প্রশ্ন: সহীহ হাদীস দ্বারা কি কুরআনের কোনো আয়াতের হুকুম রহিত (নাসিখ) করা বা কোনো সাধারণ বিধানকে নির্দিষ্ট (মুকাইয়্যাদ) করা সম্ভব?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য।শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। অতঃপর:

ইমাম খতীব বাগদাদী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ “আল কিফায়াহ ফী ‘ইলমির-রিওয়ায়াহ পৃষ্ঠা: ২৩-এ একটি অধ্যায় রচনা করেছেন এই শিরোনামে:“আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর হুকুম সমমর্যাদার, এবং এ দুটোর অনুসরণ করা ওয়াজিব ও দায়িত্বস্বরূপ এরপর তিনি হাদীস উল্লেখ করেন: মিকদাম ইবনু মাদীকারিব (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সাবধান! খুব শীঘ্রই এমন ব্যক্তির আগমন ঘটবে যে, সে তার সুসজ্জিত গদিতে হেলান দিয়ে বসে থাকবে, তখন তার নিকট আমার কোন হাদীস পৌছলে সে বলবে, আমাদের ও তোমাদের সামনে তো আল্লাহ তা’আলার কিতাবই আছে। আমরা তাতে যা হালাল পাব সেগুলো হালাল বলে মেনে নিব এবং যেগুলো হারাম পাব সেগুলো হারাম বলে মনে নিব। সাবধান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা হারাম ঘোষণা করেছেন তা আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মতোই হারাম।” (তিরমিযী হা/২৬৬৪; সিলসিলাহ সহীহা হা/২৮৭০ সনদ হাসান)।
.
আর সুন্নাহ হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, কুরআনে যা সংক্ষেপে এসেছে, তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে; যা সাধারণভাবে এসেছে, তা নির্দিষ্ট করে দেয়; যা মুক্ত তথা অবাধভাবে বলা হয়েছে, তাকে সীমাবদ্ধ করে; এবং কুরআনের কোন আয়াত রহিতকারী (নাসিখ), আর কোনটি রহিত (মানসুখ)—তাও স্পষ্ট করে দেয়।তাই তাবেঈদের ইমাম মাখহূল (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:القرآن أحوج إلى السنة من السنة إلى القرآن “সুন্নাহ যতটা না কুরআনের মুখাপেক্ষী, কুরআন বরং সুন্নাহর অধিক মুখাপেক্ষী।”(আল কিফায়াহ, পৃষ্ঠা: ৩০)
.

ইবনুন নাজ্জার ফাতূহী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
يخصَّصُ الكتابُ ببعضه ، وبالسنة مطلقا ، سواء كانت متواترة أو آحاد :مثال تخصيص الكتاب بالسنة – حتى مع كونها آحادا ، عند أحمد ومالك والشافعي رضي الله عنهم – : قوله سبحانه وتعالى : ( وأحل لكم ما وراء ذلكم )، فإنه مخصوص بقوله صلى الله عليه وسلم : ( لا تنكح المرأة على عمتها ، ولا على خالتها ) متفق عليه ، ونحوه تخصيص آية السرقة بما دون النصاب ، وقتل المشركين بإخراج المجوس ، وغير ذلك .
قال ابن مفلح : وعند الحنفية إن كان خص بدليل مجمع عليه جاز ، وإلا فلا . وقيل : بالوقف . وقيل : يجوز ولم يقع “
কুরআনের এক অংশকে অপর অংশ দ্বারা নির্দিষ্ট করা যায়, এবং সুন্নাহ দ্বারা নির্দিষ্ট করা যায় তা হাদীস মুতাওয়াতির হোক বা আহাদ হোক,উভয় অবস্থায়ই। উদাহরণ: কুরআনে আল্লাহ বলেন:”উল্লিখিত নারীগণ ব্যতীত আর সকলকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে…”।(সূরা নিসা: ২৪) এই সাধারণ বিধানকে রাসূল (ﷺ)-এর এই হাদীস দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয়েছে: এক নারীর সঙ্গে তার ফুফু বা খালাকে একসাথে বিয়ে করো না। (সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত।) এর অনুরূপ আরও উদাহরণ রয়েছে, যেমন চুরির আয়াতকে মালের পরিমাণ নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট করা এবং কাফের হত্যার আয়াতকে অগ্নি উপাসকদের (মজুসদের) ব্যতিক্রম করা ইত্যাদি। ইবনু মুফলিহ বলেন: হানাফী মাযহাব মতে, যদি এটি এমন প্রমাণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয় যে বিষয়ে সকলের ইজমা তথা ঐকমত্য আছে, তবে তা বৈধ; আর না হলে কেউ কেউ বিরত থাকার কথা বলেছেন,কেউ বলেছেন বৈধ তবে বাস্তবে এমন হয়নি।”(শারহুল কাওকাবুল মুনীর; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৫৯-৩৬৩)
.
ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: আল-কুরআনুল কারীমকে ‘খবরুল-ওয়াহিদ’ (একজন বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস) দ্বারা খাস (বিশেষ) করা যাবে কি না এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে: জামহুর আলেমগণ: তারা বলেন, এটি সর্বদা বৈধ। কিছু হানাবিলা (حنابلة): তারা বলেন, এটি একেবারেই বৈধ নয়। ইমাম গাযযালী ‘আল-মুনখুল’ গ্রন্থে এই মতটি মুতাযিলা ফেরকার পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনু বুরহান এটি কিছু কালামবিদ ও ফকীহদের থেকে বর্ণনা করেছেন। আবুল হুসাইন ইবনু কাত্তান একদল ইরাকি আলেমের পক্ষ থেকেও এই মতটি উল্লেখ করেছেন। কারখী: তিনি বলেন, কুরআনের সাধারণ নির্দেশ (عام) যদি আগে থেকেই কোনো আলাদা দলীল দ্বারা খাস (বিশেষ) করা হয়ে থাকে তা সে দলীল কাত’ঈ (নিশ্চিত) হোক বা ظني (ধারণাপ্রসূত) তাহলে খবরুল-ওয়াহিদ দিয়ে খাস করা যাবে। কিন্তু যদি তা কোনো সংযুক্ত দলীল (مثل الاستثناء বা الشرط) দ্বারা খাস করা হয়ে থাকে, বা আদৌ খাস করা না হয়ে থাকে তবে খবরুল-ওয়াহিদ দ্বারা খাস করা যাবে না। কাযী আবু বকর: তিনি এই ব্যাপারে ‘ওয়াকফ’ অর্থাৎ নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছেন (না বৈধ বলেছেন, না অবৈধ)।ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী তার ‘আল-মাহসূল’ গ্রন্থে জামহুরদের মতের সমর্থনে দলীল হিসেবে বলেছেন:”আল্লাহর কিতাবের সাধারণ হুকুম (عام) ও খবরুল-ওয়াহিদ দুটিই দলীল। কিন্তু খবরুল-ওয়াহিদ হচ্ছে সাধারণ হুকুমের তুলনায় বেশি নির্দিষ্ট তাই খবরুল-ওয়াহিদকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।” ইবনুস সামআনী এই জায়েজ হওয়ার পক্ষে সাহাবাদের ইজমা (সামূহিক সম্মতি) দ্বারা দলীল দিয়েছেন। যেমন:তাঁরা আল্লাহর বলেন:”আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে তোমাদেরকে অসিয়ত করেন.. (সূরা নিসা: ১১) এই আয়াতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর এই হাদীস দ্বারা খাস করেছেন:”إنا معشر الأنبياء لا نورث”(‘আমরা নবীগণ উত্তরাধিকারী রাখি না।’) তেমনি তাঁরা মুসলমানদের উত্তরাধিকারকে সীমিত করেছেন এই হাদীসের মাধ্যমে:”لا يرث المسلم الكافر”(‘মুসলমান কাফেরের উত্তরাধিকারী হয় না।’) তাঁরা এই আয়াত فاقتلوا المشركين (অতএব, মুশরিকদের হত্যা করো।(সূরা তওবা: ৫) এই আয়াতকে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ
(রাযি.)-থেকে বর্ণিত, মাজুসদের (অগ্নিপূজকদের) বিষয়ে আগত হাদীস দ্বারা খাস করেছেন। এরকম আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। এছাড়াও স্পষ্ট একটি দলীল হলো: আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার এমন নির্দেশ এসেছে যে, তাঁর নবীর অনুসরণ করতে হবে কোনো সীমাবদ্ধতা ছাড়া। সুতরাং যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো দলীল পাওয়া যায়, তখন তা মান্য করা ফরজ। যদি তা কুরআনের কোনো সাধারণ হুকুমের বিরোধিতা করে, তাহলে عام (সাধারণ) হুকুমকে خاص (বিশেষ) হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা করাই কর্তব্য। কারণ, কুরআনের সাধারণ নির্দেশ কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করা হবে এ ধারণাটি ‘ظني’ অর্থাৎ ধারণার উপর ভিত্তি করে, নিশ্চিত নয়। এজন্য সহীহ ‘আহাদ’ হাদীস দ্বারা খাস করায় কোনো বাধা নেই।”(ইরশাদুল ফুহূল; পৃষ্ঠা: ২৬৭–২৮৬)
.
আল্লামা আল আমীন শানক্বীতি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: اعلم أن التحقيق أنه يجوز تخصيص المتواتر بأخبار الآحاد ؛ لأن التخصيص بيان ، وقد قدمنا أن المتواتر يبيَّن بالآحاد ، قرآنًا أو سنة “জেনে রাখো, সঠিক মত হলো মুতাওয়াতির (নিশ্চিতভাবে প্রচলিত) দলীলকে ‘খবরুল-ওয়াহিদ’ দ্বারা খাস করা বৈধ। কারণ, খাস করা মানেই ব্যাখ্যা করা,আর আমরা আগেই বলেছি যে, মুতাওয়াতির দলীলকে আহাদ হাদীস দ্বারাও ব্যাখ্যা করা বৈধ তা কুরআন হোক বা সুন্নাহ।”(মুযাক্কিরা ফি উসূলিল ফিকহ: ২২২)
.

প্রথম মত: আহাদ হাদীসের দ্বারা কুরআনের আয়াত নাসখ (বাতিল বা রহিত) করা বৈধ নয় এটাই অধিকাংশ উসূলবিদের মতামত। বরং ইমাম শাফি‘ঈ (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আর-রিসালাহ (পৃষ্ঠা ১০৬–১০৯)-এ এবং ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) উভয়েই মত দিয়েছেন যে, কুরআনের আয়াতকে এমনকি মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারাও নাসখ রহিত করা জায়েয নয়।এই মতকে ইমাম ইবনু কুদামাহ এবং ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ ও সমর্থন করেছেন। এই বিষয়ে অধিক বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাবে ইমাম যারকশী আল-শাফি‘ঈর গ্রন্থ আল-বাহরুল মুহীত (খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৬২–২৭২)-এ।
দ্বিতীয় মত: আহাদ হাদীস দ্বারা কুরআনের আয়াত নাসখ করা জায়েজ। এই মত কিছু হানাফি উসূলবিদ গ্রহণ করেছেন, যেমন ” (৩/৬২)” গ্রন্থে রয়েছে। এটি সুবকী তাঁর “জামউল জাওয়ামি” (পৃষ্ঠা: ৫৭) গ্রন্থে গ্রহণ করেছেন, যেখানে তিনি বলেন: “কুরআন দ্বারা কুরআন ও সুন্নাহ নাসখ হয়, আর সুন্নাহ দ্বারা কুরআনও। বলা হয়েছে: আহাদ দ্বারা নাসখ জায়েজ নয়। আর সত্য হলো নাসখ কেবল মুতাওয়াতির দ্বারাই ঘটেছে। এটি আল্লামা মুহাম্মাদ আল আমীন শানকিতি (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতও,
.
মুহাম্মাদ আল আমীন শানকিতি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:
الذي يظهر لنا أنه الصواب : هو أن أخبار الآحاد الصحيحة يجوز نسخ المتواتر بها إذا ثبت تأخرها عنه ، وأنه لا معارضة بينهما ; لأن المتواتر حق ، والسنة الواردة بعده إنما بينت شيئا جديدا لم يكن موجودا قبل ، فلا معارضة بينهما البتة لاختلاف زمنهما .
فقوله تعالى : ( قل لا أجد في ما أوحي إلي محرما على طاعم يطعمه إلا أن يكون ميتة أو دما مسفوحا أو لحم خنزير فإنه رجس أو فسقا أهل لغير الله به فمن اضطر غير باغ ولا عاد فإن ربك غفور رحيم )
يدل بدلالة المطابقة دلالة صريحة على إباحة لحوم الحمر الأهلية ; لصراحة الحصر بالنفي والإثبات في الآية في ذلك .
فإذا صرح النبي صلى الله عليه وسلم بعد ذلك يوم خيبر في حديث صحيح بأن لحوم الحمر الأهلية غير مباحة ، فلا معارضة البتة بين ذلك الحديث الصحيح ، وبين تلك الآية النازلة قبله بسنين ; لأن الحديث دل على تحريم جديد ، والآية ما نفت تجدد شيء في المستقبل كما هو واضح .
فالتحقيق – إن شاء الله – هو جواز نسخ المتواتر بالآحاد الصحيحة الثابت تأخرها عنه ، وإن خالف فيه جمهور الأصوليين “
“আমাদের কাছে যেটি সঠিক মনে হয়,তা হলো: সহীহ ‘আহাদ’ হাদীস দ্বারা ‘মুতাওয়াতির’ দলীলকে নাসখ (বাতিল বা রহিত) করা বৈধ, যদি তা প্রমাণিত হয় যে ঐ ‘আহাদ’ হাদীসটি ‘মুতাওয়াতির’ দলীলের পরে অবতীর্ণ হয়েছে। এতে কোনো দ্বন্দ্ব বা বিরোধ নেই; কারণ মুতাওয়াতির দলীল তো সত্য এবং তার পরবর্তী সুন্নাহ কেবল একটি নতুন হুকুম বা বিধান জানাচ্ছে, যা পূর্বে ছিল না। ফলে, উভয়ের মধ্যে কোনো বিরোধের অবকাশ নেই, কারণ তারা সময় ও প্রেক্ষিতভেদে অবতীর্ণ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ,আল্লাহ তাআলার এই বাণী: “বলুন, আমার প্রতি যে ওহী হয়েছে তাতে, লোকে যা খায় তার মধ্যে আমি কিছুই হারাম পাই না, মৃত, বহমান রক্ত ও শুকরের মাংস ছাড়া।কেননা এগুলো অবশ্যই অপবিত্র অথবা যা অবৈধ, আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য উৎসর্গের কারণে। তবে যে কেউ অবাধ্য না হয়ে এবং সীমালংঘন না করে নিরুপায় হয়ে তা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে, তবে নিশ্চয় আপনার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(সূরা আন‘আম, আয়াত: ১৪৫) এই আয়াত সরাসরি ও স্পষ্টভাবে গৃহপালিত গাধার মাংস বৈধ হওয়াকে প্রমাণ করে; কারণ এই আয়াতে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ জিনিসগুলোকে নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অতঃপর বহু বছর পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার যুদ্ধের দিন, একটি সহীহ হাদীসে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে গৃহপালিত গাধার মাংস খাওয়া হারাম তাহলে এই হাদীস ও পূর্বের কুরআনি আয়াতের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কারণ হাদীসটি একটি নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এসেছে, এবং আয়াতটি ভবিষ্যতে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করেনি যা স্পষ্ট।সুতরাং সঠিক গবেষণালব্ধ মতামত ইনশাআল্লাহ হলো, মুতাওয়াতির (আয়াত) কে সহীহ আহাদ দ্বারা নাসখ (বাতিল) করা বৈধ, যদি সহীহভাবে প্রমাণিত হয় যে, ঐ হাদীসটি মুতাওয়াতির দলীলের পরে এসেছে যদিও অধিকাংশ উসূলবিদ এতে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।”(আজওয়াউল ঈমান; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৫১-৪৫২)
.
আবু হামিদ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-গাজালি আত-তুসি,(রাহিমাহুল্লাহ) “আল মুস্তাসফা” গ্রন্থে বলেন:وأما نسخ القرآن بالسنة فنسخ الوصية للوالدين والأقربين بقوله صلى الله عليه وسلم: ألا لا وصية لوارث. لأن آية الميراث لا تمنع الوصية للوالدين والأقربين إذ الجمع ممكن…কুরআনের আয়াতের হুকুমকে সুন্নাহ দ্বারা নাসখ (বাতিল/প্রতিস্থাপন) করার উদাহরণ হলো মৃত্যুর সময় পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ওসিয়ত করার বিষয়ে কুরআনের নির্দেশকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী দ্বারা নাসখ ধরা:সাবধান! উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য কোনো ওসিয়ত নেই।”(ইবনু মাজাহ হা/২৭১৪) কারণ, কুরআনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আয়াতে ওয়ারিস পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারণ করা হলেও,তা ওসিয়ত দেয়ার নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে না।বরং উভয় হুকুমকে একত্রে গ্রহণ করাও সম্ভব..।”(গাজালি আল মুস্তাসফা; পৃষ্ঠা: ১০০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:সুন্নাহ কি কুরআনকে নাসখ (বাতিল) করতে পারে নাকি পারে না?
উত্তরে শাইখ বলেন:
:السنة تخصصه، أو تقيد مطلقه، ولا تنسخه عند أهل العلم، والنسخ يختلف فيه العلماء في معناه، فعند السلف والقدماء يسمون التخصيص نسخًا، وهذا يقع في السنة تنسخ بمعنى تخصص، وتقيد. أما أنها ترفع حكم الآية بالكلية الذي هو المصطلح الأخير عند الأصوليين، فإن السنة لا ترفع أحكام القرآن، وإنما تخصص، قد تكون الآية عامة، فتأتي السنة فتخصص كما في قوله -جل وعل-ا: يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ [النساء:11] هذه الآية خصصها قول النبي ﷺ: لا يرث المسلم الكافر فهي عامة مقيدة مخصصة بهذا الحديث مع آيات أخرى بالمعنى.
“সুন্নাহ কুরআনের কোনো হুকুমকে তাখসীস (নির্দিষ্ট) করে অথবা কুরআনের মুক্ত হুকুমকে তাক্বয়ীদ (সীমাবদ্ধ) করে। কিন্তু তা কুরআনের হুকুমকে নাসখ (সম্পূর্ণভাবে বাতিল) করে না আহলুল ইলমদের মতে। ‘নাসখ’ শব্দের অর্থ ও প্রয়োগ বিষয়ে আলেমদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। সলফে সালিহীন ও প্রাচীন উসূলবিদদের কাছে ‘তাখসীস’ (নির্দিষ্টকরণ)-কেও ‘নাসখ’ বলা হতো। এই অর্থে বলা যায়, সুন্নাহ কখনো কখনো (কুরআনকে) নাসখ করে (অর্থাৎ, তা তাখসীস ও তাক্বয়ীদ করে।)” কিন্তু পরবর্তীকালের উসূলবিদদের পরিভাষায় ‘নাসখ’ বলতে বোঝানো হয়: কোনো আয়াতের হুকুম সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করে দেওয়া। এই অর্থে সুন্নাহ কুরআনের হুকুমকে বিলুপ্ত করে না। বরং এটি কোনো আয়াতকে নির্দিষ্ট করে দেয়।উদাহরণস্বরূপ,আল্লাহ তাআলা বলেন;يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ “আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে তোমাদেরকে অসিয়ত করছেন।”(সূরা আন-নিসা: ১১) এই আয়াতটি সাধারণভাবে সকল সন্তানকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:«لا يَرِثُ المسلمُ الكافرَ“মুসলিম কাফেরের উত্তারাধিকারী হয় না”(সহীহ বুখারী হা/৬৭৬৪) এই হাদীসটি ঐ আয়াতের সাধারণতা কমিয়ে দিয়েছে; অর্থাৎ এই হাদীস দ্বারা সেই আয়াতকে সীমাবদ্ধ ও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এমন আরও কিছু আয়াত রয়েছে, যেগুলোকে অর্থের দিক দিয়ে হাদীস দ্বারা নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।”(বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-৩৫৩৭) এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া-১৩৮৭৪২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬◐✪◑▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।