সালাতে দাঁড়ানোর সময় মুছল্লীর দুই পায়ের মাঝে কতটুকু ফাঁকা থাকবে

প্রশ্ন: সালাতে দাঁড়ানোর সময় মুছল্লীর দুই পায়ের মাঝে কতটুকু ফাঁকা থাকবে? দু’জনের মাঝে ফাঁকা রেখে দাঁড়ালে সালাতের কোন ক্ষতি হবে কি?
▬▬▬▬▬▬▬◖🌻◗▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সালাতে দাঁড়ানোর সময় একজন মুছল্লীর দুই পায়ের মাঝে কতটুকু ফাঁকা থাকবে এ বিষয়ে কুরআন সুন্নায় স্পষ্ট কোন বর্ণনা নেই।তবে হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কাতারে দাঁড়িয়ে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য অনুযায়ী পায়ে পা ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে যতটুকু ফাঁকা রাখার প্রয়োজন হয়, একজন মুসুল্লি ঠিক ততটুকু ফাঁকা রাখবে (সহীহ বুখারী হা/৭২৫; আবুদাঊদ হা/৬৬২; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৫/৩৫৭)। জামাআতে সালাত আদায়ের সময় কাতার সোজা করা ওয়াজিব (ইবনে উসাইমীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৬/৩, ৭/৩-১৩)। রাসূল (ﷺ) একাধিক হাদীসে কাতার সোজা করার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারী হা/৭২৩; মুসলিম হা/৪৩৩; মিশকাত হা/১০৮৭)।
.
কাতার সোজা হবে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এক অপরের কাঁধ ও পায়ের গাঁট বরাবর সোজা রেখে সীসাঢালা প্রাচীরের মত একে অপরের সাথে মিলে দাঁড়াতে হবে যাতে একজনের কাঁধ আগে এবং অপর জনের পিছে না হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পায়ের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আঙ্গুল মিলিয়ে কাতার সোজা হবে না। কারণ, পা ছোট-বড় থাকার ফলে কাতার বাঁকা থেকে যাবে। আর বসা অবস্থায় বাহুমূল বা কাঁধের সাথে বাহুমূল বা কাঁধ বরাবর থাকলে কাতার সোজা বলে ধরা যাবে।যেমন মসজিদে কাতারের দাগ থাকলে দাগের মাথায় বুড়ো আঙ্গুল রেখে কাতার সোজা হয় না। কারণ, এতে যার পা লম্বা সে কাতার থেকে পিছনের দিকে এবং যার পা ছোট সে কাতারের সামনের দিকে বের হয়ে থাকবে। সুতরাং পায়ের গোড়ালিকে দাগের মাথায় রাখলে তবেই কাতার বাঞ্ছনীয় সোজা হবে।
সুতরাং জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করার সময় কাতারের মাঝে পরস্পরের মধ্যে ফাঁক রাখা সুন্নাতের বরখেলাফ। উক্ত মর্মে কোন হাদীস বর্ণিত হয়নি। পরস্পরের পায়ের মাঝে ‘চার আঙ্গুল’ পরিমাণ ফাঁক রাখতে হবে এবং পায়ে পা মিলালে অন্যকে অপমান করা হয় মর্মে সমাজে যে কথা প্রচলিত আছে, তা এক প্রকার জাহেলিয়াত। এটি সুন্নাতকে অবজ্ঞা করার অপকৌশল এবং চূড়ান্ত মিথ্যাচার। কারণ যারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, তারা যদি পরস্পরে দাঁড়িয়ে পায়ে পা মিলিয়ে সালাত পড়তে পারেন, তাহলে আমাদের সম্মানের হানি হবে কেন? আমাদেরকেও তাঁদের পদাংক অনুসরণ করতে হবে। কারণ পায়ে পা, টাখনুর সাথে টাখনু ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছালাতে দাঁড়াতে হবে মর্মে একাধিক হাদীস বর্নিত হয়েছে। তাই কোন ভাবেই কাতারে পাক রাখা উচিত নয় কেননা কাতারের মধ্যে ফাঁকা রাখলে শয়তান প্রবেশ করে এবং মুছল্লী রহমত হ’তে বঞ্চিত হয়। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমরা কাতার সোজা করবে, বাহু সমূহ সমপর্যায়ে রাখবে, ফাঁকা সমূহ বন্ধ করবে এবং তোমাদের ভাইদের সাথে নরম হয়ে থাকবে। মধ্যখানে শয়তানের জন্য ফাঁক রাখবে না। যে ব্যক্তি কাতারকে মিলিয়ে দাঁড়ায়, আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমতের সাথে মিলান। আর যে ব্যক্তি কাতারে ফাঁকা রাখে আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত হ’তে পৃথক রাখেন। (আবূদাঊদ, মিশকাত হা/১১০২)।
.
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর। নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে আমার পিছন থেকে দেখতে পাই। আনাস (রাঃ) বলেন, আমাদের একজন অপরজনের কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পায়ে মিলিয়ে দাঁড়াতেন।(সহীহ বুখারী হা/৭২৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০০, (ইফাবা হা/৬৮৯, ২/৯৫ পৃঃ) ইমাম বুখারী (রহঃ) উক্ত হাদীস বর্ণনা করার পূর্বে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন,بَابُ إِلْزَاقِ الْمَنْكِبِ بِالْمَنْكِبِ وَالْقَدَمِ بِالْقَدَمِ فِي الصَّفِّ وَقَالَ النُّعْمَانُ بْنُ بَشِيْرٍ رَأَيْتُ الرَّجُلَ مِنَّا يُلْزِقُ كَعْبَهُ بِكَعْبِ صَاحِبِهِ.‘সালাতে কাতারের মধ্যে কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলানো অনুচ্ছেদ’। নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) বলেন, আমি মুছল্লীকে দেখতাম, সে তার টাখনুকে তার পার্শ্বের ভাইয়ের টাখনুর সাথে মিলিয়ে দিত। (সহীহ বুখারী ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৭, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০০, (ইফাবা অনুচ্ছেদ-৪৬৮, ২/৯৫ পৃঃ)।
.
অন্য বর্ণনায় রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি শয়তানকে কাতার সমূহের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করতে দেখছি, যেন সে কালো ছাগলের বাচ্চা। কাজেই তোমরা প্রাচীরের মত কাতার মিলিয়ে দাড়াও। (নাসাঈ হা/৮১৫; আবূদাঊদ হা/৬৭৩)। অন্য বর্ণনায় রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি কাতারের ফাঁকা বন্ধ করবে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। (ইবনু মাজাহ হা/৯৯৫, সিলসিলা সহীহাহ হা/১৮৯২, ২৫৩২)। রাসূল (ﷺ)বলেন, যে ব্যক্তি কাতারের ফাঁকা বন্ধ করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মাণ করবেন এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। (সিলসিলা সহীহাহ হা/১৮৯২)। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘যখন বান্দা কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায় আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন আর ফেরেশতা তার উপর নেকী ছিটিয়ে দেন (সিলসিলা সহীহাহ হা/৪৫১৬ পৃঃ ১৮৯২ নং হাদীছের অধীনে)।
.
শায়খ আলবানী (রহঃ) দুঃখ প্রকাশ করে বলেন,দুঃখজনক বিষয় হল, কাতার সোজা করার সুন্নাতকে মুসলিমরা অবজ্ঞা করে চলেছে; বরং কিছু সংখ্যক মানুষ ব্যতীত অন্যরা সবাই এই সুন্নাতকে নষ্ট করেছে। নিশ্চয় আমি সেই দলগুলোর মধ্যে ‘আহলেহাদীস’ ব্যতীত অন্য কারো মধ্যে উক্ত সুন্নাত দেখিনি। আমি মক্কায় (১৩৬৮ হিঃ) তাদেরকে দেখেছি, তারা রাসূল (ﷺ) এর অন্যান্য সুন্নাতকে যেমন আকঁড়ে ধরে আছে, তেমনি এই সুন্নাতকেও আকঁড়ে ধরার প্রতি অতীব অনুরাগী। চার মাযহাবের অনুসারীদের বিপরীতে তারাই একে আঁকড়ে ধরে আছে। হাম্বলীদেরকেও আমি এদের মধ্য থেকে পৃথক করি না। কারণ তাদের মধ্য হতে এটা সম্পূর্ণই উঠে গেছে। বরং তারা এই সুন্নাতকে পরিত্যাগ করা এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পথ অবলম্বন করছে। অধিকাংশ মাযহাব এই সুন্নাহর বিরুদ্ধে দলীল পেশ করছে যে, কাতারে দাঁড়ানোর সময় উভয় মুছল্লীর পায়ের মাঝে ‘চার আঙ্গুল’ ফাঁক রাখতে হবে। যদি এর অতিরিক্ত ফাঁক হয় তবে অপছন্দনীয়। যেমন ‘আল-ফিক্বহু আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আহ’ (১/২০৭ পৃঃ) গ্রন্থের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা এসেছে। অথচ সুন্নাহর মধ্যে উক্ত পরিমাণের কোন ভিত্তি নেই; স্রেফ কল্পনা মাত্র’। (সিলসিলা সহীহাহ হা/৩২-এর আলোচনা দ্রঃ)।

