সিয়াম পালনের ফজিলত সংক্রান্ত সমাজে প্রচলিত কিছু জাল-যঈফ হাদীসের বিবরণ

প্রশ্ন: জাল-যঈফ হাদীস কাকে বলে? সিয়াম পালনের ফজিলত সংক্রান্ত সমাজে প্রচলিত কিছু জাল-যঈফ হাদীসের বিবরণ।
▬▬▬▬▬▬▬▪️🌻▪️▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: ‘ضعيف’ এর আভিধানিক অর্থ দুর্বল। ইমাম নববী বলেন, যে হাদিসে সহীহ ও হাসান হাদীসের শর্তসমূহ পাওয়া যায় না,তাকেই যঈফ হাদিস বলে। (ইমাম নববী, মুক্বাদ্দামাহ মুসলিম পৃঃ ১৭)। মোটকথা যঈফ ওই সকল হাদীসকে বলা হয়, যার মধ্যে সহীহ এবং হাসানের শর্তগুলো পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকবে না। অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, বা তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি,বা সনদের মধ্যে কোন একজন রাবী তাঁর ঊর্ধ্বতন রাবী থেকে সরাসরি ও স্বকর্ণে শোনেননি বলে প্রমাণিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, বা অন্যান্য প্রমাণিত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া, অথবা সূক্ষ্ম কোন সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি থাকা ইত্যাদি যে কোন একটি বিষয় কোন হাদীসের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে ঐ হাদিসটি যঈফ বলে গণ্য।
.
অপরদিকে মাউজু’ (موضوع) শব্দটি আরবী। ‘ওয়ায’ শব্দ হতে গঠিত। ‘ওয়াযা’ শব্দটি অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়। موضوع কর্মবাচক বিশেষ্য وَضْع ক্রিয়া বিশেষ্য থেকে উত্থিত,অর্থ বানোয়াট, তৈরিকৃত ও নির্মিত। ‘মাওদু’র আরেক অর্থ الشيء المحطوط অর্থাৎ জমিনে পতিত বস্তু। যেমন: কোন বস্তুকে কোন স্থানে রাখা, স্থাপন করা, কারো মর্যাদাকে খাট করা, নির্ধারণ করা, নতুন করে কোন জিনিস বানানো, মিথ্যা উপাখ্যান করা ইত্যাদি। তবে হাদীস শাস্ত্রে ‘ওয়াযা’ বলা হয়, যা রাসূল (ﷺ)বলেননি, করেননি এবং সমর্থনও দেননি এমন কথা বা কাজকে রাসূল (ﷺ) এর দিকে মিথ্যা সম্বন্ধ করা। অতএব, যে হাদীসের রাবী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃত ভাবে রাসূল (ﷺ) -এর নামে বানোয়াট কথা সমাজে প্রচার করেছে অথবা, ইচ্ছাকৃত ভাবে হাদীসের সুত্র (সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কমবেশি করেছে বলে প্রমানিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদিসকে বানোয়াট বা মাউযু হাদীস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।নির্ভরযোগ্য সকল মুহাদ্দিসের মতে হাদিস রচনা করা হারাম।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:“যে আমার থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করল, অথচ দেখা যাচ্ছে তা মিথ্যা, তাহলে সেও মিথ্যাবাদীদের একজন” (সহীহ মুসলিম হা/৬২) অপর বর্ননায় রাসূল ﷺ আরো বলেছেন, আর আমার উপর যে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়” (সহীহ বুখারী হা/১০৮)
.
বর্তমান সমাজে রমাদানকে কেন্দ্র করে বহু যঈফ ও জাল হাদীস লোকমুখে তথা বহু বই-পুস্তকে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। এ স্থলে সেই শ্রেণীরই কিছু হাদীস সংক্ষেপে উল্লেখ করব। যাতে পাঠক তা পাঠ করে সতর্ক হতে পারেন। পাশাপাশি জেনে রাখা ভালো যে, আলেমদের বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা যাবে না, না ফাযায়েলে, না আহকামে, না অন্য কোন বিষয়ে। আমরা শুধু তারই অনুসরণ করব, যা নবী (ﷺ) থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। দুর্বল হাদিস রাসূল (ﷺ) এর সাথে সম্পৃক্ত করা বৈধ নয়, তবে মানুষদের জানানোর জন্য ও দুর্বলতা প্রকাশ করার উদ্দেশ্য হলে তা বর্ণনা করা যাবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমার উপর যে এমন কথা বলল, যা আমি বলেনি, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।” (সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ভূমিকা ৪৯-৫৬পৃঃ দ্রঃ)

▪️সিয়াম পালনের ফজিলত সংক্রান্ত সমাজে প্রচলিত কিছু জাল যঈফ হাদীসের বিবরণ।
_______________________________________

(১). যে ব্যক্তি রমাদ্বনন মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করল, সে ঐ ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে একটি ফরয আদায় করল। আর যে ব্যক্তি উক্ত মাসে একটি ফরয আদায় করল, সে ঐ ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করল।’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৬০৮; মিশকাত, হা/১৯৬৫)। তাহক্বীক: হাদীসটি মুনকার।কারণ, এর সানাদে আলী ইবনু যায়দ ইবনু জাদ আন একজন দুর্বল রাবী। (দেখুন, যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৫৮৯, বুগইয়াতুল বাহেছ ১/৪১২)।
.
