প্রশ্ন: সালাতে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআতের সিজদাহ থেকে কিভাবে দাঁড়াতে হবে? একটি দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা।
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। অতঃপর সিজদা থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ রাকাআতে উঠে দাঁড়ানোর পদ্ধতি কেমন হবে? এই বিষয়ে আহালুল আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এই বিষয়ে দুটি মত রয়েছে।

.
এই দলীলগুলো থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়: প্রথমত: এখানে বর্ণনা করা হয়েছে যে ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) পায়ের আঙুলের গোড়ালির উপর ভর দিয়ে উঠে যেতেন অর্থাৎ, তিনি উঠার সময় জমিনে হাত দিয়ে ভর দিতেন না। দ্বিতীয়ত: হাতের তুলনায় হাঁটু আগে তুলে উঠা মানুষের স্বাভাবিক নড়াচড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ যখন একজন মানুষ মাটি থেকে উঠে, তখন শরীরের উপরের অংশ আগে উঠে এবং তারপর নিচের অংশ উঠে। তৃতীয়ত: হাতের আগে হাঁটু তুলে ওঠা পদ্ধতি উটের ওঠার পদ্ধতির থেকে ভিন্ন, কারণ উট উঠার সময় প্রথমে দুই পা তোলে আর তার হাত বা পায়ের সামনে অংশ মাটিতে থাকে।এবং এটি সেই পদ্ধতি, যার থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে বিরত রেখেছেন এবং যা থেকে তিনি নিষেধ করেছেন।
.

.

.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল: আমি মুগনিল মুহতাজ ইলা মা‘রিফাতি মা‘আনি আলফায আল-মিনহাজ কিতাবে (যা শাইখ মুহাম্মাদ আশ-শারবীনী রচিত) একটি হাদীস পড়েছি যেখানে ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায থেকে উঠার সময় তাঁর হাত জমিনে এমনভাবে রাখতেন যেভাবে আটার মাখুনে (অর্থাৎ হাতের তালু ও আঙুল ভাঁজ করে) রাখে। এই হাদীসের সনদ কতটুকু সহীহ? এবং এর অর্থ কী? আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।”
তিনি উত্তরে বলেন:المعروف أنه ليس بصحيح، والإنسان يعتمد كيف شاء على يديه على بطونها، أو على ظهورها، يعتمد حيث شاء، هذا هو الأصل، وإذا اعتمد على ركبتيه إذا كان قويًا نشيطًا فهو أفضل، وإن احتاج للأرض اعتمد على الأرض ببطون يديه، أو بظهور أصابعه، كل ذلك لا حرج فيه، والحمد لله، الأمر في هذا واسع، وأما كونه على صفة العاجن فليس عليه دليل صحيح.”বিশ্বস্ত মত অনুযায়ী, এই হাদীসটি সহীহ নয়। মানুষ চাইলেই যেভাবে সুবিধা হয়, সেভাবেই (সালাত থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময়) হাত ব্যবহার করে ভর নিতে পারে হাতের তালুতে ভর দিয়ে হোক, কিংবা হাতের পিঠে ভর দিয়ে হোক, যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে ভর নিতে পারে। এটাই মূলনীতি। আর যদি কেউ শক্তিশালী ও সক্রিয় হয়, তাহলে হাঁটুর উপর ভর করে উঠা উত্তম। আর যদি মাটির উপর ভর নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে হাতের তালুর উপর ভর দিয়ে উঠা বা আঙ্গুলের পিঠে ভর দিয়ে উঠা সবই বৈধ। আলহামদুলিল্লাহ, এ ব্যাপারে শরীয়তে প্রশস্ততা আছে। আর “আটা মেখে এমনভাবে দাঁড়ানো” (يعني: صفة العاجن গুটিয়ে হাঁটু টেনে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ানো) এই রকম কায়দার পক্ষে কোন সহীহ দলিল নেই।”(বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-৯১৩৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে বলেন:
أن النبي صلى الله عليه وعلى آله وسلم ( كان إذا أراد أن يقوم اعتمد على يديه ) ولكن هل هو كصفة العاجن أم لا؟ هذا ينبني على صحة الحديث الوارد في ذلك، وقد أنكر النووي رحمه الله في المجموع صحة هذا الحديث، أي: أنه يقوم كالعاجن، وبعض المتأخرين صححه.وعلى كلٍ فالذي يظهر من حال النبي صلى الله عليه وعلى آله وسلم أنه يجلس، لأنه كبر وأخذه اللحم، فكان لا يستطيع النهوض تماماً من السجود إلى القيام، فكان يجلس ثم إذا أراد أن ينهض ويقوم اعتمد على يديه ليكون ذلك أسهل له، هذا هو الظاهر من حال النبي صلى الله عليه وعلى آله وسلم، ولهذا كان القول الراجح في هذه الجلسة -أعني: جلسة الاستراحة- التي يسميها العلماء جلسة الاستراحة أنه إن احتاج إليها لكبر أو ثقل أو مرض أو ألم في ركبتيه أو ما أشبه ذلك فليجلس، ثم إن احتاج إلى أن يعتمد عند القيام على يديه فليعتمد على أي صفة كانت، سواء اعتمد على ظهور الأصابع، يعني: جمع أصابعه هكذا واعتمد عليها أو على راحته، أو غير ذلك، المهم إذا احتاج إلى الاعتماد فليعتمد، وإن لم يحتج فلا يعت
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সেজদা থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইতেন, তখন তিনি তাঁর হাতের উপর ভর করে দাঁড়াতেন। কিন্তু তিনি এই ভরটি কীভাবে নিতেন তা কি আটার খামির মাখানো ব্যক্তির ভঙ্গিতে, অর্থাৎ হাতের আঙুলের পিঠে ভর দিয়ে, নাকি তালু দিয়ে এই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এ সংক্রান্ত যে হাদীসটি আছে, তার প্রামাণিকতা নির্ভরযোগ্য কি না, সে নিয়েও আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম নববী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর গ্রন্থ আল-মাজমু‘-তে এই হাদীসটির সহীহ হওয়া অস্বীকার করেছেন, অর্থাৎ তিনি একে সহীহ মনে করেননি। তবে পরবর্তী যুগের কিছু মুহাদ্দিস এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের বাস্তব অবস্থান ও বার্ধক্যকালীন অবস্থা থেকে ধারণা করা যায় যে, তিনি সেজদা থেকে সরাসরি না উঠে আগে বসতেন, এরপর দাঁড়ানোর সময় হাতের উপর ভর নিতেন যাতে দাঁড়ানো সহজ হয়। কারণ বয়স বৃদ্ধি, শরীর ভারী হয়ে যাওয়া ও দুর্বলতা এইরূপ কায়দার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে। এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই ফিকহবিদদের কাছে ‘জালসাতুল ইস্তিরাহা’ অর্থাৎ বিশ্রামের বসা বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, কেউ যদি বার্ধক্য, শরীরের ভার, হাঁটুর ব্যথা বা কোনো ধরনের অসুস্থতার কারণে সরাসরি দাঁড়াতে না পারেন, তাহলে তিনি বসে বিশ্রাম নিতে পারেন এবং প্রয়োজনে হাতের উপর ভর নিয়ে দাঁড়াতে পারেন তা হাতের তালু দিয়েই হোক, আঙুলের পিঠ দিয়েই হোক কিংবা অন্য কোনো উপায়ে। এতে কোনো সমস্যা নেই। মূল কথা হলো, শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো জায়েয। আর যদি সে প্রয়োজন না থাকে, তবে ভর না নিয়ে দাঁড়ানোতেও কোনো অসুবিধা নেই।”(ইবনু উসাইমীন, লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, সাক্ষাৎকার নং-৬৫)
.
অপরদিকে হানাবিলা (হাম্বলি মাজহাব) মতে,নামাজে দাঁড়ানোর সময় হাঁটুতে ভর দেওয়া উত্তম।হাত দিয়ে ভর দেওয়া তখনই জায়েয, যখন বৃদ্ধ, দুর্বল বা অসুস্থ হওয়ায় দাঁড়াতে কষ্ট হয়। হাফিয যাইনুদ্দীন আবুল ফারজ ‘আব্দুর রহমান বিন শিহাব যিনি ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী নামে প্রসিদ্ধ রাহিমাহুল্লাহ [জন্ম: ৭৩৬ হি. মৃত: ৭৯৫ হি:] বলেছেন:
وقد اختلف العلماء في القائم إلى الركعة الثانية من صلاة: كيف يقوم؟
فقالت طائفة: يعتمد بيديه على الأرض، كما في حديث مالك بن الحويرث هذا…
وهو قول مالك والشافعي وإسحاق.
وروي عن أحمد، أنه كان يفعله، وتأوله القاضي أبو يعلى وغيره على أنه فعله لعجز وكبر.
وقد روي عن كثير من السلف، أنه يعتمد على يديه في القيام إلى الركعة الثانية، منهم: عمر، وعبادة بن نسي، وعمر بن عبد العزيز، ومكحول، والزهري، وقال: هو سنة الصلاة -، وهو قول الاوزاعي وغيره، ورخص فيه قتادة…
والأكثرون على أنه لا تلازم بين الجلسة والاعتماد، فقد كان من السلف من يعتمد ولا يجلس للاستراحة، منهم: عبادة بن نسي، وحكاه عن أبي ريحانة الصحابي…
ولا يبعد إذا قلنا: إن جلسة الاستراحة فعلها تشريعا للأمة، أن يكون الاعتماد فعله كذلك “
“দ্বিতীয় রাকাআতে উঠার সময় কীভাবে উঠবে এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। একদল আলেম বলেছেন উঠার সময় মাটিতে দুই হাত রেখে ভর দিয়ে ওঠা উত্তম; যেমনটি সাহাবি মালিক ইবনু হুয়াইরিস (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ অভিমত ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম ইসহাক (রাহিমাহুমুল্লাহ)-এর। এমনকি ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পক্ষ থেকেও এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়, যদিও ক্বাযী আবু ইয়ালা ও অন্যান্য আলেমরা এটিকে বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার কারণে তাঁর ব্যক্তিগত আমল বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এছাড়া বহু সালাফ, সাহাবি ও তাবেঈন থেকেও বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা দ্বিতীয় রাকাআতে উঠার সময় হাত দিয়ে মাটিতে ভর দিতেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু), উবাদাহ ইবন নুসাই, উমর ইবনু আবদুল আজিজ, মাখুল এবং ইমাম যুহরী (রহিমাহুল্লাহ)। ইমাম যুহরী বলেন: “এটি সালাতের একটি সুন্নাহ।” এ মতের পক্ষেই ইমাম আওযায়ীসহ আরও অনেক আলেমের অভিমত রয়েছে। কাতাদা (রহিমাহুল্লাহ) এ বিষয়ে কিছুটা ছাড় দিয়েছেন। বেশিরভাগ আলেমের মতে, বসা এবং হাত দিয়ে ভর দেওয়া এই দুটি কাজের মধ্যে আবশ্যিক কোনো সম্পর্ক নেই। সালাফদের মধ্যে অনেকেই এমন ছিলেন যারা হাত দিয়ে ভর দিতেন কিন্তু বসতেন না। যেমন: উবাদাহ ইবনু নুসাই এবং তিনি সাহাবি আবু রাইহানা (রাযি.) সম্পর্কেও এমন বলেছেন…আর আমরা যদি বলি: বসা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য শরিয়তস্বরূপ আমল তাহলে বলা অসম্ভব নয় যে, হাতের উপর ভর দেওয়াও তেমনি শরিয়তস্বরূপ আমল ছিল।”―(ইবনু রজব আল-হাম্বালী, ফাতহুল বারী শারহু সাহীহিল বুখারী; খন্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ২৯১)
.
ইবনু বাত্তাল (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:
“اختلف العلماء في اعتماد الرجل على يديه عند القيام، فروى عن ابن عمر أنه كان يعتمد على يديه إذا أراد القيام، ويروى مثله عن مكحول، وعطاء، ومسروق، والحسن، وهو قول الشافعي، وأحمد.
ورأت طائفة أن لا يعتمد على يديه إلا أن يكون شيخا كبيرا أو مريضا، وروى ذلك عن على بن أبى طالب، وبه قال النخعي، والثوري، وكره الاعتماد ابن سيرين.
وقال الشافعي: كان عمر، وعلى وأصحاب رسول الله ينهضون في الصلاة على صدور أقدامهم، وعن ابن مسعود مثله”
“ইমামগণ ও ফিকহবিদগণ নামাজে সিজদা থেকে উঠার সময়—অর্থাৎ দাঁড়ানোর সময় হাতের ওপর ভর দেওয়ার বৈধতা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।ইবনু উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি দাঁড়াতে চাইলে নিজের হাতের উপর ভর দিতেন। অনুরূপভাবে মাকহুল, আতা, মাসরূক ও হাসান বসরি(রহিমাহুমুল্লাহ)-এর থেকেও একই ধরনের আমল বর্ণিত হয়েছে। এই অভিমত ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমদ (রহিমাহুমুল্লাহ)-এরও মতানুযায়ী। অন্যদিকে, আরেক দল আলেমের মতে যারা বলেন হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়; তবে বৃদ্ধ বা দুর্বল ব্যক্তি এর ব্যতিক্রম। এ মত আলী ইবনু আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, এবং নাখাঈ, সুফিয়ান সাওরি প্রমুখ আলেমগণ এ মতকে সমর্থন করেছেন। এমনকি ইবনু সীরিন (রহিমাহুল্লাহ) হাতের উপর ভর দিয়ে উঠা অপছন্দ করতেন।ইমাম শাফিঈ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: “উমর, আলী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক সাহাবী নামাজে সিজদা থেকে উঠার সময় পায়ের আঙুলের উপর ভর করে দাঁড়াতেন।” অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় ইবনু মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকেও।”(ইবনু বাত্তাল, শারহু সহীহুল বুখারী খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৪০)
.
ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে বলেন:
ينهض إلى القيام على صدور قدميه معتمدا على ركبتيه، ولا يعتمد على يديه. قال القاضي: لا يختلف قوله، أنه لا يعتمد على الأرض، سواء قلنا: يجلس للاستراحة أو لا يجلس. وقال مالك، والشافعي: السنة أن يعتمد على يديه في النهوض؛ لأن مالك بن الحويرث قال في صفة صلاة رسول الله – صلى الله عليه وسلم – ، إنه لما رفع رأسه من السجدة الثانية استوى قاعدا، ثم اعتمد على الأرض . رواه النسائي. ولأن ذلك أعون للمصلي. ولنا ما روى وائل بن حجر، قال: رأيت رسول الله – صلى الله عليه وسلم – إذا سجد وضع ركبتيه قبل يديه، وإذا نهض رفع يديه قبل ركبتيه رواه النسائي، والأثرم، وفي لفظ: وإذا نهض نهض على ركبتيه، واعتمد على فخذيه . وعن ابن عمر، قال: نهى رسول الله – صلى الله عليه وسلم – أن يعتمد الرجل على يديه إذا نهض في الصلاة . رواهما أبو داود، وقال علي كرم الله وجهه: إن من السنة في الصلاة المكتوبة، إذا نهض الرجل في الركعتين الأوليين، أن لا يعتمد بيديه على الأرض، إلا أن يكون شيخا كبيرا لا يستطيع . رواه الأثرم. وقال أحمد: بذلك جاء الأثر عن رسول الله – صلى الله عليه وسلم – وعن أبي هريرة، أن النبي – صلى الله عليه وسلم – كان في الصلاة ينهض على صدور قدميه . رواه الترمذي. وقال: يرويه خالد بن إلياس. قال أحمد: ترك الناس حديثه. ولأنه أشق فكان أفضل، كالتجافي والافتراش. وحديث مالك محمول على أنه كان من النبي – صلى الله عليه وسلم – لمشقة القيام عليه لضعفه وكبره، فإنه قال – عليه السلام -: إني قد بدنت، فلا تسبقوني بالركوع ولا بالسجود.
“সালাতে সিজদা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় তাকে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং হাঁটুর সাহায্যে দাঁড়াতে হবে; হাতের ওপর ভর দেওয়া উচিত নয়। কাযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এই বিষয়ে ইমামদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই যে, সালাত আদায়কারী মাটিতে হাত রাখবে না সে ‘ইসতিরাহা’ (বিশ্রামের জন্য বসা) করুক আর না-ই করুক। মালিক ও শাফেয়ি (রহিমাহুমাল্লাহ) বলেন: হাতের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো সুন্নত। কারণ, মালিক ইবনে হুয়াইরিস (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণনা করেছেন: “নবী ﷺ যখন তিনি প্রথম রাকআতে দ্বিতীয় সিজদা থেকে মাথা ওঠাতেন, তখন সোজা হয়ে বসতেন। তারপর মাটিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন।(এই হাদীস নাসাঈ হা/১১৫৩ বর্ণনা করেছেন)।কারণ এতে নামাজি সহজে দাঁড়াতে পারেন।
আমাদের দলিল হলো: ওয়াইল ইবনে হুজর (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দেখেছি, তিনি সিজদায় যাওয়ার সময় হাঁটু আগে রাখতেন এবং উঠার সময় হাত আগে উঠাতেন।” (এই হাদীস নাসাঈ ও আহমাদ বর্ণনা করেছেন)। অন্য এক বর্ণনায় আছে:”তিনি হাঁটু ব্যবহার করে উঠে দাঁড়াতেন এবং উরুর ওপর ভর দিতেন।”ইবনে উমর (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন:”নবী ﷺ নিষেধ করেছেন যে, সালাতে দাঁড়ানোর সময় পুরুষ যেন হাতে ভর না দেয়।”আলী (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন:”ফরজ সালাতে যখন কেউ দ্বিতীয় রাকাআতের পর দাঁড়াতে চায়, সে যেন হাতে ভর না দেয়; তবে যদি সে বৃদ্ধ হয়, তাহলে সে ব্যতিক্রম।”(এই বর্ণনাটি ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন।) ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এই মাসআলায় সাহাবিদের পক্ষ থেকে একাধিক হাদীস এসেছে। আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত আছে যে,”নবী ﷺ সালাতে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঠতেন।”(এই হাদীস তিরমিযী বর্ণনা করেছেন)। তবে হাদীসটির বর্ণনাকারী খালিদ ইবনে ইলিয়াস সম্পর্কে ইমাম আহমাদ বলেন: মানুষ তাঁর হাদিস বর্জন করেছে। কারণ, পায়ের ভর দিয়ে উঠা বেশি কষ্টকর, তাই তা উত্তম, যেমন সিজদায় শরীর খোলা রাখা। মালিক ইবনে হুয়াইরিসের বর্ণনাটি তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যদি ধরে নেওয়া হয় যে, নবী ﷺ বৃদ্ধ বা দুর্বলতার কারণে ভিন্নভাবে দাঁড়িয়েছেন, যেমন তিনি বলেছিলেন: আমি মোটা হয়ে গেছি, কাজেই তোমরা রুকু বা সিজদার সময় আমাকে অতিক্রম করো না (অগ্রাহ্য করো না)।”(ইবনু কুদামাহ আল মুগনী খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২১৫)
.

.
ইবনুস সালাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “এই (আজন) শব্দটি অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। কেউ কেউ শব্দটি ভুল করে “আ’জিয” (অক্ষম ব্যক্তি) পড়ে, আবার কেউ কেউ সঠিক উচ্চারণে “আজন” পড়লেও ভুলভাবে বুঝে নেয় যে, এটি আটা মাখানোর ভঙ্গি তখন তারা হাতের আঙুল মুঠো করে, একত্র করে ভর দেয় এবং হাতের তালু মাটি থেকে তুলে রাখে, যা আসলে সঠিক নয়। ইবনু রজব হাম্বলি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: কিছু আলেম ব্যাখ্যা করেছেন যে, এখানে ‘আজন’ বলতে বোঝানো হয়েছে বৃদ্ধ মানুষ যেভাবে দুই হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়; এটি রুটির খামির মাখানোর ভঙ্গি নয়। ফাতহুল বারী; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ২৯৩)
.
শায়খ আবু ফুরাইহান জামাল বিন ফুরাইহান আল-হারিসী বলেন:
“فعلى اختلاف تفسير أهل اللغة والحديث لمعنى “العَجْنُ فِي الصَّلَاةِ” ؛ يظهر لي والله أعلم أنه لا يُشدد في ذلك ولا يُشترط الالتزام والمواضبة على هيئة معينة في النهوض إلى الركعة معتمداً على اليدين سواء النهوض على أليتي الكف – أي : الكفّين منبسطة – أو مقبوضة أصابع كفية ومضمومة ، فالأمر واسع حتى يأتينا نصٌ مرفوع أو في حكم المرفوع يفسر لنا صفة “العجن في الصلاة” .
“যদিও আরবি ভাষাবিদ ও হাদিস বিশারদদের মধ্যে ‘নামাজে আজন (العَجْنُ في الصلاة)’ এর অর্থ নির্ধারণে মতভেদ রয়েছে, তবে আমার দৃষ্টিতে (আল্লাহই ভালো জানেন) এটি স্পষ্ট যে এ বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা উচিত নয়। নামাজে দাঁড়ানোর সময় হাতের ওপর ভর দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কায়দাকে আবশ্যক মনে করাও সঠিক নয় চাই তা হাত দুটি খোলা রেখে হোক, অথবা আঙুলগুলো মুঠো করে একত্রিত করে হোক। এই বিষয়টি উন্মুক্ত ও সহজসাধ্য, যতক্ষণ পর্যন্ত এমন কোনো সহিহ, স্পষ্ট মারফূ হাদিস পাওয়া না যায় যা সালাতে ‘আজন’ এর প্রকৃত রূপ নির্ধারণ করে দেয়। সুতরাং এ ধরনের বিষয় নামাজকে নষ্ট করে না; বরং ইমামদের মধ্যে যে মতভেদ রয়েছে, তা হলো সালাতে দাঁড়ানোর সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি কোনটি তা নির্ধারণ নিয়ে।”
.
শায়খ বকর আবু জাইদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
وقال الشيخ بكر أبو زيد: ” وصفة العجن بأن يقوم المصلي من ركعة إلى أخرى على هيئة العاجن، وهو أن يجمع يديه ويتكئ على ظهورهما عند القيام كحال من يعجن العجين. وهذه: هيئة أعجمية، ليست سنة شرعية…ثم العجن له صفتان في لغة العرب: المذكورة، والثانية ببسط الكفين على الأرض، كما هو معروف من حال النساء عند عجن العجين. ومتى كان التشبه بالنساء، أو العمل حال العجز سنة من سنن الهدى…. مع أن الحديث ضعيف لا تقوم به الحجة، وترك التسنن به “.
“সালাতে ‘আজন’ বলতে বোঝানো হয় রাকাআতের মধ্যে দাঁড়ানোর সময় এমনভাবে হাতের ওপর ভর দেওয়া, যেন কেউ আটা মাখাচ্ছে।অর্থাৎ, হাতগুলো মুঠো করে তার ওপর ভর দেওয়া। এই ভঙ্গি আরবের ঐতিহ্যে নেই; বরং এটি আজমী (বিদেশী) রীতির অংশ, এটা কোনো সুন্নত নয়। আরবি ভাষায় ‘আজন’ শব্দের দুই অর্থ আছে (১) হাত খোলা রেখে হাতের তালুতে ভর দেওয়া (যেমন নারীরা ময়দা মাখানোর সময় করে), (২) আঙুলগুলো মুঠো করে ভর দেওয়া। তাই যখন এই ভঙ্গি নারীদের মতো বা দুর্বলতার কারণে করা হয়, তখন তাকে সুন্নত বলা যায় না। বিশেষ করে যদি হাদিস দুর্বল হয়, তা দিয়ে সুন্নতের প্রমাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়”।(সূত্র: আল-ফিকহুল ওয়াযিহ মাযহাব ও প্রবল মত অনুযায়ী, ‘যাদুল মুস্তাকনি’ সালাত অধ্যায়; আরও দেখুন ‘লা জদীদ ফী আহকাম আস-সালাহ’, পৃষ্ঠা: ৪৭)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬◐✪◑▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।