শায়খ মুহসিন আল-আব্বাদ বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাতে পায়ে পা মিলাবে আল্লাহ তার সাথে সাওয়াবের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখবেন। আর যে ব্যক্তি সালাতে পায়ে পা মিলায় না আল্লাহ তাকে সাওয়াব থেকে বঞ্ছিত করেন (শারহে আবূ দাঊদ, পৃ. ১৪)।

পরিশেষে সুধী পাঠক! কাতারে দাঁড়ানোর সময় পায়ের সাথে পা, টাখনুর সাথে টাখনু এবং কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। উপরোক্ত হাদীস সমূহ জানার পরও কেউ যদি এই সুন্নাতকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে সে সরাসরি রাসূল (ﷺ) এর আদেশ লংঘন করবে।এমন ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) ১৫ শত বছর আগে বলে গেছেন যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিল, সে আমার দলভুক্ত নয়’(বুখারী হা/৫০৬৩; মুসলিম হা/১৪০১; মিশকাত হা/১৪৫) হাদীসে সীসা ঢালা প্রাচীরের মত দাঁড়াতে বলা হয়েছে, যেমন একটি ইট আরেকটি ইটের উপর রেখে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। সুতরাং পরস্পরের পায়ের মাঝে কোন ফাঁক থাকবে না। উল্লেখ্য, অনেক মসজিদে শুধু কনিষ্ঠা আঙ্গুলের সাথে মিলানো হয়। উক্ত মর্মেও কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।