যারা অনবরত বায়ু বের হওয়া এবং ওয়াসওয়াসা রোগে আক্রান্ত তাদের অযুর পদ্ধতি

প্রশ্ন: যে সকল নারী পুরুষ অনবরত বায়ু বের হওয়ার রোগে আক্রান্ত এবং যারা ওয়াসওয়াসা তথা সন্দেহের রোগে আক্রান্ত তাদের অযুর পদ্ধতি কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর যে ব্যক্তি (নারী-পুরুষ)-এর অপবিত্রতা স্থায়ী ও চলমান যেমন: পেশাব-ঝরা রোগী কিংবা অনবরত বায়ু ত্যাগের রোগী, তারা প্রত্যেক ওয়াক্তের সলাতের জন্য অযু করবেন। এই অযু দিয়ে তিনি যত রাকাত ইচ্ছা ফরয ও নফল সলাত আদায় করবেন; যতক্ষণ না আরেক সলাতের ওয়াক্ত শুরু হয়। দলিল হলো মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহ তোমাদের জন্য দ্বীনে কোনো রূপ সংকীর্ণতা রাখেননি।” তিনি আরো বলেন: “আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান, তোমাদের জন্য কঠিন চান না।”সহিহ বুখারী ও মুসলিমে আছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন: ফাতেমা বিনতে আবু হুবাইশ রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল! আমি ইস্তেহাযাগ্রস্ত হই। তারপর আর পবিত্র হই না। আমি কি সলাত ছেড়ে দিব?” তিনি বললেন: সেটি শিরা (থেকে রক্তক্ষরণ); হায়েযের স্রাব নয়। যখন তোমার হায়েযের স্রাব শুরু হবে তখন সলাত ছেড়ে দেবে। যখন হায়েযের স্রাব থেমে যাবে তখন তুমি রক্ত ধৌত করবে এবং পুনরায় সলাত আদায় করবে। এরপর প্রত্যেক সলাতের ওয়াক্ত এলে সেটির জন্য অযু করবে।”(সহীহ বুখারী হা/২২৬; সহীহ মুসলিম হা/৩৩৩)
.
ইমাম বুহূতী (রাহিমাহুল্লাহ) আর-রাওদুর মুরবি গ্রন্থে বলেন: (والمستحاضة ونحوها) ممن به سلس بول أو مذي أو ريح … (تتوضأ لـ) دخول (وقت كل صلاة) إن خرج شيء (وتصلي) ما دام الوقت (فروضا ونوافل)، فإن لم يخرج شيء لم يجب الوضوء“ইস্তেহাযাগ্রস্ত নারী এবং তার অনুরূপ যাদের অনবরত পেশাব ঝরে, অনবরত কামরস বের হয় কিংবা বায়ু নির্গত হয়…তারা প্রত্যেক সলাতের ওয়াক্ত প্রবেশ করলে অযু করবে, যদি কোনো কিছু বের হয়। আর যতক্ষণ ওয়াক্ত আছে ততক্ষণ ফরয ও নফল সলাত আদায় করবে। আর যদি কোনো কিছু বের না হয় তাহলে অযু করা ওয়াজিব হবে না।”(বুহূতী; আর-রাওদুর মুরবি; পৃষ্ঠা: ৫৭)
.
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:
فمن لم يمكنه حفظ الطهارة مقدار الصلاة ، فإنه يتوضأ ويصلي ، ولا يضره ما خرج منه في الصلاة، ولا ينتقض وضوؤه بذلك باتفاق الأئمة، وأكثر ما عليه أن يتوضأ لكل صلاة ” ا
“যে ব্যক্তি সলাতের সময়কাল পর্যন্ত পবিত্রতা ধরে রাখতে সক্ষম নয়, সে (প্রত্যেক সলাতের সময়) ওজু করবে এবং সলাত আদায় করবে। সলাতের মাঝে তার শরীর থেকে কিছু নিঃসরণ হলেও তাতে তার কোনো ক্ষতি নেই এবং এর মাধ্যমে তার ওজু ভঙ্গ হবে না—এ বিষয়ে ইমামগণের ঐক্যমত রয়েছে। তার জন্য সর্বোচ্চ করণীয় হলো—প্রত্যেক সলাতের সময় নতুন করে ওজু করা।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ২২১)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,
الأصل أن خروج الريح ينقض الوضوء، لكن إذا كان يخرج من شخص باستمرار وجب عليه أن يتوضأ لكل صلاة عند إرادة الصلاة، ثم إذا خرج منه وهو في الصلاة لا يبطلها وعليه أن يستمر في صلاته حتى يتمها، تيسراً من الله تعالى لعباده ورفعاً للحرج عنهم، كما قال تعالى: يريد الله بكم اليسر وقال: ما جعل عليكم في الدين من حرج اللجنة الدائمة للبحوث
“মূলনীতি হচ্ছে—বাতাস (বায়ু) নির্গত হলে ওযু ভঙ্গ হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি অনবরত বাতাস নির্গমনের সমস্যায় ভোগে, তার উপর বিধান হচ্ছে প্রতিটি ফরজ সালাতের ইচ্ছা করার সময় নতুন করে ওযু করবে। এরপর সালাতের মধ্যে যদি আবার বাতাস বের হয়, তাহলেও তার সালাত ভঙ্গ হবে না। বরং সে সালাত সম্পন্ন করবে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের প্রতি দয়া ও সহজীকরণের নিদর্শন, যেমন তিনি বলেন: আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, এবং তিনি তোমাদের উপর দ্বীনের বিষয়ে কোন কষ্ট চাপিয়ে দেননি।(সূরা আল-বাকারা: ১৮৫ ও সূরা আল-হজ্জ: ৭৮; ফাতওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ লিল বুহূস আল-ইলমিয়্যাহ ওয়াল-ইফতা; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৪১১)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এমন এক ব্যক্তির ব্যাপারে যার থেকে নিয়মিতভাবে বাতাস নির্গত হয় তার ওযু এবং সলাত কীভাবে হবে? স্থায়ী কমিটির আলেমগন উত্তরে বলেন:
إذا كان حالك ما ذكر وأن الغازات مستمرة معك ، فعليك الوضوء لكل صلاة بعد دخول الوقت، ولا يضرك ما يخرج منك بعد ذلك .وأما الجمعة فتتوضأ لها قبل دخول الخطيب ، في الوقت الذي يمكنك من سماع الخطبة وأداء الصلاة “
“যদি তোমার অবস্থা এমনই হয়ে থাকে, যেমন তুমি বর্ণনা করেছো অর্থাৎ বাতাস (বায়ু) নিরবিচ্ছিন্নভাবে বের হতে থাকে তাহলে প্রত্যেক সলাতের সময় শুরু হলে ওযু করবে, এরপরে শরীর থেকে যা-ই বের হোক না কেন, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে না। জুমু’আর ক্ষেত্রে, ইমাম মিম্বারে ওঠার আগে ওযু করে নাও, যাতে তুমি খুৎবা শুনে সলাত আদায় করতে পারো।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৪১২)
.
দ্বিতীয়ত: ওযু করার সময় বা পরে যদি সন্দেহ হয় যে, বায়ু নির্গত হয়েছে। এমতাবস্থায় করণীয় কী?
.
যেকোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে সন্দেহ নয়, বরং নিশ্চিত জ্ঞানকে ভিত্তি করতে হয়। শুধুমাত্র ধারণা বা সন্দেহের ওপর শরিয়তের কোনো বিধান প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সুতরাং, পায়ুপথ দিয়ে গ্যাস/বাতাস নির্গত হয়েছে কি না এ নিয়ে যদি শুধু সন্দেহ থাকে, তবে তা ওযু ভঙ্গের জন্য যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না ব্যক্তি নিশ্চিত হয় যে সত্যিই তা ঘটেছে। সুতরাং ওয়াসওয়াসায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য উত্তম পরামর্শ হলো তারা সলাতে বা সলাতের বাইরে কোনো ধরনের সন্দেহের প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেবে না। বরং তারা একে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করবে, এতে তারা দ্বিধান্বিত হবে না কিংবা মনঃকষ্টেও ভুগবে না। তারা এই বিশ্বাসে অবিচল থাকবে যে, তারা সঠিক ও হকের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং তার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশের অনুসারী। এরই সমর্থনে একটি সহীহ হাদীসে এসেছে তামীম আদ-দারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,شُكِىَ إِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلُ يَجِدُ فِى الصَّلَاةِ شَيْئًا أَيَقْطَعُ الصَّلَاةَ قَالَ لَا حَتَّى يَسْمَعَ صَوْتًا أَوْ يَجِدَ رِيْحًا “নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এক ব্যক্তি সম্পর্কে অভিযোগ করা হল যে, সে সালাতে এমন কিছু অনুভব করে যাতে সে সন্দেহ করে সলাত ছেড়ে দিবে কি-না? তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, না যতক্ষণ সে কোন শব্দ বা গন্ধ অনুভব না করবে, ততক্ষণ ছেড়ে দেবে না”।(সহীহ বুখারী, হা/২০৫৬) এ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হল- ওযু ভাঙ্গার ব্যাপারে পরিপূর্ণ নিশ্চিত হওয়া ছাড়া (সলাত না ছাড়া)। অতএব, সন্দেহ কিংবা কল্পনা ধর্তব্য নয়। পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া ছাড়া সলাত ছাড়া যাবে না।এটাই রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ।তবে,কোনো মুসলিম যদি পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত হয় যে, সে সালাতের মধ্যে বায়ু নির্গমন করেছে তাহলে তিনি সালাত ছেড়ে দিবেন পরে অযু করে পুনরায় সালাত আদায় করবেন।কারন সালাত আদায়ের জন্য পবিত্রতা শর্ত রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ্‌ তা’আলা পবিত্রতা ব্যতীত কোনো সালাত কবুল করেন না এবং অবৈধভাবে অর্জিত মালের সদকা গ্রহণ করেন না।(সুনানে আন-নাসায়ী হা/১৩৯)
.
ইবনে হাজার হাইতামীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “শুচিবায়ুর কি কোন চিকিৎসা আছে?
তিনি এই বলে জবাব দেন: এর কার্যকরী ঔষধ একটাই সেটা হচ্ছে শুচিবায়ুকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়া; এমনকি মনের মধ্যে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও। কেননা কেউ যদি সেটাকে ভ্রুক্ষেপ না করে তাহলে সেটা স্থির হবে না। কিছু সময় পর চলে যাবে; যেমনটি তাওফিকপ্রাপ্ত লোকেরা যাচাই করে পেয়েছেন। আর যে ব্যক্তি শুচিবায়ুকে পাত্তা দিবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে সে ব্যক্তির শুচিবায়ু বাড়তেই থাকবে; এক পর্যায়ে তাকে পাগলের কাতারে নিয়ে পৌঁছাবে কিংবা পাগলের চেয়েও নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছাবে। যেমনটি আমরা অনেক মানুষের মাঝে দেখেছি, যারা শুচিবায়ুতে আক্রান্ত হয়ে এতে কান দিয়েছেন এবং এর শয়তানের কথা শুনেছেন। যে শয়তানের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাবধান করে বলেছেন: “তোমরা পানি ব্যবহারে কুমন্ত্রণাদাতা (শয়তান) থেকে বেঁচে থাক, যাকে ‘ওয়ালাহান’ ডাকা হয়”। অর্থাৎ অহেতুক কাজ করানো ও বাড়াবাড়ির কুমন্ত্রণা দেয়ার কারণে তাকে এই নামে ডাকা হয়। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে আমি যে পরামর্শ দিয়েছি এর সমর্থনমূলক বর্ণনা এসেছে যে, যে ব্যক্তি শুচিবায়ুতে আক্রান্ত হয়েছে সে যেন ‘আউযুবিল্লাহ্‌’ পড়ে এবং (দুঃশ্চিন্তাকে বাড়তে না দিয়ে) থেমে যায়। আপনি এ উপকারী ঔষধটি একটু ভেবে দেখুন; যে ঔষধটি তার উম্মতকে শিখিয়েছেন এমন ব্যক্তি যিনি মনগড়া কোনো কথা বলেন না। জেনে রাখুন, যে ব্যক্তি এই ঔষধ অবলম্বন করা থেকে বঞ্চিত হলো সে প্রভুত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। কেননা, সর্বসম্মতিক্রমে শুচিবায়ু শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আর এই লানতপ্রাপ্ত শয়তানের সর্বাত্মক উদ্দেশ্য হচ্ছে­ মুমিনকে বিভ্রান্তির ডোবাতে ফেলে দেয়া, পেরেশান করে রাখা, জীবনকে ভারাক্রান্ত করে তোলা, অন্তরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিষাদময় করে ফেলা; যাতে এক পর্যায়ে তাকে ইসলাম থেকে এমনভাবে বের করে ফেলতে পারে যে সে টেরও পাবে না। (নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ কর।”[সূরা ফাতির, আয়াত: ৬][আল-ফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাল কুবরা (১/১৪৯)]
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] জনৈক আলেম থেকে বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি ওযু কিংবা সলাতে শুচিবায়ু রোগে আক্রান্ত তার জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা মুস্তাহাব। কেননা শয়তান যিকির শুনলে দূরে চলে যায়। আর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌’ হচ্ছে–প্রধান যিকির। শুচিবায়ু দূর করার উত্তম মহাষৌধ হচ্ছে বেশি বেশি আল্লাহ্‌র যিকিরে মশগুল থাকা।(ইবনে হাজার হাইতামি এর বক্তব্য সমাপ্ত; ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং ৬২৮৩৯)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Share: