বাতিল ফিরকাসমূহের তালিকা তাদের উপশাখাসহ

এখন পর্যন্ত আমি যেসকল তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, তার ভিত্তিতে নিচে হিজরি সাল অনুযায়ী বাতিল ফিরকাসমূহ ও তাদের উপশাখাসমূহ আনুমানিক উৎপত্তিকালসহ উপস্থাপন করেছি। যেহেতু অনেক দলের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিক মতভেদ রয়েছে, তাই আমি এখানে গ্রহণযোগ্য উৎসের ভিত্তিতে আনুমানিক সময় উল্লেখ করেছি।

🛑১) খারেজী: উৎপত্তি আনুমানিক ৩৭ হিজরি। খারেজী (আরবি: الخوارج, আল-খাওয়ারিজ) যাদের উৎপত্তি ইসলামের প্রাথমিক যুগে হয়েছিল। ‘খারেজী’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো “যারা বেরিয়ে গেছে” বা “দলত্যাগী”। খারেজীদের উৎপত্তির মূল কারণ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-এর খেলাফতকালে সংঘটিত রাজনৈতিক সংঘাত। তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর হযরত আলী (রা.) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া (রা.) উসমানের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে আলীর আনুগত্য অস্বীকার করেন। এই বিবাদের মীমাংসা করতে আলী (রা.) এবং মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে উভয় পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে সালিশের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সালিশের সিদ্ধান্তকে হযরত আলী (রা.)-এর অনুসারীদের একটি অংশ মেনে নিতে অস্বীকার করে। তারা দাবি করে যে, “আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান চলবে না” (ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ)। তাদের মতে, মানুষকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করা কুরআনের নির্দেশের লঙ্ঘন। তাই তারা হযরত আলী (রা.), মুয়াবিয়া (রা.) এবং তাদের অনুসারীদের কাফির ঘোষণা করে আলীর পক্ষ ত্যাগ করে। পরবর্তীতে তারা চরমপন্থী হয়ে ওঠে এবং এমনকি আলী (রা.)-কে হত্যা করে এক খারেজী সদস্য, আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম। এই দলত্যাগীরাই ইতিহাসে খারেজী নামে পরিচিত। তাদের কেউ কেউ “কুররা” বা “কুরআনপাঠকারী দল” নামেও পরিচিত ছিল, কারণ তারা প্রচুর কুরআন তিলাওয়াত করত। উপশাখা: হারুরিয়া, আযারিকা, নাজদাত, ইবাদিয়া, সুফরিয়া, আজরাবিকা, থা’আলিবাহ, শাবিবিয়া, সালাবিয়া, আছহারিয়া, আজরামিয়া, শামরাখিয়া, খাজিমিয়া, বাইহাসিয়া, মুহাক্কিমা।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • কবীরা গুনাহকারীকে কাফির ঘোষণা: তাদের সবচেয়ে বিতর্কিত মতবাদ হলো, যে কোনো মুসলমান যদি কোনো কবীরা গুনাহ (বড় পাপ) করে, তাহলে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায় এবং কাফির হয়ে যায়।
  • শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ: তারা বিশ্বাস করত যে, যদি কোনো মুসলিম শাসক আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসন না করেন, তবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং তাকে উৎখাত করা ফরজ। এ কারণে তারা মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য বিদ্রোহ করেছে।
  • কঠোর ও আক্ষরিক ব্যাখ্যা: তারা কুরআনের আয়াতগুলোর আক্ষরিক ব্যাখ্যা করত এবং অন্য মুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ও অসহিষ্ণু ছিল। তাদের মতে, যারা তাদের মতবাদের সাথে একমত নয়, তারাও কাফির।
  • ঈমান ও আমল: তাদের মতে, ঈমানের জন্য শুধু বিশ্বাস যথেষ্ট নয়, বরং আমল (কর্ম) করাও অত্যাবশ্যকীয়। আমল না থাকলে ঈমান থাকে না।
  • সাধারণ মুসলিমদের প্রতি মনোভাব: তারা নিজেদের ছাড়া বাকি সব মুসলিমকে কাফির বা গোমরাহ মনে করত এবং তাদের রক্তপাতকেও বৈধ মনে করত।

খারেজীরা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সংঘবদ্ধ বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। তাদের চরমপন্থী মতবাদ এবং সহিংস কার্যকলাপের কারণে তারা মুসলিম বিশ্বে কখনোই বড় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে পারেনি। তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং তারা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আধুনিক যুগে কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠীর মতবাদের সাথে খারেজীদের মতবাদের কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন: মুসলিম শাসকদের কাফির ঘোষণা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করা।

🛑২) শিয়া: উৎপত্তি আনুমানিক ৩৫-৪০ হিজরি। শিয়া (আরবি: الشيعة, আশ-শিয়া) শিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো “দল” বা “অনুসারী”। ঐতিহাসিকভাবে, শিয়া শব্দটি “শিয়াতে আলী” (আলী (রা.)-এর দল) থেকে এসেছে, যার দ্বারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জামাতা এবং চাচাতো ভাই হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর অনুসারীদের বোঝানো হয়। শিয়া ইসলামের উৎপত্তির মূল কারণ হলো মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব বা খিলাফতের উত্তরাধিকার নিয়ে মতভেদ। সুন্নি মুসলিমরা মনে করে যে, খেলাফতের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত ব্যক্তিই যোগ্য, যেমনটি প্রথম চার খলিফার (আবু বকর, উমর, উসমান, আলী) ক্ষেত্রে ঘটেছিল। অন্যদিকে, শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, মহানবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে আলী (রা.)-কে মনোনীত করেছিলেন। তাদের মতে, নেতৃত্ব কেবল মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত (পরিবারের সদস্য)-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এই মতপার্থক্য সিফফিনের যুদ্ধ এবং কারবালার ঘটনার পর আরও প্রকট হয়ে ওঠে। কারবালার প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র এবং আলী (রা.)-এর পুত্র ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত শিয়া মুসলিমদের জন্য এক গভীর শোক ও আত্মত্যাগের প্রতীক। এটি শিয়া ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ইমামত (الإمامة): এটি শিয়া ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলোর মধ্যে একটি। শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, মহানবী (সা.)-এর পর মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিচালনার জন্য আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত ইমাম অপরিহার্য। এই ইমামগণ নিষ্পাপ (মাসুম), ঐশী জ্ঞানে জ্ঞানী এবং মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখেন।
  • আহলে বাইত (أهل البيت): শিয়ারা মহানবী (সা.)-এর পরিবারের সদস্য (আলী, ফাতিমা, হাসান, হুসাইন এবং তাঁদের বংশধরগণ) যারা আহলে বাইত নামে পরিচিত, তাঁদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করে। তারা বিশ্বাস করে যে, আহলে বাইতই ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান এবং উম্মাহকে নেতৃত্ব দেওয়ার একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি।
  • তাওয়াল্লা ও তাবারা (التولي والتبري): তাওয়াল্লা অর্থ আহলে বাইত এবং তাঁদের অনুসারীদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা। তাবারা অর্থ আহলে বাইতের শত্রুদের এবং তাঁদের বিরোধীদের থেকে বিচ্ছেদ ঘোষণা করা।
  • গাইব (غيب): শিয়াদের একটি বড় অংশ (ইসনা আশারিয়া বা বারো ইমামি শিয়া) বিশ্বাস করে যে, তাদের দ্বাদশ ইমাম, ইমাম মাহদি, যিনি বর্তমানে অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছেন, তিনি একদিন আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীতে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন।
  • ফিকের বিভিন্নতা: শিয়াদের নিজস্ব ফিকহ (ইসলামী আইনশাস্ত্র) রয়েছে, যা জাফরিয়া মাযহাব নামে পরিচিত। এর কিছু অনুশীলন সুন্নি মাযহাব থেকে ভিন্ন।
  • আশুরা ও কারবালা: হযরত হুসাইন (আ.)-এর কারবালার শহীদ হওয়া শিয়াদের ধর্মীয় ও আবেগঘন স্মৃতির কেন্দ্রবিন্দু।
  • সাহাবাদের সমালোচনা: সব শিয়া সাহাবীদের গালি দেন না। কিছু শিয়া নির্দিষ্ট কিছু সাহাবী সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করে থাকেন, এবং কখনও কখনও তাদের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্যও করেন। শিয়ারা মূলত বিশ্বাস করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর নেতৃত্ব (খিলাফত) আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর প্রাপ্য ছিল। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, প্রথম তিন খলিফা (আবু বকর, উমর, উসমান রা.) নির্বাচিত হন আলী (আ.)-এর আগে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিয়াদের একটি অংশ মনে করে যে, আলীর অধিকার হরণ করা হয়েছে। শিয়ারা মনে করেন, সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যের পথে ছিলেন না এবং তাদের সমালোচনা করা ধর্মীয়ভাবে বৈধ।

শাখা: শিয়াদের প্রধানত তিনটি উপশাখা পরিচিত: ইসনা আশারিয়া, ইসমাইলিয়া, যাইদিয়া। এছাড়াও আরো কিছু আছে যা কম পরিচিত।

  • ইসনা আশারিয়া (বারো ইমামপন্থী শিয়া): এটি শিয়া ইসলামের বৃহত্তম শাখা। বিশ্বের অধিকাংশ শিয়া মুসলিম এই শাখার অনুসারী। তারা বারোজন ইমামের ধারায় বিশ্বাস করে, যার শেষ ইমাম হলেন ইমাম মাহদি (আ.)। তারা ইমামিয়া বা জা’ফরি শিয়া নামেও পরিচিত। ইরান, ইরাক, আজারবাইজান, বাহরাইন, লেবানন এবং পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম এই শাখার অনুসারী। উপশাখা: উসুলি, আখবারি, শাইখি, আলেভি/আলাওয়ি, সাদিকিয়া, তুব্বাইয়াহ, বাবিয়া ও বাহাই (বাবিয়া ও বাহাই পরে আলাদা ধর্মে রূপান্তরিত হয়)।
  • ইসমাইলিয়া (সাত ইমামপন্থী শিয়া): এরা ইসমাইল ইবনে জাফর আস-সাদিকের ইমামতে বিশ্বাসী। এদের আবার আরও অনেক উপশাখা আছে। উপশাখা: নিজারি (আগাখানী), মুস্তাআলি, দাউদী বোহরা, সুলাইমানি, আলাভি, বাতিনিয়া, কারামিতা, হাফিজি, হাসাসিন, দ্রুজ। (দ্রুজ আলাদা ধর্মে পরিণত হয়েছে)।
  • যাইদিয়া (পাঁচ ইমামপন্থী শিয়া): এরা যায়েদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলীর ইমামতে বিশ্বাসী। তাদের বিশ্বাস বারো ইমামি বা ইসমাইলিয়াদের থেকে কিছুটা ভিন্ন এবং তারা সুন্নিদের কাছাকাছি কিছু মতবাদ পোষণ করে। ইয়েমেনের হুথি আন্দোলন যাইদি শিয়াদের অন্তর্গত। উপশাখা: জারুদিয়া, সুলায়মানিয়া, বাতরিয়া/সালিহিয়া, হাদাওয়িয়া, কাসিমিয়া, তাবারিয়া, ইব্রাহিমিয়া, সরাহিয়্যা, খলাফিয়া।
  • গুলাত: গুলাত (غلاة) হলো চরমপন্থী শিয়া গোষ্ঠী। এই শব্দটি আরবি থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘যারা সীমা অতিক্রম করে’ বা ‘যারা বাড়াবাড়ি করে’। তারা আল-গালিয়াহ্ নামেও পরিচিত। উপশাখা: নুসাইরিয়া/আলাউই, খাত্তাবিয়া/গারাবিকিয়া, মুঘিরিয়া, গুরারিয়া, জানাহিয়া, মনসুরিয়া, সাবয়িয়া, তাফদিলিয়্যাহ, কিসানিয়া, সুবাইয়াহ।
  • আল-কায়সানিয়াহ্: আল-কায়সানিয়াহ্ বর্তমানে বিলুপ্ত উপদল। ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-এর পুত্র মুহাম্মদ ইবনে আল-হানাফিয়াকে কেন্দ্র করে এই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল।

🛑৩) ইসনা আশারিয়া (বারো ইমামপন্থী শিয়া): উৎপত্তি আনুমানিক ৩৫-৪০ হিজরি। ইসনা আশারিয়া হলো শিয়া ইসলামের বৃহত্তম ও প্রধান শাখা, যা বিশ্বে শিয়া মুসলিমদের প্রায় ৮৫-৯০% নিয়ে গঠিত। ‘ইসনা আশারিয়া’ শব্দের অর্থ হলো “বারোজনী” বা “বারোজন ইমামের অনুসারী”, যা তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। তারা বিশ্বাস করে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পর তাঁর আহলে বাইত (পরিবার)-এর বারো জন নিষ্পাপ (মাসুম) ইমামের মাধ্যমে নেতৃত্ব অব্যাহত ছিল, এবং সর্বশেষ ইমাম বর্তমানে আত্মগোপনে (গায়েব) রয়েছেন এবং শেষ জামানায় পুনরায় আবির্ভূত হবেন। উপশাখা: উসুলি, আখবারি, শাইখি, আলেভি/আলাওয়ি, সাদিকিয়া, তুব্বাইয়াহ, বাবিয়া ও বাহাই (বাবিয়া ও বাহাই পরে আলাদা ধর্মে রূপান্তরিত হয়)।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ইমামতের বিশ্বাস: মহানবী (সা.)-এর পর ইমামত আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এবং এটি ঐশী জ্ঞান ও নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা। ইমামগণ হলেন নিষ্পাপ (মাসুম) এবং তাদের বাণী ও কর্ম শরীয়তের অন্যতম উৎস।
  • ইমাম মাহদীর গায়েবাত (আত্মগোপন) ও জহুর (পুনরাবির্ভাব): সর্বশেষ ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী অদৃশ্য হয়ে গেছেন এবং কিয়ামতের পূর্বে পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য পুনরায় আবির্ভূত হবেন।
  • ইজতিহাদ ও তাকলিদ: ইসনা আশারিয়া শিয়ারা ইজতিহাদ (কুরআন ও সুন্নাহ থেকে স্বাধীনভাবে আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ) এর উপর জোর দেয়। সাধারণ মুসলিমদের জন্য একজন যোগ্য মুজতাহিদকে তাকলিদ (অনুসরণ) করা ওয়াজিব। এই মুজতাহিদকে প্রায়শই মারজা’ আত-তাকলিদ বলা হয়।
  • শরীয়তের উৎস: তাদের শরীয়তের উৎস হলো কুরআন, সুন্নাহ (বিশেষত আহলে বাইতের সূত্রে বর্ণিত হাদিস), ইজমা (ঐকমত্য) এবং আকল (যুক্তি)।
  • তাফযীল (শ্রেষ্ঠত্ব): তারা হযরত আলী (রা.) এবং আহলে বাইতের সদস্যদেরকে অন্যান্য সাহাবী এবং মুসলিমদের উপর শ্রেষ্ঠ মনে করে।
  • তাকিয়া (আত্মগোপন/প্রচ্ছন্নতা): প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্বাস গোপন রাখা, বিশেষ করে যখন প্রকাশ করলে জানের বা ধর্মের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন তাকিয়া করাকে জায়েজ মনে করা হয়।
  • আশুরা ও শোক: কারবালার ঘটনায় ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতকে ইসনা আশারিয়ারা গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, বিশেষ করে আশুরার দিনে।

ইসনা আশারিয়া শিয়ারা জাফরি ফিকাহ অনুসরণ করে, যা ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ.)-এর শিক্ষা থেকে উদ্ভূত। এই ফিকাহ সুন্নি ফিকাহর চারটি মাযহাব (হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী) থেকে ভিন্নতা পোষণ করে, যেমন:

  • মুতা’আ বিবাহ (সাময়িক বিবাহ): জাফরি ফিকাহে মুতা’আ বিবাহ জায়েজ।
  • সালাত : সালাতের পদ্ধতি এবং সময়ের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্নতা রয়েছে।
  • উত্তরাধিকার আইন: কিছু ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের নিয়ম ভিন্ন।
  • ওযু (পবিত্রতা): ওযুর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু ভিন্নতা দেখা যায়।

🛑৪) গুলাত (শিয়া): উৎপত্তি আনুমানিক ৬০–১০০ হিজরি। গুলাত হলো ইসলামী পরিভাষার একটি শব্দ যা এমন শিয়া মুসলিম দলগুলোকে নির্দেশ করে যারা তাদের ইমামদের (বিশেষত হযরত আলী (রা.) এবং তাঁর বংশধরদের) প্রতি মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। গুলাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো “অতিরঞ্জন” বা “অতিমাত্রায় প্রশংসা করা”। উপশাখা: নুসাইরিয়া/আলাউই, খাত্তাবিয়া/গারাবিকিয়া, মুঘিরিয়া, গুরারিয়া, জানাহিয়া, মনসুরিয়া, সাবয়িয়া, তাফদিলিয়্যাহ, কিসানিয়া, সুবাইয়াহ।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ইমামদের ঐশ্বরিককরণ: গুলাতদের সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা শিয়া ইমামদেরকে আল্লাহর মর্যাদা প্রদান করে বা তাদেরকে আল্লাহর অবতার, আল্লাহর পুত্র অথবা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী সত্তা হিসেবে বিশ্বাস করে। যেমন, কিছু গুলাত গোষ্ঠী হযরত আলী (রা.)-কে সরাসরি আল্লাহ হিসেবে বিশ্বাস করত (নাউজুবিল্লাহ)।
  • নবুওয়াত অস্বীকার বা ইমামদের শ্রেষ্ঠত্ব: কিছু গুলাত গোষ্ঠী নবীদের নবুওয়াত অস্বীকার করত অথবা ইমামদেরকে নবীদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ মনে করত। যেমন, গারাবিকিয়া যারা বিশ্বাস করত যে জিবরাঈল (আ.) ভুল করে নবুওয়াতের বার্তা হযরত আলী (রা.)-এর কাছে না নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।
  • শরীয়তের বিলুপ্তি (ইবাহিয়্যা): গুলাত গোষ্ঠীগুলোর অনেকে বিশ্বাস করত যে, যেহেতু তারা ঐশ্বরিক সত্যের গভীর জ্ঞান লাভ করেছে (বাতিন), তাই তাদের জন্য বাহ্যিক শরীয়তের (ইসলামী আইন যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব) কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটিকে ইবাহিয়্যা (শরীয়তের শিথিলতা বা প্রত্যাখ্যান) বলা হয়।
  • জন্মান্তরবাদ: কিছু গুলাত দল আত্মাদের পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করত, যা ইসলামী আকিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
  • আল্লাহর শারীরিক রূপ (তাজসিম): কিছু গুলাত আল্লাহকে একটি শারীরিক রূপ বা দেহ আছে বলে বিশ্বাস করত, যা মুশাব্বিহা বা মুজাস্সিমা ধারণার চরম রূপ।
  • তাকিয়া (আত্মগোপন): গুলাত গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই তাদের বিশ্বাসগুলোকে চরম গোপনীয়তার সাথে চর্চা করত এবং প্রয়োজনে তাদের আসল পরিচয় গোপন রাখত।

🛑৫) মুরজিয়া: উৎপত্তি আনুমানিক ৭০-৮০ হিজরি। মুরজিয়া (আরবি: المرجئة, আল-মুরজিয়াহ) শব্দটি এসেছে আরবি “إرجاء” (ইরজাহ) থেকে, যার অর্থ “স্থগিত রাখা” বা “বিলম্ব করা”। মুরজিয়াদের আবির্ভাব ঘটেছিল মূলত খারেজী এবং শিয়া মতবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ইসলামের প্রথম দিকের খেলাফতকালে, বিশেষ করে হযরত উসমান (রা.)-এর শাহাদাত এবং হযরত আলী (রা.)-এর খেলাফতকালে মুসলিম সমাজে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এই সময়ে মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিতর্ক ছিল, কবীরা গুনাহ (বড় পাপ) করলে একজন মুসলিমের ঈমানের কী হয়? উপশাখা: জাহমিয়া, কাররামিয়া, গাসসানিয়াহ, থাউবানিয়াহ, তুমেনিয়াহ, ইউনুসিয়াহ।

  • খারেজীরা চরমপন্থী অবস্থান নিয়েছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, যে কোনো ব্যক্তি যদি কবীরা গুনাহ করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যায় এবং ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। এই কারণে তারা অনেক সাহাবী ও পরবর্তী মুসলিম শাসকদের কাফির ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত।
  • শিয়ারা আবার আহলে বাইতের (নবীর পরিবার) প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য দাবি করত এবং যারা তাদের মতে আহলে বাইতের অধিকার খর্ব করেছে, তাদের সমালোচনা করত।

এই দুটি চরমপন্থী মতবাদের বিপরীতে, কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ একটি মধ্যপন্থী বা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, যারা পরিচিত হন মুরজিয়া নামে। তারা মনে করতেন যে, এই ধরনের বিতর্কগুলো আল্লাহর কাছে স্থগিত রাখা উচিত এবং মানুষের উচিত নয় নিজেদের মধ্যে কে কাফির আর কে মুসলিম, তা নিয়ে চূড়ান্ত রায় দেওয়া।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ঈমান এবং আমলের সম্পর্ক: মুরজিয়াদের সবচেয়ে মৌলিক বিশ্বাস হলো, ঈমান (বিশ্বাস) এবং আমল (কর্ম)-এর মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই বা আমল ঈমানের অংশ নয়। তাদের মতে, ঈমান হলো কেবল অন্তরের স্বীকৃতি (তাসদিক) এবং মুখের ঘোষণা (ইকরার)। একজন ব্যক্তি যদি মনে প্রাণে আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং মুখে শাহাদা পাঠ করে, তাহলে সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন, যদিও সে কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয় বা কিছু ফরয আমল ছেড়ে দেয়। তাদের কিছু চরমপন্থী অংশ বিশ্বাস করত যে, একজন ব্যক্তি মনে মনে ঈমান রাখলে সে জান্নাতে যাবে, যদিও সে প্রকাশ্যে কুফরি কাজ করে বা আল্লাহর সাথে শিরক করে। তারা বলত, কারো ঈমান আছে কি না, বা সে কাফের কি না—এই সিদ্ধান্ত একমাত্র আল্লাহ দিতে পারেন, মানুষ নয়। তারা বলত আমল বা কাজ দ্বারা ইমান কমে বা বাড়ে না।
  • কবীরা গুনাহকারীর অবস্থান: খারেজীদের মতো কবীরা গুনাহকারীকে কাফির ঘোষণা না করে, মুরজিয়ারা বিশ্বাস করত যে, কবীরা গুনাহকারী একজন মুসলিমই থাকে। তার বিচার আল্লাহর উপর ন্যস্ত। আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন, অথবা তার পাপের জন্য শাস্তি দিতে পারেন, কিন্তু সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী হবে না, যতক্ষণ তার অন্তরে ঈমান থাকে। এই কারণেই তাদের “আশাপ্রদানকারী” বলা হতো, কারণ তারা পাপী মুসলিমদের জান্নাতের আশা প্রদান করত।
  • তাকফীর (কাফির ঘোষণা করা) স্থগিত রাখা: মুরজিয়ারা মনে করত যে, কোনো মুসলিমকে তার পাপের কারণে কাফির ঘোষণা করার অধিকার মানুষের নেই। শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন কে সত্যিকারের মুমিন আর কে নয়। তাই মুসলিমদের উচিত পরস্পরের ব্যাপারে রায় দেওয়া থেকে বিরত থাকা এবং বিচারকে কিয়ামতের দিনের জন্য বিলম্বিত করা (ইরজা)। এই মূলনীতি তাদের নামকরণের পেছনে একটি বড় কারণ।
  • শাসকের আনুগত্য: এই মতবাদ পরোক্ষভাবে উমাইয়া শাসকদের জন্য সুবিধাজনক হয়েছিল। কারণ মুরজিয়ারা মনে করত, একজন শাসক যদি প্রকাশ্যে মুসলিম হওয়ার দাবি করেন, তাহলে তার আনুগত্য করা উচিত, যদিও তিনি অন্যায় করেন বা পাপী হন। তাদের মতে, শাসকের বিদ্রোহ করা ফেতনা সৃষ্টি করে এবং এর বিচার আল্লাহর উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এ কারণে কিছু মুরজিয়াকে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা সমর্থিত হিসেবেও দেখা হতো, কারণ তাদের মতবাদ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে নিরুৎসাহিত করত।

🛑৬) কাদেরিয়া: উৎপত্তি আনুমানিক ৭০-৮০ হিজরি। যারা তাকদির অস্বীকার করে। তারা কাদর (তাকদির বা ঐশী বিধান) নিয়ে বিতর্কে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার উপর জোর দিয়েছিল। এই নামটি ‘কদর’ (قدر) শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ক্ষমতা’ বা ‘শক্তি’। কাদেরিয়া মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগে, উমাইয়া খিলাফতের সময়, যখন তাকদির ও মানুষের কর্মের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বসরার মা’বাদ আল-জুহানি এবং গাইলান আল-দিমাশকিকে এই মতবাদের প্রাথমিক প্রচারক হিসেবে ধরা হয়।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • স্বাধীন ইচ্ছা: কাদেরিয়ারা বিশ্বাস করত যে, মানুষ তার নিজের কাজের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন ও দায়ী। আল্লাহ মানুষের ভালো বা মন্দ কাজের জন্য সরাসরি দায়ী নন, বরং মানুষ নিজের ইচ্ছায় তা করে।
  • ঐশী জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা: প্রথম দিকের কিছু চরমপন্থী কাদেরিয়া আল্লাহর পূর্ব জ্ঞানকে (ইলম) অস্বীকার করত, অর্থাৎ তারা মনে করত আল্লাহ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগে থেকে সব জানেন না। তবে, পরবর্তীতে এই মতবাদ পরিবর্তিত হয় এবং তারা আল্লাহর পূর্ব জ্ঞানকে মেনে নেয়, কিন্তু মানুষের কর্মের স্বাধীনতাকে বজায় রাখে।
  • আল্লাহর ন্যায়বিচার: তাদের যুক্তি ছিল, যদি আল্লাহ মানুষের কর্মের পূর্বনির্ধারক হন, তাহলে পরকালে মানুষকে তার কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া আল্লাহর ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হবে। তাই, মানুষ স্বাধীনভাবে কাজ করে বলেই সে তার কর্মের জন্য দায়ী।

🛑৭) ইবাদিয়া: উৎপত্তি আনুমানিক ৭০-৮০ হিজরি। ইবাদি (আরবি: الإباضية, আল-ইবাদিয়াহ) সুন্নি ও শিয়া থেকে ভিন্ন। আবদুল্লাহ ইবন ইবাদ আল-তামিমি নামে একজন প্রাথমিক মুসলিম চিন্তাবিদকে ইবাদি মতবাদের প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয়, যদিও অনুসারীরা জাবির ইবন জাইদ আল-আজদিকে প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মনে করে। ইবাদি মতবাদের উৎপত্তি ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে তৃতীয় ফিতনার (মুসলিম গৃহযুদ্ধ) সময়কালে। এটি মূলত খারেজী আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হলেও, ইবাদিরা নিজেদেরকে মূলধারার খারেজীদের চরমপন্থী শাখা থেকে বিচ্ছিন্ন করে। ইবাদি সম্প্রদায়ের মধ্যে নফাথি ও হাফসি শাখাগুলো ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে বর্তমানে ওমানি ইবাদিরাই প্রধান ধারা হিসেবে টিকে আছে। উপশাখা: নফাথি, হাফসি,খালাফি, নাফফুসা ইবাদি, জেরবা ইবাদি, ওমানি ইবাদি।

  • নামকরণ: ইবাদি নামটি আব্দুল্লাহ ইবনে ইবাদ আল-তামিমি থেকে এসেছে। তবে, এই মতবাদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জাবির ইবনে জায়েদ আল-আজদি কে ধরা হয়, যিনি বিশিষ্ট তাবেয়ী এবং আনাস ইবনে মালিক (রা.)-এর শিষ্য ছিলেন।
  • খারেজীদের থেকে ভিন্নতা: খারেজীদের মূল মতবাদ ছিল, যে ব্যক্তি কবীরা গুনাহ (বড় পাপ) করে সে কাফির হয়ে যায় এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ। ইবাদিরা এই চরমপন্থী ধারণা থেকে সরে আসে। তারা কবীরা গুনাহকারীকে ‘কাফির’ হিসেবে ঘোষণা না করে, বরং তাকে ‘মুওয়াহহিদুন’ (একত্ববাদী) বা ‘ফারিকাহ’ (দলত্যাগী) হিসেবে দেখে, যার অর্থ সে মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ নয়, তবে পুরোপুরি কাফিরও নয়। তারা মনে করে, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তার কর্মের কারণে সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে চলে যেতে পারে। ইবাদিরা খারেজীদের মতো নির্বিচারে মুসলিমদের রক্তপাতকে বৈধ মনে করে না, যা তাদের একটি বড় পার্থক্য।
  • রাজনৈতিক বিচ্ছেদ: ইবাদিরা হযরত আলী (রা.) এবং মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে সিফফিনের যুদ্ধে সালিশের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে খারেজীদের সাথে একমত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা খারেজীদের সহিংস পথ পরিহার করে একটি ভিন্ন, অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী ও সংগঠিত ধারায় বিকশিত হয়।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: ইবাদি (বা ইবাদিয়া) হলো মূলত খারেজি আন্দোলনের একটি নরমপন্থী ধারার উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত। খারেজিদের মতো তাকফির ও সহিংস বিদ্রোহে বিশ্বাস করে না। ঈমান, তাকদির ও আল্লাহর গুণাবলির বিষয়ে মুতাজিলা ও সুন্নিদের মাঝামাঝি অবস্থান। শিয়া মতের মতো সাহাবাদের সমালোচনা করে না। অধিকাংশ সময় শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে ধৈর্য ও স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দেয়। তারা নিজেদেরকে “আহলুল ইস্তিকামাহ” (সত্যের উপর অবিচল) বলে পরিচয় দেয়। তারা সুন্নি ও শিয়া উভয় ধারার বাইরে একটি স্বতন্ত্র মাজহাব। তাদের নিজস্ব শরিয়াহ ব্যাখ্যা ও ফিকহ রয়েছে, যা হানাফি, মালিকি, শাফি বা হাম্বলি মাযহাবের মতো নয়।

🛑৮) জাবরিয়া: উৎপত্তি আনুমানিক ১০০-১২০ হিজরি। জাবরিয়া (আরবি: الجبرية, আল-জাবরিয়াহ) যারা মানুষের কর্মের ক্ষেত্রে আল্লাহর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ বা বাধ্যবাধকতার উপর জোর দিত। ‘জাবরিয়া’ শব্দটি আরবি ‘জাবর’ (جبر) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘বাধ্য করা’, ‘জোর খাটানো’ বা ‘নিয়ন্ত্রণ করা’। এই সম্প্রদায়ের মূল বিশ্বাস ছিল যে, মানুষ তার কর্মের ক্ষেত্রে কোনো স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী নয়, বরং সে আল্লাহর ইচ্ছার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বাধ্য ও নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ করে উমাইয়া খিলাফতের সময়কালে। এই সময়ে তাকদির (ভাগ্য) এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা নিয়ে মুসলিম সমাজে তীব্র বিতর্ক চলছিল। উপশাখা: জাহমিয়া, দিরারিয়া।

  • কাদেরিয়া সম্প্রদায়ের বিপরীতে জাবরিয়ারা অবস্থান নিয়েছিল। কাদেরিয়ারা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার উপর জোর দিত এবং মানুষের কর্মের জন্য আল্লাহকে দায়ী মনে করত না।
  • উমাইয়া শাসকরা মাঝে মাঝে জাবরিয়া মতবাদকে সমর্থন করত, কারণ এটি তাদের শাসনের বৈধতা দিত। যদি সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে, তাহলে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় বা স্বৈরাচারী শাসনকেও ঐশী ইচ্ছা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেত, যা জনগণের বিদ্রোহের সম্ভাবনা কমিয়ে দিত।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • মানুষের ইচ্ছার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি: জাবরিয়ারা বিশ্বাস করত যে, মানুষের নিজস্ব কোনো স্বাধীন ইচ্ছা বা ক্ষমতা নেই। মানুষ কেবল আল্লাহর ইচ্ছার একটি উপকরণ মাত্র। মানুষ যা কিছু করে, তা আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত ইচ্ছার ফল। মানুষ একটি পালকের মতো, যা বাতাসের দ্বারা পরিচালিত হয়, অথবা একজন রোগীর মতো, যে জোরপূর্বক ওষুধ খায় – তার নিজের কোনো ক্ষমতা নেই।
  • আল্লাহই সকল কাজের সৃষ্টিকর্তা: তাদের মতে, আল্লাহই মানুষের সকল কর্মের (ভালো বা মন্দ) একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এবং নিয়ন্ত্রক। মানুষ কেবল সেই কর্মের বাহক, তার নিজের কোনো ক্ষমতা নেই।
  • পরকালে জবাবদিহিতা নিয়ে বিতর্ক: এই মতবাদ একটি গুরুতর ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল: যদি মানুষ তার কর্মের জন্য স্বাধীন না হয়, তাহলে পরকালে তাকে তার কাজের জন্য কেন জবাবদিহি করতে হবে বা শাস্তি পেতে হবে? জাবরিয়ারা এই প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, যা তাদের মতবাদের একটি বড় দুর্বলতা ছিল।
  • নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব: এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তাদের মধ্যে জাহম ইবনে সাফওয়ান (জাহমিয়াহ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা) অন্যতম ছিলেন। যদিও জাহমিয়াহদের অন্যান্য মতবাদ ছিল, তবে তাকদিরের ক্ষেত্রে তারা জাবরিয়াদের মতই চরম বাধ্যবাধকতাকে সমর্থন করত।

🛑৯) মুতাজিলা: উৎপত্তি আনুমানিক ১০৫-১১০ হিজরি। মু’তাজিলা (আরবি: المعتزلة, আল-মু’তাজিলা) হলো একটি যুক্তিবাদী সম্প্রদায়, যা ইরাকের বসরায় উদ্ভূত হয়েছিল। ‘মু’তাজিলা’ শব্দের অর্থ হলো “যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে” বা “যারা একপাশে সরে গেছে”। তাদের স্বতন্ত্র ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনার জন্য তারা ইসলামের মূলধারা (সুন্নি) ভিন্ন পথে চলে গিয়েছিল। সবচেয়ে প্রচলিত বর্ণনা অনুযায়ী, এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ওয়াসিল ইবনে আতা। তিনি হাসান আল-বসরী (রহ.)-এর ছাত্র ছিলেন। একবার হাসান আল-বসরীর মজলিসে কবীরা গুনাহ (বড় পাপ)কারীর অবস্থান নিয়ে বিতর্ক চলছিল। খারেজীরা বলত, কবীরা গুনাহকারী কাফির। মুরজিয়ারা বলত, সে পূর্ণ মুমিন। ওয়াসিল ইবনে আতা উভয় মতের বিরোধিতা করে বলেন যে, কবীরা গুনাহকারী মুমিনও নয়, কাফিরও নয়; বরং সে ‘মানযিলা বাইনাল মানযিলাতাইন’ (দুটি অবস্থানের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান)-এ থাকে। এই ভিন্নমত পোষণ করে তিনি হাসান আল-বসরীর মজলিস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, এবং এর থেকেই ‘মু’তাজিলা’ নামটি এসেছে। উপশাখা: বাসরী ধারা, বাগদাদী ধারা, জাহিজিয়া, হুদাইলিয়া, জুব্বাইয়াহ, বাহশামিয়া, নায্যামিয়াহ, জাহিজিয়াহ, কাররামিয়া, নাজ্জারিয়া, কা’বিয়াহ।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ): এটি তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি। মু’তাজিলারা আল্লাহর একত্ববাদের উপর চূড়ান্ত জোর দিত এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর সাথে শরিক করা বা তাঁর গুণাবলীকে তাঁর সত্তা থেকে পৃথক সত্তা হিসেবে দেখা শিরক মনে করত। তারা আল্লাহর গুণাবলীকে তাঁর সত্তারই অংশ মনে করত, পৃথক কোনো অস্তিত্ব নয়। এই নীতির ভিত্তিতেই তারা বিশ্বাস করত যে, কুরআন সৃষ্ট (খালক আল-কুরআন), কারণ যদি কুরআন অনাদি হয়, তবে তা আল্লাহর সত্তার সমকক্ষ হয়ে যায়, যা আল্লাহর একত্ববাদের পরিপন্থী। তারা আল্লাহর সত্তাগত গুণের (যেমন – আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত) আক্ষরিক ব্যাখ্যা করত না, বরং রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করত, যেন তা আল্লাহর গুণাবলীকে সীমিত না করে।
  • আদল (আল্লাহর ন্যায়বিচার): মু’তাজিলারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহ সম্পূর্ণ ন্যায়পরায়ণ এবং তিনি কোনো অন্যায় করেন না। এই নীতির ভিত্তিতে তারা মনে করত যে, মানুষ তার কর্মের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং দায়ী। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন এবং সেই ইচ্ছার ভিত্তিতে মানুষ যা করে, তার জন্য আল্লাহ দায়ী নন। যদি আল্লাহ মানুষের কর্মের সৃষ্টিকর্তা হতেন, তাহলে অন্যায়ের জন্য মানুষকে শাস্তি দেওয়া আল্লাহর ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হতো। এই কারণে তারা তাকদিরকে মানবীয় স্বাধীনতা এবং আল্লাহর ন্যায়বিচারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করত।
  • আল-ওয়া’দ ওয়াল-ওয়া’ঈদ (প্রতিশ্রুতি ও ভীতিপ্রদর্শন): এই নীতি অনুযায়ী, আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি (জান্নাতের সুসংবাদ) এবং ভীতিপ্রদর্শন (জাহান্নামের শাস্তি) উভয়ই পূরণ করবেন। অর্থাৎ, যারা ভালো কাজ করবে, তারা অবশ্যই পুরস্কার পাবে; আর যারা মন্দ কাজ করবে, তারা অবশ্যই শাস্তি পাবে। এই নীতির কারণে তারা সুপারিশ (শাফায়াত) বা আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনাকে সীমিত করত, যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মতামতের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল।
  • আল-মানযিলা বাইনাল মানযিলাতাইন (দুটি অবস্থানের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান): এটি তাদের অন্যতম মৌলিক নীতি, যা কবীরা গুনাহকারীর অবস্থান সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে। মু’তাজিলাদের মতে, যে ব্যক্তি কবীরা গুনাহ করে, সে মুমিনও থাকে না, আবার কাফিরও হয়ে যায় না। বরং সে ‘ফাসিক’ (পাপী) হিসেবে একটি মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকে। যদি সে তাওবা না করে মারা যায়, তাহলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামে যাবে।
  • আল-আমর বিল-মা’রুফ ওয়ান-নাহি আনিল-মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ): এই নীতিটি সমস্ত মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মু’তাজিলারা এই নীতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিত এবং প্রয়োজনে শাসকদের বিরুদ্ধেও এই নীতি প্রয়োগ করার পক্ষে ছিল, যদি শাসকগণ শরীয়ত বিরোধী কাজ করে। তবে, তারা এই কাজের জন্য কিছু শর্তারোপ করত, যেমন: ফিতনা বা বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকা।

🛑১০) জাহমিয়া: উৎপত্তি আনুমানিক ১২০-১২৮ হিজরি। জাহমিয়া (আরবি: الجهمية, আল-জাহমিয়াহ) ছিল একটি চরমপন্থী সম্প্রদায়, যা খোরাসানে (বর্তমান ইরান ও মধ্য এশিয়ার অংশ) উদ্ভূত হয়েছিল। এই সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতা জাহম ইবনে সাফওয়ান এর নামানুসারে।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার (তা’তীল): এটি জাহমিয়াদের সবচেয়ে প্রধান এবং বিতর্কিত মতবাদ। তারা আল্লাহকে তাঁর গুণাবলী (যেমন জ্ঞান, ক্ষমতা, শ্রবণ, দর্শন, জীবন, কথা বলা ইত্যাদি) থেকে বিমুক্ত বলে মনে করত। তাদের মতে, আল্লাহর কোনো গুণাবলী নেই যা তাঁর সত্তা থেকে আলাদা। আল্লাহর কোনো গুণ স্বীকার করলে তা তাঁকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করে তুলবে এবং তাঁর একত্ববাদকে (তাওহীদ) খর্ব করবে। তাই তারা আল্লাহর সমস্ত গুণাবলীকে আক্ষরিক অর্থে অস্বীকার করত এবং বলত যে আল্লাহকে কোনো বৈশিষ্ট্য দ্বারা বর্ণনা করা যায় না। তাদের মতে, আল্লাহকে শুধু “স্রষ্টা” ও “ক্ষমতাধর” বলা যেতে পারে, কারণ এইগুলো তাঁর কার্যগত গুণ। এর ফলে তারা কুরআনের এমন অনেক আয়াতকে আক্ষরিক অর্থে অস্বীকার করত যেখানে আল্লাহর গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে (যেমন, “আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা” বা “আল্লাহর হাত”). তারা এই আয়াতগুলোর রূপক ব্যাখ্যা করত অথবা সেগুলোকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করত।
  • সৃষ্ট কুরআন (খালক আল-কুরআন): মু’তাজিলাদের মতো জাহমিয়ারাও বিশ্বাস করত যে, কুরআন সৃষ্ট (মাখলুক)। তাদের যুক্তি ছিল, যদি কুরআন অনাদি হয়, তাহলে তা আল্লাহর সত্তার সমকক্ষ হয়ে যায়, যা আল্লাহর একত্ববাদের পরিপন্থী। তাদের মতে, আল্লাহর বাণী একটি সৃষ্ট বস্তু, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ে অস্তিত্ব লাভ করেছে।
  • মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি (জাবর): জাহমিয়ারা জাবরিয়া সম্প্রদায়ের একটি চরম শাখা ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, মানুষের নিজস্ব কোনো স্বাধীন ইচ্ছা বা ক্ষমতা নেই। মানুষ যা কিছু করে (ভালো বা মন্দ), তা আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত ইচ্ছার ফল এবং মানুষ কেবল সেই কর্মের বাহক মাত্র। মানুষ একটি গাছের পাতার মতো যা বাতাসের দ্বারা চালিত হয়, তার নিজের কোনো ক্ষমতা বা পছন্দ নেই। এই মতবাদ অনুযায়ী, মানুষ তার পাপের জন্য দায়ী নয়, কারণ সে তার কর্মের ক্ষেত্রে স্বাধীন নয়।
  • ঈমান এবং আমল: ঈমানের ক্ষেত্রে জাহমিয়ারা ছিল মুরজিয়াদের সবচেয়ে চরমপন্থী শাখা। তারা বিশ্বাস করত যে, ঈমান হলো কেবল অন্তরের জ্ঞান বা স্বীকৃতি। একবার কেউ আল্লাহকে চিনে ফেললে, সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন। আমল (কর্ম) ঈমানের অংশ নয়। এমনকি যদি কেউ প্রকাশ্যে কুফরি কাজ করে বা শিরক করে, তাহলেও তার অন্তরে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে সে কাফির হয় না এবং জান্নাতে যাবে। তাদের মতে, কোনো পাপকর্ম ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না।
  • জান্নাত ও জাহান্নামের বিনাশশীলতা: জাহম ইবনে সাফওয়ান বিশ্বাস করতেন যে, জান্নাত ও জাহান্নাম চিরস্থায়ী নয়, বরং একসময় সেগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুই ধ্বংসশীল।

🛑১১) জায়দিয়া (পাঁচ ইমামপন্থী শিয়া): উৎপত্তি আনুমানিক ১২২-১৩০ হিজরি। বর্তমান হুথি। যায়দিয়া (আরবি: الزيدية, আয-যায়দিয়্যাহ) হলো শিয়া ইসলামের একটি শাখা। এটি শিয়াদের মধ্যে প্রাচীনতম এবং ঐতিহাসিকভাবে সুন্নি ইসলামের সবচেয়ে কাছাকাছি ধারা হিসেবে পরিচিত। এই শাখার অনুসারীরা যায়েদ ইবনে আলী (রহ.)-এর ইমামতে বিশ্বাস করে। যায়দিয়া শিয়াদের নামকরণ করা হয়েছে মহানবী (সা.)-এর প্রপৌত্র, ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পৌত্র এবং ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যয়নুল আবেদীন (রহ.)-এর পুত্র যায়েদ ইবনে আলী (রহ.) থেকে। যায়েদ ইবনে আলী (রহ.) ছিলেন একজন সম্মানিত আলেম ও বীর পুরুষ। তিনি উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, কারণ তিনি তৎকালীন শাসক হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের অন্যায় ও অবিচারের প্রতিবাদ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একজন ইমামকে অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রয়োজনে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে তরবারি হাতে নিতে হবে। এই কারণেই তিনি কুফাতে বিদ্রোহ করেন এবং শেষ পর্যন্ত শাহাদাত বরণ করেন। যায়দিয়া শিয়াদের মূল বিভেদ ঘটেছিল অন্যান্য শিয়াদের সাথে ইমামতের ধারণা নিয়ে। যখন অন্যান্য শিয়ারা (যারা পরবর্তীতে ইসমাইলিয়া ও ইসনা আশারিয়া শিয়া নামে পরিচিত হয়) যায়েদ ইবনে আলীর ভাই মুহাম্মাদ আল-বাকির (রহ.)-কে পরবর্তী ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তখন যায়েদ ইবনে আলীর অনুসারীরা যায়েদ (রহ.)-কে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে এবং বিশ্বাস করে যে, তিনিই ছিলেন প্রকৃত ইমাম। উপশাখা: জারুদিয়া, সুলায়মানিয়া, বাতরিয়া/সালিহিয়া, হাদাওয়িয়া, কাসিমিয়া, তাবারিয়া, ইব্রাহিমিয়া, সরাহিয়্যা, খলাফিয়া।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: 

  • ইমামতের শর্তাবলী: যায়দিয়াদের মতে, একজন ইমাম হওয়ার জন্য শুধু আহলে বাইতের সদস্য হওয়াই যথেষ্ট নয়। একজন ইমামকে অবশ্যই নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে: তিনি অবশ্যই ফাতেমা (রা.)-এর বংশধর হতে হবে (হাসান বা হুসাইনের বংশ থেকে)। তাকে অবশ্যই আলেম হতে হবে এবং ধর্মীয় জ্ঞানে গভীর পাণ্ডিত্য থাকতে হবে। তাকে অবশ্যই সাহসী ও বীর হতে হবে এবং অন্যায় ও অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করার যোগ্যতা ও ইচ্ছা থাকতে হবে। এই শর্তটিকে তারা খুরুজ (خرج) বা ‘বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত করে। যে ব্যক্তি এই শর্ত পূরণ করে, তিনিই ইমাম হিসেবে গণ্য হন। অন্যান্য শিয়াদের মতো তারা ‘অদৃশ্য ইমাম’ বা ‘নিষ্পাপ ইমামে’ বিশ্বাস করে না। তাদের মতে, ইমামগণ নিষ্পাপ নন এবং তারা ভুল করতে পারেন।
  • সাহাবীদের প্রতি মনোভাব: অন্যান্য শিয়াদের (বিশেষত ইসনা আশারিয়া) বিপরীতে, যায়দিয়া শিয়ারা ইসলামের প্রথম দুই খলিফা, হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত উমর (রা.)-কে বৈধ খলিফা হিসেবে গ্রহণ করে। তারা মনে করে যে, যদিও হযরত আলী (রা.) খিলাফতের জন্য অধিকতর যোগ্য ছিলেন, তবুও আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর খেলাফত ইসলামী শরীয়তের আওতাধীন ছিল। তারা সাহাবীদের সমালোচনা করে না বা গালি দেয় না, যা তাদের সুন্নিদের খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে।
  • ফিকহ (আইনশাস্ত্র): যায়দিয়াদের নিজস্ব ফিকহী মাযহাব রয়েছে, যা আল-হাদাউয়ী মাযহাব নামে পরিচিত। এটি অনেকাংশে সুন্নি হানাফী মাযহাবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, এবং কিছু ক্ষেত্রে শাফেয়ী মাযহাবের সাথেও মিল রয়েছে। তারা নিজেদের আইনগত সিদ্ধান্তে ইজতিহাদ (স্বাধীন যুক্তি) প্রয়োগের উপর জোর দেয়।
  • তাকফির থেকে বিরত থাকা: যায়দিয়ারা কবীরা গুনাহকারীকে কাফির মনে করে না, যা খারেজীদের থেকে তাদের পার্থক্য গড়ে তোলে। তারা মুসলিমদের মধ্যে ‘তাকফির’ (কাফির ঘোষণা করা) থেকে বিরত থাকে।
  • গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার: আধুনিক যুগে, যায়দিয়াদের ইমামতের শর্তগুলি (বিশেষত অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ) কিছু রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, যেখানে তারা সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের উপর জোর দেয়। বর্তমানে, যায়দিয়া শিয়াদের বৃহত্তম জনবসতি হলো ইয়েমেন। ইয়েমেনের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যায়দি শিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে, ইয়েমেনের হুথি আন্দোলন যায়দি শিয়াদের অন্তর্গত একটি রাজনৈতিক ও সামরিক গোষ্ঠী।

🛑১২) মুশাব্বিহা: উৎপত্তি আনুমানিক ১৩০-১৫০ হিজরি। মুশাব্বিহা (আরবি: المشبهة, আল-মুশাব্বিহা) হলো যারা আল্লাহ তায়ালাকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ (সদৃশ) করার চেষ্টা করত। ‘মুশাব্বিহা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো “যারা সাদৃশ্য দান করে” বা “সাদৃশ্য স্থাপনকারী”। তাদের মূল প্রবণতা ছিল আল্লাহর গুণাবলী বা সত্তাকে মানবীয় গুণাবলী বা সৃষ্ট বস্তুর সাথে তুলনা করা। মুশাব্বিহা মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল ইসলামের প্রথম দিকে, যখন আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী (সিফাত) নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক শুরু হয়। এই বিতর্কের একটি প্রধান অংশ ছিল কুরআনে এবং হাদীসে বর্ণিত আল্লাহর গুণবাচক নাম বা বর্ণনাগুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। উপশাখা: মুজাসসিমা, হাশবিয়া।

  • বিপরীত মেরু: এই মতবাদ মু’তাজিলা এবং জাহমিয়াদের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। মু’তাজিলা ও জাহমিয়ারা আল্লাহর গুণাবলীকে আক্ষরিক অর্থে অস্বীকার করত বা সেগুলোর ব্যাখ্যা দিত যা আল্লাহর গুণাবলীকে সীমিত করে, পাছে তা আল্লাহর একত্ববাদকে (তাওহীদ) খর্ব না করে। এর প্রতিক্রিয়ায়, কিছু গোষ্ঠী আল্লাহর গুণাবলীকে এত আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করতে শুরু করে যে, তারা আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করে ফেলত।
  • প্রথম দিকের কিছু মুশাব্বিহা: যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠাতা নেই, তবে কিছু ঐতিহাসিক ইবনুল কার্রাম এবং তার অনুসারী কাররামিয়া সম্প্রদায়কে মুশাব্বিহা হিসেবে গণ্য করে, যারা আল্লাহর জন্য দেহ (জিসম) এবং দিক (জিহা) এর মতো গুণাবলী আরোপ করত।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করা: এটি তাদের মূল বৈশিষ্ট্য। তারা কুরআনে এবং হাদীসে বর্ণিত আল্লাহর গুণাবলী (যেমন: আল্লাহর হাত, পা, মুখ, চোখ, আরশের উপর সমাসীন হওয়া ইত্যাদি) কে মানুষের হাত, পা, মুখ বা চোখের মতোই আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করত। উদাহরণস্বরূপ, যখন আল্লাহ সম্পর্কে বলা হয় যে তিনি আরশের উপর ইস্তাওয়া (সমাসীন) হয়েছেন, তখন মুশাব্বিহারা এর আক্ষরিক অর্থ করত যে, তিনি এমনভাবে আরশের উপর বসে আছেন যেমনভাবে একজন মানুষ চেয়ারে বসে। * যখন বলা হয় আল্লাহর ইয়াদ (হাত) আছে, তখন তারা এর অর্থ করত যে তাঁর এমন হাত আছে যা সৃষ্টির হাতের মতোই।
  • সৃষ্ট বস্তুর সাথে তুলনা: তারা আল্লাহকে এমনভাবে বর্ণনা করত যেন তিনি সৃষ্টির মতোই একটি দেহ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধারণকারী সত্তা। এই ধরনের ব্যাখ্যা আল্লাহর নিরঙ্কুশতার (তানযীহ) ধারণার পরিপন্থী।
  • আল্লাহর স্থান ও দিক নির্দিষ্ট করা: মুশাব্বিহাদের কিছু শাখা আল্লাহকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন আরশের উপরে) বা একটি নির্দিষ্ট দিকে (যেমন উপরে) সীমিত করত, যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকিদার “আল্লাহ স্থান ও কাল থেকে মুক্ত” ধারণার বিরুদ্ধে ছিল।

🛑১৩) ইয়াজিদি: উৎপত্তি আনুমানিক ১৩২–২০০ হিজরি। ইয়াজিদি (আরবি: اليزيدية – Al-Yazīdīyah; কুর্দি: ئێزیدی – Êzidî) হলো একটি স্বতন্ত্র, একেশ্বরবাদী ধর্ম যা মূলত কুর্দিভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত। এটি মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন মেসোপটেমীয় ধর্মগুলোর উপাদান, যেমন জরথুস্ত্রবাদ এবং প্রাচীন স্থানীয় বিশ্বাস, সেইসাথে কিছু ইসলামি ও খ্রিস্টান প্রভাবের সমন্বয়ে গঠিত একটি ধর্ম। ইয়াজিদিদের উৎপত্তিস্থল হলো বর্তমান ইরাকের মসুল শহরের আশেপাশে, বিশেষ করে সিনজার পর্বতমালা এলাকায়।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • এক ঈশ্বর ও সাত পবিত্র সত্তা: ইয়াজিদীরা একজন সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, যিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সরাসরি এর দৈনন্দিন কার্যক্রমে জড়িত হন না। তিনি সাতজন পবিত্র সত্তাকে মহাবিশ্ব পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন, যাদেরকে ‘হেফত সির’ (সাত রহস্য) বা ‘আঞ্জেলস’ বলা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেন তাউস মালেক (ময়ূর ফেরেশতা), যিনি প্রধান ফেরেশতা এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত।
  • ২. তাউস মালেক (ময়ূর ফেরেশতা): ইয়াজিদিদের কাছে তাউস মালেক অত্যন্ত সম্মানিত একটি সত্তা। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি হলেন সেই ফেরেশতা যাকে ঈশ্বর আদমকে সেজদা করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি অহংকারবশত তা অস্বীকার করেননি বরং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা হিসেবে দেখেছিলেন যে তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদা করবেন না। এই ঘটনাকে ইসলামে শয়তানের অবাধ্যতা হিসেবে দেখা হলেও, ইয়াজিদীরা এটিকে তাউস মালেকের ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে দেখে এবং তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। এই ভিন্ন ব্যাখ্যার কারণেই ইয়াজিদীদেরকে প্রায়শই “শয়তান পূজারী” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
  • ৩. পুনর্জন্ম: ইয়াজিদীরা পুনর্জন্ম বা আত্মার স্থানান্তরে বিশ্বাস করে। তাদের মতে, আত্মা মৃত্যুর পর অন্য দেহে প্রবেশ করে এবং এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকে যতক্ষণ না আত্মা পরিশুদ্ধ হয়ে ঈশ্বরের কাছে ফিরে যেতে পারে। তাদের ধারণা, যারা খারাপ কাজ করে, তাদের আত্মা নিম্নস্তরের জীব বা বস্তুতে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে।
  • ৪. ধর্মীয় গ্রন্থ: ইয়াজিদিদের দুটি প্রধান পবিত্র গ্রন্থ রয়েছে: কিতাব আল-জিলওয়াহ এটি তাউস মালেকের উপদেশাবলী ধারণ করে। মুসহাফ রাশ এটি ইয়াজিদি ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব এবং অন্যান্য বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করে। তবে, তাদের ধর্ম মূলত মৌখিক ঐতিহ্য এবং গোপন জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল।
  • ৫. সামাজিক কাঠামো: ইয়াজিদি সমাজে একটি কঠোর জাতিগত এবং বংশগত শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। তাদের সমাজে প্রধানত তিনটি জাতিগত শ্রেণি বিদ্যমান: পীর: ধর্মীয় নেতা এবং আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক, শায়খ: ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষক, মুরিদ: সাধারণ অনুসারী। তাদের ধর্ম ও সমাজ কাঠামো মূলত বংশানুক্রমিক, বাইরের কেউ এই ধর্মে প্রবেশ করতে পারে না।
  • হিন্দু ধর্মের সঙ্গে কিছু মিল রয়েছে যেমন পুনর্জন্ম, প্রদীপ জ্বালানো, আরতি, মন্দিরে বিয়ে, কর্মফল ইত্যাদি।
  • ইয়াজিদি ধর্ম নবীপ্রথা অস্বীকার করে।

🛑১৪) খাত্তাবিয়া/গারাবিকিয়া (শিয়া): উৎপত্তি আনুমানিক ১৪০-১৫০ হিজরি। খাত্তাবিয়া সম্প্রদায়টি ইরাকের কুফায় উদ্ভূত হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবুল খাত্তাব মুহাম্মাদ ইবনে আবি যায়নাব আল-আসাদি আল-আজদা’ (আবু আল-খাত্তাব নামে পরিচিত)। তিনি ছিলেন শিয়া ইমাম জা’ফর আস-সাদিক (রহ.)-এর একজন প্রাক্তন শিষ্য। জা’ফর আস-সাদিক (রহ.) তার চরমপন্থী মতবাদের কারণে তাকে বর্জন করেছিলেন।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ইমামদের ঐশ্বরিককরণ: খাত্তাবিয়ারা বিশ্বাস করত যে, শিয়া ইমামগণ, বিশেষ করে হযরত আলী (রা.) এবং তার বংশধররা (আহলে বাইত), আল্লাহর ঐশ্বরিক গুণাবলী ধারণ করেন। তারা ইমামদেরকে খোদা বা খোদার প্রকাশ হিসেবে দেখত। আবুল খাত্তাব নিজেও নিজেকে ‘নবী’ এবং ইমাম জা’ফর আস-সাদিককে ‘খোদা’ বলে দাবি করতেন।
  • সৃষ্ট বস্তুর উপাসনা: তারা বিশ্বাস করত যে, ইমামদেরকে উপাসনা করা জায়েজ, কারণ তারা আল্লাহর ঐশ্বরিক সত্তার প্রকাশ। এটি ইসলামের মৌলিক তাওহীদ (একত্ববাদ) ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
  • আল্লাহর গুণাবলীর মানবীয়করণ (তাশবীহ ও তাজসিম): তারা আল্লাহকে মানবীয় রূপে কল্পনা করত এবং তাঁর জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আরোপ করত। এটি মুশাব্বিহা ও মুজাস্সিমা মতবাদের চরম রূপ ছিল।
  • শরীয়তের বিলুপ্তি: খাত্তাবিয়ারা মনে করত যে, তারা যেহেতু ঐশ্বরিক সত্যের গভীর জ্ঞান লাভ করেছে, তাই তাদের জন্য শরীয়তের (ইসলামী আইন) বাধ্যবাধকতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা নামাজ, রোজা, হজ্ব এবং অন্যান্য ইসলামী ইবাদতকে প্রতীকী অর্থে ব্যাখ্যা করত এবং সেগুলোর বাহ্যিক আমল পরিত্যাগ করত।
  • জন্মান্তরবাদ: কিছু খাত্তাবিয়া দল জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করত।
  • নৈতিক অবক্ষয়: তাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করত যে, যেহেতু তারা ইমামদের ঐশ্বরিক জ্ঞানের অংশীদার, তাই তারা যেকোনো কাজ করতে স্বাধীন, এমনকি হারাম কাজও। এটি তাদের মধ্যে চরম নৈতিক অবক্ষয় এবং পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করেছিল।

গারাবিকিয়া হলো খাত্তাবিয়াদেরই একটি উপশাখা, যারা আরও চরমপন্থী মতবাদ পোষণ করত। ‘গারাবিকিয়া’ শব্দটি আরবি ‘গারাব’ (غراب) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘কাক’। এই নামকরণের কারণ হলো তাদের এই বিশ্বাস যে, জিবরাঈল (আ.) ভুল করে নবুওয়াত হযরত আলী (রা.)-এর কাছে না নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কারণ আলী (রা.) এবং মুহাম্মদ (সা.) দেখতে প্রায় একই রকম ছিলেন, যেমন দুটি কাক দেখতে একই রকম হয়। (নাউজুবিল্লাহ)।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • জিবরাঈল (আ.)-এর ভুল: গারাবিকিয়ারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহ আসলে হযরত আলী (রা.)-কে নবী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন এবং কুরআন তাঁর উপর নাজিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) ভুলক্রমে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন, কারণ তাদের মধ্যে চেহারায় অনেক সাদৃশ্য ছিল। এটি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস (নবুওয়াত এবং ওহী) কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।
  • ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব: এই মতবাদের মাধ্যমে তারা হযরত আলী (রা.)-কে এমনকি মহানবী (সা.)-এর চেয়েও শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার চেষ্টা করত।

🛑১৫) ইসমাইলিয়া (শিয়া): উৎপত্তি আনুমানিক ১৪৮-১৬০ হিজরি। ইসমাইলিয়া হলো শিয়া ইসলামের একটি শাখা। এটি বারো ইমামপন্থী শিয়া শিয়াদের (ইছনা আশারিয়া) থেকে ভিন্ন, কারণ তারা ষষ্ঠ শিয়া ইমাম জাফর আস-সাদিক এর বড় ছেলে ইসমাইল ইবনে জাফরকে পরবর্তী ইমাম হিসেবে স্বীকার করে, যেখানে বারো ইমামপন্থীরা ইসমাইলের ছোট ভাই মূসা আল-কাযিমকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে। এই উত্তরাধিকার বিতর্কের কারণেই ইসমাইলিয়াদের উৎপত্তি হয়। ইসমাইলিরা বিশ্বাস করে যে, ইসমাইলের মাধ্যমেই ইমামতের গোপন ধারা প্রবাহিত হয়েছে। তাদের মতে, ইমামরা শুধু রাজনৈতিক নেতা নন, বরং ঐশ্বরিক জ্ঞানের ধারক এবং মানবজাতির জন্য আল্লাহর নির্দেশের ব্যাখ্যাকারী। উপশাখা: নিজারি (আগাখানী), মুস্তাআলি, দাউদী বোহরা, সুলাইমানি, আলাভি, বাতিনিয়া, কারামিতা, হাফিজি, হাসাসিন, দ্রুজ (দ্রুজ আলাদা ধর্মে পরিণত হয়েছে)।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ইমামতের ধারণা: ইসমাইলিয়ারা ইমামতকে ঐশী, অবিচ্ছিন্ন এবং জীবন্ত নেতৃত্ব হিসেবে দেখে। তারা বিশ্বাস করে যে, ইমাম হলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত, নিষ্পাপ এবং তিনি আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় বিষয়ে সম্প্রদায়ের জন্য নির্দেশিকা প্রদান করেন। তারা জীবিত, প্রকাশ্য ইমামের নেতৃত্বে বিশ্বাসী। তাদের মতে, আল্লাহর নির্দেশনা সবসময় একজন জীবিত ইমামের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পৌঁছে, যিনি ঐশ্বরিক জ্ঞানের উত্তরাধিকারী।
  • জাহির (বাহ্যিক) ও বাতিন (ভিতরের) অর্থের উপর জোর: ইসমাইলিয়ারা কুরআন ও শরীয়তের গুপ্ত বা নিগূঢ় অর্থ (বাতিন) এর উপর বিশেষ জোর দেয়, যা কেবলমাত্র ইমামদের মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব। তারা বিশ্বাস করে যে, ইসলামের একটি বাহ্যিক, আক্ষরিক অর্থ (জাহির) রয়েছে যা সাধারণ মানুষের জন্য, কিন্তু এর একটি গভীর, রূপক অর্থও রয়েছে যা উচ্চতর আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রদান করে। এই কারণে তাদের বাতিনী সম্প্রদায় হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। এই গুপ্ত অর্থ উন্মোচন করার পদ্ধতিকে তারা তা’ওয়িল বলে।
  • তাকিয়া (আত্মগোপন): প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্বাস গোপন রাখা, বিশেষ করে যখন প্রকাশ করলে জান বা ধর্মের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন তাকিয়া করাকে জায়েজ মনে করা হয়।
  • বাতিনিয়া পদ্ধতি: ইসমাইলিরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো এবং ইসলামী আইন (শরীয়ত) ব্যাখ্যা করার জন্য বাতিনিয়া পদ্ধতি ব্যবহার করে। তারা মনে করে যে, বাহ্যিক নিয়মকানুন (জাহির) হলো অভ্যন্তরীণ সত্যের (বাতিন) প্রতীক। যেমন: সালাত, সাওম, হজ্ব ইত্যাদির বাহ্যিক রূপের পাশাপাশি একটি গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ রয়েছে।
  • নুবুওয়াত ও ইমামত: ইসমাইলিরা নবুওয়াত (নবীদের আগমন) এবং ইমামতের একটি চক্রীয় ধারণা পোষণ করে। তারা বিশ্বাস করে যে, ধর্মীয় আইনগুলো (শরীয়ত) নবীদের (নাতিক) মাধ্যমে আসে, আর ইমামরা সেই আইনগুলোর গভীর অর্থ প্রকাশ করেন।

🛑১৬) বাতিনিয়া (শিয়া): উৎপত্তি আনুমানিক ১৪৮-১৬০ হিজরি। বাতিনিয়া হলো একটি মতাদর্শ। ‘বাতিনিয়া’ শব্দটি আরবি ‘বাতিন’ (باطن) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘গোপন’ বা ‘অভ্যন্তরীণ’। বাতিনিয়ারা বিশ্বাস করে যে, কুরআনের আয়াত এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোর একটি বাহ্যিক বা আক্ষরিক (জাহির) অর্থ থাকার পাশাপাশি একটি গভীর, গোপন বা অভ্যন্তরীণ (বাতিন) অর্থ রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাদের মতে, এই অভ্যন্তরীণ জ্ঞান শুধুমাত্র তাদের ইমামগনের মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব। বাতিনিয়া হলো একটি পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি যা ইসমাইলিরা (এবং অন্যান্য কিছু গোষ্ঠী) তাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অনুসরণ করে।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • জাহির (বাহ্যিক) ও বাতিন (ভিতরের) অর্থের দ্বৈততা: বাতিনিয়ারা মনে করে যে ধর্মীয় আয়াত, বিধান, এমনকি মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনার একটি সুস্পষ্ট, আক্ষরিক অর্থ আছে যা সাধারণ মানুষের জন্য প্রযোজ্য। তবে এর পাশাপাশি একটি গভীর, রূপক অর্থও রয়েছে, যা কেবল বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাই (যেমন ইমামগণ) উপলব্ধি করতে পারেন।
  • তা’ওয়িল (ব্যাখ্যা): এই গুপ্ত অর্থ উন্মোচন করার পদ্ধতিকে তারা তা’ওয়িল বলে। তাদের মতে, শুধু বাহ্যিক ব্যাখ্যা বা তাফসীর যথেষ্ট নয়।
  • শরীয়তের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি: কিছু চরমপন্থী বাতিনী গোষ্ঠী এই বাতিন অর্থের ওপর এতটাই জোর দেয় যে তারা বাহ্যিক শরীয়তের বিধানগুলো (যেমন নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ) অপ্রয়োজনীয় বা সাধারণ মানুষের জন্য মনে করে। তারা বিশ্বাস করে যে একজন ব্যক্তি যখন বাতিন জ্ঞান অর্জন করে, তখন তার জন্য বাহ্যিক শরীয়তের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। এই প্রবণতাকে ইবাহিয়্যা বলা হয়, যেখানে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে শিথিলতা বা প্রত্যাখ্যান দেখা যায়।
  • ইমামের ভূমিকা: বাতিনিয়াদের কাছে ইমাম (বা আধ্যাত্মিক নেতা) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বাস করে যে ইমামই বাতিন জ্ঞানের ধারক এবং তিনিই এই গুপ্ত অর্থের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী ইমামকে ঐশ্বরিক গুণাবলী বা ক্ষমতার অধিকারী মনে করে
  • কুরআনের বিকৃতি: বাতিনী ব্যাখ্যাগুলো কুরআনের সুস্পষ্ট অর্থকে বিকৃত করে এবং নিজেদের মনগড়া অর্থ আরোপ করে।
  • শরীয়তের বিলুপ্তি: বাতিনিয়ারা শরীয়তের বাহ্যিক বিধানাবলীকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে।
  • তাকফির (কাফির ঘোষণা): কিছু চরমপন্থী বাতিনী গোষ্ঠী অন্যদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকেও বৈধ মনে করে.।

🛑১৭) মুজাসসিমা: উৎপত্তি আনুমানিক ১৫০-২০০ হিজরি। মুজাস্সিমা (আরবি: المجسمة, আল-মুজাস্সিমাহ) হলো যারা আল্লাহ তায়ালাকে একটি শারীরিক রূপ বা দেহ (জিসম) আছে বলে বিশ্বাস করত। ‘মুজাস্সিমা’ শব্দের অর্থ হলো “যারা আল্লাহকে দেহ বা আকার দান করে”। এটি মুশাব্বিহা (যারা আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দান করে) সম্প্রদায়েরই একটি চরম শাখা বা প্রায় সমার্থক একটি পরিভাষা। মুশাব্বিহারা আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দিত, আর মুজাস্সিমারা এই সাদৃশ্যকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে আল্লাহকে একটি সুনির্দিষ্ট দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী সত্তা হিসেবে দেখত। জাস্সিমা মতবাদের উৎপত্তি ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে যখন আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী (সিফাত) নিয়ে বিতর্ক তীব্র আকার ধারণ করে। মু’তাজিলা ও জাহমিয়ারা আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করত বা সেগুলোর ব্যাখ্যা দিত যা আল্লাহর গুণাবলীকে সীমিত করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে, কিছু গোষ্ঠী এতটাই আক্ষরিক ব্যাখ্যায় লিপ্ত হয় যে তারা আল্লাহকে সৃষ্টির মতো দেহধারী সত্তা হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করে।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর জন্য দেহ আরোপ: মুজাস্সিমারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর একটি শারীরিক অস্তিত্ব বা দেহ রয়েছে। তারা আল্লাহর গুণাবলী যেমন হাত, পা, চোখ, মুখ, আরশের উপর সমাসীন হওয়া ইত্যাদিকে মানবীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতোই আক্ষরিক ও শারীরিক অর্থে ব্যাখ্যা করত।
  • সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য (তাশবীহ): তাদের এই বিশ্বাস সরাসরি আল্লাহর নিরঙ্কুশতার (তানযীহ) ধারণার পরিপন্থী। তারা আল্লাহকে এমনভাবে বর্ণনা করত যেন তিনি তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা কুরআনের ” “(তাঁর মতো কিছুই নেই) [সূরা শুরা, ৪২:১১] আয়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত।
  • স্থান ও দিক আরোপ: মুজাস্সিমার কিছু শাখা আল্লাহকে একটি নির্দিষ্ট স্থান (যেমন আরশের উপরে) এবং একটি নির্দিষ্ট দিকে (যেমন উপরে) সীমিত করত। এটি সুন্নি আকিদার “আল্লাহ স্থান ও কাল থেকে মুক্ত” ধারণার বিরুদ্ধে।
  • সৃষ্ট বস্তুর বৈশিষ্ট্য আরোপ: তারা আল্লাহকে এমন বৈশিষ্ট্য দ্বারা বর্ণনা করত যা কেবল সৃষ্টির পক্ষেই প্রযোজ্য, যেমন ওজন, আকার, গতি বা স্থবিরতা।

🛑১৮) নুসাইরিয়া/আলাউই (শিয়া): উৎপত্তি আনুমানিক ১৫০-২৭০ হিজরি। নুসাইরিয়া, যাদেরকে আলাউই নামেও পরিচিত। তাদের বিশ্বাস ও রীতিনীতি (সুন্নি ও শিয়া ইসনা আশারিয়া) থেকে যথেষ্ট ভিন্ন এবং এতে সুফি, শিয়া, খ্রিস্টান এবং প্রাচীন পৌত্তলিক কিছু প্রভাবের সংমিশ্রণ দেখা যায়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো প্রায়শই গোপন রাখা হয়। নুসাইরিয়াদের উৎপত্তির মূল শিকড় রয়েছে নবম শতাব্দীর শেষ দিকে (৩য় হিজরী শতাব্দী)। এই সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতা আবু শুয়াইব মুহাম্মাদ ইবনে নুসাইর আন-নুমাইরি (আবু শুআইব) এর নামে। তিনি ছিলেন শিয়া ইমাম হাসান আল-আসকারী (১১তম ইমাম)-এর অনুসারী এবং পরে নিজেকে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে দাবি করেন।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ঐশ্বরিক ত্রয়ী (Trinity): আলাউইরাও আল্লাহর প্রকাশকে একটি ত্রয়ীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে। এই ত্রয়ী হলো: মা’না (المعنى – অর্থ/ভাবসত্তা): এটি ঐশ্বরিক সত্তা বা ‘আল-হাকিম’, যিনি সকল সৃষ্টির উৎস। আলাউইরা বিশ্বাস করে যে, হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) ছিলেন এই ঐশ্বরিক সত্তার প্রকাশ। ইসম (الإسم – নাম/পর্দা): এটি ঐশ্বরিক সত্তার ‘নাম’ বা ‘পর্দা’, যা মা’নাকে গোপন রাখে। আলাউইরা বিশ্বাস করে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন এই ‘ইসম’। বাব (الباب – দরজা): এটি ‘ইসম’-এর দরজা, যার মাধ্যমে ঐশ্বরিক জ্ঞান মানবজাতির কাছে পৌঁছায়। আলাউইরা বিশ্বাস করে যে, সালমান আল-ফারসি (রা.) ছিলেন এই ‘বাব’। তাদের বিশ্বাসকে ‘আ-ম-স’ (ع-م-س) ফর্মুলা দ্বারা সংক্ষেপ করা হয়: আলী (মা’না), মুহাম্মাদ (ইসম), সালমান (বাব)।
  • জন্মান্তরবাদ: দিরুজদের মতো আলাউইরাও আত্মাদের পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুর পর আত্মা অন্য একটি দেহে প্রবেশ করে। পুণ্যাত্মারা পুনর্জন্ম নিয়ে আরও উন্নত রূপে আসে, আর পাপীরা জন্তু-জানোয়ার বা অ-আলাউইদের দেহে পুনর্জন্ম নিতে পারে।
  • শরীয়তের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি: আলাউইরা ইসলামের প্রচলিত শরিয়াহ (যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত) অনুসরণ করে না। তারা এই ইবাদতগুলোর অভ্যন্তরীণ বা প্রতীকী অর্থকে বেশি গুরুত্ব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, তাদের ‘সালাত’ হলো কিছু গোপন প্রার্থনা যা দিনে পাঁচবার পড়ার পরিবর্তে নির্দিষ্ট দিনে পড়া হয়। তারা মদপানকে জায়েজ মনে করে।
  • গোপনীয়তা (তাকিয়া): আলাউইরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো কঠোরভাবে গোপন রাখে, বিশেষ করে অ-আলাউইদের কাছ থেকে। তারা ‘তাকিয়া’ (আত্মরক্ষা বা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন করা) নীতি অনুশীলন করে।
  • খ্রিস্টান প্রভাব: তাদের কিছু উৎসবে খ্রিস্টান প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যেমন ক্রিসমাস এবং ইস্টার। তারা কিছু খ্রিস্টান সাধু ও ব্যক্তিত্বকে সম্মান করে।
  • সামাজিক ও লিঙ্গ বিভাজন: তাদের সমাজে পুরুষদের আধ্যাত্মিক দীক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের সুযোগ রয়েছে, কিন্তু নারীদের সাধারণত ধর্মীয় দীক্ষা দেওয়া হয় না এবং তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতে পারে না।

🛑১৯) সূফিবাদ: উৎপত্তি আনুমানিক ২০০-৩০০ হিজরি। সূফিবাদ হলো ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক বা রহস্যবাদী ধারা, যা আত্মিক পরিশুদ্ধি, আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং তাঁর নৈকট্য লাভের উপর গুরুত্বারোপ করে। এটি ইসলামের বাহ্যিক শরীয়তের পাশাপাশি এর অভ্যন্তরীণ, আধ্যাত্মিক দিকটি নিয়ে কাজ করে। সূফিরা নিজেদেরকে ‘তাসাউফ’ বা ‘ইহসান’ (উত্তম কর্ম) এর অনুসারী বলে পরিচয় দেন। ‘সূফি’ শব্দটি সম্ভবত আরবি ‘সুফ’ (صوف) থেকে এসেছে, যার অর্থ পশম, যা দ্বারা প্রথম দিকের সূফিরা পশমের তৈরি সাধারণ পোশাক পরতেন। উপশাখা: কাদিরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, মওলভিয়া, শাযুলিয়া, তিজানিয়া, বেকতাশিয়া, নি’মাতুল্লাহিয়্যাহ, দাহাবিয়া, কালন্দরিয়া, সাবরিয়া, মাদারিয়া, আহমদিয়া সুফি, রিফাইয়া, সাত্তারিয়া, সেনুশিয়া, শাজিলিয়া,  ফিরদৌসিয়া, কুবরাবিয়া, নোরাব্বাকশিয়া, ঋষি তরিকা, সারিওয়ালি, রায্যাক্বীয়্যাহ, মুরিদিয়া, বারকাতিয়া, মাইজভান্ডারিয়া, সুরেশ্বরী, ফুরফুরা, আটরশি, ছরছিনা, রাজারবাগী, ফুলতলী, এনায়েতপুরী, চরমোনাই তরিকা, শাহজালাল ও শাহপরান, জুগিরকান্দি, চুনতি, মোহাম্মাদিয়া, খুব্রাওয়িয়াহ, দেওয়ানবাগী, কুতুববাগী, জৈনপুরী, রাহে ভান্ডার, বাউল তরিকা, ফরায়েজিকান্দি, সোনাকান্দা, আশরাফিয়া, নিজামিয়া, উম্মিয়া তরিকা, মেভলেভি বা মৌলভি তরিকা, কুবরাইয়া, মুরিদিয়া তরিকা, সেনুসি তরিকা।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা (ইশক): সূফিরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর প্রতি চরম ভালোবাসা এবং তাঁর নৈকট্য লাভই মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটি শুধু ভীতি নয়, বরং গভীর প্রেম দ্বারা চালিত হয়।
  • আত্মশুদ্ধি (তাযকিয়াতুন নফস): নফসের (আত্মা/নিম্ন সত্তা) খারাপ প্রবণতাগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা সূফিবাদের মূল ভিত্তি। এর মাধ্যমে অহংকার, লোভ, ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি দূর করে বিনয়, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা এবং আল্লাহর উপর ভরসা স্থাপন করা হয়।
  • জিকির (আল্লাহর স্মরণ): নিয়মিতভাবে আল্লাহর নাম জপ করা বা স্মরণ করা (জিকির) সূফিবাদের একটি প্রধান অনুশীলন। এটি নীরব (জিকরে খফি) বা উচ্চস্বরে (জিকরে জলি) হতে পারে।
  • মুরাকাবা (ধ্যান): আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর মহিমা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করা, যা আত্মিক উপলব্ধির জন্য অপরিহার্য।
  • ফানা ও বাকা (বিলীন হওয়া ও অবশিষ্ট থাকা): ফানা হলো ব্যক্তির সত্তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে আল্লাহর সত্তায় বিলীন হওয়ার একটি আধ্যাত্মিক অবস্থা। এটি আল্লাহর সাথে চরম নৈকট্যের প্রতীক। ফানার পর আসে বাকা, যেখানে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে ফিরে আসে।
  • পীর-মুর্শিদ (আধ্যাত্মিক শিক্ষক): সূফিরা সাধারণত একজন যোগ্য পীর বা শাইখের (আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক) হাতে বাইয়াত (শপথ) গ্রহণ করে আধ্যাত্মিক পথে পা বাড়ায়। পীর শিষ্যকে আত্মিক বিকাশের পথে নির্দেশনা দেন।
  • শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত, মা’রিফাত: সূফিবাদ এই চারটি ধাপকে আধ্যাত্মিক যাত্রার অংশ হিসেবে দেখে: শরীয়ত: ইসলামের বাহ্যিক আইন ও বিধিবিধান। তরীকত: আধ্যাত্মিক পথ, যা শরীয়তের গভীর অর্থ উপলব্ধি এবং আত্মশুদ্ধির অনুশীলন। হাকীকত: ঐশী সত্যের উপলব্ধি। মা’রিফাত: আল্লাহর গভীর জ্ঞান এবং তাঁর সত্তার উপলব্ধি।

🛑২০) নাজ্জারিয়া (মুতাজিলা): উৎপত্তি আনুমানিক ২২০ হিজরি। নাজ্জারিয়া ছিল মুতাজিলা মতবাদের একটি উপশাখা, যা মূলধারার মুতাজিলাদের তুলনায় কিছু ভিন্ন দার্শনিক ও কালামভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল। এই সম্প্রদায় ইরাকের বসরা বা বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আল-হুসাইন আন-নাজ্জার।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • কুরআন সৃষ্ট: নাজ্জারিয়ারা মু’তাজিলাদের মতো বিশ্বাস করত যে, কুরআন সৃষ্ট (মাখলুক), অর্থাৎ এটি আল্লাহর শাশ্বত বাণী নয়, বরং তিনি এটি সৃষ্টি করেছেন। এই বিষয়টি আব্বাসীয় খিলাফতের সময় একটি বড় ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, যেখানে সুন্নি আলেমগণ (যেমন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল) কুরআনের অনাদি হওয়ার পক্ষে ছিলেন।
  • আল্লাহর গুণাবলী: আল্লাহর গুণাবলী (সিফাত) সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মু’তাজিলাদের কাছাকাছি ছিল। তারা আল্লাহর সত্তা থেকে গুণাবলীকে পৃথক সত্তা হিসেবে অস্বীকার করত। তাদের মতে, আল্লাহর গুণাবলী আল্লাহর সত্তার মধ্যেই নিহিত এবং সেগুলো আল্লাহর সত্তা থেকে আলাদা নয়। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ ‘আলিম’ (জ্ঞানী) কারণ তাঁর সত্তাই জ্ঞান, পৃথক কোনো ‘জ্ঞান’ গুণ নেই।
  • মানুষের কর্মের স্বাধীনতা ও তাকদির: এই বিষয়ে নাজ্জারিয়ারা জাবরিয়া (যারা মনে করত মানুষ তার কর্মে সম্পূর্ণ বাধ্য) এবং কাদেরিয়া (যারা মনে করত মানুষ তার কর্মে সম্পূর্ণ স্বাধীন) উভয়ের থেকে একটি মধ্যপন্থী অবস্থান নিতে চেয়েছিল।
    • তারা বিশ্বাস করত যে, মানুষের কর্ম আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট। তবে, মানুষ সেই কর্মের ক্ষমতা অর্জন করে এবং সেই ক্ষমতার ব্যবহারের জন্য দায়ী। অর্থাৎ, আল্লাহ মানুষকে কাজ করার ক্ষমতা দেন, আর মানুষ সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে কাজটি সম্পাদন করে। এই বিষয়টি সুন্নিদের ‘কাসব’ (অর্জন) ধারণার সাথে কিছুটা মিল থাকলেও, নাজ্জারিয়ারা আল্লাহর সৃষ্টির উপর বেশি জোর দিত।
    • তাদের মতে, আল্লাহই সব কাজের স্রষ্টা, এমনকি মানুষের মন্দ কাজেরও। কিন্তু মানুষের সেই কাজ করার “ইচ্ছা” এবং “সক্ষমতা” তাকে সেই কাজের জন্য দায়ী করে তোলে।
  • ঈমান: ঈমানের ক্ষেত্রে নাজ্জারিয়ারা মনে করত যে, ঈমান কেবল মুখের স্বীকারোক্তি এবং অন্তরের বিশ্বাস। আমল (কর্ম) ঈমানের অংশ নয়। এই দিক থেকে তারা মুরজিয়াদের মতবাদের কাছাকাছি ছিল, যারা কবীরা গুনাহকারীকে মুসলিম হিসেবেই গণ্য করত।
  • দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা: নাজ্জারিয়াদের মধ্যে কিছু উপদলও ছিল, যাদের মধ্যে মতভেদ ছিল। কিছু নাজ্জারিয়া মনে করত যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়, আবার কেউ কেউ শর্তসাপেক্ষে দেখার সম্ভাবনাকে স্বীকার করত।
  • দর্শন ও যুক্তির প্রাধান্য: যুক্তি ও দর্শনের মাধ্যমে আকীদা ব্যাখ্যা করাকে গুরুত্ব দিতেন।

🛑২১) কাররামিয়া: উৎপত্তি আনুমানিক ২৫০-৩০০ হিজরি। কাররামিয়া হলো একটি বিতর্কিত এবং বিলুপ্ত সম্প্রদায়, যারা আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে কাররাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্প্রদায়ের নামকরণ তার নামানুসারেই করা হয়েছে। কাররামিয়ারা তাদের স্বতন্ত্র এবং কিছু চরমপন্থী ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদের জন্য পরিচিত ছিল, যা সুন্নি ইসলামের মূলধারা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর জন্য দেহ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আরোপ (তাজসিম): এটি কাররামিয়াদের সবচেয়ে বিতর্কিত মতবাদ ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর একটি দেহ (জিসম) রয়েছে, তবে তা সাধারণ মানুষের দেহের মতো নয়, বরং একটি ‘অনন্য দেহ’ যা তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন। তারা আল্লাহর জন্য স্থান ও দিকও আরোপ করত, যেমন তারা বিশ্বাস করত যে আল্লাহ আরশের উপর এমনভাবে উপবিষ্ট যেমনভাবে কোনো মানুষ একটি আসনে বসে। এই মতবাদ তাদের মুজাস্সিমা (দেহবাদী) এবং মুশাব্বিহা (সাদৃশ্যদানকারী) সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে।
  • ঈমান কেবল মুখের স্বীকারোক্তি: কাররামিয়াদের মতে, ঈমান হলো কেবল মুখের স্বীকারোক্তি (ইকরার বিল লিসান), অর্থাৎ মুখে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” বলা। অন্তরের বিশ্বাস (তাসদিক বিল কালব) বা আমল (কর্ম) ঈমানের জন্য অপরিহার্য নয়। এই দিক থেকে তারা মুরজিয়া সম্প্রদায়ের চরম শাখার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তাদের মতে, একজন ব্যক্তি যদি মুখে ঈমান ঘোষণা করে, তবে সে মুমিন, যদিও তার অন্তরে বিশ্বাস না থাকে এবং সে কোনো ভালো কাজ না করে বা প্রকাশ্যে পাপ করে।
  • আল্লাহর কথা বলার প্রকৃতি: তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর কথা বলা (কালামুল্লাহ) নবসৃষ্ট (হাদিস)। অর্থাৎ, কুরআন আল্লাহর একটি নবসৃষ্ট বাণী, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ে অস্তিত্ব লাভ করেছে। এই মতবাদ মু’তাজিলা ও জাহমিয়াদের সৃষ্ট কুরআনের ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
  • নৈতিকতা ও কর্মের প্রভাব: যেহেতু তারা ঈমানকে কেবল মুখের স্বীকারোক্তি হিসেবে দেখত, তাই কর্মের (আমল) গুরুত্ব তাদের কাছে তুলনামূলকভাবে কম ছিল। এর ফলে, তাদের মধ্যে কিছু উপদলের বিরুদ্ধে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগও উঠেছিল।

🛑২২) জুব্বাইয়াহ (মুতাজিলা): উৎপত্তি আনুমানিক ২৭০–৩০০ হিজরি। জুব্বাইয়াহ হলো মুতাজিলা মতবাদের একটি উপশাখা। এর নামকরণ করা হয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান তাত্ত্বিক আবু আলী মুহাম্মাদ ইবনে আব্দ আল-ওয়াহাব আল-জুব্বাই (আবু আলী আল-জুব্বাই) এর নামানুসারে। তিনি বসরা অঞ্চলের মুতাজিলাদের প্রধান আলেম ছিলেন।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: 

  • আল্লাহর গুণাবলি: তারা আল্লাহর গুণাবলিকে সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করে।
  • মানব স্বাধীনতা: তারা মানুষের কর্মের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার উপর দৃঢ়ভাবে জোর দেয়। তারা মনে করত যে, মানুষ নিজেই তার ভালো বা মন্দ কর্মের স্রষ্টা। যদি আল্লাহ মানুষের কর্মের স্রষ্টা হত, তাহলে পুরস্কার ও শাস্তির ধারণা অর্থহীন হয়ে যেত এবং আল্লাহকে অন্যায়কারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হতো। এটি কাদারিয়াদের মতামতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
  • তাকদির: আল্লাহর পূর্বনির্ধারণ নয়, বরং মানুষ নিজেই তার কর্মের নিয়ন্ত্রক।
  • কুরআন সৃষ্ট: কুরআনকে সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করে, যা মুতাজিলাদের সাধারণ অবস্থান।
  • তারা বিশ্বাস করে কোনো কর্মের ফল যদি এর বিপরীত হয় (যেমন, আগুনে হাত দেওয়ার ফলে গরম হওয়া, কিন্তু কখনো কখনো ঠান্ডা হওয়া), তবে সেই বিপরীত ফল সরাসরি আল্লাহর সৃষ্টি নয়, বরং কর্মেরই অন্তর্নিহিত ফল।

🛑২৩) কারামিতা (শিয়া): উৎপত্তি আনুমানিক ২৭৮-৩১৭ হিজরি। কারামিতা ছিল একটি অত্যন্ত উগ্রপন্থী ও বিপ্লবী শিয়া ইসমাইলি উপদল, যারা মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় ছিল। কারামিতা গোষ্ঠী, বিশেষ করে তাদের নেতা আবু তাহির আল-কারামাতি, ইসলামী বিশ্বের জন্য একটি বড় আতঙ্ক ছিল। ৩১৭ হিজরীতে তারা মক্কায় হজের সময় আক্রমণ করে। এই হামলায় তারা প্রায় ৩০,০০০ হাজিকে নির্বিচারে হত্যা করে, জমজম কূপ হাজিদের লাশে ভরে দেয় এবং সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ হলো হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) চুরি করে নিয়ে যায়। হাজরে আসওয়াদ ২৩ বছর তাদের দখলে ছিল।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • গোপন জ্ঞান (বাতিন): তারা বিশ্বাস করত যে, কুরআনের আয়াত এবং ইসলামী শরীয়তের বাহ্যিক অর্থের (জাহির) পাশাপাশি একটি গোপন, অভ্যন্তরীণ অর্থ (বাতিন) রয়েছে, যা কেবল তাদের ইমামদের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। তারা বাহ্যিক শরীয়তকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করত এবং তার অনুশীলন পরিত্যাগ করত।
  • ইমামদের ঐশ্বরিককরণ: কারামিতারা তাদের ইমামদেরকে ঐশ্বরিক বা প্রায় ঐশ্বরিক সত্তা হিসেবে দেখত। তারা দাবি করত যে, ইমামদের কাছে সরাসরি ঐশ্বরিক জ্ঞান রয়েছে এবং তাদের নির্দেশই চূড়ান্ত।
  • সাম্যবাদী প্রবণতা: কারামিতা আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক প্রবণতা। তারা সম্পদের সমান বন্টন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার উপর জোর দিত। এটি তাদের অনেক দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে আকৃষ্ট করতে সাহায্য করেছিল।
  • ধর্মীয় আইনের শিথিলতা: যেহেতু তারা বাহ্যিক শরীয়তকে গুরুত্ব দিত না, তাই তাদের মধ্যে অনেক ইসলামী বিধিনিষেধের প্রতি শিথিলতা দেখা যেত। মদপান, ব্যভিচার এবং অন্যান্য ইসলামী নিষিদ্ধ কাজ তাদের সমাজে প্রচলিত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

🛑২৪) কুল্লাবিয়্যাহ: উৎপত্তি আনুমানিক ২৮০-৩০০ হিজরি। কুল্লাবিয়্যাহ সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ ইবনে সাঈদ ইবনে কুল্লাব আল-কাত্তান এর নামানুসারে। কুল্লাবিয়্যাহ মতবাদ পরবর্তীকালে আশআরি আকিদা স্কুলের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কারণ আশআরিরা তাদের অনেক মতবাদ গ্রহণ ও পরিমার্জন করেছিল।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর গুণাবলী (সিফাত) এর প্রতিষ্ঠা: মু’তাজিলাদের বিপরীতে, কুল্লাবিয়্যাহরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর কিছু শাশ্বত (কাদীম) গুণাবলী রয়েছে, যা তাঁর সত্তা থেকে পৃথক নয় কিন্তু তাঁর সত্তার সাথে যুক্ত। এই গুণাবলীগুলো হলো জীবন, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা, শ্রবণ, দর্শন এবং কালাম (কথা)। তারা বিশ্বাস করত যে, এই গুণাবলী আল্লাহর সত্তার অংশ হলেও সেগুলো তাঁর সত্তার বর্ধিত রূপ নয়, বরং তাঁর অনাদি ও অপরিহার্য অংশ।
  • কুরআনের প্রকৃতি (কালামুল্লাহ): কুল্লাবিয়্যাহরা বিশ্বাস করত যে, কুরআন অনাদি (কাদীম) এবং আল্লাহর কালাম (কথা)। তবে, তারা এই বিষয়টিকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করত: তারা আল্লাহ তায়ালার কালামে নফসি (কালামে কাদীম) এবং কালামে লফযি (কালামে হাদিস) এর মধ্যে পার্থক্য করত। কালামে নফসি হলো আল্লাহর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য ও অনাদি কালাম (কথা), যা শ্রুতিযোগ্য নয় এবং যা পরিবর্তন হয় না। এটি আল্লাহর একটি বৈশিষ্ট্য। কালামে লফযি হলো কুরআন শরীফের আয়াত যা জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে নবী (সা.)-এর উপর নাজিল হয়েছে। এটি সৃষ্ট, তবে এটি অনাদি কালামে নফসির একটি অভিব্যক্তি বা প্রতীকী প্রকাশ। এই ব্যাখ্যাটি মু’তাজিলাদের ‘কুরআন সৃষ্ট’ এবং আহলে হাদীসদের ‘কুরআন অনাদি’ – এই দুই মতবাদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরির চেষ্টা করেছিল।
  • আল্লাহর দর্শন (রু’য়াতুল্লাহ): মু’তাজিলাদের বিপরীতে, কুল্লাবিয়্যাহরা বিশ্বাস করত যে, কিয়ামতের দিন মুমিনগণ আল্লাহকে দেখতে পাবে, তবে তা কোনো স্থান বা দিক ছাড়া এবং কোনো সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়ে। এটি সুন্নিদের একটি মৌলিক বিশ্বাস।
  • মানুষের কর্মের স্বাধীনতা ও বাধ্যবাধকতা: এই বিষয়ে কুল্লাবিয়্যাহরা কাসব (অর্জন) ধারণার দিকে ঝুঁকেছিল, যেখানে আল্লাহই কর্মের সৃষ্টিকর্তা, তবে মানুষ সেই কর্মের জন্য দায়ী, কারণ মানুষ নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সেই কর্ম অর্জন করে। এটি জাবরিয়া এবং কাদেরিয়া উভয়ের চরমপন্থী অবস্থানের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান।

🛑২৫) কা’বিয়াহ: উৎপত্তি আনুমানিক ২৮০-৩২০ হিজরি। কা’বিয়াহ মুতাজিলা মতবাদের একটি উপশাখা, যা আবু আল-কাসিম আল-কা’বি আল-বালখি এর অনুসারীদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন মুতাজিলা স্কুলের বসরা শাখার একজন প্রভাবশালী আলেম। আবু আল-কাসিম আল-কা’বি মুতাজিলাদের সাধারণ নীতিগুলো মেনে চললেও, নির্দিষ্ট কিছু ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা ও মতবাদ দেন, যা তার অনুসারীদের কা’বিয়াহ হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর গুণাবলী (সিফাত) সম্পর্কে: কা’বিয়াহরা জুব্বাইয়াহর মতোই বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর গুণাবলী আল্লাহর সত্তা থেকে অতিরিক্ত কিছু নয়। আল্লাহ তার সত্তার মাধ্যমেই জ্ঞানী, ক্ষমতাধর ইত্যাদি। তাদের মতে, আল্লাহর গুণাবলীকে তার সত্তা থেকে পৃথক অস্তিত্ব হিসেবে দেখলে তাওহীদ লঙ্ঘিত হয়।
  • মানুষের কর্মের স্বাধীনতা ও দায়িত্ব: কা’বিয়াহরা মানুষের কর্মের পূর্ণ স্বাধীনতার উপর দৃঢ়ভাবে জোর দেয়। তারা মনে করত যে, মানুষ তার কর্মের (ভালো বা মন্দ) স্রষ্টা, এবং আল্লাহ মানুষের কর্মের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেন না। তারা আল্লাহর ন্যায়বিচারের ধারণাকে সমর্থন করে যুক্তি দিত যে, যদি মানুষ তার কর্মের জন্য দায়ী না হয়, তাহলে পুরস্কার বা শাস্তির কোনো অর্থ থাকে না।
  • আল্লাহর ইচ্ছা ও তার জ্ঞান: কা’বিয়াহ মতবাদ মতে, আল্লাহর ইচ্ছা তার জ্ঞান থেকে ভিন্ন। আল্লাহ তার জ্ঞানের মাধ্যমে কোনো কিছুকে জানেন, কিন্তু তার ইচ্ছা সেটিকে অস্তিত্বে নিয়ে আসে। তারা মনে করত যে, আল্লাহর ইচ্ছা পরিবর্তনশীল এবং এটি নির্দিষ্ট বস্তুর সাথে সম্পর্কিত, যেখানে আল্লাহর জ্ঞান অপরিবর্তনীয় ও সবকিছুকে বেষ্টনকারী।
  • কুরআন সৃষ্ট: মুতাজিলাদের সাধারণ মতবাদের মতো, কা’বিয়াহরাও বিশ্বাস করত যে, কুরআন সৃষ্ট (মাখলুক)। তারা যুক্তি দিত যে, আল্লাহর কালাম যদি অনাদি হয়, তবে তা আল্লাহর সাথে সহ-অনাদি আরেকটি সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে, যা তাওহীদের পরিপন্থী।
  • জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি: আল-কা’বি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির পাশাপাশি ‘আকল’ (বুদ্ধি)-এর গুরুত্বের উপর জোর দিতেন। তিনি মনে করতেন যে, কিছু ধর্মীয় সত্য যুক্তির মাধ্যমেও বোঝা সম্ভব।

🛑২৬) আশআরি: উৎপত্তি আনুমানিক ৩০০-৩১০ হিজরি। আশআরি মতবাদ ইমাম আবুল হাসান আল-আশআরী (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইমাম আবুল হাসান আল-আশআরী ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণ করেন এবং বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু মূসা আল-আশআরী (রা.)-এর বংশধর ছিলেন। তাঁর জীবনের প্রথম ৪০ বছর তিনি মু’তাজিলা মতবাদের অনুসারী ছিলেন এবং তৎকালীন প্রসিদ্ধ মু’তাজিলা আলেম আবু আলী আল-জুব্বাই-এর শিষ্য ছিলেন। তবে, গভীর অধ্যয়ন ও চিন্তাভাবনার পর তিনি মু’তাজিলাদের অনেক মতবাদের দুর্বলতা উপলব্ধি করেন। এরপর তিনি প্রকাশ্যে মু’তাজিলা মতবাদ ত্যাগ করেন। তিনি কুলাবিয়্যাহ মতবাদের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা ছিল মু’তাজিলাদের এবং আক্ষরিকতাবাদী (মুশাব্বিহা/মুজাস্সিমা) উভয় চরমপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যবর্তী একটি অবস্থান। ইমাম আশআরী তাঁর নিজস্ব একটি ধর্মতাত্ত্বিক পদ্ধতি গড়ে তোলেন, যা পরে তাঁর নামানুসারে ‘আশআরি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর গুণাবলী (সিফাত): আশআরিরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর কিছু বাস্তব ও শাশ্বত গুণাবলী রয়েছে, যা তাঁর সত্তা থেকে পৃথক নয়, তবে তাঁর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য। এই গুণাবলীগুলো হলো: জীবন (হায়াত), জ্ঞান (ইলম), ক্ষমতা (কুদরত), ইচ্ছা (ইরাদা), শ্রবণ (সাম’), দর্শন (বাসার), কালাম (কথা) এবং তাকবীন (সৃষ্টি করার ক্ষমতা)। তারা এই গুণাবলীগুলোকে আক্ষরিক অর্থে স্বীকার করে, কিন্তু এগুলোকে সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে সাদৃশ্য দান করে না। অর্থাৎ, আল্লাহ শোনেন, কিন্তু তাঁর শ্রবণ সৃষ্টির শ্রবণের মতো নয়; তিনি দেখেন, কিন্তু তাঁর দেখা সৃষ্টির দেখার মতো নয়। এটি তাশবীহ (সাদৃশ্য) এবং তা’তীল (অস্বীকার) – এই উভয় চরমপন্থার মধ্যবর্তী একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আল্লাহর হাত, পা, আরশের উপর সমাসীন হওয়া (ইসতিওয়া) ইত্যাদির ক্ষেত্রে আশআরিরা বিনা কাইফ (كيف بلا تكييف) নীতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ, তারা বিশ্বাস করে যে আল্লাহ আরশের উপর ইসতিওয়া করেছেন, কিন্তু কীভাবে তা আমরা জানি না এবং তার কোনো আকার বা ধরন কল্পনা করি না। কিছু আশআরি আলেম প্রয়োজনে এগুলোর রূপক ব্যাখ্যা (তা’বীল) করার অনুমতি দিয়েছেন, তবে তা খুব সতর্কতার সাথে।
  • কুরআনের প্রকৃতি (কালামুল্লাহ): আশআরিরা বিশ্বাস করে যে, কুরআন আল্লাহর অনাদি (কাদীম) কালাম (কথা)। তারা আল্লাহর ‘কালামে নফসি’ (সত্ত্বাগত কথা) এবং ‘কালামে লফযি’ (বাচ্যিক কথা) এর মধ্যে পার্থক্য করে। * কালামে নফসি হলো আল্লাহর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য, অনাদি ও শ্রুতিযোগ্য নয় এমন কথা। কালামে লফযি হলো নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর নাজিলকৃত আরবী কুরআন, যা সৃষ্ট। এটি অনাদি কালামে নফসির একটি অভিব্যক্তি বা প্রতীকী রূপ। এই ব্যাখ্যাটি মু’তাজিলাদের ‘কুরআন সৃষ্ট’ এবং আহলে হাদীসদের ‘কুরআন অনাদি’ – এই দুই মতবাদের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করে।
  • তাকদির (ভাগ্য) এবং মানুষের কর্মের স্বাধীনতা: আশআরিরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই সকল কর্মের সৃষ্টিকর্তা, ভালো হোক বা মন্দ। তবে তারা মানুষের কাসব (كسب – অর্জন) নামক একটি ধারণার প্রবর্তন করে। ‘কাসব’ হলো: আল্লাহ মানুষকে কর্ম করার ক্ষমতা (কুদরত) এবং ইচ্ছাশক্তি (ইরাদা) দান করেছেন। মানুষ এই ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে কর্মটি অর্জন করে। সুতরাং, আল্লাহ কর্মের সৃষ্টিকর্তা হলেও, মানুষ নিজের ইচ্ছায় কর্মটি অর্জন করার জন্য দায়ী এবং পরকালে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এটি জাবরিয়া (যারা মানুষকে সম্পূর্ণরূপে বাধ্য মনে করত) এবং কাদেরিয়া (যারা মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত) উভয় মতের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান।
  • ঈমান: আশআরিদের মতে, ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস (তাসদিক বিল কালব) এবং মুখের স্বীকারোক্তি (ইকরার বিল লিসান)। তারা বিশ্বাস করে যে, কর্ম (আমল) ঈমানের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য, কিন্তু তা ঈমানের মৌলিক অংশ নয়। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি যদি কবীরা গুনাহ করে, তবে সে ‘ফাসিক’ (পাপী) হয়, কিন্তু কাফির হয় না, যতক্ষণ না সে গুনাহকে হালাল মনে করে বা অন্তরের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এই দিক থেকে তারা খারেজী (যারা কবীরা গুনাহকারীকে কাফির মনে করত) এবং মুরজিয়া (যারা আমলকে ঈমানের জন্য অপ্রয়োজনীয় মনে করত) উভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থান নেয়।
  • আল্লাহর দর্শন (রু’য়াতুল্লাহ): আশআরিরা বিশ্বাস করে যে, কিয়ামতের দিন মুমিনগণ আল্লাহকে দেখতে পাবে, তবে তা কোনো স্থান বা দিক ছাড়া এবং কোনো সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়ে।
  • আল্লাহর ইচ্ছায় সব হয়। বিশ্বাস ও কর্ম আলাদা। ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস এবং মুখের স্বীকারোক্তি। আমল ঈমানের অংশ নয়। ঈমান বৃদ্ধি-হ্রাস পায়।

🛑২৭) মাতুরিদি: উৎপত্তি আনুমানিক ৩০০-৩১০ হিজরি। মাতুরিদি ইমাম আবু মনসুর আল-মাতুরিদি (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইমাম আবু মনসুর আল-মাতুরিদি বর্তমান উজবেকিস্তানের সমরকন্দের মাতুরিদ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। উপশাখা: সামরকন্দি ধারা, তুর্কি ধারা, দেওবন্দি ধারা, বেরলভী/রেজভী ধারা, ফারুকী/সিরহিন্দি ধারা।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • আল্লাহর গুণাবলী (সিফাত): মাতুরিদিরা আশআরিদের মতোই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর কিছু বাস্তব ও শাশ্বত গুণাবলী রয়েছে, যা তাঁর সত্তা থেকে পৃথক নয়, তবে তাঁর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য। এই গুণাবলীগুলো হলো: জীবন (হায়াত), জ্ঞান (ইলম), ক্ষমতা (কুদরত), ইচ্ছা (ইরাদা), শ্রবণ (সাম’), দর্শন (বাসার), কালাম (কথা), এবং তাকবীন (সৃষ্টি করার ক্ষমতা)। তারা এই গুণাবলীগুলোকে আক্ষরিক অর্থে স্বীকার করে, কিন্তু সেগুলোকে সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে সাদৃশ্য দান করে না (তাশবীহ প্রত্যাখ্যান)। তারা মনে করে, আল্লাহ যেমন তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, আমরা সেভাবেই বিশ্বাস করি, কিন্তু কীভাবে তা আমরা জানি না এবং তার কোনো আকার বা ধরন কল্পনা করি না।
  • কুরআনের প্রকৃতি (কালামুল্লাহ): মাতুরিদিরা বিশ্বাস করে যে, কুরআন আল্লাহর অনাদি (কাদীম) কালাম (কথা)। আশআরিদের মতোই তারা ‘কালামে নফসি’ (সত্ত্বাগত কথা) এবং ‘কালামে লফযি’ (বাচ্যিক কথা) এর মধ্যে পার্থক্য করে। কালামে নফসি হলো আল্লাহর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য, অনাদি ও শ্রুতিযোগ্য নয় এমন কথা। কালামে লফযি হলো নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর নাজিলকৃত আরবী কুরআন, যা সৃষ্ট। এটি অনাদি কালামে নফসির একটি অভিব্যক্তি বা প্রতীকী রূপ। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে তারা মু’তাজিলাদের ‘কুরআন সৃষ্ট’ মতবাদ খণ্ডন করে।
  • তাকদির (ভাগ্য) এবং মানুষের কর্মের স্বাধীনতা: মাতুরিদিরা আশআরিদের ‘কাসব’ (অর্জন) ধারণার সাথে একমত। তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই সকল কর্মের সৃষ্টিকর্তা, ভালো হোক বা মন্দ। * তবে, তারা মনে করে যে, মানুষের ইচ্ছাশক্তি (ইরাদা জুযইয়াহ) এবং বেছে নেওয়ার ক্ষমতা (ইখতিয়ার) রয়েছে। আল্লাহ মানুষকে কাজ করার ক্ষমতা দেন এবং মানুষ সেই ক্ষমতার মধ্যে থেকেই নিজের ইচ্ছায় কাজটি ‘অর্জন’ করে। এই ‘অর্জন’ এর জন্যই মানুষ পরকালে দায়ী হবে। মাতুরিদিরা এই বিষয়ে আশআরিদের চেয়ে মানবীয় ইচ্ছার উপর কিছুটা বেশি জোর দেয়।
  • ঈমান: মাতুরিদিদের মতে, ঈমান হলো কেবল অন্তরের বিশ্বাস (তাসদিক বিল কালব)। তারা মুখের স্বীকারোক্তি (ইকরার বিল লিসান) কে একটি শর্ত হিসেবে দেখে, যা ঈমানের প্রকাশ, কিন্তু ঈমানের মৌলিক অংশ নয়। তারা বিশ্বাস করে যে, আমল (কর্ম) ঈমানের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য, কিন্তু তা ঈমানের মৌলিক অংশ নয়। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি যদি কবীরা গুনাহ করে, তবে সে ‘ফাসিক’ (পাপী) হয়, কিন্তু কাফির হয় না। তারা মনে করে, ঈমান বাড়ে বা কমে না, বরং তা পূর্ণ বা অপূর্ণ হয়। এটি আশআরিদের থেকে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য, কারণ আশআরিরা মনে করে ঈমান বাড়ে ও কমে।
  • আল্লাহর দর্শন (রু’য়াতুল্লাহ): মাতুরিদিরা আশআরিদের মতোই বিশ্বাস করে যে, কিয়ামতের দিন মুমিনগণ আল্লাহকে দেখতে পাবে, তবে তা কোনো স্থান বা দিক ছাড়া এবং কোনো সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়ে। তারা যুক্তির মাধ্যমে এর সম্ভাবনা প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
  • নবুওয়াত এবং যুক্তির স্থান: মাতুরিদিরা যুক্তির (আকল) ভূমিকাকে বেশ গুরুত্ব দেয়। তারা বিশ্বাস করে যে, কিছু মৌলিক ধর্মীয় সত্য, যেমন আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ববাদ, নবুওয়াত ছাড়াই যুক্তি দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব। তবে, বিস্তারিত শরীয়তের বিধান জানার জন্য নবুওয়াত (অর্থাৎ, নবীদের মাধ্যমে ঐশী নির্দেশনা) অপরিহার্য।

🛑২৮) বাহশামিয়া: উৎপত্তি আনুমানিক ৩০০–৩২০ হিজরি। বাহশামিয়া হলো মুতাজিলা মতবাদের একটি উপশাখা। এর নামকরণ করা হয়েছে এর প্রধান তাত্ত্বিক আবু হাশিম আল-জুব্বাই এর নামানুসারে। আবু হাশিম ছিলেন প্রভাবশালী মুতাজিলা আলেম আবু আলী আল-জুব্বাই এর পুত্র।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • কুরআনের সৃষ্টি: আবু হাশিম মূলধারার মুতাজিলাদের মতোই কুরআনকে সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করতেন।
  • যুক্তির প্রাধান্য: আবু হাশিম ধর্মে যুক্তি ও দর্শনের ব্যবহারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন।
  • আল্লাহর গুণাবলী (সিফাত) সম্পর্কে ‘আহওয়াল’ ধারণা: এটি বাহশামিয়াদের সবচেয়ে স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। আবু হাশিম মনে করতেন যে, আল্লাহর গুণাবলী (যেমন জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা) আল্লাহর সত্তা থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন কিছু নয়, আবার সত্তার অভিন্নও নয়। বরং, এগুলো হলো আল্লাহর সত্তার “অবস্থা” (আহওয়াল)। এই অবস্থাগুলো সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য, কিন্তু সত্তার অতিরিক্ত কোনো অস্তিত্ব নেই।জ্ঞান (ইলম) সম্পর্কে: আবু হাশিম যুক্তি দিয়েছিলেন যে, আল্লাহর জ্ঞান মানুষের জ্ঞানের মতো নয়। মানুষের জ্ঞান নতুন অভিজ্ঞতা বা ধারণার ফল হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর জ্ঞান শাশ্বত ও পরিবর্তনহীন।ইচ্ছা (ইরাদা) সম্পর্কে: বাহশামিয়া মতবাদ মতে, আল্লাহর ইচ্ছা এক প্রকার ‘অবস্থা’ (হাল), যা আল্লাহর সত্তার সাথেই বিদ্যমান। এই ইচ্ছা পরিবর্তনশীল নয় এবং আল্লাহর জ্ঞানও এর সাথে জড়িত।মানুষের কর্মের স্বাধীনতা: মুতাজিলাদের মতো, বাহশামিয়ারাও মানুষের কর্মের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার উপর জোর দেয়। তারা মনে করে যে, মানুষ তার কর্মের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী, এবং আল্লাহ মানুষের কর্মের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেন না। আল্লাহ কেবল মানুষের কর্মের সৃষ্টিকর্তা নন, বরং মানুষ নিজেই তার কর্মের স্রষ্টা। এটি তাকদির (ভাগ্য) নিয়ে বিতর্কে তাদের কঠোর অবস্থানের পরিচায়ক।

🛑২৯) চিশতীয়া (সুফি): উৎপত্তি আনুমানিক ৩২০ হিজরি। চিশতীয়া তরিকা এর উদ্ভব হয় বর্তমান আফগানিস্তানের হেরাতের নিকটবর্তী চিশত শহরে আবু ইসহাক শামী (রহ.) মাধ্যমে। পরবর্তীতে, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লাহোর ও আজমীরে এই তরিকা নিয়ে আসেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে এর ব্যাপক বিস্তারে সহায়ক হয়।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: চিশতীয়া তরিকা মূলত প্রেম (ইশক), সহনশীলতা এবং উদারতার উপর গুরুত্বারোপ করে। এই তরিকার অনুসারীরা আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা, মানবজাতির সেবা, এবং বিনয়কে তাদের আধ্যাত্মিক সাধনার মূল ভিত্তি হিসেবে দেখে। তারা সঙ্গীত (কাওয়ালি) এবং ধিকরের (আল্লাহর স্মরণ) মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে বিশ্বাসী। চিশতীয়া তরিকা উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে এবং সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

🛑৩০) দ্রুজ: উৎপত্তি আনুমানিক ৪০৮ হিজরি। দ্রুজ (আরবি: الدروز, আদ্-দুরুজ) হলো একটি স্বতন্ত্র একেশ্বরবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়। এটি মূলত ইসলামের শিয়া শাখার ইসমাইলি ধারা থেকে উদ্ভূত একটি ধর্ম, কিন্তু এর নিজস্ব স্বতন্ত্র বিশ্বাস, আইন এবং আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে। দ্রুজরা নিজেদেরকে “মুওয়াহহিদুন” (একত্ববাদী) বলে পরিচয় দেয়, যার অর্থ হলো “এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী”। তাদের ধর্মের উৎপত্তি মিশরের ফাতিমীয় খিলাফতের সময় ইসমাইলি শিয়া ইসলামের একটি শাখা থেকে। মিশরের তৎকালীন ফাতিমীয় খলিফা আল-হাকিম বিল্লাহ-কে দ্রুজরা ঐশ্বরিক সত্তার প্রকাশ বলে বিশ্বাস করে। তাঁর মন্ত্রী ও প্রধান ধর্মপ্রচারক হামযা ইবনে আলী ইবনে আহমদ দ্রুজ ধর্মের মূল মতবাদগুলো প্রতিষ্ঠা করেন। দ্রুজদের প্রধান শ্রেণি দুটি: উক্কাল ও জুহাল।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: দ্রুজরা বিশ্বাস করে যে, তাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো গোপন রাখা হয়েছে এবং কেবল দ্রুজ সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট কিছু সদস্য (উক্কাল বা জ্ঞানী ব্যক্তিরা) সেগুলো অধ্যয়ন করতে পারে। তবে কিছু প্রধান বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ্যে রয়েছে:

  • আল্লাহর একত্ব ও ঐশ্বরিক প্রকাশ: দ্রুজরা আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্বে বিশ্বাসী। তারা মনে করে যে আল্লাহ এতটাই অসীম ও অবোধ্য যে তাঁকে সরাসরি উপলব্ধি করা অসম্ভব। বরং, তিনি যুগে যুগে তাঁর সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন বিভিন্ন ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ ছিলেন আল-হাকিম বিল্লাহ।
  • আত্মার রূপান্তর: দ্রুজরাজন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে। তাদের মতে, আত্মা মৃত্যুর পর অন্য একটি নতুন দেহ ধারণ করে (মানুষের মধ্যেই)। তারা বিশ্বাস করে যে, আত্মারা দ্রুজ হিসেবেই পুনর্জন্ম নেয়, এবং মৃত্যুর পর পরই তাদের আত্মা অন্য একটি দ্রুজ শিশুর দেহে প্রবেশ করে। এটি তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে দৃঢ় সংহতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
  • ধর্মীয় গ্রন্থের গোপনীয়তা: তাদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ হলো কিতাব আল-হিকমাহ বা রাসাইল আল-হিকমাহ। এই গ্রন্থগুলো এবং অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষাগুলো সাধারণ দ্রুজদের জন্য উন্মুক্ত নয়। কেবলমাত্র ‘উক্কাল’ (জ্ঞানী) বা ‘উচ্চতর পদে থাকা দ্রুজ’রাই এই জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
  • নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ: দ্রুজরা সত্যবাদিতা, সততা, সম্মান, পারিবারিক বন্ধন এবং সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্যের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তারা অতিথিপরায়ণতা এবং নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাকে অত্যন্ত মূল্য দেয়।
  • শরিয়তের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি: দ্রুজরা ইসলামের প্রচলিত শরিয়াহ (আইন) অনুসরণ করে না। তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আইন ও রীতি রয়েছে। তারা সালাত (নামাজ), সাওম (রোজা), হজ (হজ্ব) এবং যাকাত (যাকাত) এর মতো প্রচলিত ইসলামী স্তম্ভগুলো ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে বা প্রতীকী অর্থ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, তাদের নামাজ অনেকটা ব্যক্তিগত প্রার্থনা এবং ধ্যানের মতো।
  • তারা নবিগণকে অস্বীকার করে এবং তাঁদের প্রতি ঘৃণাপোষণ করে।
  • তারা কুরআনকে মিথ্যা ও মানুষের কথা হিসেবে বিশ্বাস করে।
  • তারা শেষ দিবস, জান্নাত-জাহান্নাম এবং উভয়ের শাস্তি ও পুরস্কার অস্বীকার করে।
  • তারা সাহাবিগণকে গালি দেয় এবং তাঁদের সমালোচনা করে।
  • ফাতিমীয় খলিফা আল-হাকিম বিল্লাহ-কে দ্রুজরা ঈশ্বররূপে বিশ্বাস করে।

🛑৩১) নকশবন্দি (সুফি): উৎপত্তি আনুমানিক ৭০০-৭৫০ হিজরি। নকশবন্দীয়া তরিকার নামকরণ করা হয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতা খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ বুখারী (রহ.) এর নামানুসারে। তিনি বুখারার কাছে কসর আল-আরিফান নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য:

  • নীরব জিকির (জিকিরে খফি): এটি নকশবন্দীয়া তরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নকশবন্দী সূফিরা সাধারণত নীরবে আল্লাহর নাম জপ করে (জিকরে খফি)। তারা বিশ্বাস করে যে, নীরব জিকির আত্মাকে আরও গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং জাগতিক বিভ্রান্তি থেকে মনকে মুক্ত রাখে। এটি অন্যদের কাছে প্রদর্শন না করে আল্লাহর সাথে ব্যক্তিগত সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে।
  • শরীয়তের কঠোর অনুসরণ: নকশবন্দীয়া তরিকা শরীয়তের (ইসলামী আইন) কঠোর অনুসরণ উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তারা বিশ্বাস করে যে, শরীয়ত পালন ছাড়া কোনো আত্মিক উন্নতি সম্ভব নয়। এটি তাদের এবং কিছু অন্যান্য সুফি তরিকার মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে, যেখানে কিছু তরিকা শরীয়তের বাহ্যিক দিককে কম গুরুত্ব দিত।
  • বাহ্যিক প্রদর্শনী থেকে দূরে থাকা: নকশবন্দীয়া সূফিরা সাধারণত আধ্যাত্মিকতার বাহ্যিক প্রদর্শন, যেমন উচ্চস্বরে জিকির বা সামা (আধ্যাত্মিক সঙ্গীত) শোনা থেকে দূরে থাকে। তারা বিনয়, সংযম এবং নীরবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বিশ্বাসী।
  • সোহবত (উত্তম সঙ্গ): তারা একজন যোগ্য পীর বা শাইখের (আধ্যাত্মিক শিক্ষক) সংস্পর্শে থাকার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। সোহবত অর্থাৎ সৎসঙ্গের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং অবস্থা অর্জন করা যায় বলে তারা মনে করে।
  • নকশ: ‘নকশবন্দ’ শব্দের একটি অর্থ হলো ‘ছাপ বা নকশা তৈরি করা’। এর দ্বারা বোঝানো হয় যে, আল্লাহর নাম ও জিকির যেন হৃদয় ও আত্মার গভীরে খোদাই হয়ে যায়।
  • আধ্যাত্মিক শক্তি ও অলৌকিক ক্ষমতার  মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

🛑৩২) মুজাদ্দেদিয়া (সুফি): উৎপত্তি আনুমানিক ১০২৪ হিজরি। এটি মূলত নকশবন্দীয়া তরিকার একটি শাখা। এই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইমাম রব্বানী মুজাদ্দিদ আলফে সানি শেখ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.)। ‘মুজাদ্দিদ আলফে সানি’ অর্থ ‘দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক’। তিনি ভারতের পাঞ্জাবের সিরহিন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নকশবন্দীয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত শিষ্য।

মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য: মুজাদ্দেদিয়া তরিকা নকশবন্দীয়া তরিকার মূলনীতিগুলো (যেমন নীরব জিকির, শরীয়তের কঠোর অনুসরণ) বজায় রাখে, তবে এর কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  • শরীয়তের প্রতি চূড়ান্ত অঙ্গীকার: মুজাদ্দেদিয়া তরিকা শরীয়তের (ইসলামী আইন) প্রতি কঠোর ও আপোষহীন আনুগত্যের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। ইমাম আহমদ সিরহিন্দী (রহ.) জোর দিয়েছিলেন যে, শরীয়তকে সুফিবাদের বাহ্যিক রূপ হিসেবে দেখা যাবে না, বরং এটিই আধ্যাত্মিক উন্নতির ভিত্তি। তার মতে, শরীয়তের বাইরে কোনো প্রকৃত তাসাউফ (সুফিবাদ) নেই। তিনি সুফিবাদের নামে প্রচলিত যেকোনো বিদআত বা শরীয়ত বিরোধী চর্চাকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।
  • তাওহীদ-ই-শুহুদী (প্রত্যক্ষের ঐক্য): ইমাম আহমদ সিরহিন্দী (রহ.) ওয়াহদাতুল ওজুদ (অস্তিত্বের ঐক্য) দর্শনের একটি বিশেষ ব্যাখ্যা দেন, যা ওয়াহদাতুল শুহুদ নামে পরিচিত। ওয়াহদাতুল ওজুদ (ইবনে আরাবী কর্তৃক প্রচারিত) হলো এমন একটি মতবাদ যেখানে সবকিছুই আল্লাহর সত্তার প্রকাশ বা অংশ হিসেবে দেখা হয়, এবং বস্তুত আল্লাহর সত্তা ছাড়া আর কোনো সত্তার অস্তিত্ব নেই/।ওয়াহদাতুল শুহুদ এর মতে, এই ‘একত্বের উপলব্ধি’ একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা বা মানসিক অবস্থা, যেখানে সাধক অনুভব করে যে সে এবং আল্লাহ এক। কিন্তু এটি কোনো বাস্তব বা পরম সত্য নয়। বাস্তবে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও অদ্বিতীয়। এই ব্যাখ্যাটি ইসলামে আল্লাহর তানযীহ (অতুলনীয়তা) ও তাওহীদকে শক্তিশালী করে।
  • নবুওয়াত ও ওলিয়াতের শ্রেষ্ঠত্ব: মুজাদ্দেদিয়া তরিকা নবুওয়াতকে ওলিয়াত (বেলায়েত) থেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। ইমাম আহমদ সিরহিন্দী (রহ.) ব্যাখ্যা করেন যে, নবীগণ হলেন চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক পথের পথিক এবং তাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত শরীয়তই মুসলিমদের জন্য একমাত্র অনুসরণীয় পথ। কোনো ওলি (আউলিয়া) নবীর পদমর্যাদার উপরে যেতে পারেন না।
  • নীরব জিকির ও ফানা-বাকার ব্যাখ্যা: নকশবন্দীয়াদের মতো মুজাদ্দেদিয়াতেও নীরব জিকির প্রধান অনুশীলন। ফানা (আল্লাহর সত্তায় বিলীন হওয়া) ও বাকা (স্থায়িত্ব) এর ধারণাগুলো তারা শরীয়তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে ব্যাখ্যা করেন, যেখানে ফানা হলো নিজের ইচ্ছা ও গুণাবলীকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে বিলীন করা, আর বাকা হলো আল্লাহর গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে মানবজাতির কল্যাণে কাজ করা।

🛑৩৩) বাহাই: উৎপত্তি আনুমানিক ১২৬০ হিজরি। বাহাই ধর্ম ইসলামের একটি শাখা নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি ইসলামের শিয়া ধারার ইসমাইলি ও সুফি প্রভাবিত পরিবেশে জন্ম নিলেও, পরবর্তীতে নিজস্ব ধর্মতত্ত্ব, নবুয়ত ও ধর্মগ্রন্থসহ একটি আলাদা ধর্মব্যবস্থা হিসেবে গড়ে ওঠে। বাহাই ধর্মের উৎপত্তি পারস্যে (বর্তমান ইরান) সাইয়্যেদ আলী মুহাম্মদ আল-বাব নামক একজন ব্যক্তির মাধ্যমে, যিনি নিজেকে ‘মাহদি’র প্রবেশদ্বার (বাব) বলে দাবি করেন এবং একটি নতুন ধর্মীয় যুগের সূচনা করেন। তার অনুসারীরা ‘বাবী’ নামে পরিচিত ছিল। বাবের আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই পারস্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে, কিন্তু তৎকালীন সরকার ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের বিরোধিতার কারণে এটি কঠোরভাবে দমন করা হয় এবং বাবকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাবে’র মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যদের মধ্যে থেকে বাহাউল্লাহ (মির্জা হুসাইন আলী নুরি) নামক একজন ব্যক্তি নিজেকে সেই প্রতিশ্রুত ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করেন যার আগমনের কথা বাব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বাগদাদে প্রকাশ্যে তাঁর এই দাবি ঘোষণা করেন অর্থাৎ নিজেকে “আল্লাহর বার্তাবাহক বা নবী” দাবি করেন। ‘বাহাউল্লাহ’ শব্দের অর্থ ‘আল্লাহর মহিমা’ বা ‘আল্লাহর উজ্জ্বল দীপ্তি’। তাঁর অনুসারীরাই পরবর্তীতে বাহাই নামে পরিচিত হয়। বাহাউল্লাহ বাহাই ধর্মের মূল গ্রন্থগুলো রচনা করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কিতাব-ই-আকদাস।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ঈশ্বরের ঐক্য: বাহাইরা এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস করে, যিনি অসীম, অপ্রাপ্য এবং সকল মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। ঈশ্বরকে সরাসরি উপলব্ধি করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে তাঁর গুণাবলী তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে এবং যুগে যুগে পাঠানো ঐশ্বরিক দূতদের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
  • ধর্মীয় ঐক্য: বাহাইরা বিশ্বাস করে যে, সমস্ত প্রধান ধর্ম একই ঐশ্বরিক উৎস থেকে এসেছে। ইব্রাহিম, মোশি, বুদ্ধ, যীশু, মুহাম্মদ (সা.), এবং বাব — এঁরা সবাই একই ঈশ্বরের বার্তাবাহক, যারা মানবজাতির বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। প্রতিটি দূত তাঁদের সময়ের মানবজাতির প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা দিয়েছেন এবং পরবর্তী দূতের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বাহাইরা বিশ্বাস করে যে, বাহাউল্লাহ এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ দূত এবং তাঁর আগমনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোর অঙ্গীকার পূর্ণ হয়েছে।
  • মানবজাতির ঐক্য: এটি বাহাই ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলোর একটি। বাহাইরা বিশ্বাস করে যে, সমস্ত মানুষ এক পরিবারের সদস্য, জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনো ভেদাভেদ নেই। তারা বিশ্বশান্তি, ন্যায়বিচার এবং ঐক্যের উপর জোর দেয় এবং জাতিগত, ধর্মীয় ও লিঙ্গভিত্তিক সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের আহ্বান জানায়। নারী-পুরুষের সমান অধিকার, বিশ্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষা, চরম দারিদ্র্য ও সম্পদের অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ বর্জন, এবং একটি আন্তর্জাতিক সহায়ক ভাষা গ্রহণ – এইগুলো তাদের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নীতি।

🛑৩৪) আহমদিয়া/কাদিয়ানি: উৎপত্তি আনুমানিক ১৩০০ হিজরি। আহমদিয়া মুসলিম জামাত হলো একটি ধর্মীয় আন্দোলন, যা ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের কাদিয়ান এলাকায় মির্যা গোলাম আহমদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। তার জন্মস্থানের নামানুসারে এই সম্প্রদায়ের অনুসারীদের অনেকে কাদিয়ানি নামেও পরিচিত। উপশাখা: আহমদিয়া আঞ্জুমান ইশা’আত ইসলাম লাহোর, আহমদিয়া মুসলিম জামায়াত।

মির্যা গোলাম আহমদ তার জীবনে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দাবি করেন:

  • প্রথম দিকে তিনি নিজেকে ইসলামের সংস্কারক (মুজাদ্দিদ) হিসেবে দাবি করেন।
  • পরবর্তীতে তিনি প্রতিশ্রুত মাহদী (ইমাম মাহদী) এবং প্রতিশ্রুত মসীহ (ঈসা মাসীহ) হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। তিনি দাবি করেন যে, খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রতীক্ষিত ঈসা (আ.) সশরীরে আসমান থেকে নেমে আসবেন না, বরং তার পুনরাগমন হবে মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদের মধ্য থেকে, আর তিনি নিজেই সেই রূপক অর্থে প্রতিশ্রুত মসীহ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈসা (আ.) স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং কাশ্মীরের শ্রীনগরে তার কবর রয়েছে।
  • অবশেষে, তিনি নিজেকে ‘উম্মতি নবী’ এবং পরে একজন পূর্ণাঙ্গ নবী ও রাসূল হিসেবে ঘোষণা করেন, তবে এই নবীত্ব মহানবী (সা.)-এর শরীয়তের অধীনস্থ এবং স্বাধীন শরীয়তবিহীন। অর্থাৎ, তিনি দাবি করেন যে তিনি মহানবী (সা.)-এর অনুসারী একজন নবী।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • খাতামুন-নাবিয়্যীন (নবুওয়াতের সমাপ্তি) ধারণা: ইসলামের মূলধারার বিশ্বাস হলো, হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ নবী এবং তার পর আর কোনো নবী আসবেন না। এটি ‘খাতামুন-নাবিয়্যীন’ ধারণার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু আহমদিয়ারা বিশ্বাস করে যে, মুহাম্মদ (সা.) হলেন ‘খাতামুন-নাবিয়্যীন’ এই অর্থে যে, তিনি হলেন নবীদের মোহর বা সীল, যার মাধ্যমে তাঁরই উম্মতদের মধ্য থেকে কিছু নবী আসতে পারে, যারা তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবে এবং তাঁর শরীয়তের অধীন থাকবে। তারা মির্যা গোলাম আহমদকে এই ধরনের একজন ‘উম্মতি নবী’ হিসেবে বিশ্বাস করে। এটিই মুসলিম বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সাথে আহমদিয়াদের সবচেয়ে বড় বিবাদের কারণ।
  • ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু: আহমদিয়ারা বিশ্বাস করে যে, হযরত ঈসা (আ.) ক্রুশবিদ্ধ হননি এবং তিনি আকাশে জীবিত অবস্থায় উঠিয়েও নেওয়া হননি। বরং, তিনি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং কাশ্মীরের শ্রীনগরে তার কবর রয়েছে। এটি মুসলিমদের প্রচলিত বিশ্বাস (যে ঈসা (আ.) জীবিত আছেন এবং কিয়ামতের পূর্বে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন) এর পরিপন্থী।
  • জিহাদ: আহমদিয়া মুসলিম জামাত ‘জিহাদ’কে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। তারা ‘কলমের জিহাদ’ (জ্ঞান ও যুক্তির মাধ্যমে ইসলামের প্রচার) এবং আত্মশুদ্ধির উপর জোর দেয় এবং আক্রমণাত্মক বা ‘তরবারির জিহাদ’-কে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলে যে, ‘ইসলামে আক্রমণাত্মক অর্থাৎ ‘তরবারির জিহাদ’-এর কোনো স্থান নেই’।
  • স্বতন্ত্র ধর্মীয় ব্যবস্থা: যদিও তারা নিজেদের মুসলিম দাবি করে এবং ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলো (কালিমা, নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্ব) পালন করে, কিন্তু তাদের নিজস্ব খলিফা (বর্তমানে পঞ্চম খলিফা মির্যা মাসরূর আহমদ), মসজিদ, এবং প্রচার কার্যক্রম রয়েছে যা মূলধারার মুসলিমদের থেকে পৃথক।

🛑৩৫) দেওবন্দি: উৎপত্তি আনুমানিক ১২৮৩ হিজরি। দেওবন্দি হলো সুন্নি ইসলামের (বিশেষত হানাফী মাযহাবের) একটি প্রভাবশালী ধর্মীয় ও শিক্ষাগত আন্দোলন, যা ব্রিটিশ ভারতের উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে উদ্ভূত হয়েছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষাপটে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং ইসলামী জ্ঞানকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। দেওবন্দি আন্দোলনের কেন্দ্র হলো দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা, যা ১৮৬৬ সালের ৩০শে মে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদ্রাসার মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতভি (রহ.) এবং মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি (রহ.), যাদের লক্ষ্য ছিল ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা সংরক্ষণ, ইসলামী মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন, ঔপনিবেশিক প্রভাব প্রতিরোধ। প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের ধর্মীয় জীবন ও সংস্কৃতির উন্নতির জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই স্বাধীন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। উপশাখা: জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (পাকিস্তান), কওমী মাদরাসা আন্দোলন, তাবলিগ জামাত।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি কঠোর অনুসরণ: দেওবন্দিরা কুরআন ও মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহর প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য ও কঠোর অনুসরণের উপর জোর দেয়। তারা ইসলামের মৌলিক উৎসগুলোর আক্ষরিক ও প্রামাণ্য ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দেয়।
  • হানাফী ফিকাহর অনুসরণ: আইনশাস্ত্রের (ফিকাহ) ক্ষেত্রে দেওবন্দিরা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর প্রতিষ্ঠিত হানাফী মাযহাবের কঠোর অনুসারী। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও ফতোয়া (ধর্মীয় রায়) মূলত হানাফী ফিকাহর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
  • মাতুরিদি আকিদার অনুসরণ: আকিদা (ধর্মীয় বিশ্বাস) এর ক্ষেত্রে দেওবন্দিরা আবু মনসুর আল-মাতুরিদি (রহ.)-এর মতবাদ অনুসরণ করে। তারা আল্লাহর গুণাবলী, তাকদির এবং মানুষের কর্মের স্বাধীনতার বিষয়ে মাতুরিদি দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে।
  • সূফিবাদের সাথে সম্পর্ক (তবে সংযত): দেওবন্দিরা সুফিবাদের (তাসাউফ) আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ও আত্মশুদ্ধির গুরুত্বকে স্বীকার করে। অধিকাংশ দেওবন্দি আলেম নকশবন্দীয়া, চিশতীয়া, কাদেরিয়া বা সুহরাওয়ার্দীয়া তরিকার সাথে যুক্ত। তবে, তারা সুফিবাদের নামে প্রচলিত যেকোনো বিদআত (ধর্মীয় উদ্ভাবন) বা শরীয়তবিরোধী কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বিশেষ করে মাজার পূজা, পীরদের অতি-ভক্তি এবং মিলাদ/উরস-এর মতো কিছু প্রচলিত প্রথাকে বর্জন করে, যা তাদের বেরেলভি আন্দোলনের থেকে পৃথক করে।
  • সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে দেওবন্দিরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল। অনেকে ভারতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং মুসলিম ও হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করার পক্ষে ছিলেন (যেমন জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ)। তবে, পরবর্তীতে কেউ কেউ (যেমন জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ধারণাকেও সমর্থন করেন।

🛑৩৬) বেরলভী/রেজভী: উৎপত্তি আনুমানিক ১৩০০ হিজরি। বেরেলভি হলো সুন্নি ইসলামের (বিশেষত হানাফী মাযহাবের) একটি ধর্মীয় আন্দোলন, যা ব্রিটিশ ভারতের উত্তরপ্রদেশের বেরেলি শহরে উদ্ভূত হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইমাম আহমদ রেজা খান বেরেলভি (রহ.)। যিনি তার সময়ের বিভিন্ন ধর্মীয় বিতর্কের প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বেরেলভি আন্দোলন মূলত মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান এবং সুফিবাদের ঐতিহ্যবাহী চর্চার উপর বিশেষ জোর দেয়। উপশাখা: রেজভী মিশন, সুন্নি দাওয়াত-ই-ইসলামি, জামিয়াত উলামায়ে পাকিস্তান, সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল, সুন্নি তহরীক, মাযহারুল উলুম, আঞ্জুমান-ই-রহমানিয়া, জামিয়াতে রাযাবিয়া, মারকাজি জামিয়াত আহলে সুন্নাত, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআহ (বেরেলভি), তানজিম উল মাদারিস আহলে সুন্নাত (পাকিস্তান), আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট (বাংলাদেশ)।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • মহানবী (সা.)-এর প্রতি অতিভক্তি ও সম্মান: এটি বেরেলভি আন্দোলনের সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারা মহানবী (সা.)-কে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করে। তাদের মতে, মহানবী (সা.) হলেন নূরের তৈরি (নূরুন মিন নূরিল্লাহ), অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন (ইলমে গায়ব), হাজের ও নাজের (সর্বত্র উপস্থিত ও দর্শক), এবং শাফায়াতকারী (সুপারিশকারী)। তারা মনে করে, মহানবী (সা.)-এর শাফায়াত ছাড়া জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয় এবং তাঁর প্রতি চরম ভালোবাসা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা বিশ্বাস করেন, নবী মুহাম্মদ (সা.) জীবিত ও পরকালীন উভয় জগতে উম্মতের সাহায্য করেন এবং তাঁর (তাওয়াসসুল) মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যায়। তাঁরা “ইয়া রাসুলাল্লাহ” বলে নবীর প্রতি আহ্বান করেন, এবং মনে করেন, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রহমত প্রকাশ করেন।
  • ঐতিহ্যবাহী সুফি চর্চা: বেরেলভিরা সুফিবাদের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী চর্চার কঠোর অনুসারী। এর মধ্যে রয়েছে: মাজার জিয়ারত ও আউলিয়াদের প্রতি সম্মান: তারা পীর-আউলিয়াদের মাজার জিয়ারত করা, তাদের ওয়াসিলা (মাধ্যম) হিসেবে আল্লাহর কাছে চাওয়া, এবং তাদের আধ্যাত্মিক প্রভাবকে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, আউলিয়ারা আল্লাহর বন্ধু এবং তাদের মাধ্যমে বরকত ও ফয়েজ (আধ্যাত্মিক কল্যাণ) হাসিল হয়। আউলিয়া ও বুযুর্গদের মাধ্যমে দোয়া ও সাহায্য চাওয়াকে বৈধ মনে করেন। তাঁদের মতে, আল্লাহর কিছু বান্দা (নবী, অলী) আল্লাহর অনুমতিতে গায়েবের খবর জানতে ও সমস্যার সমাধান করতে পারেন। মিলাদ ও উরস: মহানবী (সা.)-এর জন্মোৎসব (মিলাদ) এবং আউলিয়াদের মৃত্যুবার্ষিকী (উরস) তারা অত্যন্ত ভক্তি ও আনন্দ সহকারে উদযাপন করে। তারা এসব অনুষ্ঠানে কিয়াম (দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো), সালাত ও সালাম পাঠ করাকে পুণ্যের কাজ মনে করে। সামা ও কাওয়ালি: তারা আধ্যাত্মিক সঙ্গীত (সামা) এবং কাওয়ালিকে জিকিরের একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে।
  • হানাফী ফিকাহর অনুসরণ: আইনশাস্ত্রের (ফিকাহ) ক্ষেত্রে তারা কঠোরভাবে হানাফী মাযহাব অনুসরণ করে।
  • মাতুরিদি আকিদার অনুসরণ: আকিদা (ধর্মীয় বিশ্বাস) এর ক্ষেত্রে তারা আবু মনসুর আল-মাতুরিদি (রহ.)-এর মতবাদ অনুসরণ করে, যেমনটি দেওবন্দিরাও করে। তবে আল্লাহর গুণাবলী এবং নবুওয়াতের মর্যাদা সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় তারা দেওবন্দিদের থেকে ভিন্ন হয়।
  • শিরক ও বিদআত নিয়ে বিতর্ক: তারা মাজার পূজা, মিলাদ-কিয়াম এবং আউলিয়াদের ওয়াসিলার মতো কিছু প্রথাকে মহানবী (সা.) এবং আউলিয়াদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে দেখে এবং শরীয়তের পরিপন্থী মনে করে না। তাঁরা শরিয়তের প্রচলিত সংজ্ঞার বাইরে অনেক আচার-অনুষ্ঠানকে দ্বীনের অংশ মনে করেন, যেগুলো অন্যান্য সুন্নি গোষ্ঠী বিদআত বা কুসংস্কার বলে মনে করে।

🛑৩৭) কুরআনবাদী/আহলে কুরআন: উৎপত্তি আনুমানিক ১৩০০ হিজরি। কুরআনবাদী বা আহলে কুরআন হলো এমন একটি সম্প্রদায় যারা বিশ্বাস করে যে, ইসলামের একমাত্র এবং চূড়ান্ত ধর্মীয় কর্তৃত্ব হলো কুরআন, এবং হাদিস বা সুন্নাহ ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে অপ্রয়োজনীয় বা গৌণ। তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস ও সুন্নাহকে ইসলামী শরিয়তের অংশ বা বাধ্যতামূলক মনে করেনা।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • কুরআনই একমাত্র উৎস: তারা বিশ্বাস করে যে, কুরআন হলো আল্লাহর সম্পূর্ণ, নির্ভুল এবং চূড়ান্ত ওহী। তাদের মতে, আল্লাহ কুরআনে সব প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অন্য কোনো বাহ্যিক উৎসের প্রয়োজন নেই। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন যে তিনি তাঁর কিতাবকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং এর মধ্যে সবকিছু সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।
  • হাদিস ও সুন্নাহর প্রত্যাখ্যান বা গৌণীকরণ: এটি কুরআনবাদীদের সবচেয়ে বিতর্কিত অবস্থান। সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান: কিছু কট্টর কুরআনবাদী হাদিস ও সুন্নাহর সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে, দাবি করে যে এগুলো মানুষের দ্বারা তৈরি এবং কুরআনের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। তাদের মতে, হাদিসগুলো নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর অনেক পরে সংকলিত হয়েছে, তাই সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। গৌণীকরণ: অন্য কিছু কুরআনবাদী হাদিসকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান না করে সেগুলোকে গৌণ হিসেবে দেখে। তারা মনে করে যে হাদিস কুরআনের ব্যাখ্যা বা পরিপূরক হতে পারে, তবে তা কুরআনের শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যদি কোনো হাদিস কুরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে কুরআনকে প্রাধান্য দিতে হবে।
  • শরীয়তের ভিন্ন ব্যাখ্যা: হাদিস প্রত্যাখ্যানের কারণে কুরআনবাদীরা ইসলামের প্রচলিত শরীয়তের অনেক বিধানকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। উদাহরণস্বরূপ: সালাত: তারা কুরআনে সালাতের নির্দেশ অনুসরণ করে, তবে প্রচলিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী ও রাক’আত সংখ্যাকে হাদিস-নির্ভর মনে করে এবং ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। যাকাত: যাকাতের পরিমাণ ও বিতরণ পদ্ধতি সম্পর্কেও তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা থাকে। হজ্ব: হজ্বের কিছু রীতিনীতি নিয়েও তাদের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। অন্যান্য আইন: উত্তরাধিকার, বিবাহ-তালাক এবং ফৌজদারি আইনের অনেক ক্ষেত্রে তারা সরাসরি কুরআনের আয়াত থেকে তাদের নিজস্ব বিধান তৈরি করে।
  • যুক্তির গুরুত্ব: কুরআনবাদীরা কুরআনের আয়াত বুঝতে এবং ইসলামী বিধান নির্ধারণে ব্যক্তিগত যুক্তি ও গবেষণার উপর জোর দেয়। তারা নিজেদেরকে প্রচলিত মাযহাবের অনুসারী মনে করে না।

🛑৩৮) তাবলিগ জামাত: উৎপত্তি আনুমানিক ১৩৪৫ হিজরি। তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি (রহ.)। যিনি একজন দেওবন্দি আলেম ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের মেওয়াত অঞ্চলে (বর্তমানে হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশ) এর সূচনা হয়। তার লক্ষ্য ছিল মুসলিমদেরকে মসজিদের সাথে যুক্ত করা, সালাতে (নামাজ) উৎসাহিত করা এবং তাদের মধ্যে দ্বীনের (ধর্মের) দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়ার প্রেরণা সৃষ্টি করা। উপশাখা: জুবায়ের পন্থী (শুরাপন্থী), মারকাজ নিজামুদ্দিন (সাদপন্থী)।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: অতিরঞ্জিত দাওয়াতি পদ্ধতি, বিদআতপ্রবণতা ও শিরকী দুরূদ ও গাফেল জিকির। তাদের বার্ষিক ইজতেমাকে হজের সাথে তুলনা করা।

🛑৩৯) ইখওয়ানুল মুসলিমিন (মুসলিম ব্রাদারহুড): উৎপত্তি আনুমানিক ১৩৪৮ হিজরি। ইখওয়ানুল মুসলিমিন (সাধারণত মুসলিম ব্রাদারহুড নামে পরিচিত) হলো একটি সুন্নি ইসলামী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন মিশরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি আধুনিক ইসলামী বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর মূল লক্ষ্য হলো ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা। ইখওয়ানুল মুসলিমিন মিশরের ইসমাইলিয়া শহরে হাসান আল-বান্না নামক একজন স্কুলশিক্ষক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় মিশর ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে ছিল। উপশাখা: কুতুবি, মিশরের ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি, হা-মা-স, জর্ডান ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্ট, সিরিয়ান মুসলিম ব্রাদারহুড, তিউনিশিয়ার নাহদা পার্টি, আলজেরিয়ার মুভমেন্ট অফ সোসাইটি ফর পিস, সুদানের ইসলামিস্ট মুভমেন্ট, লিবিয়ার জামা’আত আল-আদল ওয়াল-বিনিয়া, ইরাকি ইসলামিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান (আদর্শিক মিল)।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য:

  • ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা: ইখওয়ান বিশ্বাস করে যে, ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়, বরং এটি জীবন, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির সকল ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে। তাদের স্লোগান হলো: “আল্লাহ আমাদের লক্ষ্য, রাসূল আমাদের নেতা, কুরআন আমাদের সংবিধান, জিহাদ আমাদের পথ, শাহাদাত আমাদের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা।”
  • ইসলামী শরীয়তের বাস্তবায়ন: তারা ইসলামী শরীয়তকে সমাজের সকল ক্ষেত্রে (রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা) বাস্তবায়নের উপর জোর দেয়। তাদের মতে, শরীয়ত হলো আল্লাহর বিধান এবং এর অনুসরণ মানবজাতির জন্য কল্যাণকর।
  • সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সমতা: ইখওয়ানুল মুসলিমিন সামাজিক ন্যায়বিচার, দরিদ্রদের সহায়তা এবং সম্পদের সুষম বন্টনের উপর গুরুত্ব দেয়। তারা সুদভিত্তিক অর্থনীতি প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের আহ্বান জানায়।
  • শিক্ষা ও দাওয়াহ: শিক্ষার মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং ইসলামী দাওয়াত (ধর্মপ্রচার) তাদের কার্যক্রমের মূল ভিত্তি। তারা মাদ্রাসা, হাসপাতাল, দরিদ্রদের জন্য সাহায্য কেন্দ্র এবং বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করে।
  • রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: যদিও ইখওয়ান নিজেদের অরাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু করেছিল, তবে পরবর্তীতে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তারা বিশ্বাস করে যে, সমাজ সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন অপরিহার্য।
  • জিহাদ: তারা জিহাদকে (সংগ্রাম) একটি ব্যাপক অর্থে দেখে, যা আত্মিক পরিশুদ্ধি থেকে শুরু করে সামাজিক সংস্কার এবং প্রয়োজনে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে, তাদের সশস্ত্র শাখার কার্যকলাপ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

🛑৪০) কুতুবি: উৎপত্তি আনুমানিক ১৩৭০-১৩৮০ হিজরি। কুতুবি মূলত মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন প্রভাবশালী নেতা সাইয়্যেদ কুতুব এর চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত। এই মতাদর্শটি ইসলামী বিশ্বে, বিশেষ করে আধুনিক জিহাদি এবং ইসলামী চরমপন্থী আন্দোলনের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে।  সাইয়্যেদ কুতুব ছিলেন একজন সাহিত্যিক, সমালোচক এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক। তার সবচেয়ে প্রভাবশালী কাজগুলো, বিশেষ করে “মা’আলিম ফিত-তারিক” এবং “ফী জিলালিল কুরআন”, তার মতাদর্শের ভিত্তি স্থাপন করে। উপশাখা: আল-কা-য়ে-দা, ই-স-লা-মি-ক স্টেট, হিজবুত তাহরীর, জামায়াতে ইসলামি (কিছু অংশ), সুরুরি।

তার চিন্তা মূলত নিচের বিষয়গুলো দ্বারা প্রভাবিত ছিল:

  • পাশ্চাত্য সভ্যতার সমালোচনা: যুক্তরাষ্ট্রে তার শিক্ষা জীবন (১৯৪৮-১৯৫০) তাকে পশ্চিমা সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, বস্তুবাদ এবং ভোগবাদের প্রতি গভীরভাবে সমালোচনামূলক করে তোলে।
  • মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতা: তিনি আরব বিশ্বের তৎকালীন ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী সরকারগুলোকে (যেমন মিশরের জামাল আবদেল নাসেরের সরকার) ইসলাম বিরোধী এবং স্বৈরাচারী বলে মনে করতেন।
  • ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা: তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিম সমাজকে তার নৈতিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে হলে ইসলামী শরীয়তের ভিত্তিতে একটি প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: কুতুবি মতাদর্শের কিছু মৌলিক এবং বিতর্কিত ধারণা রয়েছে:

  • জাহিলিয়্যাত: এটি কুতুবির একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। কুতুব বিশ্বাস করতেন যে, আধুনিক মুসলিম সমাজগুলো, যারা ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী শাসন করে না, তারা ইসলামের পূর্ববর্তী জাহিলিয়্যাত (প্রাক-ইসলামী অজ্ঞতার যুগ)-এর অবস্থায় ফিরে গেছে। এই জাহিলিয়্যাত শুধু ধর্মের অভাব নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা আল্লাহ থেকে বিচ্যুত। তার মতে, এমনকি যারা নামেমাত্র মুসলিম, তারাও এই জাহিলিয়্যাতের অংশ, কারণ তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (হাকিমিয়্যাহ) স্বীকার করে না।
  • হাকিমিয়্যাহ (আল্লাহর সার্বভৌমত্ব): কুতুব জোর দিয়েছিলেন যে, শাসন ক্ষমতা (হাকিমিয়্যাহ) কেবল আল্লাহরই। এর অর্থ হলো, সকল আইন ও বিধান আল্লাহর শরীয়ত থেকেই আসবে, মানুষের তৈরি কোনো আইন গ্রহণযোগ্য নয়। যারা আল্লাহর এই সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে এবং মানবসৃষ্ট আইন দিয়ে শাসন করে, তারা অবিশ্বাসী (কাফির)।
  • তাকফির: জাহিলিয়্যাত এবং হাকিমিয়্যাহর ধারণার ভিত্তিতে কুতুবের চিন্তাভাবনায় তাকফিরের প্রবণতা দেখা যায়। তাকফির হলো কোনো মুসলিমকে কাফির বা অবিশ্বাসী ঘোষণা করা। কুতুবের অনুসারীরা মনে করে যে, যারা আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী শাসন করে না বা এর বিরোধিতা করে, তারা মুসলিম হলেও কাফির। এই তাকফিরের ধারণাই পরবর্তীতে অনেক চরমপন্থী গোষ্ঠীকে সহিংসতা ও বিদ্রোহের জন্য উৎসাহিত করেছে।
  • বিপ্লবী পরিবর্তন (ইখওয়ান): কুতুব বিশ্বাস করতেন যে, সমাজকে জাহিলিয়্যাত থেকে মুক্ত করতে এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে একটি বিপ্লবী আন্দোলন প্রয়োজন। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের মাধ্যমে এই সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে চেয়েছিলেন।
  • জিহাদ: কুতুবি মতাদর্শ জিহাদকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বা আধ্যাত্মিক সংগ্রাম হিসেবে দেখে না, বরং এটিকে একটি বিপ্লবী প্রচেষ্টা হিসেবে দেখে যা জাহিলী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। এটি তার অনুসারী জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর জন্য সহিংসতার একটি ন্যায্যতা তৈরি করেছে।

🛑৪১) হিযবুত তাহরীর: উৎপত্তি আনুমানিক ১৩৭২ হিজরি। হিযবুত তাহরীর যার অর্থ “মুক্তির দল” হলো একটি আন্তর্জাতিক ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠন। যা জেরুজালেমে তাকিউদ্দিন আন-নাবহানি নামক একজন ফিলিস্তিনি ইসলামী পণ্ডিত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। হিযবুত তাহরীরের ঘোষিত লক্ষ্য হলো মুসলিম উম্মাহকে একত্রিত করে একটি একক ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন ব্যবস্থা (শরীয়াহ) বাস্তবায়ন করা।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: হিযবুত তাহরীর একটি সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ এবং কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করে, যা এর প্রতিষ্ঠাতা তাকিউদ্দিন আন-নাবহানির চিন্তাভাবনা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত:

  • খিলাফত প্রতিষ্ঠা: হিযবুত তাহরীরের প্রধান এবং একমাত্র লক্ষ্য হলো মুসলিম বিশ্বে বিলুপ্ত খিলাফত পদ্ধতি পুনরুদ্ধার করা। তারা বিশ্বাস করে যে, খিলাফত হলো ইসলামের একমাত্র বৈধ শাসন ব্যবস্থা এবং এটি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব ফিরে আসবে।
  • শরীয়াহ বাস্তবায়ন: তারা বিশ্বাস করে যে, প্রতিষ্ঠিত খিলাফত রাষ্ট্রকে অবশ্যই ইসলামী শরীয়াহ (আইন) দ্বারা সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত হতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ বা অন্যান্য মানবসৃষ্ট ব্যবস্থা তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
  • বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম: হিযবুত তাহরীর মূলত একটি চিন্তাভিত্তিক আন্দোলন। তারা সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন ঘটাতে চায়। তাদের কার্যক্রমের মূল ভিত্তি হলো: চিন্তার লড়াই: কুফরি (অবিশ্বাস) চিন্তা এবং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালানো। এর উদ্দেশ্য হলো, প্রচলিত ভ্রান্ত চিন্তা ও কুফরি মতবাদের অসত্যতা ও ত্রুটিগুলো সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং ইসলামী চিন্তা ও বিধান কী, তা বর্ণনা করা।রাজনৈতিক সংগ্রাম: সাম্রাজ্যবাদী কাফিরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম চালানো।
  • অরাজনৈতিক নয়, কিন্তু সহিংসতা বর্জন: হিযবুত তাহরীর নিজেদেরকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেই পরিচয় দেয়। তারা মনে করে, ইসলামী শরীয়াহ আইন অনুযায়ী মানুষের বিষয়াদি দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধান করাটাই হলো সিয়াসত (রাজনীতি)। তবে, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র জিহাদ বা সহিংস পথ অবলম্বন করে না বলে দাবি করে। তাদের পদ্ধতি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি, জনমত গঠন এবং মুসলিম উম্মাহর চেতনাকে জাগিয়ে তোলা, যাতে তারা নিজেরাই খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হয়। তাদের বিবৃত কার্যক্রম হলো চিন্তা-চর্চা, বই-পুস্তক প্রকাশ, সেমিনার আয়োজন এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করা। যদিও তাদের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
  • নিকট শত্রু: সংগঠনটি প্রাথমিকভাবে “নিকট শত্রু”র দিকে মনোযোগ দেয়। অর্থাৎ, যেসব শাসক মুসলিম পরিচয় ধারণ করলেও প্রকৃতপক্ষে ইসলামকে সঠিকভাবে অনুসরণ করে না বা ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে না, তাদেরকে তারা ইসলামের শত্রু হিসেবে দেখে।

🛑৪২) সুরুরি: উৎপত্তি আনুমানিক ১৪০০-১৪১০ হিজরি। সুরুরি হলো সালাফিবাদের মধ্যে একটি উপধারা বা চিন্তাধারা, যা মূলত সৌদি আরবের ধর্মতাত্ত্বিক মুহাম্মদ সুরুর জয়নাল আবিদীন কর্তৃক বিকশিত হয়েছিল। এটি একটি রাজনৈতিক সালাফি আন্দোলন যা ইখওয়ানুল মুসলিমিন (মুসলিম ব্রাদারহুড)-এর রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং সাংগঠনিক কাঠামোকে সালাফি আকিদার সাথে একত্রিত করার চেষ্টা করে। মুহাম্মদ সুরুর জয়নাল আবিদীন ছিলেন একজন সিরীয় মুসলিম পন্ডিত যিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সদস্য হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। সিরিয়ায় ইখওয়ানুল মুসলিমিনের উপর দমন-পীড়ন শুরু হলে সৌদি আরবে চলে আসেন। সৌদি আরবে এসে তিনি সেখানকার সালাফি আলেমদের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হন। সুরুরি মতাদর্শের জন্ম হয় যখন মুহাম্মদ সুরুর ইখওয়ানের রাজনৈতিক সক্রিয়তা, সরকারবিরোধী মনোভাব এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে ঐতিহ্যবাহী সালাফি আকিদার (বিশেষ করে তাওহীদ, শিরক বর্জন এবং বিদআত থেকে দূরে থাকা) সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি মনে করতেন যে, মুসলিম বিশ্বকে জাগিয়ে তুলতে এবং ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।

মূল বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্য: সুরুরি মতাদর্শের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  • ইখওয়ানিজম এবং সালাফিজমের সংমিশ্রণ: এটিই সুরুরিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইখওয়ানি প্রভাব: মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো, সুরুরিরা রাজনৈতিক সক্রিয়তা, ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক পরিবর্তন এবং বিদ্যমান স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার উপর জোর দেয়। তারা মনে করে যে, শাসক যদি শরীয়ত অনুযায়ী শাসন না করে, তবে তার সমালোচনা করা বা তাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। সালাফি প্রভাব: একই সাথে, তারা সালাফি আকিদার প্রতিও কঠোর আনুগত্য বজায় রাখে। তারা তাওহীদকে বিশুদ্ধ করা, শিরক ও বিদআত বর্জন করা এবং ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মের (সালাফ আস-সালিহ) পদাঙ্ক অনুসরণ করার উপর জোর দেয়। এই আকিদাগত বিশুদ্ধতা তাদের ওয়াহাবি ধারার সালাফিজমের কাছাকাছি নিয়ে আসে।
  • শাসকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি (সমালোচনা): ঐতিহ্যবাহী সালাফিরা সাধারণত শাসকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ বা সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকে, এমনকি যদি শাসক অন্যায়কারীও হন। তারা বিশ্বাস করে যে, শাসকদের আনুগত্য করা এবং ধৈর্য ধারণ করা ফিতনা (বিশৃঙ্খলা) এড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু সুরুরিরা, ইখওয়ানের প্রভাবে, শাসকদের প্রকাশ্য সমালোচনা এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করে, যদি তারা ইসলামী শরীয়ত বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় বা সীমালঙ্ঘন করে। তারা ‘জাহিলিয়্যাত’ (প্রাক-ইসলামী অজ্ঞতার যুগ)-এর ধারণাকে আধুনিক সমাজের প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করে, যেখানে প্রচলিত শাসনব্যবস্থাকে ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী হিসেবে দেখা হয়।
  • রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন: সুরুরিরা মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেয়। তারা মনে করে, ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য শুধু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়, বরং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামী কাঠামোর আওতায় আনাও অপরিহার্য।
  • জিহাদ: সুরুরিরা জিহাদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসেবে দেখে। যদিও তারা সাধারণত চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলির মতো সরাসরি সশস্ত্র জিহাদের আহ্বান জানায় না, তবে তাদের মতাদর্শ কিছু ক্ষেত্রে জিহাদি দলগুলোকে প্রভাবিত করেছে, যারা শাসকবর্গকে অমুসলিম আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহকে বৈধতা দেয়।
  • শিক্ষা ও দাওয়াহ: তারা তাদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য শিক্ষা, প্রকাশনা এবং দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনা করে। মুহাম্মদ সুরুর নিজেই অসংখ্য বই ও নিবন্ধ লিখেছেন এবং তার অনুসারীরা তার চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দিয়েছে।

সংক্ষেপে, সুরুরি হলো একটি রাজনৈতিক সালাফি ধারা যা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের রাজনৈতিক সক্রিয়তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সালাফি আকিদাকে একত্রিত করার চেষ্টা করে। তারা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতি জোর দেয় এবং সালাফি আলেমদের সমালোচনা করে বিশেষ করে যারা সরকারপন্থী বলে বিবেচিত। এই দলটি মূলধারার সালাফি আলেমদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে এবং অনেক সময় “গোপন ইখওয়ানি” বা “রাজনৈতিক সালাফি” বলেও অভিহিত করা হয়।

▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬

সংকলন ও উপস্থাপনায়: আসাদ রনি।

Share: