সফর সম্পর্কে বিস্তারিত

সফর অর্থ কি? সফরের নির্দিষ্ট দূরত্ব আছে কি? কতটুকু দূরত্বে গেলে সালাত কসর করা যায় এবং কোন কোন সালাত কসর করা যায়? সফরে সুন্নাত সালাত ছেড়ে দেওয়া যাবে কি? পোস্টটি একটু বড় মনোযোগ দিয়ে পড়ুন অনেক কিছু জানতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
সফর শব্দটি আরবী, শব্দটির অনেক অর্থ আছে। যেমন: স্পষ্ট হওয়া, প্রকাশ পাওয়া, অতিক্রম করা ভ্রমণ করা ইত্যাদি। ভ্রমণে যেহেতু দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয় আর এই ভ্রমণের দ্বারা ভ্রমণ সঙ্গীর আখলাক-চরিত্র, ‍দুুনিয়ার হালত ও আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন সফরকারীর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তাই সফরকে সফর বলে নামকরণ করা হয়েছে।সহজে বলতে গেলে বাসস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও ভ্রমণে বের হওয়াকে বলা হয় সফর। আর যে ব্যক্তি ভ্রমণ বা সফর করে তাকে সফররত অবস্থায় মুসাফির বলে। মুসাফির আরবি শব্দ। এর অর্থ সফরকারী বা ভ্রমণকারী।

◾সফরের নির্দিষ্ট দূরত্ব আছে কি এবং এক সফরে কত দিন পর্যন্ত কসর করা চলবে?
_______________________________________
সফরের নিদিষ্ট দূরত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মাজীদে অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন হাদীসে নির্দিষ্ট কোন দূরত্ব উল্লেখ করা হয়নি। ফলে এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের অনেক মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেছেন ৪৮, কেউ ৭২, কেউ ৮০ কিঃমিঃ বলেছেন। তবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল নেই, যা আছে সবই ওলামাদের মত। অনেক আলেম সফরের দূরত্ব ৮০ কিঃ মিঃ এই মত পোষণ করেছেন। এই জন্য সফরের দূরত্ব সম্পর্কে সঠিক বক্তব্য এই যে, পরিভাষায় বা প্রচলিত অর্থে যাকে সফর বলা হয়,সেই সফরে সালাত কসর করা চলবে। [আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪৯৭-৪৯৮]। ইবনুল মুনযির বলেন যে, সফরের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদ্বীনা শহর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার পূর্বে ‘ক্বসর’ করেছেন বলে আমি জানতে পারিনি। তিনি বলেন, বিদ্বানগণ একমত হয়েছেন যে, সফরের নিয়তে বের হয়ে নিজ গ্রাম (বা মহল্লার) বাড়ীসমূহ অতিক্রম করলেই তিনি ক্বসর করতে পারেন। (নায়লুল আওত্বার ৪/১২৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৩)
.
এক হাদীসে এসেছে, রাসূল (ﷺ) তিন মাইল কিংবা তিন ফারসাখ বা ৯ মাইল যাওয়ার পর দুই রাক‘আত পড়তেন। [সহীহ মুসলিম হা/১৬১৫, ১/২৪২ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৪৫৩)]। শুরাহবীল ইবনু সামত ১৭ বা ১৮ মাইল পর কসর করে পড়তেন। [ মুসলিম হা/১৬১৬, ১/২৪২ পৃঃ]। ইবনু ওমর ও ইবনু আব্বাস (রাঃ) চার বুরদ বা ১৬ ফারসাখ অর্থাৎ ৪৮ মাইল অতিক্রম করলে ক্বসর করতেন। [বুখারী ‘ক্বসর সালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪, ১/১৪৭ পৃঃ।]। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ১৯ দিন (মক্কা বিজয় অথবা তাবূক অভিযানে) অবস্থানকালে ‘ক্বসর’ করেছেন। আমরাও তাই করি। তার বেশী হলে পুরা করি। (বুখারী ১/১৪৭, হা/৪২৯৮; ঐ, মিশকাত হা/১৩৩৭)। যদি কারো সফরের মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকে, তথাপি তিনি ‘ক্বসর’ করবেন, যতক্ষণ না তিনি সেখানে স্থায়ী বসবাসের সংকল্প করেন। (সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৩)

যেনে রাখা ভাল যে,বিশুদ্ধ মতে কোথাও ৪ দিনের বেশি অবস্থানের নিয়তে গেলে তখন সালাত কসর করা যাবেনা বরং পরিপূর্ণ সালাত আদায় করতে হবে কিন্তু কেউ সফরে কতদিন থাকতে হবে তা যদি অনিশ্চিত থাকে তাহলে সফর যত দীর্ঘদিনেরই হোক কসর করবে এমনকি ১৯ দিনের বেশী হলেও ‘ক্বসর’ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাবুক অভিযানের সময় সেখানে ২০ দিন যাবৎ ‘ক্বসর’ করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) আযারবাইজান সফরে গেলে পুরা বরফের মৌসুমে সেখানে আটকে যান ও ছ’মাস যাবৎ ক্বসরের সাথে সালাত আদায় করেন। অনুরূপভাবে আনাস (রাঃ) শাম বা সিরিয়া সফরে এসে দু’বছর সেখানে থাকেন ও ক্বসর করেন। (মিরক্বাত ৩/২২১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৩-১৪)

◾মুসাফিরের ইমাম ও মুক্তাদী হয়ে নামায আদায়ের নিয়ম
_______________________________________
মুসাফির ইমামতি করতে পারে এবং এ অবস্থাতেও সে কসর করে নামায পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে গৃহ্‌বাসী অমুসাফির মুক্তাদীরা মুসাফির ইমামের সালাম ফিরার পর সালাম না ফিরে উঠে বাকী নামায পূরণ করতে বাধ্য হবে। [লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ৭/১৮] অনুরুপ মুসাফির অমুসাফির ইমামের পিছনে নামায পড়তে পারে। আর এ ক্ষেত্রে সে ঐ ইমামের মতই পূর্ণ নামায পড়তে বাধ্য হবে। এমন কি ইমামের শেষের ২ রাকআতে জামাআতে শামিল হলেও মুসাফির বাকী ২ রাকআত একাকী আদায় করতে বাধ্য। এখানে ঐ ২ রাকআতকে কসর ধরে নিলে হবে না।আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, মুসাফির একাকী নামায পড়লে ২ রাকআত, আর অমুসাফির ইমামের পশ্চাতে পড়লে ৪ রাকআত নামায পড়ে, তার কারণ কি? উত্তরে তিনি বললেন, ‘এটাই হল আবুল কাসেম (ﷺ)-এর সুন্নত।’ [আহমাদ, মুসনাদ ১৮৬২, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম ১২৮৯৫] তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘মক্কায় থেকে ইমামের সাথে জামাআতে নামায না পেলে কিভাবে নামায পড়ব?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘দুই রাকআত আবুল কাসেম (ﷺ)-এর সুন্নত।’ [মুসলিম, সহীহ ৬৮৮ ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ] যদি কোন মুসাফির পথের কোন মসজিদে জামাআত চলতে দেখে এবং সে বুঝতে না পারে যে, ইমাম স্থানীয় বসবাসকারী, বিধায় পূর্ণ নামায পড়ার নিয়ত করে জামাআতে শামিল হবে, নাকি মুসাফির, বিধায় কসর করার নিয়তে শামিল হবে? উত্তর হল এমত অবস্থায় মুসাফির ইমামের আকার-আকৃতি ও সফরের চিহ্ন দেখে মোটামুটি আন্দাজ লাগাবে, ইমাম কি? এরপর যদি প্রবল ধারণা হয় যে, সে স্থায়ী বসবাসকারী, তাহলে পূর্ণ নামায পড়ার নিয়তে জামাআতে শামিল হবে। পক্ষান্তরে যদি তার প্রবল ধারণা এই হয় যে, সে মুসাফির, তাহলে কসরের নিয়তে জামাআতে শামিল হবে।

◾ক্বসর সালাতের নিয়মটা কি? কোন ওয়াক্তে কত রাকাত পড়ব?
_______________________________________
‘ক্বসর’ আরবী শব্দ। এর অর্থ-সংক্ষিপ্ত করা, কমানো ইতাদি। পারিভাষিক অর্থে চার রাক‘আত বিশিষ্ট সালাত দু’রাক‘আত করে পড়াকে ক্বসর বলে। অর্থাৎ যোহর, আসর ও এশার সালাত ৪ রাক‘আতের পরিবর্তে ২ রাক‘আত আদায় করা। ফজর ও মাগরিবের সালাতে ক্বসর নেই। সফর অবস্থায় সালাতে ‘ক্বসর’ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের প্রতি একটি উপহার স্বরূপ। আর উপহার যে গ্রহণ করাই উত্তম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যখন তোমরা সফর কর, তখন তোমাদের সালাতে ক্বসর করায় কোন দোষ নেই। যদি তোমরা আশংকা কর যে, কাফেররা তোমাদেরকে উত্যক্ত করবে। নিশ্চয়ই কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (নিসা/১০১)।

শান্তিপূর্ণ সফরে ক্বসর করতে হবে কি-না এ সম্পর্কে ওমর ফারূক (রাঃ)-এর এক প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, এটি সাদাক্বা। আল্লাহ তা‘আলা (সালাত ‘ক্বসর’ করার অনুমতি দানের মাধ্যমে) তোমাদের প্রতি এটি সাদাক্বা হিসাবে দিয়েছেন। অতএব তোমরা তাঁর সাদাক্বা গ্রহণ কর।’ (মুসলিম/৬৮৬,মিশকাত/১৩৩৫)। সফর অবশ্যই আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের সফর হতে হবে, গোনাহের সফর নয়।’ (মির‘আত ৪/৩৮১)

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলাম, তিনি সফরে দু’রাক‘আতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। আবু বকর, ওমর ও ওসমান (রাঃ)-এরও এই রীতি ছিল। (সহীহ বুখারী হা/১১০২)

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নবী করীম (ﷺ)-এর যবানীতে মুক্বীম অবস্থায় চার রাক‘আত, সফরকালে দু’রাক‘আত এবং ভয়ের সময় এক রাক‘আত সালাত ফরয করেছেন। (মুসলিম হা/৬৮৭; নাসাঈ হা/১৫৩২; আহমাদ হা/২২৯৩; মিশকাত হা/১৩৪৯)
.
প্রকাশ থাকে যে, এই সফর পায়ে হেঁটে হোক অথবা উটের পিঠে, সাইকেলে হোক বা বাসে-ট্রেনে, পানি-জাহাজে হোক অথবা এরোপ্লেনে, কষ্টের হোক অথবা আরামের, বৈধ কোন কাজের জন্য হলে তাতে ক্বসর বিধেয়। [মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২০/১৫৭]
.
উল্লেখ্য যে, সফরে ক্বসর কেবল মাত্র চার রাক‘আত বিশিষ্ট সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন যোহর, আসর ও এশাতে। ফজর ও মাগরিবে পূর্ণ সালাত আদায় করতে হবে। আর সুন্নাতের ক্ষেত্রে কেবল ফজরের পূর্বের দু’রাক‘আত সুন্নাত ও বিতর সালাত পড়তে হবে। কারণ রাসূল (ﷺ) এই দু’সালাত কখনো পরিত্যাগ করতেন না।’ (সুনানে দারেমী হা/১৫৯৪; সহীহাহ হা/১৯৯৩; যাদুল মা‘আদ ১/৪৭৩)

• সফরে দুই ওয়াক্ত সালাত জমা করার বিধান:
_______________________________________
সফরে থাকা অবস্থায় যোহর-আসর (২+২=৪ রাক‘আত) ও মাগরিব-এশা (৩+২=৫ রাক‘আত) পৃথক এক্বামতের মাধ্যমে সুন্নাত ও নফল ছাড়াই জমা ও ক্বসর করে তাক্বদীম ও তাখীর দু’ভাবে পড়ার নিয়ম রয়েছে। (বুখারী, মিশকাত হা/১৩৩৯; আবু দাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৩৪৪)। অর্থাৎ শেষের ওয়াক্তের সালাত আগের ওয়াক্তের সাথে ‘তাক্বদীম’ করে অথবা আগের ওয়াক্তের সালাত শেষের ওয়াক্তের সাথে ‘তাখীর’ করে একত্রে পড়বে।(ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৫)
.
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَجْمَعُ بَيْنَ صَلاَةِ الْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ فِي السَّفَرِ ‘নবী করীম (ﷺ) সফরকালে মাগরিব ও এশার সালাত একত্রে আদায় করতেন।’(বুখারী হা/১১০৮, ১১১০) ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে অন্য বর্ণনায় এসেছে, সফরে দ্রুত চলার সময় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যোহর ও আসরের সালাত একত্রে আদায় করতেন। আর মাগরিব ও এশা একত্রে আদায় করতেন।’(বুখারী হা/১১০৭; বুলুগুল মারাম হা/৪৩৯; মিশকাত হা/১৩৩৯)
.
আদায়ের ক্ষেত্রে সুবিধা অনুযায়ী আসরকে যোহরের সাথে অথবা যোহরকে আসরের সাথে আদায় করা যাবে। অনুরূপভাবে মাগরিবকে এশার সাথে অথবা এশাকে মাগরিবের সাথে আদায় করবে।’ (বুখারী হা/১১০৯, ১১১১, ১১১২; মুসলিম হা/৭০৪; নাসাঈ হা/৫৮৬,৫৮৭, ৫৮৯; আহামাদ হা/১৩৮০১)। মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ) তাবুকের যুদ্ধ চলাকালে যোহরের সময় সূর্য ঢলে গেলে যোহর ও আসরের সালাত দেরী করতেন এবং আসরের সালাতের জন্য মনযিলে নামতেন (যোহর ও আসরের সালাত এক সাথে আদায় করতেন)। মাগরিবের সালাতের সময়ও তিনি এরূপ করতেন। সূর্য তাঁর ফিরে আসার আগে ডুবে গেলে তিনি মাগরিব ও এশার সালাত একত্রে আদায় করতেন। আর সূর্যাস্ত যাওয়ার আগে চলে এলে তিনি মাগরিবের সালাত দেরী করতেন। এশার সালাতের জন্য নামতেন, তখন দু’সালাতকে একত্রে আদায় করতেন। (আবু দাউদ হা/১২০৮; তিরমিযী হা/৫৫৩; ইরওয়া হা/৫৭৮; মিশকাত হা/১৩৪৪)
.
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, জমা করে সালাত আদায় কখনো প্রথম ওয়াক্তে সাথে হতে পারে। যেমন আরাফার দিনের সালাত (যেখানে আসরের সালাতকে যোহরের ওয়াক্তে যোহরের পরে আদায় করা হয়)। আবার কখনো দ্বিতীয় ওয়াক্তের সাথে হতে পারে। যেমন মুযদালিফার সালাত (যেখানে মাগরিবের সালাতকে বিলম্ব করে এশার সালাতের সময় আদায় করা হয়)। কখনো দুই ওয়াক্তের মাঝখানেও আদায় করা যায়। এসব পদ্ধতিই জায়েয। (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৪/৫৬ পৃঃ)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ) বলেন, কেউ যদি সূর্য হেলে যাওয়ার আগে সফর শুরু করে তাহলে যোহরকে দেরী করে আসরের সময় আদায় করবে। আর সূর্য হেলে যাওয়ার পরে সফর শুরু করলে যোহরের সময় আসরকে এগিয়ে যোহরের সাথে আদায় করবে। অনুরূপ ভাবে মাগরিব ও এশা সালাত আদায় করবে। (যাদুল মা‘আদ ১/৪৫৯-৪৬০)
.
জেনে রাখা ভালো য, দুই ওয়াক্ত সালাত জমা করা শুধু সফরের জন্য খাছ নয়। বিভিন্ন শরীয়তী ওজরের কারণে মুকীম অবস্থায় একত্রে ক্বসর ছাড়া জমা করা যায়। (আবু দাউদ হা/১২১০, ১২১১, ১২১৪; নাসাঈ হা/৬০২; তিরমিযী হা/১৮৭) যেমন: ভীতি ও ঝড়-বৃষ্টি ছাড়াও অন্য কোন বিশেষ শারঈ ওযর বশতঃ মুক্বীম অবস্থায়ও দু’ওয়াক্তের সালাত ক্বসর ও সুন্নাত ছাড়াই একত্রে জমা করে পড়া যায়। যেমন যোহর ও আসর পৃথক এক্বামতের মাধ্যমে ৪+৪=৮ (ثَمَانِيًا) এবং মাগরিব ও এশা অনুরূপভাবে ৩+৪=৭ (سَبْعًا) রাক‘আত। ইবনু আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, এটা কেন? তিনি বললেন, যাতে উম্মতের কষ্ট না হয়।’ (সহীহ বুখারী হা/৫৪৩, ৫৬২১১৭৪ ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়-১৯, অনুচ্ছেদ-৩০; মুসলিম হা/১৬৩৩-৩৪; নায়লুল আওত্বার ৪/১৩৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৮) নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর যুগে প্রসিদ্ধ ছিল যে, তিনি বৃষ্টির সময় দুই ওয়াক্ত সালাত জমা করতেন। (ইরওয়াউল গালীল ৩/৪০ পৃঃ)। শীতের অন্ধকার রাতে প্রচন্ড বাতাস থাকলে। (মুগনী ৩/১৩৪ পৃঃ)। অসুস্থের কারণে বা বিভিন্ন অসুবিধার কারণে। যেমন: যার অনবরত ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাবের সমস্যা বা মহুমুত্রের রোগী, মহিলাদের মুস্তাহাযার সমস্যা, যে পবিত্রতা অর্জনে অক্ষম, যে নিজের উপর, সম্পদের উপর বা ইয্যতের বিষয়ে ভয় করে, কর্মব্যস্ত ভাই-বোনেরা মাঝে-মধ্যে বিশেষ কারণবশত সালাত জমা করতে পারেন। (ফিকহুস সুন্নাহ ১/২২০; নায়লুল আওত্বার ৪/১৩৬-৪০)। ইস্তেহাযা বা প্রদর রোগগ্রস্ত মহিলা ও বহুমূত্রের রোগী বা অন্যান্য কঠিন রোগী, বাবুর্চী এবং কর্মব্যস্ত ভাই-বোনেরা মাঝে-মধ্যে বিশেষ ওযর বশতঃ সাময়িকভাবে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। (নায়লুল আওত্বার ৪/১৩৬-৪০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৭-১৮)

• সফরে সুন্নাত সালাত ছেড়ে দেওয়ার বিধান:
___________________________________
মহানবী (ﷺ) সফরে সাধারণত: ফরয নামাযের আগে বা পরে সুন্নত নামায পড়তেন না। তবে বিত্‌র ও ফজরের সুন্নত তিনি সফরেও নিয়মিত পড়তেন। যেমন: এর পূর্বেও ইঙ্গিত করা হয়েছে।(যাদুল মা‘আদ ১/৪৫৬)
.
বলা বাহুল্য, সফরে (বিত্‌র ও ফজরের আগে ২ রাকআত ছাড়া) সুন্নত (মুআক্কাদাহ) না পড়াই সুন্নত। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) এক সফরে লোকেদেরকে ফরয নামাযের পর সুন্নত পড়তে দেখে বললেন, ‘যদি আমাকে সুন্নতই পড়তে হত, তাহলে ফরয নামায পুরা করেই পড়তাম। আমি নবী (ﷺ)-এর সাথে সফরে থেকেছি। আমি তাঁকে সুন্নত পড়তে দেখিনি।’ অতঃপর তিনি বললেন- আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (আহযাব ৩৩/২১ বুখারী হা/১১০১)। আবু বকর (রাঃ) ও উসমান (রাঃ)-এরও এ রীতি ছিল। (বুখারী হা/১১০২; আবু দাউদ হা/১২২৩; মুসলিম হা/৬৮৯)। তবে সফরে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়া যাবে না এমন কথা নয়। যেহেতু মহানবী (ﷺ) কখনো কখনো কিছু কিছু সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়তেন!যেমন রাসূল (ﷺ) বিতর ও ফজর সালাতের দু’রাক‘আত সুন্নাত মুকীম ও মুসাফির উভয় অবস্থাই আদায় করতেন। (যাদুল মা‘আদ ১/৪৫৬)। আয়েশা (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-এর ফজরের সুন্নাত সম্পর্কে বলেন,وَلَمْ يَكُنْ يَدَعُهُمَا أَبَدًا- এ দু’রাক‘আত তিনি কখনো পরিত্যাগ করতেন না। (বুখারী হা/১১৫৯) ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ) সফরে ফরয সালাত ব্যতীত তাঁর সওয়ারী হতেই ইঙ্গিতে রাতের সালাত আদায় করতেন সওয়ারী যে দিকেই ফিরুক না কেন। আর তিনি বাহনের উপরেই বিতর আদায় করতেন। (সহীহ বুখারী হা/১০০০)
.
তবে সাধারণ নফল সালাতগুলোর ক্ষেত্রে মুক্বীম ও মুসাফিরের জন্য একই হুকুম। যেমন: তাহিয়াতুল মসজিদ, তাহিয়াতুল ওযূর সালাত, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণের সালাত, কাবা ঘর তাওয়াফের পর সালাত, সালাতুয যোহা ইত্যাদি।
.
জেনে রাখা ভাল যে,ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন নামায ফরজ হোক আর নফল হোক কাযা করা যাবে না। করলে ওই সালাত পরবর্তীতে আদায় করলেও কবুল হবেনা। এখন যদি কেউ কোনো নামাজের কথা ভুলে যায়, তাহলে যখনই স্মরণ হবে, তখন তাকে তা আদায় করতে হবে। এ ব্যতীত সে নামাজের অন্য কোনো কাফ্ফারা নেই। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, ‏وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي‏ আমাকে স্মরণের উদ্দেশে নামাজ কায়েম কর। (সহীহ মুসলিম ৬৮৪)। তিনি আরো বলেন, “নিদ্রা অবস্থায় কোন শৈথিল্য নেই। শৈথিল্য তো জাগ্রত অবস্থায় হয়। সুতরাং যখন তোমাদের মধ্যে কেউ কোন নামায পড়তে ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তার উচিৎ, স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেওয়া। কেন না, আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তুমি নামায কায়েম কর।” (কুরআন মাজীদ ২০/১৪, মুসলিম, মিশকাত ৬০৪)
.
যে নামায যে অবস্থায় কাযা হয়, সেই নামাযকে সেই অবস্থা ও আকারে পড়া জরুরী। সুতরাং রাতের নামায দিনে কাযা পড়ার সুযোগ হলে রাতের মতই করে জোরে ক্বিরাআত করতে হবে। কারণ, মহানবী (ﷺ) যখন ফজরের নামায দিনে কাযা পড়েছিলেন, তখন ঠিক সেই রুপই পড়েছিলেন, যেরুপ প্রত্যেক দিন ফজরের সময় পড়তেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং)। তদনুরুপ ছুটে যাওয়া নামায রাতে কাযা পড়ার সুযোগ হলে দিনের মতই চুপে চুপে ক্বিরাআত পড়তে হবে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/২৭, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২০৪, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা কমিটি ১/৩১০)
.
তদনুরুপ কেউ মুসাফির অবস্থায় নামায কাযা করে বাড়ি ফিরলে, বাড়ি ফিরার পর নামায ক্বসর করে না পড়ে পুরোপুরি পড়বে; কিন্তু ঐ কাযা নামায ক্বসর করেই আদায় করবে। কারণ, সফর অবস্থায় তার ক্বসর নামাযই কাযা হয়েছে। আর বাড়িতে থাকা অবস্থায় কোন ছুটে যাওয়া নামায সফরে মনে পড়লে বা কাযা পড়ার সুযোগ হলে তা পুরোপুরিই আদায় করতে হবে। মোট কথা যেমন নামায কাযা হবে, ঠিক তেমনিভাবে তা আদায় করতে হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫১৮)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।