বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর কুফু সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: কুফু অর্থ কি? বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর ‘কুফু’ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। অতঃপর আরবি (كُفُو) ‘কুফু’ শব্দের অর্থ সমান, সমতা, সাদৃশ্য, সমকক্ষতা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় বর-কনের দ্বীন-দুনিয়ার যাবতীয় কিছুতে সমান সমান বা কাছাকাছি হওয়াকে “কুফু” বলে। অথবা বিয়ের ক্ষেত্রে বর ও কনের মধ্যে দ্বীনদারিতা, সামাজিক মর্যাদা, আচার-আচরণ, নৈতিকতা, সম্পদ, বংশগৌরব ও ব্যক্তিগত রুচিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সামঞ্জস্য বা সমতা।বিয়ের ক্ষেত্রে “কুফু” একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:تَخَيَّرُوا لِنُطَفِكُمْ وَانْكِحُوا الْأَكْفَاءَ وَأَنْكِحُوا إِلَيْهِمْ“তোমরা ভবিষ্যত বংশধরদের স্বার্থে উত্তম নারী গ্রহণ করো এবং ‘কুফু’ বিবেচনায় বিবাহ করো, আর বিবাহ দিতেও ‘কুফুর’ প্রতি লক্ষ্য রাখো।’’(ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৯৬৮; হাদিসটি বিশুদ্ধ)
.
▪️বিয়ের ক্ষেত্রে কুফু (সামঞ্জস্যতা) রক্ষা করা কেন জরুরি?
.
বিবাহের ক্ষেত্রে “কুফু” বা সামঞ্জস্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, সুখী, সুন্দর ও মধুর দাম্পত্য জীবনের অন্যতম শর্ত হলো পাত্র-পাত্রীর মধ্যে চারিত্রিক, ধর্মীয় ও মানসিক দিক থেকে সামঞ্জস্যতা বা কুফু বিদ্যমান থাকা। কারণ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, বিপরীত চরিত্রের নারী-পুরুষ একত্রে বসবাস করলেও দাম্পত্যজীবনে প্রকৃত শান্তি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা হতে পারে না।যেমন, একজন মুত্তাকী, পরহেযগার ও নেককার ব্যক্তি (নারী পুরুষ) যদি কোনো ব্যভিচারী, চরিত্রহীন ও দুরাচারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহলে তাদের মাঝে পারস্পরিক সম্মান, ভালোবাসা ও বোঝাপড়া গড়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে।আর পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা এই বিষয়ে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন:اَلزَّانِیۡ لَا یَنۡکِحُ اِلَّا زَانِیَۃً اَوۡ مُشۡرِکَۃً ۫ وَّ الزَّانِیَۃُ لَا یَنۡکِحُہَاۤ اِلَّا زَانٍ اَوۡ مُشۡرِکٌ ۚ وَ حُرِّمَ ذٰلِکَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ”ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক নারীকেই বিবাহ করে, আর ব্যভিচারিণী নারীকে বিবাহ করে কেবল ব্যভিচারী বা মুশরিক পুরুষ। এটি মুমিনদের জন্য হারাম করা হয়েছে।”(সূরা আন-নূর: ৩) এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, নেককার ও চরিত্রবান মুমিন ব্যক্তি কখনোই ব্যভিচারী ও পথভ্রষ্ট ব্যক্তির সমকক্ষ হতে পারে না; এবং দাম্পত্যজীবনে তাদের মধ্যে ‘কুফু’ বা সামঞ্জস্যতা থাকে না। অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:اَفَمَنۡ کَانَ مُؤۡمِنًا کَمَنۡ کَانَ فَاسِقًا ؕؔ لَا یَسۡتَوٗنَ”যে ব্যক্তি ঈমানদার, সে কি ফাসিকের মত হতে পারে? তারা কখনো সমান নয়।”(সূরা আস-সাজদাহ: ১৮) এই আয়াতগুলো আমাদেরকে দাম্পত্য জীবনের জন্য উপযুক্ত জীবনসঙ্গী বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে, যার মধ্যে দ্বীন, চরিত্র ও শালীনতার অনুপম গুণাবলি বিদ্যমান। কারণ ভালোবাসা, শান্তি ও সুখ তখনই টেকসই হয়,যখন দু’জন মানুষের মধ্যে অন্তরের ও চারিত্রিক সামঞ্জস্য থাকে।
.
তাছাড়া একজন ধার্মিক ও পরহেযগার নারী-পুরুষ এবং একজন গুনাহগার ও অবাধ্য নারী পুরুষের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনা ও জীবনধারায় বিপুল ফারাক থাকে যা সংসার জীবনে সংঘাত ও অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বীনদারির উপস্থিতি থাকলে বংশমর্যাদা, সামাজিক অবস্থান কিংবা অন্যান্য পার্থিব ব্যবধান ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়া যায়। তবে এর অর্থ এই নয় যে বংশমর্যাদা বা সামাজিক সামঞ্জস্যের বিষয়গুলো একেবারে অপ্রাসঙ্গিক। বরং আজকের সময়ে প্রকৃত দ্বীনদার মানুষের অভাব এতটাই প্রকট যে, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় রাখতে এসব বিষয়ও পরিমিত গুরুত্বের দাবিদার। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে দ্বীন ও চরিত্রের বিশুদ্ধতা। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা দরকার “কুফু” বা উপযুক্ততা বিবাহ বৈধ হওয়া বা না হওয়ার শর্ত নয়; বরং এটি একটি উত্তম ও পরামর্শযোগ্য দিক মাত্র। কুফুর শর্ত পূর্ণ না হলেও বিয়ে শরীয়তে দৃষ্টিতে বৈধ। তবে অনেক সময় কুফুর প্রতি অমনোযোগিতা মানুষকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, একজন কুরআনের হাফিজা ও পরহেযগার নারীর বিয়ে যদি এমন একজন পুরুষের সঙ্গে হয়, যে দাড়ি কামাতে অভ্যস্ত, হারাম উপার্জনে লিপ্ত এবং ইসলামের নির্দেশাবলিকে তুচ্ছজ্ঞান করে তাহলে সেই নারীকে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। হয়তো তাকে বলা হবে আধুনিক পোশাক পরতে, গান-বাজনায় অংশ নিতে বা ইসলামী জীবনদর্শন থেকে সরে আসতে।অন্যদিকে, কোনো ধর্মভীরু পুরুষ যদি এমন কোনো নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, যে তার দ্বীনদারিতে বাধা দেয়, হারাম পথে উপার্জনের জন্য তাকে প্ররোচিত করে, বা মা-বাবার হক আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে সেই সংসার হবে পাপ, কলহ ও অন্তরজ্বালায় পূর্ণ এক ঘোর অন্ধকার। এই কারণেই বিবাহের পূর্বে দ্বীন, চরিত্র, চিন্তাধারা, জীবনদর্শন ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে সামঞ্জস্যতা তথা কুফুর বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করা একান্ত প্রয়োজন। নচেৎ পারিবারিক সুখ-শান্তি ও দ্বীনি স্থিরতার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।
.
▪️পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে কোন কোন ক্ষেত্রে কুফু বিবেচনা করতে হবে?
.
শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে বিয়েতে বংশীয় কুফুর গুরুত্ব সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে।অধিকাংশ আলেমগন চারটি বিষয়কে কুফুর অন্তর্ভূক্ত বলেছেন। সেগুলো হলো: দ্বীনদারি, স্বাধীন হওয়া (ক্রীতদাস না হওয়া), বংশমর্যাদা এবং পেশা। তাঁদের মতে, অতি উচ্চ বংশের কারও সাথে একদম নিচু বংশের কারও বিবাহ দেওয়া উচিত নয়। এমনকি সাহাবীগণের মাঝেও এসব কারণে অমিল হয়েছে (তবে সেটি কিছু সাহাবীর ক্ষেত্রে হয়েছে)। যেমন: নবীজির মুক্ত দাস যায়েদ (রা.)-এর সাথে কুরাইশ বংশের রমণী যাইনাব (রা.)-এর বিবাহ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ তাঁদের রুচি ভিন্ন ভিন্ন ছিলো।
.
