কবরের আযাব কিসের উপর হবে আত্মার উপর নাকি শরীরের উপর

প্রশ্ন: কবরের ‘আযাব কি নফস তথা আত্মার উপর হবে নাকি শরীরের উপর হবে? নাকী আত্মা ও শরীর উভয়ের উপর হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। যিনি পৃথিবীতে রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন এবং তাঁর পরিবার পরিজন, সাথীবর্গ ও তাবে‘ঈনদের ওপর কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হোক। অতঃপর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামগন ইজমা তথা ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায় তখন বারযাখী জীবনে সে শাস্তিতে না হয় শান্তিতে থাকে। কবরের আযাব কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ বলেন: “অতঃপর আল্লাহ তাকে তাদের ষড়যন্ত্রের অনিষ্ট হতে রক্ষা করলেন এবং ফিরআউন গোষ্ঠীকে ঘিরে ফেলল কঠিন শাস্তি; আর আগুন, তাদেরকে তাতে উপস্থিত করা হয় সকাল ও সন্ধ্যায় এবং যেদিন কিয়ামত ঘটবে সেদিন বলা হবে, ফিরআউন গোষ্ঠীকে নিক্ষেপ কর কঠোর শাস্তিতে।(সূরা মুমিন: ৪৫-৪৬)। অত্র আয়াতে সকাল-সন্ধ্যা যে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে কবরের শাস্তি। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আহলে সুন্নাতের নিকট অত্র আয়াতই আলামে বারযাখে কবরের শাস্তি সাব্যস্ত হওয়ার মৌলিক ভিত্তি”।(তাফসীরে ইবনু কাসীর,সূরা মুমিন আয়াত: ৪৬)। আল্লাহ অন্য আয়াতে আরো বলেন: “অচিরেই আমি তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করব, অতঃপর (পরকালেও) তারা মহা শাস্তির দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে”।(সূরা তাওবা: ১০১)। অত্র আয়াতে বারবার শাস্তি বলে কবরের শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম হাসান বসরী ও ক্বাতাদাহ বলেন, দু’বার শাস্তি অর্থ রোগ-শোক ও বিপদাপদের মাধ্যমে প্রথমবার দুনিয়াবী শাস্তি এবং দ্বিতীয়বার কবর আযাবের শাস্তি’ (তাফসূরে কুরতুবী, দ্রঃ বুখারী ‘জানাযা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ৮৫)। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ বুখারীতে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার হাদীস নিয়ে এসেছেন, তিনি বলেন, একদা এক ইয়াহূদী মহিলা তাঁর নিকট এসে কবরের ‘আযাবের কথা উল্লখ করলে তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাকে কবরের ‘আযাব থেকে রক্ষা করুন। অতঃপর তিনি কবরের ‘আযাব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, কবরের ‘আযাব সত্য।(সহীহ বুখারী হা/১৩৭২;সিলসিলা সহীহাহ হা/১৩৭৭)। এছাড়া বহু সহীহ হাদীস দ্বারা এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। সুতরাং কেউ কবরে ‘আযাব প্রাপ্য হলে সে তার নির্ধারিত ‘আযাব ভোগ করবে, যদিও তাকে কবর দেওয়া হোক বা না হোক বা তাকে হিংস্র জানোয়ার খেয়ে ফেলুক, বা আগুনে জ্বলে ভস্মীভূত হোক, এমনকি সে যদি ছাই-বালুতে পরিণত হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে দিলেও বা তাকে ফাঁসি দেওয়া হোক, বা সে সমুদ্রে ডুবে মারা যাক।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] তার লিখিত কিতাবের বহু জায়গায় তা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে ‘‘আল আকীদা আল ওয়াসিতিয়ায়’’ উল্লেখ করে বলেন, পরকালের প্রতি ঈমান আনার মধ্যে মৃত্যুর পরের ঘটনাবলী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসকল সংবাদ দিয়েছেন তাঁর প্রতি ঈমান আনা। কাজেই কবরের ফিতনা, কবরের শাস্তি ও শান্তির প্রতি তাঁরা ঈমান আনবে। অতঃপর ফিতনা সম্পর্কে বলেন, মানুষ তাদের কবরে ফিতনার সম্মুখীন হবে, প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমার রব কে, তোমার দ্বীন কী এবং তোমার নবী কে? আল্লাহ মুমিন বান্দাদেরকে সুদৃঢ় বাক্য (তাওহীদের কালিমা) দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন। মুমিন ব্যক্তি বলবে, আমার রব আল্লাহ, আমার দ্বীন ইসলাম এবং নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর সন্দেহকারী ব্যক্তি বলবে, হায়! হায়! আমি জানি না; কিন্তু লোকের মুখে যা শুনেছি আমিও তা বলেছি। তখন তাকে লোহার হাতুড়ী দ্বারা মারা হলে সে এমন ভাবে চিৎকার করবে যে, মানুষ ব্যতীত সকল সৃষ্টি জীবই তা শুনবে। মানুষ যদি তা শুনতো তবে ছিটকে পড়ে যেত। (আল আকীদাতুল ওয়াসিতিয়াহ রওজা নাদিয়ার শরাহ, পৃষ্ঠা নং: ৩১১) ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম ইমাম আহমাদ রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, কবরের ‘আযাব সত্য, কেবল পথভ্রষ্টরা বা পথভ্রষ্টকারীই তা অস্বীকার করে থাকে। হাম্বল ইবন আব্দুল্লাহ রহ. বলেন, আমি আবূ আব্দুল্লাহ (ইমাম আহমাদ) কে কবরের ‘আযাব সম্বন্ধে বললে তিনি বলেন, এ সকল হাদীস সহীহ। আমরা এর প্রতি ঈমান রাখি এবং তা স্বীকার করি। যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো বিশুদ্ধ সনদে হাদীস আসবে আমরা তা স্বীকার করব। তিনি যা নিয়ে এসেছেন আমরা যদি তা স্বীকার না করে ফিরিয়ে দেই তাহলে আমরা যেন আল্লাহর নির্দেশই তাঁর ওপর ফিরিয়ে দিলাম। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ﴾“এবং রাসূল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসছেন তা গ্রহণ কর।” [সূরা হাশর, আয়াত: ৭] আমি তাকে বললাম, কবরের ‘আযাব কি সত্য? তিনি বললেন: হ্যাঁ সত্য, কবরে শাস্তি দেওয়া হবে।(ইবনুল কাইয়্যেম আর রূহ- পৃষ্ঠা নং: ১৬৬, দার ইবন কাসীর প্রকাশিত)
.
দ্বিতীয়ত: কবরের আযাব আত্মার উপর হবে নাকি আত্মা এবং শরীর উভয়ের ওপর সংঘটিত হবে এই বিষয়ে সালাফদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ দুটি মত পাওয়া যায় আর তা হচ্ছে:
.
(১). একদল আলেমদের মতে কবরের আযাব শুধুমাত্র আত্মার উপর হবে দেহের উপর নয় কেননা মৃত্যুর পর দেহ কেবল মৃতদেহ। ফলে শরীরের বেঁচে থাকার জন্য কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না। যার কারনে সে খাওয়া-দাওয়া কিংবা পান করে না। বরং পোকামাকড় তার দেহ খেয়ে ফেলে। সুতরাং আযাব মূলত আত্মার উপর ঘটে থাকে। সমকালীন আলেমদের মধ্যে ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এই মত গ্রহন করেছেন।

বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] -কে প্রশ্ন করা হয়েছে: আত্মা এবং শরীরের ওপর কবরের আজাব কি হয়? উত্তরে তিনি বলেছেন:

الأصل أنه على الروح ، لأن الحكم بعد الموت للروح ، والبدن جثة هامدة ، ولهذا لا يحتاج البدن إلى إمداد لبقائه ، فلا يأكل ولا يشرب ، بل تأكله الهوام ، فالأصل أنه على الروح ، لكن قال شيخ الإسلام ابن تيمية إن الروح قد تتصل بالبدن فيعذب أو ينعم معها …. فبناء على ذلك قال العلماء إن الروح قد تتصل في البدن فيكون العذاب على هذا وهذا ، وربما يستأنس لذلك بالحديث الذي قال فيه رسول الله صلى الله عليه وسلم : ( إن القبر ليضيق على الكافر حتى تختلف أضلاعه ) فهذا يدل على أن العذاب يكون على الجسم لأن الأضلاع في الجسم .

“মূলনীতি হল এটি (আযাব) আত্মার উপর হয়, কারণ মৃত্যুর পরে বিধি-বিধানগুলো আত্মার উপর নির্ভর করে, দেহ একটি প্রাণহীন মৃতদেহে পরিণত হয়। তাই দেহের বেঁচে থাকার জন্য পুষ্টি সরবরাহের প্রয়োজন হয় না, যার ফলে এটি খায় না বা পান করে না, বরং পোকামাকড় তাকে খায়। তাই মূলনীতি হল এটি আত্মার উপর হয়। তবে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন আত্মা শরীরের সাথে যুক্ত থাকে এবং তার সাথে আজাব হয় অথবা শান্তি পায় এর উপর ভিত্তি করে আলিমগন বলেছেন আত্মা শরীরের সাথে যুক্ত থাকে ফলে শরীরের এবং আত্মার উভয়ের শাস্তি কিংবা শান্তি পায়। সম্ভবত এটি সেই হাদিস থেকে নেওয়া যেতে পারে যেখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: (প্রকৃতপক্ষে, কাফেরদের জন্য কবর এতই সংকীর্ণ হবে যে তার পাঁজরের হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে) এটি ইঙ্গিত করে যে আযাব শরীরের উপর হবে। কেননা পাঁজরের হাড় শরীরের অন্তর্ভুক্ত”।(উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা:২৫)
.
(২). পক্ষান্তরে এই উম্মতের পূর্বলোক (সালাফ) এবং জমহুর ইমামদের বিশুদ্ধ মাযহাব হলো, যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায় তখন সে তার ঈমান ও আমল অনুযায়ী শান্তি বা শাস্তিতে থাকে। আর তা শরীর ও রূহ উভয়েরই ঘটবে। শরীর থেকে রূহ বেরিয়ে যাওয়ার পর তা আযাব কিংবা নে‘মত ভোগ করতে থাকবে। আর নির্দিষ্ট সময়ে তা শরীরের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে শরীরও শাস্তির সম্মুখীন হবে; এই মতের পক্ষে রয়েছেন ইমাম ইবনে তায়মিয়াহসহ জমহূর ওলামায়ে সালাফ। আর এই মতটাই বিশুদ্ধ। হাদিসেও এর প্রমান পাওয়া যায়। যেমন প্রখ্যাত সাহাবী বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) এবং অক্ষত সাহাবী আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হাদিস গুলো দেখুন:(মুসনাদে আহমাদহা/ ১৮৫৩৪, ইবনু আবী শায়বাহ্ হা/ ১২০৫৯, মুসতাদরাক লিল হাকিম হা/১০৭, সহীহ আত্ তারগীব হা/৩৫৫৮, সহীহ আল জামি‘ আস সগীর ১৬৭৬; মিশকাতুল মাসাবিহ, হা/ ১৬৩০ এবং তিরমিজী, হাদীস নং ১০৭১; হাদীসগুলো অনেক বড় তাই উল্লেখ করা হয়নি)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন;

“ومذهب سلف الأمة وأئمتها أن العذاب أو النعيم يحصل لروح الميت وبدنه، وأن الروح تبقى بعد مفارقة البدن منعمة أو معذبة، وأيضا تتصل بالبدن أحيانا فيحصل له معها النعيم أو العذاب”
“সালাফে সালেহীন ইমামদের মতামত হলো, মৃত ব্যক্তির আযাব এবং শান্তি আত্মা ও দেহের উপর হয়ে থাকে। আত্মা দেহ থেকে পৃথক হওয়ার পরে শান্তি কিংবা শাস্তি ভোগ করে আবার কখনো দেহের সাথে আত্মা মিলিত হয়ে উভয়ে একসাথে সুখ বা শাস্তি ভোগ করে”।(আল ইখতিয়ারাতুল ফিক্বহিয়্যাহ পৃষ্ঠা: ৯৪)
.
ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা,(রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেন: শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)- কে এই মাসালার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমরা তাঁর উত্তরটি নিম্নে উল্লেখ করছি:

“بل العذاب والنعيم على النفس والبدن جميعاً باتفاق أهل السنة والجماعة، تُنعَّم النفس وتعذب منفردة عن البدن وتنعم وتعذب متصلة بالبدن، والبدن متصل بها فيكون النعيم والعذاب عليها في هذه الحال مجتمعين كما تكون على الروح منفردة عن البدن.

مذهب سلف الأمة وأئمتها أن الميت إذا مات يكون في نعيم أو عذاب، وأن ذلك يحصل لروحه وبدنه، وأن الروح تبقى بعد مفارقة البدن منعمة أو معذبة، وأنها تتصل بالبدن أحياناً ويحصل له معها النعيم أو العذاب، ثم إذا كان يوم القيامة الكبرى أعيدت الأرواح إلى الأجساد وقاموا من قبورهم لرب العالمين ومعاد الأبدان متفق عليه بين المسلمين واليهود والنصارى”

“আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ঐক্যমত অনুসারে শাস্তি ও শান্তি আত্মা ও দেহ উভয়ের ওপরই পতিত হয়। আত্মাকে শান্তি দেওয়া হয় আর দেহ থেকে পৃথক করে শাস্তি দেওয়া হয়, শান্তি এবং শাস্তি দেহের সাথে মিলিত হয়ে দেওয়া হয় এবং দেহ আত্মার সাথে মিলিত হয়ে একই সাথে শান্তি ও শাস্তি ভোগ করে থাকে যেমন ভাবে আত্মা দেহ থেকে পৃথক হয়ে ভোগ করে ঠিক তেমনি।

এই উম্মতের সালাফ ও ইমামগণের মতামত হলো যে, যখন কোন মৃত মৃত্যু বরণ করে তখন হয় সে শান্তি অথবা আজাবের ভেতর থাকে, তা আত্মা এবং ও শরীর উভয়ের উপরে আপতিত হয়। আর এটা দেহ এবং আত্মা উভয়ের উপর পতিত হয়। আত্মাটা দেহ থেকে পৃথক হওয়ার পরে শান্তি কিংবা শাস্তি উপভোগ করে অথবা কখনো কখনো দেহের সাথে মিলিত হয়ে উপভোগ করে। অতঃপর যখন কিয়ামত সংগঠিত হবে তখন রূহগুলোকে তাদের দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং তারা তাদের কবর থেকে উঠে বিশ্ব পালনকর্তার সাথে দাঁড়ানোর জন্য বের হয়ে আসবে। মৃতদেহের যে পুনরুত্থান হবে এ ব্যাপারে মুসলিম, ইহুদি- খ্রিস্টান সকলেই ইজমা তথা ঐক্যমত পোষণ করেছেন।” (ইবনুল কাইয়ুম;আর রুহ পৃষ্ঠা:৫১-৫২)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন: “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে কবরের শাস্তি একটি সত্য বিষয়। আর এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের বহু সংখ্যক প্রমাণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,﴿ٱلنَّارُ يُعۡرَضُونَ عَلَيۡهَا غُدُوّٗا وَعَشِيّٗاۚ ٤٦﴾ [غافر: ٤٦]“আগুন, তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়”। [সূরা গাফির, আয়াত: ৪৬] এ বিষয়ে যথেষ্ঠ পরিমাণে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর আকল-বুদ্ধি এটাকে অসম্ভব মনে করে না। যদি কারো আকল বা জ্ঞান এটাকে অসম্ভব মনে করে তবে তাকে বুঝতে হবে, এ বিষয়ে যখন কুরআন ও হাদীসের সিদ্ধান্ত এসে গেছে তখন এটা মান্য করা অবশ্য কর্তব্য। এটা আমাদের জ্ঞানের পরিধির ভিতরে হোক বা বাহিরে হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। আসল কথা হলো, কবরের শাস্তির বিশ্বাসটি আহলে সুন্নাতের আকীদা বিশ্বাসের অন্তর্গত। খারেজী, অধিকাংশ মুতাযিলা ও মুরজিয়াদের একটি দল কবরের শাস্তির বিষয়টি অস্বীকার করে। তিনি আরো বলেন, যদি মৃত ব্যক্তির শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা পুড়ে ছাই হয়ে যায় কিংবা কোনো জীব-জন্তুর পেটে চলে যায় তাহলেও কবরের শাস্তি ভোগ করা সম্ভব। তিনি আরো বলেছেন,
“فإن قيل: فنحن نشاهد الميت على حاله في
قبره فكيف يُسأل ويُقعد ويضرب بمطارق من حديد ولا يظهر له أثر، فالجواب: أن ذلك غير ممتنع بل له نظر في العادة وهو النائم، فإنه يجد لذة وآلاما لا نحس نحن شيئا منها، وكذا يجد اليقظان لذة وآلما لما يسمعه أو يفكر فيه ولا يشاهد ذلك جليسه منه، وكذا كان جبرئيل يأتي النبي صلى الله عليه وسلم فيخبره بالوحي الكريم ولا يدركه الحاضرون، وكل هذا ظاهر جلى”
“যদি বলা হয়, আমরা দেখি মৃত ব্যক্তিকে কবরে যেভাবে রাখা হয়েছে সেভাবেই আছে। কখন তাকে বসানো হলো আর কীভাবে তাকে লোহার হাতুড়ি দ্বারা শাস্তি দেওয়া হলো অথচ তার তো কোন চিহ্ন প্রকাশ হয় না? এর উত্তরে বলা যায়, আমরা অনুভব না করলেও এটা ঘটা সম্ভব। যেমন আমাদের পাশে কোনো ব্যক্তি নিদ্রায় থাকে আর সে স্বপ্নে কত খারাপ অবস্থা ভোগ করতে থাকে বা কত সুখ ভোগ করতে থাকে। অথচ আমরা তার পাশে থেকেও তার কোনো কষ্ট বা সুখ অনুভব করি না বা দেখি না। অনুরুপভাবে জাগ্রত অবস্থায় সে আনন্দ এবং বেদনা অনুভব করে, যখন সে কোন কিছু শুনে অথবা কোন বিষয় চিন্তা করে অথচ তার পাশে বসা ব্যক্তি তা দেখতে পায় না। এমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিবরীল অহী নিয়ে আসতো। আর রাসূল কষ্ট করে সে অহী ধারন করতেন কিন্তু পাশে উপস্থিত সাহাবীগণ তা টের পেতেন না। আর এগুলো প্রত্যেকটি হলো প্রকাশ্য স্পষ্ট বিষয়।(নববী শারহ মুসলিম” খন্ড: ১৭; পৃষ্ঠা: ২০১)
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:

والنائم يحصل له في منامه لذة وألم وذلك يحصل للروح والبدن حتى إنه يحصل له في منامه من يضربه فيصبح والوجع في بدنه، ويرى في منامه أَنّه أُطْعِم شيئاً طيباً فيصبح وطعمه في فمه، وهذا موجود، فإذا كان النائم يحصل لروحه وبدنه من النعيم والعذاب ما يحس به والذي إلى جنبه لا يحس به حتى قد يصيح النائم من شدة الألم أو الفزع الذي يحصل له ويسمع اليقظان صياحه وقد يتكلم إما بقرآن وإما بذكر وإما بجواب واليقظان يسمع ذلك وهو نائم عينه مغمضة ولو خوطب لم يسمع: فكيف ينكر حال المقبور الذي أخبر الرسول أنه (يسمع قرع نعالهم)، وقال: (ما أنتم أسمع لما أقول منهم؟)،
والقلب يشبه القبر، ولهذا قال لما فاتته صلاة العصر يوم الخندق: (ملأ الله أجوافهم وقبورهم ناراً)، وفى لفظ: (قلوبهم وقبورهم ناراً)، وَفرَّق بينهما في قوله: (بعثر ما في القبور وحصل ما في الصدور) وهذا تقريب وتقرير لإمكان ذلك.

ولا يجوز أن يقال ذلك الذي يجده الميت من النعيم والعذاب مثلما يجده النائم في منامه، بل ذلك النعيم والعذاب أكمل وأبلغ وأتم وهو نعيم حقيقي وعذاب حقيقي، ولكن يذكر هذا المثل لبيان إمكان ذلك، إذا قال السائل: الميت لا يتحرك في قبره والتراب لا يتغير ونحو ذلك مع أن هذه المسألة لها بسط يطول وشرح لا تحتمله هذه الورقة والله أعلم وصلى الله على محمد وآله وصحبه وسلم” ا

“ঘুমন্ত ব্যক্তি তার স্বপ্নে আনন্দ এবং বেদনা অনুভব করে, এটি আত্মা এবং শরীরের সাথে ঘটে, এমনকি সে স্বপ্নে দেখতে পারে যে কেউ তাকে তার স্বপ্নে আঘাত করছে, ফলে সে তার শরীরে ব্যথা অনুভব করে জেগে ওঠে অথবা সে স্বপ্নে দেখতে পারে যে, তাকে ভালো কিছু খাওয়ানো হয়েছে, তারপর সে তার মুখে খাবারের স্বাদ নিয়ে জেগে উঠতে পারে। এটি এমন কিছু যা সত্যিই ঘটে। যদি একজন ঘুমন্ত ব্যক্তির শরীর এবং আত্মা আনন্দ এবং ব্যথা অনুভব করতে পারে যা তার পাশের ব্যক্তি অনুভব করে না,এবং একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি তার উপর যে ব্যথা আতঙ্কের তীব্রতায় তার সাথে যা ঘটছে তার ভয়ে চিৎকার করতে পারে এবং যারা জেগে আছে তারা তাকে শুনতে পারে, এবং (ঘুমের মধ্যে) সে কথা বলতে পারে, কুরআন তেলাওয়াত বা যিকির করতে পারে বা কারো সাথে কথা বলতে পারে, এবং যারা জেগে আছে তারা তা শুনতে পারে, যদিও সে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে, অথচ তারা কথা বললেও সে তা শুনতে পায় না তাহলে কবরবাসীর অবস্থা কিভাবে অস্বীকার করা যায় যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে “সে তাদের জুতার আওয়াজ শুনতে পায়”। হৃদয় কবরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এজন্যই যখন খন্দকের দিন (রাসূল ﷺ এর) আসরের সালাত ছুটে যাই তখন তিনি (ﷺ) বলেছিলেন: আল্লাহ তাআলা তাদের ঘর ও ক্ববরগুলোকে জাহান্নামের আগুনে পরিপূর্ণ করে দিন। অন্য শব্দ রয়েছে আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তর এবং কবর আগুনে পরিপূর্ণ করে দিন। উভয় কথার মাঝে পার্থক্য হল আল্লাহ তাআলা বলেছেন,”তাদের কবরে যা রয়েছে সেদিন সব কিছু উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং অন্তরে যা কিছু (লুকানো) রয়েছে তা প্রকাশ করা হবে”। এটি শুধুমাত্র ব্যাখ্যা করার জন্য যে এটি ঘটতে পারে। এটা বলা জায়েয নয় যে, একজন মৃত ব্যক্তি যে সুখ ও আযাব ভোগ করে তা ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়,বরং সেই আনন্দ বা যন্ত্রণা আরও পরিপূর্ণ এবং আরও সুদূরপ্রসারী; এবং এটাই প্রকৃত সুখ ও প্রকৃত যন্ত্রণা। তবুও এই উদাহরণটি দেখানোর কারন হচ্ছে যে এটি সম্ভব। যদি প্রশ্নকারী বলেন: মৃত ব্যক্তি তার কবরে নড়াচড়া করে না, মাটির পরিবর্তন হয় না, ইত্যাদি। তাহলে বলব এই বিষয়টির দ্বীর্ঘ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যা এই কাগজে লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। আল্লাহ সবচেয়ে বেশি জানেন। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ও তাঁর সাহাবীর উপর শান্তি বর্ষিত হোক”। (মাজমুউল ফাতাওয়া: খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৭৫-২৭৬)
.
পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাওফীক কামনা করছি যে, তিনি যেন আমাদিগকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন এবং কিয়ামতের কঠিন শাস্তি থেকে আমাকে, আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং সকল মুসলিম ভাই-বোনকে মুক্তি দান করেন। আমীন!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:)। শিক্ষক, চর বাগডাঙ্গা সেরাজুল হুদা লতিফিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ও হাফিজিয়া মাদরাসা‌ চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

Share: