وسلم لم يحدد مسافة معينة.وقال أنس بن مالك رضي الله عنه: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا خَرَجَ مَسِيرَةَ ثَلاثَةِ أَمْيَالٍ أَوْ ثَلاثَةِ فَرَاسِخَ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ. رواه مسلم (691).وقول شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله تعالى أقرب إلى الصواب.ولا حرج عند اختلاف العرف فيه أن يأخذ الإنسان بالقول بالتحديد؛ لأنه قال به بعض الأئمة والعلماء المجتهدين، فلا بأس به إن شاء الله تعالى، أما مادام الأمر منضبطا فالرجوع إلى العرف هو الصواب.
“সালাত ক্বসর (সংক্ষিপ্ত) করার দূরত্বকে কিছু আলেম প্রায় ৮৩ কিলোমিটারে নির্দিষ্ট করেছেন। আবার কিছু আলেম প্রচলিত প্রথার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। সফরের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার না হলেও মানুষ যদি এটাকে সফর গণ্য করে তাহলে সেটা সফর। আর মানুষ যেটাকে সফর হিসেবে গণ্য করে না সেটা ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে হলেও সফর নয়। শেষের এই মতটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বেছে নিয়েছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সালাত ক্বসর করা বৈধ হওয়ার জন্য কোন নির্দিষ্ট দূরত্ব নির্ধারণ করেননি। একইভাবে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কোন নির্দিষ্ট দূরত্ব নির্ধারণ করেননি। আনাস ইবনে মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন “রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিন মাইল অথবা তিন ফারসাখ দূরত্বের পথে বের হলে সালাত দুই রাকাত আদায় করতেন (অর্থাৎ সালাত সংক্ষিপ্ত করতেন)।”(হাদিসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন হা/৬৯১) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহর এই বক্তব্যটি সঠিকতর।প্রচলিত প্রথায় দ্বিমত দেখা গেলে যদি কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট দূরত্বের মতটি (অর্থাৎ প্রথম মতটি) গ্রহণ করেন এতে দোষের কিছু নেই। কারণ এটি অনেক ইমাম ও মুজতাহিদ ‘আলেমগণের বক্তব্য। তাই এতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ্। আর যদি প্রচলিত প্রথায় স্পষ্ট দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় তবে তা অনুসারে আমল করাই সঠিক।”(ফাতওয়া আরকানুল ইসলাম পৃষ্ঠা: ৩৮১)
.

.
সফরে সালাত কসর বা একত্রিত করা এবং রোজা ভঙ্গ করার শর্তাবলী নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তবে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জমহুর (বৃহৎ সংখ্যক) আলেমদের অধিক গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী, যিনি সফরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন, তিনি তার নিজ শহরের জনবসতি এলাকা বা নগর সীমা অতিক্রম না করা পর্যন্ত সালাত কসর, একত্রিতকরণ এবং রোজা ভঙ্গের ছাড় পাওয়ার অধিকারী নয়। অর্থাৎ, যাত্রা শুরুর পর যখন সে তার শহরের জনবসতি এলাকা পেরিয়ে বাহিরে প্রবেশ করবে, তখনই তার উপর সফরের বিধি-নিষেধ এবং সফর সংক্রান্ত ছাড় (রুকসাত) প্রযোজ্য হবে। কেননা সহীহ হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী (ﷺ) যখন কোনো শহর বা জনপদ ত্যাগ করতেন, তখনই কসর সালাত শুরু করতেন এর আগে নয়। যেমন আনাস (রাঃ) বলেন, আমি নবী (ﷺ)-এর সাথে মক্কা থেকে মদিনার পথে মদীনায় যোহরের ৪ রাকআত এবং যুল-হুলাইফা (মদীনা থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে) পৌঁছে আসরের ২ রাকআত সালাত পড়তাম। (সহীহ বুখারী, হা/হা/১০৮৯) সুতরাং, সফরের ক্ষেত্রে শহর বা গ্রাম ত্যাগ করার আগেই কসর সালাতশুরু করা যাবে না। সালাতের নির্ধারিত সময় এসে গেলে যদি সফরে থাকেন, তাহলে পথেই কসর সালাত আদায় করতে পারেন। আর যদি সফরের সময় সালাতের সময় শেষে বাসায় ফিরে আসেন, তাহলে বাড়িতে পূর্ণ সালাত আদায় করতে হবে। যখন সফর শুরু করে শহরের বাইরে পৌঁছান যেমন বিমানবন্দর, স্টেশন বা বাস স্ট্যান্ডে তখন থেকে কসর সালাত চালু থাকবে। সেখানে কসর সালাত আদায়ের পর যদি কোন কারণে প্লেন বা গাড়ি না এসে বাধাগ্রস্ত হন এবং বাড়ি ফিরতে হয়, তবুও ওই কসর সালাত পুনরায় পূর্ণ পড়তে হবে না। আরও কথা হলো, যদি সফররত অবস্থায় প্লেন বা গাড়ি মুসাফিরের নিজ শহর বা গ্রাম অতিক্রম করেও যাত্রা চালিয়ে যায়, তবুও বিমানবন্দর বা স্টেশন বা বাস-স্ট্যান্ডে কসর সালাত আদায় বৈধই হবে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইমাম ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘,আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫১৪-৫২৩; ইবনু উসামীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৭৯)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ,শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,ليس لمن نوى السفر القصر حتى يخرج من بيوت قريته، ويجعلها وراء ظهره. وبهذا قال مالك، والشافعي، والأوزاعي، وإسحاق، وأبو ثور، وحكي ذلك عن جماعة من التابعين. وحكي عن عطاء، وسليمان بن موسى، أنهما أباحا القصر في البلد لمن نوى السفر,قال ابن المنذر: أجمع كل من نحفظ عنه من أهل العلم، أن للذي يريد السفر أن يقصر الصلاة إذا خرج من بيوت القرية التي يخرج منها” ا”যে ব্যক্তি সফরের ইচ্ছা পোষণ করে, সে তখনই সালাত কসর করতে পারে যখন সে নিজের গ্রামের (অথবা শহরের) ঘরবাড়ি থেকে বের হয়ে যায় এবং সেগুলোকে পেছনে ফেলে আসে। এই মত মালিক, শাফঈ, আওজাঈ, ইসহাক এবং আবু সাওর সহ অনেক ইমামদের। এছাড়া তাবেঈদের একদল আলেমও এ অবস্থান গ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে, আতা ও সুলায়মান ইবন মূসা শহরের ভেতর থেকেই সফর ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য কসর করার অনুমতি দিয়েছেন। ইবনুল মুনযির বলেন: “আমরা যে আলেমদের কথা সংরক্ষণ করেছি, তারা সবাই একমত যে, যে ব্যক্তি সফরের উদ্দেশ্যে গ্রামের ঘরবাড়ি অতিক্রম করবে, তখন তার জন্য সালাত কসর করা বৈধ।”(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৯১) ইমাম নববি (রাহিমাহুল্লাহ) ও অনুরূপ কথা বলেছেন।(নববী; আল মাজমূ; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২২৮)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন: আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা, আর আল্লাহর রাসূলের ওপর শান্তি ও দোয়া বর্ষিত হোক।অতঃপর; অধিকাংশ আলেমের মতে, ভ্রমণকারী শহরের সীমানা অতিক্রম করার পরই সালাত কসর করে আদায় করতে পারবে। এর প্রমাণ হলো, নবী ﷺ মদীনা থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত কসর শুরু করতেন না। এরপর তিনি দুই রাকআত সালাত আদায় করতেন। মূল বিবেচ্য বিষয় হলো কাজ কখন সম্পাদিত হচ্ছে। সুতরাং, যদি মুয়াজ্জিন যোহর বা আসরের আযান দেয় এবং ভ্রমণকারী শহরের সীমানা অতিক্রম করে, তবে তার উচিত চার রাকআতের সালাত কসর করে দুই রাকআত আদায় করা। কারণ এখানে আসল বিষয় হলো কাজ সম্পাদনের সময়কাল শহর ত্যাগের সময় নয় যেহেতু সালাত আদায়ের সময় সে ভ্রমণ অবস্থায় রয়েছে।” (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ও মাকালাত মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১২, পৃষ্ঠা: ২৯৮)
.

.
যখন কোনো মুসাফির (ভ্রমণকারী) তার নিজ শহর বা স্থায়ী বসবাসের এলাকায় প্রবেশ করে, তখন সফরের বিশেষ বিধান আর প্রযোজ্য থাকে না, বরং বাতিল হয়ে যায় এবং সে মুকীম (অবস্থানকারী) হিসেবে গণ্য হবে। সে নিজ শহরে স্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করুক, কিংবা কেবলমাত্র অতিক্রম করার জন্য, অথবা কোনো প্রয়োজনে যেকোনো কারণে হোক না কেন, তা প্রযোজ্য। সফরের বিধান শেষ হওয়ার মানে হচ্ছে, সে সেই জায়গায় ফিরে এসেছে যেখান থেকে সালতের কসর শুরু করেছিল। অতএব, যদি সে তার শহরের কাছাকাছি এসে পৌঁছায় আর সালাতের সময় হয়ে যায়, তবে সে তখনও মুসাফির বিবেচিত হবে যতক্ষণ না সে নিজ শহরে প্রবেশ করে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; আল মাওসুয়াতুল ফিক্বহিয়্যাহ; খণ্ড: ২৭; পৃষ্ঠা: ২৮৭)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আমি ভ্রমণে ছিলাম এবং ভ্রমণ থেকে ফেরার সময় নিয়ত করেছিলাম যে, আমি আমার বাসায় পৌঁছে যোহর ও আসরের নামাজ জমা (একত্র) করে আদায় করব। এখন প্রশ্ন হলো, আমি কি এই দুই নামাজ কসর করে পড়তে পারব? আমি কিন্তু আসরের পর বাসায় পৌঁছেছি। উত্তরে তাঁরা বলেছিলেন:إذا وصل المسافر إلى بلده ، فإنه لا يجوز له قصر الصلاة ؛ لانتهاء السفر بدخوله إلى بلده ، ولو كانت الصلاة قد وجبت عليه قبل وصوله ؛ لأن العبرة بحالة أداء الصلاة، لا بحالة وجوبها عليه في هذه الحالة”যখন একজন মুসাফির তার নিজ শহরে পৌঁছে যায়, তখন তার জন্য নামাজ কসর করা জায়েজ নেই। কারণ, সে তার শহরে প্রবেশ করার মাধ্যমে মুসাফির হওয়া শেষ হয়ে গেছে। যদিও সে সালাত তার ওপর ফরজ হয়েছিল শহরে পৌঁছানোর আগে, তবুও বিচার হবে সালাত আদায়ের সময় অবস্থার ওপর, ফরজ হওয়ার সময়ের ওপর নয়। (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৪৪৯)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: যদি কেউ তার পরিবার থেকে দূরে এমন এক জায়গায় যায় যেখানে সে থেকে যাওয়ার (স্থায়ী হওয়ার) নিয়ত করে এবং আগের শহরে ফেরার কোনো ইচ্ছা না থাকে, তারপর কোনো এক সময় সে তার পরিবারকে দেখতে আগের শহরে ফিরে আসে তাহলে সে কি নিজেকে মুসাফির মনে করবে?
উত্তরে শাইখ বলেন:إذا خرج الإنسان عن وطنه الأول بنية الاستقرار في البلد الثاني فإنه إذا رجع إلى وطنه الأول يكون مسافراً ، ما دام على نيته الأولى ، والدليل على ذلك : أن الرسول عليه الصلاة والسلام كان وطنه الأول مكة ولما فتح مكة قصر وفي حجة الوداع قصر .السائل : يا شيخ وإن كان في نفس هذا البلد – بلده الأول – زوجته وأولاده ؟ الشيخ : إي : نعم . حتى وإن كان زوجته وأولاده فيه “যদি কেউ নিজের প্রথম শহর (মূল বাসস্থান) ছেড়ে দ্বিতীয় শহরে স্থায়ীভাবে থাকার নিয়তে চলে যায়, তাহলে সে যখন তার প্রথম শহরে ফিরে আসে, তখনো সে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে যতক্ষণ না তার সেই প্রথম নিয়ত পরিবর্তিত হয়। এর প্রমাণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রথম শহর ছিল মক্কা, এবং তিনি যখন মক্কা বিজয়ের সময় ফিরে আসেন, তখন তিনি সালাত কসর করেছিলেন, হজ্জ্বে বিদায়ের সময়ও কসর করেছিলেন। প্রশ্নকারী জিজ্ঞেস করলেন: হে শাইখ! যদি ঐ শহরেই তার স্ত্রী-সন্তান বসবাস করে, তাহলেও? শাইখ উত্তর দিলেন: হ্যাঁ, তাহলেও। এমনকি যদি তার স্ত্রী ও সন্তানরাও সেখানে থাকে, তবুও সে মুসাফিরই থাকবে।”(ইবনু উসাইমীন; লিক্বাউল বাবিল মাফতুহ; ২৩/৮২)
.

.
জমহুর উলামাদের বিশুদ্ধ মত অনুসারে,যদি কোনো মুসাফির ৪ দিনের বেশি সময়ের জন্য অবস্থান করার নিয়ত করে, তাহলে সে সালাতগুলো পূর্ণ সংখ্যায় (কাদাহ পূর্ণ করে) আদায় করবে। অন্যদিকে, যদি কোনো মুসাফির সফরে গিয়ে নির্দিষ্ট কোনো দিনের অবস্থানের সংকল্প না করে, অর্থাৎ যেই কাজে গিয়েছে সেটি শেষ হয়ে গেলে ফিরে আসার নিয়ত থাকে, অথবা পথে কোনো বাধা বা অসুবিধা দেখা দিলে সেই বাধা কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত নামায কসর করে আদায় করা জায়েজ। দলিল মহানবী ﷺ) একবার একটি সফরে ১৯ দিন ছিলেন এবং ততদিন সালাত কসর করেছেন।(সহীহ বুখারী হা/১০৮০) আনাস (রাযি.) শুআনূতে দুই বছর অবস্থান করেছিলেন এবং সে সময়ও কসর নামায আদায় করে গিয়েছিলেন। (মুওয়াত্ত্বা মালেক খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৮৮; ফিকহুস সুন্নাহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৬) আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযি. শুআনূতে বরফের কারণে ছয় মাস পর্যন্ত আযার বাইজানে আটকা পড়ে ছিলেন এবং ততদিন কসর করে নামায আদায় করেছিলেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক; ২/৪৩৩৯, বায়হাকী খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৫২) অন্যদিকে, বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে গিয়ে বসবাস শুরু করলে যেমন ব্যবসা, চাকুরি বা পড়াশোনার জন্য দীর্ঘদিন অবস্থান করা হয়, তখন আর কসর নামায চলবে না। তবে যদি কোনো সফরকারী নির্দিষ্ট দিনের অবস্থানের সংকল্প নিয়ে না থাকে, এবং কাজ শেষ না হয়, ততদিন পর্যন্ত সে মুসাফিরই এবং কসর নামায করতে পারে। এজন্য ৪ কিংবা তারও অধিক দিনের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী বসবাসের নিয়ত না করে, ততদিন সে সফরকারীই গণ্য। এখানে এক ব্যতিক্রমমূলক দৃষ্টিকোণ হলো, যারা প্রতিদিন ভাড়া গাড়ি, বাস, ট্রেন বা প্লেনে যাতায়াত করেন, তারা ও মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন এবং তাদের জন্যও নামায কসর করা যথাযথ।”( বিস্তারিত জানতে দেখুন; ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪০৬-৪০৭; মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ; ২২/১০৩; ইবনু উসাইমীন; আশ শারহুল মুমতি; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫৩২-৫৩৯)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেনمَنْ لَمْ يُجْمِعْ الْإِقَامَةَ مُدَّةً تَزِيدُ عَلَى إحْدَى وَعِشْرِينَ صَلَاةً، فَلَهُ الْقَصْرُ، وَلَوْ أَقَامَ سِنِينَ، مِثْلُ أَنْ يُقِيمَ لِقَضَاءِ حَاجَةٍ يَرْجُو نَجَاحَهَا، أَوْ لِجِهَادِ عَدُوٍّ، أَوْ حَبَسَهُ سُلْطَانٌ، أَوْ مَرَضٌ، وَسَوَاءٌ غَلَبَ عَلَى ظَنِّهِ انْقِضَاءُ الْحَاجَةِ فِي مُدَّةٍ يَسِيرَةٍ، أَوْ كَثِيرَةٍ، بَعْدَ أَنْ يَحْتَمِلَ انْقِضَاؤُهَا فِي الْمُدَّةِ الَّتِي لَا تَقْطَعُ حُكْمَ السَّفَرِ.قَالَ ابْنُ الْمُنْذِرِ: أَجْمَعَ أَهْلُ الْعِلْمِ أَنَّ لِلْمُسَافِرِ أَنْ يَقْصُرَ مَا لَمْ يُجْمِعْ إقَامَةً، وَإِنْ أَتَى عَلَيْهِ سِنُونَ”যে ব্যক্তি ২১ ওয়াক্ত সালাতের চেয়ে বেশি সময় অবস্থানের মনস্থির করেনি সে ব্যক্তি কসর করতে পারেন। এমনকি তিনি যদি কোন কাজ শেষ করার তাগিদে কিংবা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কিংবা শাসক তাকে আটক রাখার কারণে কিংবা অসুস্থতার কারণে বছরের পর বছর থেকে যান তবুও। কসরের সময়ের চেয়েও কম সময়ের মধ্যে কাজটি নিষ্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকার পর যদি স্বল্প সময়ে কিংবা বেশি সময়ে কাজটি নিষ্পন্ন হওয়ার প্রবল ধারণা হয় তবুও হুকুমে হেরফের হবে না। ইবনুল মুনযির (রহঃ) বলেন: আলেমগণ ইজমা করেছেন যে, মুসাফির যদি মুকীম হওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেয় তাহলে সে যদি বছর বছর থেকে যায় তবুও সে মুসাফির।”(ইবনে কুদামাহ আল-মুগনি’ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২১৫)
.

.
যখন কোনো মুসাফির কোনো মুকীম (অবস্থানকারী) এর পিছনে সালাত আদায় করবে তখন মুসাফিরের উপর কর্তব্য হবে সে সালাতটি পূর্ণরূপে আদায় করা। সে সালাতের শুরু থেকে পেলো নাকি কেবল এক রাকা‘আত পেলো অথবা দুই রাকা‘আত বা তিন রাকা‘আত পেলো এতে কোনো তারতম্য হবে না। তখন মুসাফিরের জন্য কসর করা জায়েয হবে না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যেমনটি বুখার ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে;إنما جعل الإمام ليؤتم به فلا تختلفوا عليه“ইমাম তো নির্ধারণ করা হয়েছে তাকে অনুসরণ অনুকরণ করার জন্য, সুতরাং তোমরা তার সাথে ভিন্নমত করো না”।(সহীহ বুখারী হা/৭২২) তাছাড়া ইমাম মুসলিম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, যখন তাক জিজ্ঞেস করা হলো, মুসাফিরের বিধান এমন কেনো যে সে যখন একা পড়ে তখন কসর করে কিন্তু (মুকীম) ইমামের পিছনে চার রাকা‘আত পড়ে? তখন তিনি বললেন,«تلك هي السنة”এটাই হচ্ছে সুন্নাহ তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ”। তাছাড়া জামাতের সাথে সালাত আদায় করা অন্যদের মত মুসাফিরের ওপরও ওয়াজিব।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৮২৬৫৮)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: যদি একজন ব্যক্তি জেদ্দায় ভ্রমণ করে, উদাহরণস্বরূপ, তাকে কি তার নামায সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হবে নাকি তাকে মসজিদে জামাতের সাথে সালাত আদায় করতে হবে? তিনি জবাবে বলেন:إذا كان المسافر في الطريق فلا بأس ، أما إذا وصل البلد فلا يصلي وحده ، بل عليه أن يصلي مع الناس ويتم ، أما في الطريق إذا كان وحده وحضرت الصلاة فلا بأس أن يصلي في السفر وحده ويقصر الرباعية اثنتين”
“মুসাফির যদি পথেই থাকে তবে তাতে কিছু আসে যায় না, তবে যদি সে তার গন্তব্যে পৌঁছে থাকে তবে তার নিজের নামায পড়া উচিত নয়, বরং তাকে লোকদের সাথে জামআতে সালাত আদায় করতে হবে এবং পূর্ণরূপে সালাত আদায় করতে হবে। কিন্তু যদি সে রাস্তায় থাকে এবং একা থাকে এবং সালাতের সময় হয়ে যায়, তবে তার নিজের সালাত পড়া এবং সফর অবস্থায় সালাত সংক্ষিপ্ত করে চার রাকাআত সালাত দুই রাকাআত পড়ায় কোন দোষ নেই।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খন্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ২৯৭)
.
সৌদি সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: শাইখ আমি যদি সফরে থাকি এবং সালাতের আযান শুনতে পাই, তাহলে কি আমাকে মসজিদে সালাত আদায় করতে হবে? আমি যেখানে অবস্থান করছি সেখানে যদি সালাত পড়ি, তাতে কি দোষ আছে? যদি আমার সফরের সময়কাল টানা চার দিনের বেশি হয়, তাহলে আমি কি আমার সালাত সংক্ষিপ্ত করব নাকি পূর্ণ আদায় করব?
তিনি উত্তর দিলেনঃ “আপনি যেখানে অবস্থান করছেন সেখানে যদি আপনি আযান শুনতে পান, তাহলে আপনাকে মসজিদে উপস্থিত হতে হবে, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তিকে বলেছিলেন যে তার কাছে বাড়িতে সালাত আদায়ের অনুমতি চেয়েছিল। রাসূল ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি আযান শুনতে পাও? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে সালাতে এসো।(মুসলিম হা/৬৫৩; নাসাঈ হা/৮৫০; মিশকাত হা/১০৫৪) এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু সংখ্যক সাহাবী হতে বর্ণিত আছে, তারা বলেছেন, যে ব্যক্তি আযান শুনার পরও জামা’আতে উপস্থিত হয়নি তার কোন সালাত নেই।(অর্থাৎ তার সালাত সহীহ নয়), একমাত্র যার একটি অজুহাত রয়েছে সে ব্যক্তি ছাড়া।(সুনানে তিরমিজি হা/২১৭ সনদ সহীহ) শরীয়তে এমন কোন প্রমাণ নেই যে এই বিধানটি শুধুমাত্র সফরকারীর জন্য প্রযোজ্য, যদি না মসজিদে যাওয়া আপনার সফরে কিছু সমস্যা সৃষ্টি করে, যেমন আপনার বিশ্রাম ও ঘুমের প্রয়োজন হলে এবং আপনি যেখানে আছেন সেখানে সালাত পড়তে চান। এমনভাবে থাকা যাতে আপনি ঘুমাতে পারেন, অথবা আপনি ভয় পাচ্ছেন যে আপনি মসজিদে গেলে ইমাম সালাত পড়তে দেরি করবেন এবং আপনি চলে যেতে চান এবং আপনি ভয় পাচ্ছেন যে আপনি ট্রেন বা প্লেন মিস করতে পারেন। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ৪২২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬◐✪◑▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।