(২). আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন; তাঁর উম্মাতকে রমাযান মাসের শেষ রাতে মাফ করে দেয়া হয়। নিবেদন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! সেটা কি লায়লাতুল কদরের রাত? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, না। বরং আমলকারী যখন নিজের আমল শেষ করে তখনই তার বিনিময় তাকে মিটিয়ে দেয়া হয়। (মুসনাদে আহমাদহা/ ৭৯১৭, মুসনাদ আল বায্যার ৮৫৭১, শু‘আবূল ঈমান ৩৩৩০)। তাহক্বীক: হাদীসটি যঈফ। কারণ, এর সনদে হিশাম নামে যঈফ রাবী আছে (মির‘আতুল মাফাতীহ, ৬/৪২৩ পৃ.; যঈফ আত-তারগীব হা/৫৮৬; তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/১৯৬৮)।
.
(৩). আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সাওম রাখে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নাম থেকে ওই উড়তে থাকা কাকের দূরত্বের পরিমাণ দূরে রাখবেন, যে কাক বাচ্চা অবস্থায় উড়তে শুরু করে বৃদ্ধ অবস্থায় মারা যায়। (মুসনাদে আহমাদ ১০৪২৭, মিশকাত হা/ ২০৭৪)। তাহক্বীক: হাদীসটি যঈফ। কারণ, এর সানাদে লাহই‘আহ-এর উস্তায একজন অপরিচিত রাবী। আর লাহ্ই‘আহ্-কে ইবনুল কত্ত্বান মাজহূলুল হাল বলেছেন।(সিলসিলাতুয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘য়া হা/১৩৩০)
.
(৪). আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা শুধু রামাযান বল না। কেননা রামাযান আল্লাহর নামসমূহের একটি। বরং বল রামাযান মাস।’ (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৮১৫৮)। তাহক্বীক: বর্ননাটি জাল। ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসটি জাল। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওযূ‘আত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৭)
.
(৫). রাসূল (ﷺ) বলেছেন, পাঁচটি রাতের দু‘আ ফেরত দেয়া হয় না। রজবের প্রথম রাত্রি, শাবানের মধ্য রাত্রি, জুমু‘আর রাত্রি, ঈদুল ফিতরের রাত্রি এবং ঈদুল আযহার রাত্রি। (ইবনু আসাকির, তারীখে দিমাষ্ক ১০/২৭৫ পৃঃ)। তাহক্কীক: বর্ণনাটি জাল। কারণ, এর সনদে আবু সাঈদ বান্দার ইবনু ওমর এবং ইব্রাহীম ইবনু আবু ইয়াহইয়া নামে দুইজন মিথ্যুক বর্ণনাকারী আছে। এছাড়া আবূ ক্বা‘নাব নামের রাবী অপরিচিত। (সিলসিলাহ যঈফাহ, হা/১৪৫২)।
.
(৬). ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমি কি তোমাদের সর্বোত্তম ফেরেশতা সম্পর্কে জানাব না? সে জিব্রীল। সর্বোত্তম নবী আদম (আলাইহিস সালাম)। সর্বোত্তম দিন জু‘আর দিন। মাসসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম মাস রামাযান মাস। রাতের মধ্যে সর্বোত্তম রাত লায়লাতুল ক্বদরের রাত। সর্বোত্তম নারী মারইয়াম বিনতে ইমরান। (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১১৩৬১)। তাহক্বীক: হাদীসটি জাল। আলবানী রহ. বলছেন, এটি বানোয়াট। নাফে আবু হুরমুযকে ইবনু মা’ঈন মিথ্যুক আখ্যা দিয়েছেন। নাসাঈ বলেছেন; তিনি নির্ভরযোগ্য নন। (সিলসিলাতুয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ, ১/৬৩৮, হা/৪৪৬)
.
(৭). ইবনু আব্বাস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রমাযান মাস শুরু হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক বন্দীকে মুক্তি দিতেন এবং প্রত্যেক সাহায্যপ্রার্থীকে দান করতেন। (শু‘আবূল ঈমান হা/ ৩৩৫৭ মিশকাত হা/১৯৬৬)। তাহক্বীক: খুবই দুর্বল। কারণ, এর সানাদে আবু বাকর আল হুযালী একজন মাতরূক রাবী এবং আল হিম্মানী একজন দুর্বল রাবী। সিলসিলাহ্ আয্ য‘ঈফাহ্ ৯/৩০১৫, য‘ঈফ আল জামি ৪৩৯৬)
.
(৮). আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন রামাযান মাসের প্রথম রাত আসে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টি জগতের প্রতি দৃষ্টি দেন তাকে কখনোই শাস্তি দেন না। আর আল্লাহ তা‘আলা রামাযানের রাতে হাযার হাযার লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৫)। তাহক্বীক: হাদীসটি জাল। কারণ, হাদীসটি বর্ণনা করার ক্ষেত্রে উসমান ইবনু আবদিল্লাহ শামী মিথ্যার দোষে দোষী। ইবনুল জাওযীও তার “আল-মাওযূ’আত” গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করে বলেছেন; এটি জাল। এটির সনদে একাধিক মাজহুল ব্যক্তি রয়েছেন। উসমান মিথ্যার দোষে দোষী, জলকারী। (সিলসিলাতুয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ ১/৪৭০, হা/২৯৯)
.
(৯). আবু সাঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন; রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিনটি জিনিস সায়িমের সওম ভঙ্গ করে না। শিঙ্গা, বমি ও স্বপ্নদোষ। (তিরমিযী ৭১৯, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৯৩১৬)। তাহক্বীক: য‘ঈফ। কারণ, এর সানাদে আবদুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনু আসলাম একজন দুর্বল রাবী যেমনটি ইমাম বুখারী (রহঃ) তার উস্তায আলী ইবনু মাদীনী হতে উল্লেখ করেছেন। (আল জামি ২৫৬৭, মিশকাত হা/২০১৫)

(১০). আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সায়িম অবস্থায় চুমু খেতেন এবং তিনি তাঁর জিহবা লেহন করতেন। (আবু দাঊদ ২৩৮৬, আহমাদ ২৪৯১৬, ইবনু খুযায়মাহ্ ২০০৩, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮১০২)। তাহক্বীক: সনদ জয়ীফ। কারণ, এর সানাদে মুহাম্মাদ ইবনু দীনার এবং সা‘ঈদ ইবনু আওস দু’জনই দুর্বল রাবী। আর মিসদা মাজহূলুল হাল। (মিশকাত হা/২০০৫)
.
(১১). আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, যখন রামাযান মাস আসত- রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাপড়কে কোমরে শক্ত করে বেঁধে নিতেন। এভাবে রামাযান মাস কেটে যেত তিনি বিছানায় যেতেন না।’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৩/৩১০, হা/৩৬২৪)। তাহক্বীক: হাদীসটি দুর্বল। (ইবনু হিব্বান, আছ-ছিক্বাত, ৫/১৮৫; আল-কাশিফ, ২/২৭০)

(১২). ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; রমাযানকে স্বাগত জানাবার জন্য বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জান্নাতকে সাজানো হতে থাকে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, বস্তুত যখন রমাযানের প্রথম দিন শুরু হয়, আরশের নীচে জান্নাতের গাছপালার পাতাগুলো হতে ‘‘হূরিল ঈন’’-এর মাথার উপর বাতাস বইতে শুরু করে। তারপর হূরিল ঈন বলতে থাকে, হে আমাদের রব! তোমার বান্দাদেরকে আমাদের স্বামী বানিয়ে দাও। তাদের সাহচর্যে আমাদের আঁখি যুগল ঠাণ্ডা হোক আর তাদের চোখ আমাদের সাহচর্যে শীতল হোক। (মুসনাদে আহমেদ হা/৭৮৫৭, মিশকাত হা/১৯৬৭)। তাহক্বীক: খুবই দুর্বল। কারণ, এর সানাদে আল ওয়ালীদ ইবনু আল ওয়ালীদ একজন খুবই দুর্বল রাবী। যেমনটি ইমাম যাহাবী তার মীযান-এ উল্লেখ করেছেন। আবার কেউ কেউ তাকে মাতরূক বলেছেন। (য‘ঈফ আত্ তারগীব ৫৮৬, মু‘জামুল আওসাত ৬৮০০, শু‘আবূল ঈমান ৩৩৬০, সিলসিলাহ আয্ য‘ঈফাহ ১৩২৫)
.
(১৩). আবদুর রহমন ইবনু আওফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; রমাযান (রমজান) মাসে সফরের সায়িম, নিজের বাসস্থানে সায়িম না থাকার মতো। (ইবনু মাজাহ ১৬৬৬)। তাহক্বীক: হাদীসটি যঈফ। কারণ, প্রথমত এর সানাদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে যেহেতু আবু সালামাহ্ তার পিতা আবদুর রহমান হতে শ্রবণ করেনি। আর দ্বিতীয়ত উসামাহ্ ইবনু যায়দ এর স্মরণশক্তিতে দুর্বলতা রয়েছে।(সিলসিলাতুয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ হা/২৯৬)
.
(১৪). বিলাল ইবনু হারিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মদীনার একদিনের রামাযান অন্য শহরের হাযার রামাযানের চেয়ে উত্তম। মদীনার একদিনের জুমু‘আহ অন্য শহরের হাযার জুমু‘আহর চেয়ে উত্তম।’ (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ১/৪৯৩, হা/১১৪৪)। তাহক্বীক: হাদীসটি বাতিল। মানবী বলেন; বাযযার বলেছেন- হাদীসটি একমাত্র এ সূত্রেই আমরা অবহিত হয়েছি। ওবায়েদের মধ্যে সমস্যা নেই …। হায়ছামী (৪/৩২০) বলেন; হাদীসটির সনদে ওবায়েদ রয়েছেন, আবু হাতিম তাকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। বাযযার তাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। শাইখ (আলবানী) বলেন ইবনু আবী হাতিম তার এ হাদীসটি “আল-ইলাল” (১/৩১৩) গ্রন্থে উল্লেখ করে বলেছেন; আমি আমার পিতাকে হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেন, এ হাদীসটি মুনকার। আরেকবার বলেন, এ সনদে হাদীসটি বানোয়াট। (সিলসিলাতুয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ, ২/২৩০, হা/৮১৩)
.
(১৫). আমির ইবনু রবীআহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সওম অবস্থায় এতবার মিসওয়াক করতে দেখেছি যে, তা আমি হিসাব করতে পারি না। (আবু দাঊদ ২৩৬২, তিরমিযী ৭২৫, আহমাদ ১৫৬৭৪, দারাকুত্বনী ২৩৬৮)। তাহক্বীক: দুর্বল হাদীস। কারণ এর সানাদে আসিম ইবনু উবায়দুল্লাহ্ একজন দুর্বল রাবী। (ইরওয়া ৬৮, মিশকাত হা/২০০৯)
.
(১৫). আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনটি খেজুর দ্বারা ইফতার করাকে ভালোবাসতেন কিংবা এমন কিছু দ্বারা যাকে আগুন স্পর্শ করেনি। (হায়ছামী, আল-মাজমাঊয যাওয়াইদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৫৫)। তাহক্বীক: এ সনদটি খুবই দুর্বল। কারণ, বর্ণনাকারী আব্দুল ওয়াহেদ সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেন: তিনি মুনকারুল হাদীস। উকায়লী বলেন; এ হাদীসটিতে তার অনুসরণ করা যায় না। হায়ছামী হাদীসটি “আল-মাজমা” (৩/১৫৫) গ্রন্থে উল্লেখ করে বলেন; তাতে আব্দুল ওয়াহেদ রয়েছেন, তিনি দুর্বল। (সিলসিলাতুয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ ২/২২৪, হা/৯৯৬)
.
(১৬). আল্লাহ নিজের জন্য এই ফায়সালা ও স্থির করে রেখেছেন যে, “যে ব্যক্তি কোন গরমের দিনে আল্লাহর ওয়াস্তে নিজেকে (রোযা রেখে) পিপাসিত করবে, আল্লাহ তাকে এই অধিকার দেবেন যে, তিনি কিয়ামতের দিন তার পিপাসা দূর করে দেবেন।’ (বর্ননাটি জয়ীফ তারগীব হা/৫৭৮)
.
(১৭). মালিক (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তাঁর পর্যন্ত এ বর্ণনাটি পৌঁছেছে যে, ইবনু উমার (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হতো, কোন ব্যক্তি কি অন্য কোন ব্যক্তির পক্ষ থেকে সাওম আদায় করে দিতে পারে, কিংবা সলাত আদায় করে দিতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে ইবনু উমার বলতেন, কোন লোকের পক্ষ থেকে কেউ না সালাত আদায় করতে পারে আর না কেউ সাওম রাখতে পারে। (মুয়াত্ত্বা মালিক ১০৬৯)। তাহক্বীক: এর সানাদটি মুনক্বতি। অর্থাৎ হাদিসের সনদ মুত্তাসিল নয়। (মিশকাত হা/২০৩৫)
.
(১৮). নিশ্চয় আল্লাহ কোন মুসলিমকে রমাযান মাসের প্রথম দিবসের প্রত্যূষে ক্ষমা না করে ছাড়েন না। (খাতীব বাগদাদী ৫/৯১ আলমাওযু’আত” গ্রন্থ, ২/১৯০) তাহক্বীক: সনদটি মাওযু (বানোয়াট)। সালাম আত-তাবীলকে একাধিক ব্যক্তি মিথ্যুক এবং জাল করার দোষে দোষী করেছেন। তার শাইখ যিয়াদ ইবনু মায়মুন স্বস্বীকৃত হাদীস জালকারী। ইবনুল জাওযী বলেন; হাদীসটি সহীহ্ নয়। সালাম মাতরূক এবং যিয়াদ মিথ্যুক। (সিলসিলাতুয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ হা/২৯৬)
.
(১৯). মুআয ইবনু যুহরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেক ইফতারের সময় বলতেন, اَللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ ‘হে আল্লাহ! আপনার জন্য সিয়াম পালন করেছি এবং আপনার দেয়া রিযক থেকেই ইফতার করছি।’ (আবু দাঊদ, হা/২৩৫৮; মিশকাত, হা/১৯৯৪)। তাহক্বীক: হাদীসটির সনদ দুর্বল। কারণ, বর্ননাকরী মু‘আয ইবনুয যুহরা একজন মাজহূল রাবী।(ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৮, হা/৯১৯; যঈফুল জামে হা/৪৩৪৯)
.
(২০). আবু হুরায়রাহ্ (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তি কোন শারঈ কারণ কিংবা কোন রোগ ছাড়া রমাযানের কোনদিন ইচ্ছা করে সওম পালন না করে, তাহলে সারা জীবন সাওম রেখেও তার কাযা আদায় হবে না। (আবু দাঊদ ২৩৯৬, তিরমিযী ৭২৩, ইবনু মাজাহ ১৬৭২, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক্ব ৭৪৭৫, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৯৭৮৪, আহমাদ ১০০৮০, দারিমী ১৭৫৬)। তাহক্বীক: যঈফ। কারণ, এর সানাদে ইবনুল মুত্বওয়িস একজন মাজহূল রাবী। (আল জামি ৫৪৬২, মিশকাতুল মাসাবিহ হা/২০১৩)
.
(২১). আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; … বান্দারা ঈদের দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যখন বের হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের লক্ষ্য করে বলেন, আমার ইযযতের কসম! জেনে রাখ, আমি তাদের দু‘আ নিশ্চয় কবুল করব। অতঃপর তিনি বলেন, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের গুনাহসমূহকে নেকীতে পরিণত করলাম। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, অতঃপর তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ী ফিরে। (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৭১৭; মিশকাত, হা/২০৯৬) তাহক্বীক: হাদীছটি জাল। কারণ, এর সানাদে আসরম ইবনু হাওশাব আল হামাদানী রয়েছেন, ইয়াহ্ইয়া (রহঃ) তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। বুখারী, মুসলিম ও নাসায়ী (রহঃ) মাতরূক বলেছেন। দারাকুত্বনী (রহঃ) তাকে মুনকার বলেছেন। ইবনু হিব্বান (রহঃ) বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য রাবীর বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে হাদীস জাল করতেন। (যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৯৪)
.
(২২). রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আমার উম্মতকে রমাযানে পাঁচটি জিনিস দান করা হয়েছে; যা ইতিপূর্বে কোন উম্মতকে দান করা হয় নি। ইফতার করা পর্যন্ত পানির মাছ অথবা ফিরিশ্তারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ প্রত্যেক দিন বেহেশ্তকে সুসজ্জিত করে থাকেন।(মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/১৪০, মুসনাদে আহমেদ হা/ ৭৯০৪ টীকা, তাহক্বীক: হাদীসটি যঈফ, যঈফ আত তারগীব হা/৫৮৬)
.
(২৩). আলী ইবনু হুসাইন তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে- তিনি বলেছেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; যে ব্যক্তি রামাযান মাসে দশদিন ই‘তিকাফ করবে, সেটা তার জন্য দু’টি হজ্জ ও দু’টি ওমরার মত হবে। (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৬৮০-৩৬৮১)। তাহক্বীক: বর্ণনাটি জাল। কারণ, বর্ননাকারী মুহাম্মাদ ইবনু যাযান মাতরুক। ভার সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেন; তার হাদীস লিখা যাবে না। তাতে আম্বাসা ইবনু আবদির রহমানও রয়েছেন। তার সম্পর্কেও ইমাম বুখারী বলেন, মুহাদ্দিসগণ তাকে পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম যাহাবী “আয-যোয়াফা” গ্রন্থে বলেছেন; তিনি মাতরুক, তাকে জাল করার দোষে দোষী করা হয়েছে। “ফায়যুল কাদীর” গ্রন্থে এরূপই এসেছে। (সিলসিলা যঈফাহ, হা/৫১৮)
.
(২৪). যে ব্যক্তি রামাযান মাসের শেষ জুমুআয় দিনে- রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায় করবে, তার ঐ বছরের ছুটে যাওয়া সালাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। তাহক্বীক: বর্ণনাটি জাল (আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ হা/১১৫-এর আলোচনা দ্রঃ, পৃঃ ৫৪)। উল্লেখ্য যে, সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্ভট বর্ণনার আলোকে রামাযানের শেষ জুমু‘আকে ‘জুম‘আতুল বিদা’ নাম দিয়ে পালন করা হয়। মসজিদের ইমাম ও বিদ‘আতী আলেমরা শরী‘আতের দোহায় দিয়ে এই বিদ‘আতী প্রথা চালু রেখেছে। সাধারণ শিক্ষিত মানুষগুলোও এই মিথ্যা স্রোতে ভেসে যান। যাচাইয়ের কোন প্রয়োজন মনে করেন না।
.
(২৫). যে ব্যক্তি রামাযান মাসের শেষ জুম‘আয় ক্বাযা সালাতগুলো আদায় করবে, তার জীবনের ৭০ বছরের ছুটে যাওয়া প্রত্যেক সালাতের ক্ষতি পূরণের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। তাহক্বীক: বর্ণনাটি বাতিল। মোল্লা আলী ক্বারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এটি চূড়ান্ত মিথ্যা কথা।’ (আল-মাছনূ ফী মা‘রেফাতুল হাদীছিল মাওযূ‘, পৃ. ১৯১, হা/৩৫৮)।
.
(২৬). রাসূল (ﷺ) বলেন, “সাওম পালনকারীর ইফতারের সময় দোয়া প্রত্যাখ্যান করা হয় না।” (মুসনাদে আহমদ: ২/৩০৫, তিরমিযি: ৩৬৬৮, ইবনু খুযাইমাহ: ১৯০১, ইবনু মাজাহ: ১৭৫২)। এ হাদিসের সনদে বিদ্যমান ইসহাক ইবনু উবাইদুল্লাহ মাদানি অপরিচিত। ইবনুল কাইয়্যেম হাদিসটি “যাদুল মায়াদ” গ্রন্থে দুর্বল বলেছেন। ইমাম তিরমিযিও হাদিসটি দুর্বল বলেছেন। (হাদিসটি দুর্বল)
.
(২৭).মু‘আয ইবনু যুহরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করার সময় (এ দু‘আ) বলতেন; ‘আল্লা-হুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা আফতারতু।’(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তোমার জন্য সওম রেখে, তোমার [দান] রিযক দিয়ে ইফতবার করছি)। (আবু দাঊদ ২৩৫৮, আদ্ দা‘ওয়াতুল কাবীর ৫০০, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮১৩৪)। তাহক্বীক: বর্ননাটি যঈফ। কারণ, মু‘আয ইবনুয্ যুহরা একজন মাজহূল রাবী। (য‘ঈফ আল জামি‘ ৪৩৪৯, ইরওয়া ৯১৯)। অনুরূপ ‘আল্লা-হুম্মা সুমতু লাকা ওয়া তাওয়াক্কালতু ‘আলা রিযক্বিকা… নামে প্রচলিত দু‘আটি ভিত্তিহীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।