প্রশ্ন: তাওবা শব্দের প্রকৃত অর্থ কী? একনিষ্ঠ হৃদয়ে গীবতসহ সমস্ত গুনাহ থেকে ফিরে আসার উদ্দেশ্যে আল্লাহর নিকট খাঁটি ও গ্রহণযোগ্য তাওবার শর্তসমূহ এবং সঠিক পদ্ধতি কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬

.
হাদিসে সাঈদের পিতা সাদ বিন মালিক বিন সিনান আল-খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের মাঝে এমন এক লোক ছিল যে নিরানব্বইজন মানুষকে হত্যা করেছে। সে ঐ সময়কার সবচেয়ে জ্ঞানবান ব্যক্তির অনুসন্ধান করল। তাকে একজন ধর্মযাজককে দেখিয়ে দেয়া হল। সে ধর্মযাজকের কাছে এসে বলল: আমি নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করেছি; আমার জন্য কি তওবার সুযোগ আছে? ধর্মযাজক বলল: না। তখন সে উক্ত ধর্মযাজককে হত্যা করে একশজন পূর্ণ করল। এরপর সে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে আছে তার সন্ধান করল? তখন তাকে একজন ধর্মীয় পণ্ডিতকে দেখিয়ে দেয়া হল। সে (পণ্ডিতকে) বলল যে, সে একশজন মানুষকে হত্যা করেছে; তার জন্যে কি তওবা করার সুযোগ আছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। তার তওবা কবুলের পথে কে প্রতিবন্ধক হতে পারে? তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে কিছু লোক আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত আছে। তুমিও তাদের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত হও এবং কখনও তোমার নিজ দেশে ফিরে যাবে না। কেননা, সেটা খুব খারাপ জায়গা। লোকটি নির্দেশিত স্থানের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল। অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর তার মৃত্যুর সময় হয়ে গেল। তখন তাকে নিয়ে রহমতের ফেরেশতা ও আযাবের ফেরেশতাদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিল। রহমতের ফেরেশতারা বলল: লোকটি তওবা করে অন্তর থেকে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে। আর আযাবের ফেরেশতারা বলল: লোকটি কখনো কোন পুণ্যের কাজ করেনি। এ সময় একজন ফেরেশতা মানুষের বেশে হাজির হল। তারা এ ব্যক্তিকে তাদের মাঝে বিচারক হিসেবে মেনে নিল। তিনি বললেন: তোমরা উভয় দিকের জায়গা মেপে দেখ। যে দিকের ভূমি কম হবে এ লোক তার ভাগের হিসেবে গণ্য হবে। তখন তারা জায়গা মেপে দেখল যে, ঐ ব্যক্তি যে স্থানের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল সে স্থানের কাছাকাছি। ফলে রহমতের ফেরেশতারা লোকটির প্রাণ কেড়ে নিল।”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম] সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে যে, “ঐ ব্যক্তি নেককারদের গ্রামের দিকে এক বিঘত এগিয়ে ছিল। ফলে তাকে নেককার গ্রামের অধিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়”।(সহীহ মুসলিম হা/২৭১৬) সহিহ বুখারীর অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে:“আল্লাহ্ তাআলা এ ভাগের ভূমির কাছে প্রত্যাদেশ করলেন যে, তুমি নিকটবর্তী হয়ে যাও এবং ঐ ভাগের ভূমির কাছে প্রত্যাদেশ করলেন যে, তুমি দূরে যাও। লোকটি বলল: তোমরা এ দুই ভূমির মধ্যবর্তী জায়গা মেপে দেখ। মেপে পাওয়া গেল যে, নেককারদের গ্রামের দিকে এক বিঘত কাছে। তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হল।”(সহীহ বুখারী
হা/৩৪৭০) সহিহ মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে,“ঐ ব্যক্তি তার বুক দিয়ে ঐ স্থানের দিকে আগাচ্ছিল।”(সহীহ মুসলিম হা/২৭৬৬)
.

.
(১).তাওবাহ্ একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে করতে হবে।
(২).গুনাহর কাজ করার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে।
(৩).যে গুনাহ হতে তাওবাহ্ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে।
(৪).ভবিষ্যতে এই গুনাহ আর না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
(৫).নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাওবাহ্ করতে হবে।
(৬).মানুষের অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
أن كلَّ من ارتكب معصيةً لزمه المبادرةُ إلى التوبة منها، والتوبةُ من حقوق الله تعالى يُشترط فيها ثلاثة أشياء: أن يُقلع عن المعصية في الحال، وأن يندمَ على فعلها، وأن يَعزِمَ ألاّ يعود إليها. والتوبةُ من حقوق الآدميين يُشترط فيها هذه الثلاثة، ورابع: وهو ردّ الظلامة إلى صاحبها أو طلب عفوه عنها والإِبراء منها، فيجبُ على المغتاب التوبة بهذه الأمور الأربعة، لأن الغيبة حقّ آدمي، ولا بدّ من استحلاله مَن اغتابَه،
“পাপে লিপ্ত প্রত্যেক ব্যক্তির অবশ্য করণীয় হল অনতিবিলম্বে তওবা করা। আর আল্লাহর অধিকাররের সাথে সম্পৃক্ত পাপ থেকে তওবা করার শর্ত তিনটি:
(১) কৃত পাপকর্ম থেকে নিবৃত্ত হওয়া।
(২) কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।
(৩) ভবিষ্যতে সেই গুনাহ না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা।
আর বান্দার সাথে সম্পৃক্ত গুনাহ থেকে তওবা করার ক্ষেত্রে আরো একটি শর্ত যুক্ত হবে, সেটা হ’ল-
(৪) যার অধিকার নষ্ট করা হয়েছে তাকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে দায়মুক্ত হয়ে যাওয়া। সুতরাং গীবতকারীকে উপরিউক্ত চারটি শর্ত মেনে তওবা করা ওয়াজিব। কেননা গীবত বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট পাপ। সেজন্য যার গীবত করা হয়েছে তার কাছ থেকেই দায়মুক্ত হওয়া আবশ্যক”।(ইমাম নববী, আল-আযকার, পৃষ্ঠা: ৩৪৬)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:
قَالَ العلماءُ: التَّوْبَةُ وَاجبَةٌ مِنْ كُلِّ ذَنْب، فإنْ كَانتِ المَعْصِيَةُ بَيْنَ العَبْدِ وبَيْنَ اللهِ تَعَالَى لاَ تَتَعلَّقُ بحقّ آدَمِيٍّ، فَلَهَا ثَلاثَةُ شُرُوط:
أحَدُها: أنْ يُقلِعَ عَنِ المَعصِيَةِ. والثَّانِي: أَنْ يَنْدَمَ عَلَى فِعْلِهَا.والثَّالثُ: أنْ يَعْزِمَ أَنْ لا يعُودَ إِلَيْهَا أَبَدًا. فَإِنْ فُقِدَ أَحَدُ الثَّلاثَةِ لَمْ تَصِحَّ تَوبَتُهُ. وإنْ كَانَتِ المَعْصِيةُ تَتَعَلقُ بآدَمِيٍّ فَشُرُوطُهَا أرْبَعَةٌ: هذِهِ الثَّلاثَةُ، وأنْ يَبْرَأ مِنْ حَقّ صَاحِبِها، فَإِنْ كَانَتْ مالًا أَوْ نَحْوَهُ رَدَّهُ إِلَيْه، وإنْ كَانَت حَدَّ قَذْفٍ ونَحْوَهُ مَكَّنَهُ مِنْهُ أَوْ طَلَبَ عَفْوَهُ، وإنْ كَانْت غِيبَةً استَحَلَّهُ مِنْهَا، ويجِبُ أنْ يَتُوبَ مِنْ جميعِ الذُّنُوبِ، فَإِنْ تَابَ مِنْ بَعْضِها صَحَّتْ تَوْبَتُهُ عِنْدَ أهْلِ الحَقِّ مِنْ ذلِكَ الذَّنْبِ، وبَقِيَ عَلَيهِ البَاقي. وَقَدْ تَظَاهَرَتْ دَلائِلُ الكتَابِ، والسُّنَّةِ، وإجْمَاعِ الأُمَّةِ عَلَى وُجوبِ التَّوبةِ
“আলেমগণ বলেছেন: প্রত্যেক গুনাহ থেকে তাওবা করা ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয় কর্তব্য)। যদি গুনাহটি আল্লাহ তা‘আলার হক (অধিকার) সংক্রান্ত হয় এবং তাতে কোনো মানুষের হক সংশ্লিষ্ট না থাকে, তাহলে তাওবার তিনটি শর্ত পূরণ করা আবশ্যক:
(১).গুনাহ পরিত্যাগ করা।
(২).কৃত গুনাহর জন্য আন্তরিক অনুতপ্ত হওয়া।
(৩).ভবিষ্যতে ঐ গুনাহে ফিরে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা।
এই তিন শর্তের একটি শর্তও যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে তাওবা সহীহ (গ্রহণযোগ্য) হবে না। আর যদি গুনাহটি কোনো মানুষের হকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে উপরোক্ত তিনটি শর্তের সঙ্গে আরও একটি চতুর্থ শর্ত সংযুক্ত হবে, তা হলো: ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির হক আদায় করে তাকে মুক্ত করা। যদি তা সম্পদ বা এ জাতীয় কিছু হয়, তাহলে তা মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। আর যদি তা অপবাদ বা মানহানিকর কথা হয়, তবে তাকে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে অথবা তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।আর যদি তা গীবত হয়ে থাকে, তাহলে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। এছাড়াও, প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত সকল গুনাহ থেকে তাওবা করা। তবে কেউ যদি কিছু গুনাহ থেকে তাওবা করে, তাহলে আহলুস-সুন্নাহর নিকট তা গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ সে গুনাহসমূহের তাওবাকারী হিসেবে গণ্য হবে যদিও অন্যান্য গুনাহ থেকে এখনো দায়মুক্ত হয়নি। আর কুরআন, সুন্নাহ ও মুসলিম উম্মাহর ইজমা (ঐক্যমত) দ্বারা তাওবার আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়েছে।”(বিন বায; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২৯৮; আরও দেখুন; অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, ফাতওয়া নং-৫৬১/০২)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন:
وذكر العلماء أن التوبة النصوح هي التي جمعت خمسة شروط :
1- أن تكون خالصة لله عز وجل .
2- أن يكون نادماً حزنا على ما سلف من ذنبه , يتمنى أنه لم يحصل منه .
3- أن يقلع عن المعصية فوراً ، فإن كانت المعصية بفعل محرم تركه في الحال , وإن كانت المعصية بترك واجب فعله في الحال , وإذا كانت المعصية فيما يتعلق بحقوق الخلق لم تصح التوبة منها حتى يتخلص من تلك الحقوق .
4- أن يعزم على أن لا يعود في المستقبل إلى المعصية .
5- أن لا تكون بعد انتهاء وقت قبول التوبة , كما سبق .
আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে,”তাওবাতুন নাসূহ” হলো সেই তাওবাহ যা নিম্নোক্ত পাঁচটি শর্ত পূরণ করে—
(১).তা যেন আল্লাহর জন্যই খালিস (বিশুদ্ধভাবে নিবেদিত) হয়: (অর্থাৎ তাওবাহটি একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে কোনো লোক দেখানো বা দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে নয়)।
(২).ব্যক্তি নিজের পূর্ববর্তী গোনাহের জন্য সত্যিকারের অনুতপ্ত ও দুঃখিত থাকবে, এমনকি তার অন্তরে এই আকাঙ্ক্ষা থাকবে—ইশ! যদি এ গোনাহ সে কখনও না করতো!
(৩).সে যেন অবিলম্বে সেই গুনাহ ত্যাগ করে যদি গুনাহটি কোনো হারাম কাজ করে থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই তা ছেড়ে দেবে; আর যদি গুনাহটি কোনো ফরয (আবশ্যিক) কাজ পরিত্যাগ করার মাধ্যমে হয়ে থাকে, তাহলে তা সঙ্গে সঙ্গেই আদায় করবে। আর যদি গুনাহটি মানুষের হক বা অধিকার সংক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে সেই তওবা তখনো শুদ্ধ হবে না যতক্ষণ না সে মানুষের সেই অধিকার থেকে নিজেকে মুক্ত করে না নেয়।
(৪).ভবিষ্যতে সেই পাপে আর ফিরে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা।( অর্থাৎ তাওবাহকারী ব্যক্তির মনে দৃঢ় ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা থাকতে হবে যে, সে ভবিষ্যতে আর কখনও সেই গোনাহে লিপ্ত হবে না।
(৫).তাওবাহ এমন সময় যেন না হয় যখন তওবার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে যেমন ইতঃপূর্বে তা স্পষ্ট করা হয়েছে।(অর্থাৎ তওবা করতে হবে মৃত্যু শুরু হওয়ার পূর্বে এবং পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় শুরু হওয়ার আগে।”(ইমাম ইবনু উসাইমীন; মাজালিসু শারহি রামাদান’ পৃষ্ঠা: ১৪৩; ইবনু উসাইমীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৫৩/৭৩)
.
একনিষ্ঠ হৃদয়ে গীবতসহ সমস্ত গুনাহ থেকে ফিরে আসার উদ্দেশ্যে আল্লাহর নিকট খাঁটি ও গ্রহণযোগ্য তাওবার শর্তসমূহ ৬ টি। এই ৬ টি শর্ত নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
(১).তাওবাহ্ একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে করতে হবে: খাঁটি তাওবাহ্ কেবল আল্লাহর জন্যই হতে হবে।
আল্লাহর ভয় ও সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কারো খাতিরে যেমন লোক দেখানো, প্রশংসা কুড়ানো, কারো চাপে, মন রক্ষায় বা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য—তাওবাহ্ করলে তা কবুল হবে না, বরং নতুন গুনাহর কারণ হতে পারে। তাওবাহ্ হলো আল্লাহর কাছে সরাসরি নিজের গুনাহর জন্য ক্ষমা চাওয়া, নিঃস্বার্থ অন্তরে ফিরে আসা। কোনো পাদ্রী, পীর, মাশায়েখ বা পুরোহিত কারো কাছেই তাওবাহ্ করার সুযোগ নেই; তারা কারো গুনাহ মাফ করতে পারে না। ইসলামে পাপ মোচনের একমাত্র পথ আল্লাহর দরবারে আন্তরিক তাওবাহ্। হ্যাঁ, আলেমগণ তাওবাহ্ করার পদ্ধতি শেখাতে বা পরামর্শ দিতে পারেন; কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার কাজটি একান্তই ব্যক্তির আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়। শুধু মুখে কিছু বললেই হয় না, বরং তা হতে হবে হৃদয় নিঃসৃত, গুনাহ থেকে সরে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্পসহ।
.
(২). গুনাহের কাজ করার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে: গুনাহ করার পর তা থেকে তাওবাহ্ করতে চাইলে তাওবাকারীকে অবশ্যই তার কৃতকর্মের জন্য অন্তর থেকে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে। অপরাধকর্মের কারণে লজ্জিত হওয়া খাঁটি তাওবার শর্ত। তাইতো নাবী ﷺ বলেছেন :النَّدَمُ تَوْبَةٌ ‘‘অনুতপ্ত হওয়াই হল তাওবার মূল বিষয়।’’(ইবনু মাজাহ হা/৪২৫২) কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত না হয়ে, অনুতপ্ত না হয়ে যত তাওবাই করা হোক তা আল্লাহ গ্রহণ করবেন না।ইসলামের নীতিমালায় প্রসিদ্ধ নীতি হলো, ‘পাপকাজ করে লজ্জিত হলে পাপ কমে যায়। আর পুণ্য কাজ করে গর্ববোধ করলে পুণ্য বাতিল হয়ে যায়।’ যে পাপ কাজ করে, সে সাধারণ মানুষ। যে পাপ করে অনুতপ্ত হয়, সে নেককার মানুষ; কিন্তু যে পাপ করে তা প্রকাশ করে বেড়ায়, সে শয়তানের অনুসারী। রাসূল (ﷺ) বলেন:“আমার উম্মতের সব গুনাহ মাফ করা হবে, তবে যারা প্রকাশ্যে পাপ করে তাদের নয়।”(সহীহ বুখারী হা/৬০৬৯) তাই পাপ হলে গোপন রাখুন, লজ্জিত হন, এবং একান্তভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান তবেই তাওবা কবুলের আশা করা যায়।
.
(৩).যে গুনাহ হতে তাওবাহ্ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে: যে ব্যক্তি কোনো গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চায়, তার প্রথম করণীয় হলো সেই গুনাহ সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা। এটি খাঁটি তাওবার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। যদি কেউ কোনো ফরয ইবাদত যেমন যাকাত না দেয়ার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চায়, তাহলে তাকে আগে পূর্বের হিসাব অনুযায়ী যাকাত আদায় করতে হবে। কারণ যাকাত আল্লাহ ও গরীবের হক কেবল তাওবাহ্ করলেই গরীবের হক আদায় হয় না। একইভাবে পিতা-মাতার অবাধ্যতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরণ, মদ্যপান, ধূমপান বা সুদের মতো হারাম কাজ ত্যাগ করে, সংশ্লিষ্টদের হক আদায় করে তাওবাহ্ করতে হবে। সুদের সম্পদ থাকলে তা হালাল অর্থ থেকে আলাদা করে সওয়াবের নিয়ত ছাড়াই কল্যাণমুখী কাজে ব্যয় করতে হবে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৬১১৯) সুতরাং তাওবার পরও যদি কেউ সেই গুনাহ চালিয়ে যায়, তাহলে তা আল্লাহর সঙ্গে ঠাট্টা করার নামান্তর। এটি এমন, যেমন কেউ পা ধুয়ে আবার ময়লায় রেখে দেয় এতে ধোয়ার কোনো অর্থ থাকে না।এ প্রসঙ্গে একটি শিক্ষণীয় কাহিনি রয়েছে: এক ব্যক্তি দুর্গন্ধযুক্ত কুয়ার পানি পবিত্র করতে বারবার পানি তুলেও ব্যর্থ হচ্ছিল। পরে জানা গেল, কুয়ার তলদেশে একটি মৃত বিড়াল ছিল। যতক্ষণ না পচা-গলা সেই মৃতদেহ সরানো হলো, ততক্ষণ পানি বিশুদ্ধ হয়নি। এই গল্প কাল্পনিক হলেও এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবেই বোঝা গেল যে, কুয়ার মধ্যে বিড়ালের পচা-গলা দেহ রেখে কুয়ার পানিকে দুর্গন্ধমুক্ত ও পবিত্র করার চেষ্টা করা আর পাপরত অবস্থায় তাওবাহ্ ও ইস্তিগফার করা প্রায় একই কথা। পাপে রত অবস্থায় তাওবাহ্ ও ইস্তিগফার করার কী মূল্য হতে পারে? মদ খেতে খেতে ‘তাওবা-তাওবা’ বললে, ব্যভিচারে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ‘আস্তাগফিরুল্লাহ-আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়লে কী লাভ হতে পারে? তাই আগে পাপ বর্জন করতে হবে, তারপর তাওবাহ্ করতে হবে। তবেই সেই তাওবাহ্ কবূল হবে। নয়তো তা হবে পন্ডশ্রম। তবে ইস্তিগফার সবসময়ই করতে থাকতে হবে।
.
(৪).ভবিষ্যতে এই গুনাহ আর না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে: খাঁটি তাওবাহ্ করার জন্য কৃত গুনাহর জন্য লজ্জিত হয়ে গুনাহ বর্জন করলেই হবে না। ভবিষ্যতে আর এই গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। যদি তাওবাহ্ করার সময় মনে মনে নিয়ত থাকে যে সুযোগ পেলে আবার ঐ গুনাহর কাজ করবো তাহলে সেই তাওবার কোন গুরুত্ব আল্লাহর কাছে নেই। সেই তাওবাহ্ কোন তাওবাই নয়। যেমন কোন ব্যক্তি অঢেল অর্থ-সম্পত্তির মালিক। এমতাবস্থায় সে ক্ষমতাধর নারী নিয়ে যেনা-ব্যভিচার করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বিদেশ গেলো। হঠাৎ কোন এক কারণে তার অর্থ-সম্পদ শেষ হয়ে সে নিঃস্ব হয়ে পড়লো। তখন সে তাওবাহ্ করতে লাগলো। অথচ তার মনে আকাঙ্খা আছে যে, সে যদি আবার অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পারে তাহলে সে আবার যেনা করবে। মদ পান করবে। তাহলে তার এই তাওবাহ্ আল্লাহর নিকট কবূল হবে না। তার তাওবাহ্ হচ্ছে অপারগের তাওবাহ্। কোন পাপ কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে তা থেকে তাওবাহ্ করলে তা তাওবাহ্ হয় না। তবে যৌবন বয়সে করা পাপের তাওবাহ্ বৃদ্ধকালে করলে আশা করা যায় আল্লাহ কবূল করবেন। কারণ সে হয়তো যৌবনকালে বুঝতে পারেনি। বৃদ্ধকালে নিজের অপরাধের কথা বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে তাওবাহ্ করলে সেই তাওবাও আল্লাহ কবূল করবেন, ইনশা-আল্লা-হ।তবে কখনো কখনো পাপ পুনরায় না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যদি আবার তা করে ফেলে, তাহলে বলা যাবে না যে, পাপীর আগের তাওবাহ্ কবূল হয়নি, তা বাতিল হয়ে গেছে। কারও আগের তাওবাহ্ কবূল হওয়ার পরও সে আবার পাপে লিপ্ত হতে পারে। তখন সে আবার তাওবাহ্ করবে। ভবিষ্যতে পাপ না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও যদি অনিচ্ছা সত্ত্বে বারবার সে পাপে লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে সে বারবারই তাওবাহ্ করবে। তবে মনে রাখতে হবে পাপী ব্যক্তি কোন অবস্থায় সেই পাপে লিপ্ত হয়েছে তা কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা জানেন। তাই আল্লাহকে ফাঁকি দিয়ে তাওবাহ্ করা যায় না। সাধারণভাবে কেউ যদি অনিচ্ছকৃত বা না জেনে গুনাহ করে আল্লাহর কাছে মাফ চায়, আবার গুনাহ করে মাফ চায় আল্লাহ ক্ষমা করবেন। সে কথাই নাবী (ﷺ) হাদীসে কুদসীতে বর্ণনা করেন।তিনি বলেন:”কোন বান্দা একটি পাপ করে বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার পাপ ক্ষমা কর।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা একটি পাপ করেছে, অতঃপর সে জেনেছে যে, তার একজন রব আছেন, যিনি পাপ ক্ষমা করেন অথবা তা দিয়ে পাকড়াও করেন।’ অতঃপর সে আবার পাপ করল এবং বলল, ‘হে আমার রব! তুমি আমার পাপ ক্ষমা কর।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা একটি পাপ করেছে, অতঃপর সে জেনেছে যে, তার একজন রব আছেন, যিনি পাপ ক্ষমা করেন অথবা তা দিয়ে পাকড়াও করেন।’ আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করলাম। সুতরাং সে যা ইচ্ছা করুক।’’(সহীহুল বুখারী হা/ ৭৫০৭; সহীহ মুসলিম হা/৭১৬২) এই হাদীসে “সে যা ইচ্ছা করুক’ কথার অর্থ হল, সে যখন এরূপ করে; অর্থাৎ পাপ করে সাথে সাথে তাওবাহ্ করে এবং আমি তাকে মাফ করে দেই, তখন সে যা ইচ্ছা করুক, তার কোন চিন্তা নেই। যেহেতু তাওবাহ্ পূর্বকৃত পাপ মোচন করে দেয়। অবশ্য একই পাপ জেনেশুনে বারবার করলে অথবা তাওবার সময় পাপ বর্জনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা না করলে সে ক্ষমার যোগ্য নাও হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেছেন, আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজেদের প্রতি যুল্ম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তারা তার পুনরাবৃত্তি করে না।’’(সূরা আলে ইমরান: ১৩৫) তাই, আসল তাওবাহ্ হলো আল্লাহকে ফাঁকি না দিয়ে, আন্তরিক অনুতাপে ভবিষ্যতে পাপ না করার প্রতিজ্ঞা করে গুনাহ ছেড়ে দেওয়া। আর তাওবাহ্ করেও যদি আবার পাপ হয়ে যায়, তবে আলস্য না করে আবার তাওবাহ্ করতে হবে।কোন অবস্থাতেই গুনাহর উপর অটল থাকা যাবে না। কারণ কেউ জানে না সে কখন মৃত্যুবরণ করবে, আদৌ সে তাওবার সুযোগ পাবে কিনা।
.
(৫).নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাওবাহ্ করতে হবে: তাওবাহ্ করার নির্ধারিত সময় আছে। আর তাওবার নির্ধারিত সময় দুই ধরনের: (এক). প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাওবার সর্বশেষ সময় হচ্ছে তার মৃত্যু। তাই মৃত্যু আসার আগেই তাওবাহ্ করতে হবে। (দুই).সকল মানুষের জন্য তাওবাহ্ করার সর্বশেষ সময় হচ্ছে ক্বিয়ামাতের আলামত হিসেবে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাই সাধারণভাবে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগেই তাওবাহ্ করতে হবে।মূলত পাপ করার পরক্ষণেই তাওবাহ্ করা উচিত। অনেকে শেষ জীবনে দাড়ি-চুল পাকলে পরে তাওবাহ্ করবেন বলে অপেক্ষায় থাকে, অবহেলা করে। কিন্তু হঠাৎ মৃত্যু এসে যাওয়ায় সে আর তাওবার সুযোগ পায় না।মহান আল্লাহ বলেছেন:‘নিশ্চয় তাদের তাওবাহ্ কবূল করা আল্লাহর দায়িত্ব যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করে। তারপর অনতিবিলম্বে তারা তাওবাহ্ করে। অতঃপর আল্লাহ এদের তাওবাহ্ কবূল করবেন আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, অতিপ্রজ্ঞাময়। আর তাওবাহ্ নেই তাদের, যারা অন্যায় কাজসমূহ করতে থাকে, অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু এসে যায়, তখন বলে, আমি এখন তাওবাহ্ করলাম; আর তাওবাহ্ তাদের জন্য নয়, যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়; আমরা এদের জন্যই তৈরী করেছি যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব।”(সূরা আন্ নিসা: ১৭-১৮) হাদিসে রাসূল ﷺ বলেছেন; “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবাহ্ সে পর্যন্ত কবূল করবেন, যে পর্যন্ত তার প্রাণ কণ্ঠাগত না হয় (অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে ঘ্যার ঘ্যার করা শুরু করে)।(মুসনাদ আহমাদ হা/৬১৬০; জামি‘ আত তিরমিযী হা/৩৫৩৭) পক্ষান্তরে, মহান আল্লাহর ‘আযাব দেখার পরে করা তাওবাও কোন উপকারে আসবে না। মৃত্যুর সময় ফির‘আওনের ঈমান তার কোন উপকার করেনি। সুতরাং কেউ আল্লাহর ‘আযাব গ্রাস করার মুহূর্তে তাওবাহ্ করলে তা তার কোন উপকারে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন; তারপর তারা যখন আমার ‘আযাব দেখল তখন বলল, ‘আমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম, আর যাদেরকে আমরা তার সাথে শরীক করতাম তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম’। সুতরাং তারা যখন আমার ‘আযাব দেখল তখন তাদের ঈমান তাদের কোন উপকার করল না। এটা আল্লাহর বিধান, তাঁর বান্দাদের মধ্যে চলে আসছে। আর তখনই ঐ ক্ষেত্রে কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’’(সূরা আল মু’মিন/গাফির ৪০: ৮৪-৮৫) তাই মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হওয়ার বা পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বেই গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে হবে। আগামীকাল নয়, আজই এখনই তাওবাহ্ করতে হবে।
.
(৬).মানুষের অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে: যদি কোন গুনাহর সম্পর্ক কোন মানুষের অধিকারের সাথে হয়, তাহলে যার অধিকার নষ্ট হয়েছে, তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা ক্ষমা চেয়ে তার সাথে মিটমাট করে নিতে হবে। যদি অবৈধ পন্থায় কারো মাল বা অন্য কিছু গ্রহণ-হরণ করে থাকে, তাহলে তা মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। আর যদি কারো উপর মিথ্যা অপবাদ দেয় অথবা অনুরূপ কোনো দোষ করে থাকে, তাহলে জমহুর ওলামাদের মতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে শাস্তি নিতে নিজেকে পেশ করতে হবে অথবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যার প্রতি যুল্ম করা হয়েছে, তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে গিয়ে বলতে হবে, ভাই/বোন! আমি আপনার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছি বা আপনার গীবত করে আপনার সম্মান নষ্ট করেছি বা যুলুম করেছি। এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে তাওবাহ্ করছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। এভাবে যত মানুষের সাথে সম্পৃক্ত গুনাহ করেছে তত মানুষের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। তবে গীতের ক্ষেত্রে যার গীবত করা হয়েছিল তিনি যদি সেটা না জানেন তাহলে সরাসরি তার গিয়ে গীবতের কথা স্বীকার না করে বরং তার কল্যানের জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করা,তার ভাল গুনাবলি অন্যদের সামনে বলা অধিক উত্তম।আর যদি সেই ব্যক্তি মারা গিয়ে থাকে তাহলে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, অর্থ-সম্পদ হরণ করে থাকলে তা ঐ ব্যক্তির উত্তরাধিকারের নিকট পৌঁছে দিবে, তার পক্ষ থেকে দান-সদাক্বাহ্ করবে এবং নিজে বেশি বেশি করে সৎ কাজ/সাওয়াবের কাজ করে সাওয়াব বাড়িয়ে নেবে। কেননা ঐ যার অধিকার নষ্ট করেছে সে ব্যক্তি যদি জাহান্নামী হয় তাহলে সে ক্বিয়ামাতের মাঠে এই ব্যক্তির কাছে তার অধিকার ফেরত চাইতে পারে। তখন তাকে সাওয়াব দিয়ে প্রতিদান দিতে হবে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন: ‘‘যদি কোন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতি তার সম্ভ্রম বা অন্য কিছুতে কোন যুলুম ও অন্যায় করে থাকে, তাহলে সেদিন আসার পূর্বেই সে যেন আজই তার নিকট হতে (ক্ষমা চাওয়া অথবা প্রতিশোধ/পরিশোধ দেয়ার মাধ্যমে) নিজেকে মুক্ত করে নেয়; যে দিন (ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য) না দীনার হবে না দিরহাম, টাকা-পয়সা, মাল-ধন (সেদিন) যালেমের নেক ‘আমল থাকলে তার যুল্ম অনুপাতে নেকী তার নিকট থেকে কেটে নিয়ে (মাযলুমকে দেয়া) হবে। পক্ষান্তরে যদি যদি তার নেকি না থাকে (অথবা নিঃশেষ হয়ে যায়) তাহলে তার বাদীর (মাযলূমের) গুনাহ নিয়ে তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’’(সহীহুল বুখারী হা/২৪৪৯; জামি‘ আত তিরমিযী হা/২৪১৯) আর কেউ যদি কোন বান্দার হক নষ্ট করে কিন্তু যার হক নষ্ট করেছে শত চেষ্টা করেও তাওবাহ্ করার সময় তাকে খুঁজে না পায় বা তার কাছে পৌঁছতে না পারে তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তা‘আলা গুনাহকারীকে মাফ করবেন। ইন-শা-আল্লাহ। উল্লেখ্য যে, আল্লাহর হক নষ্ট করার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করার জন্য প্রথম ৫টি শর্ত যথেষ্ট। তবে আল্লাহর হকের মধ্যে কিছু হক আছে যা তাওবার মাধ্যমে মাফ হয় না সেগুলো কাযা আদায় করে হক পূরণ করতে হয়। যেমন, সলাত, সিয়াম ইত্যাদি। উপরে উল্লিখিত সকল সকল শর্ত পালন করে যে পাপী তাওবাহ্ করবে, তার তাওবাহ্ হবে খাঁটি তাওবাহ্। এই তাওবাই আল্লাহ চান এবং তিনি এই তাওবাই গ্রহণ করেন। বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী মা‘ইয বিন মালিক এর মত তাওবা। যার ব্যাপারে নাবী (ﷺ) বলেছিলেন :لَقَدْ تَابَ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ أُمَّةٍ لَوَسِعَتْهُمْ‘‘সে এমন তাওবাহ্ করেছে যে, যদি তা একটি জাতির মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হত, তাহলে সকলের জন্য তা যথেষ্ট হত।’’(সহীহ মুসলিম হা/৪৫২৭) বিশুদ্ধ তাওবার উদাহরণ স্বরূপ ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী জুহায়নাহ্ গোত্রের নারীটির তাওবার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যার ব্যাপারে রাসূল ﷺ বলেছেন :لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ سَبْعِينَ مِنْ أهْلِ المَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ‘‘এই মহিলাটি এমন বিশুদ্ধ তাওবাহ্ করেছে যদি তা মদীনার ৭০ জন লোকের মধ্যে বণ্টন করা হত তাহলে তা তাদের জন্য যথেষ্ট হত।’’(সহীহ মুসলিম হা/ ৪৫২৯) বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল, যার পরে গুপ্ত ও প্রকাশ্যভাবে ‘আমলে কোন প্রকার পাপের আচরণ থাকবে না। যে তাওবাহ্ তাওবাকারীকে বিলম্বে ও অবিলম্বে সাফল্য দান করে। বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল তাই, যার পরে তাওবাকারী বিগত অপরাধ জীবনের জন্য কান্না করে, পুনরায় সেই অপরাধ যেন ঘটে না যায় তার জন্য ভীত-আতঙ্কিত ও সতর্ক থাকে, অসৎসঙ্গীদের সংসর্গ বর্জন করে এবং সৎসঙ্গীদের সাহচর্য অবলম্বন করে। আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় পাপকর্ম থেকে হেফাজতে রাখুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।