পক্ষান্তরে আলেমদের অন্যদল প্রথম মতের বিরোধিতা করে বলেছেন যে,কুফু হবে দ্বীনদারিতার ক্ষেত্রে অর্থাৎ দ্বীনি কুফু ছাড়া কোন কুফু নেই। এই মতের অনুসারীগণ হলেন প্রখ্যাত সাহাবী উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু), ইবনু মাসঊদ (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা), মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন, উমার ইবনু আব্দুল আযীয, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ,শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইবনু ক্বাইয়িম (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখ। দলিলের আলোকে এই মতটিই সবচেয়ে বিশুদ্ধ। ইতিহাসে সেরা তিনজন ধনী সাহাবির একজন কুরাইশ বংশের আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.)-এর বোনকে নবিজি বিয়ে দেন দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া বিলাল (রা.)-এর সাথে। এমন অসম বিবাহের ঘটনা সাহাবিগণের মাঝে অনেক ছিলো। মূল বিষয় হলো: দ্বীনদারি ঠিক থাকলে অন্য কিছু সেভাবে ম্যাটার করে না। অল্প কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটে। সেজন্য নবিজি দ্বীনদারিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। হাদীসে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘‘তোমরা যে ছেলের দ্বীনদারি ও চরিত্রের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারবে, সে যদি প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার কাছে (তোমাদের মেয়েকে) বিয়ে দিয়ে দাও। যদি তা না করো, তবে পৃথিবীতে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি হবে।’’ সাহাবীগণ বলেন, ‘যদি তার মাঝে কিছু ত্রুটি থাকে?’ নবীজি তখন আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করেন। (ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ১০৮৫; হাদিসটি হাসান সহিহ) অপর বর্ননায় এসেছে বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘‘মনে রেখো! আরবের ওপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং অনারবের ওপরও কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং কোনো শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা যায় কেবল তাকওয়া তথা আল্লাহ-ভীতির মাধ্যমে।’’ [ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৩৪৮৯; হাদিসটি সহিহ]
.
তাছাড়া বংশীয় সমতার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না। বরং এর বিপরীতে এমন অনেক ঘটনা ও রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল (ﷺ) ও সাহাবীদের যুগে বংশীয় সমতা লক্ষণীয় বিষয় ছিল না। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) (১৯৪-২৫৬ হি./৮১০-৮৭০ খ্রি.) তাঁর ছহীহুল বুখারীতে بَابُ الْأَكْفَاءِ فِى الدِّيْنِ ‘স্বামী ও স্ত্রী একই দ্বীনভুক্ত হওয়া’ শীর্ষক শিরোনাম নির্ধারণ করেছেন। সেখানে তিনি চারটি হাদীছ উপস্থাপন করে প্রমাণ করেছেন যে, বংশীয় সমতা গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং তাক্বওয়া, দ্বীনদারিতাই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,”আবূ হুযাইফাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইবনু উতবাহ ইবনু রাবি‘আ ইব‌নু আবদে শামস, যিনি বদ‌রের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ‌ (ﷺ)-এর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, তিনি সালিমকে পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন এবং তার সঙ্গে তিনি তাঁর ভাতিজী ওয়ালীদ ইব‌নু উতবাহ ইবনু রাবি‘আর কন্যা হিন্দাকে বিয়ে দেন। সে ছিল এক আনছারী মহিলার আযাদকৃত দাস”।(সহীহ বুখারী, হা/৫০৮৮) আবার মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সহধর্মিণী ছিলেন যুবা‘আহ বিনতে যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহা)। অথচ তিনি ছিলেন অভিজাত বংশের সম্ভ্রান্ত মেয়ে।(সহীহ বুখারী, হা/৫০৮৯) এমনকি দারিদ্র্যতা কুফুর ক্ষেত্রে বাধা তাও ঠিক নয়। যেমন সাহল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,”এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ‌ (ﷺ)-এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল। তখন তিনি (সাহাবীবর্গকে) বললেন, তোমাদের এর সম্পর্কে কী ধারণা? তারা উত্তর দিলেন, যদি কোথাও কোন মহিলার প্রতি এ লোকটি বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তার সঙ্গে বিয়ে দেয়া যায়। যদি সে সুপারিশ করে, তাহলে সুপারিশ গ্রহণ করা হয়, যদি কথা বলে, তবে তা শোনা হয়। রাবী বলেন, অতঃপর নবী করীম (ﷺ) চুপ করে থাকলেন। এরপর সেখান দিয়ে একজন গরীব মুসলিম অতিক্রম করতেই রাসূলুল্লাহ‌ (ﷺ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা? তারা জবাব দিলেন, যদি এ ব্যক্তি কোথাও বিয়ের প্রস্তাব করে, তার সাথে বিয়ে দেয়া হয় না। যদি কারও জন্য সুপারিশ করে, তবে তা গ্রহণ করা হয় না। যদি কোন কথা বলে, তবে তা শোনা হয় না। তখন রাসূলুল্লাহ‌ (ﷺ) বললেন, দুনিয়া ভর্তি ঐ ধনীদের চেয়ে এ দরিদ্র লোকটি উত্তম”।(সহীহ বুখারী, হা/৫০৯১)
.
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ)-সহ অনেক আলিম কেবল দ্বীনদারির ক্ষেত্রে বর-কনের মাঝে সমতাবিধানকে জরুরি বলেছেন। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] কুফু সম্পর্কে বলেন, وَعِفَّةٌ فَلَيْسَ فَاسِقٌ كُفْءَ عَفِيْفَةٍ ‘চারিত্রিক নিষ্কলুষতার সাথে নাফরমানীর কোন কুফু নেই”(যাকারিয়া মুহাম্মাদ ইবনু যাকারিয়া আল-আনছারী আশ-শাফেঈ, মাবহাজুত তুল্লাবি ফী ফিক্বহি ইমাম আশ-শাফেঈ পৃষ্ঠা: ১৮৩) কুফুর আলোচনায় অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, وَالْمُبْتَدِعُ مَعَ السُّنِّيَّةِ كَالْفَاسِقِ مَعَ الْعَفِيْفَةِ ‘চারিত্রিক নিষ্কলুষতার সাথে নাফরমানীর যেমন কোন কুফু নেই। অনুরূপভাবে সুন্নাহপন্থীদের সাথে বিদ‘আতীদের কোন কুফু নেই”( মুগনীউল মুহতাজ, ৩য় খণ্ড; পৃষ্ঠা: ১৬৬) ইমাম ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৬২০ হি.] বলেন,والكفء ذو الدين والمنصب “কুফু হল দ্বীন ও সম্মান-মর্যাদার’।(মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল হাওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খণ্ড; পৃষ্ঠা: ৩৮৫)
.
আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ,আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা,(রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] তাঁর বিখ্যাত ‘যাদুল মা‘আদ’ গ্রন্থে الكفاءة في النكاح ‘বিবাহের ক্ষেত্রে সমতা’ এর বিধানাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, বিবাহের ক্ষেত্রে দ্বীনই মূলত কুফু বা সমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং দ্বীনদারিতার উপর ভিত্তি করে মুসলিম নারী-পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। কেননা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাপন্থী যদি বিদ‘আতী কোন ছেলে বা মেয়ের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়, তাহলে দ্বীন মানার ক্ষেত্রে উভয়ের মাঝে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে। যা পারিবারিক সুখ-শান্তি ও দাম্পত্যময় জীবনের জন্য চরম অন্তরায়। অনুরূপভাবে দ্বীন মানার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হবে। মূলত তাক্বওয়া, পরহেযগারিতা তথা দ্বীনদারিতাই হলো বিবাহের ক্ষেত্রে কুফু বা সমতা। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত দলীলগুলো উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ.”হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহ‌র নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ‌ সবকিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন’ (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (সূরা আল-হুজুরাত: ১০)। তিনি আরো বলেন, وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتُ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ‘মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু’ (সূরা আত-তাওবাহ: ৭১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, فَاسۡتَجَابَ لَہُمۡ رَبُّہُمۡ اَنِّیۡ لَاۤ اُضِیۡعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِّنۡکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی ۚ بَعۡضُکُمۡ مِّنۡۢ بَعۡضٍ ‘অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে কর্মনিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না; তোমরা একে অপরের অংশ’ (সূরা আলে ‘ইমরান: ১৯৫)। হাদীছে এসেছে,لَا فَضْلَ لِعَرَبِىٍّ عَلَى أَعْجَمِىٍّ وَلَا لِعَجَمِىٍّ عَلَى عَرَبِىٍّ وَلَا لأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ إِلَّا بِالتَّقْوَى اَلنَّاسُ مِنْ آدَمَ وَآدَمَ مِنْ تُرَابٍ.”আযমীদের উপর আরবীদের কোন মর্যাদা নেই। আরবীদের উপর আযমীদেরও কোন মর্যাদা নেই। কালোর উপর লালের এবং লালের উপর কালোর কোন মর্যাদা নেই, তাক্বওয়া ব্যতীত। মানুষ আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে” (আলী ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিল ঈয আল-হানাফী, শারহুল আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়্যাহ, তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ২য় সংস্করণ, ১৪১৪ হি.), হা/৪০৬) অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আবূ হাতিম আল-মুযানী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِيْنَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوْهُ إِلَّا تَفْعَلُوْا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِى الْأَرْضِ وَفَسَادٌ.”তোমরা যে লোকের দ্বীনদারী ও নৈতিক চরিত্র দ্বারা সন্তুষ্ট আছ, তোমাদের নিকট যদি সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তবে তার সাথে (তোমাদের পাত্রীর) বিয়ে দাও। তা না করলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে”(তিরমিযী, হা/১০৮৫, সনদ হাসান) আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ‘ইবাদ (বৈরূত: মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৭শ সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ৫ম খণ্ড; পৃষ্ঠা: ১৫৯-১৬০ শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ, ফাতাওয়া সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৬৫৫১০)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! বিবাহের ক্ষেত্রে যেখানে ছেলে-মেয়ের দ্বীনদারিতাই মূলত কুফু। সেখানে আক্বীদার বিষয়টি আরো জোরালোভাবে মূল্যায়ন করা কর্তব্য। কারণ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পথের একজন মেয়ের সাথে বিদ‘আতপন্থী কোনো ছেলের বিয়ে হলে, তা দাম্পত্য জীবনে দ্বীনী সংঘাত, অন্তরদ্বন্দ্ব ও কলহ সৃষ্টি করবে।সহীহ আক্বীদা ও আমলের পরিবেশ নষ্ট হবে, সন্তানরাও সঠিক দীন থেকে বঞ্চিত হবে। এমন সম্পর্ক হৃদয়কে বিদ‘আতের গন্ধে ব্যাধিগ্রস্ত করে দেয় এবং আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই বিবাহে অবশ্যই সুদৃঢ় আক্বীদা ও সহীহ মানহাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।প্রখ্যাত তাবি‘ তাবি‘ঈ, আহলুস সুন্নাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘আলিম, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ফুদ্বাইল বিন ‘ইয়াদ্ব (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৮৭ হি.] বলেছেন,مَنْ أَحَبَّ صَاحِبَ بِدْعَةٍ أَحْبَطَ اللهُ عَمَلَهُ وَأَخْرَجَ نُوْرَ الْإِسْلَامِ مِنْ قَلْبِهِ، وَمَنْ زَوَّجَ كَرِيْمَتَهُ مِنْ مُبْتَدِعٍ فَقَدْ قَطَعَ رَحِمَهَا، وَمَنْ جَلَسَ مَعَ صَاحِبِ بِدْعَةٍ لَمْ يُعْطَ الْحِكْمَةَ، وَإِذَا عَلِمَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ رَجُلٍ أَنَّهُ مُبْغِضٌ لِصَاحِبِ بِدْعَةٍ رَجَوْتُ أَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَهُ.”যে ব্যক্তি বিদ‘আতীকে ভালোবাসে আল্লাহ তা‘আলা তার আমলকে ধ্বংস করে দেন এবং তার অন্তর থেকে ইসলামের জ্যোতিকে বের করে দেন। আর যে কোন বিদ‘আতীর কন্যাকে বিবাহ করে তার প্রতি রহম বা আল্লাহর দয়া কেটে যায়। যে বিদ‘আতীর সাথে উপবেশন করে তাকে হেকমত বা প্রজ্ঞা দান করা হয় না। আর আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন ব্যক্তির ব্যাপারে জানেন যে, সে বিদ‘আতীর সাথে বিদ্বেষপরায়ণ, আমি আশা করি আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিবেন”।(আল-জামিঊ লি আহকামিল কুরআন, ৭ম খন্ড; পৃষ্ঠা: ১৩) বিদ‘আতীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত;১৭৯ হি.] বলেন, لَا يُنْكَحُ أَهْلُ الْبِدَعِ وَلَا يُنْكَحُ إلَيْهِمْ وَلَا يُسَلَّمُ عَلَيْهِمْ وَلَا يُصَلَّى خَلْفَهُمْ وَلَا تُشْهَدُ جَنَائِزُهُمْ ‘বিদ‘আতীকে বিয়ে করা যাবে না। তাদের সাথে কাউকে বিয়ে দেয়া যাবে না, তাদেরকে সালাম দেয়া যাবে না, তাদের পিছনে ছালাত আদায় করা যাবে না এবং তাদের জানাযায় অংশগ্রহণ করবে না”।(মালিক ইবনু আনাস, আল-মুদাওয়ানাতু (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.); ১ম খণ্ড; পৃষ্ঠা: ১৭৭) ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, مَنْ لَمْ يَرْبَعْ بِعَلِّي ابْنِ أَبِي الطَّالِبِ فِي الخِلَافَةِ فَلَا تُكَلِّمُوْهُ وَلَا تَنَاكِحُوُهْ ‘যারা আলী ইবনু আবী তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফতকালে তাঁর সাথে থাকেনি তার সাথে তোমরা কথা বলবে না এবং তার সাথে বিবাহ করবে না”।(আবুল হুসাইন ইবনু আবূ ই‘আলা, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ, ত্বাবাক্বাতুল হানাবালাহ (বৈরূত: দারুল মা‘আরিফাহ, তাবি), ১ম খণ্ড; পৃষ্ঠা: ৪৫)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Share: