ধর্ম যার যার উৎসব সবার চলুন বাক্যটির মর্ম জানার চেষ্টা করি

”ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”। কি চমৎকার ধর্মনিরপেক্ষতা! চলুন বাক্যটির মর্ম জানার চেষ্টা করি।
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
ধর্ম যার যার, উৎসব সবার বাক্যটি নিয়ে আলোচনার শুরুতে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন তা হলো, বাক্যটি যেহেতু ধর্ম কেন্দ্রীক তাই এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও ধর্মীয় চিন্তার আলোকেই করতে হবে। তবে একটু বলে রাখা ভালো যে, অধিকাংশ সময় উল্লেখিত বাক্যটি হিন্দুদের দূর্গা পূজার সময় বেশি প্রয়োগ করতে লক্ষ্য করা যায়। এযাবত আমরা কখনও মুসলিমদের ধর্মীয় কোন উৎসবে যেমন,ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আযহার সময় এ বাক্য কোন হিন্দু ভাইকে ব্যবহার করতে দেখিনা। বরং গত কয়েক বছর ধরে ঈদুল আযহার সময় ভারত সহ বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলো আওয়াজ তুলেছিল যে, মুসলমানদের জন্য গরু কুরবানী নিষিদ্ধ করা হোক।সুতরাং এতে আমরা যতটুকু বুঝি তা হলো,ধর্ম যার যার, উৎসব সবার এ বাক্য শুধু মুসলমানদেরকে হিন্দুদের ধর্মের বিভিন্ন শির্কী উৎসবে যুক্ত করার জন্য। কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষকে ইসলামের উৎসবে অংশগ্রহনের জন্য নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিক কয়েক বছর আগে থেকে দেখতে পাচ্ছি যে, দেশের বিভিন্ন মুসলিম নামধারী রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু বুদ্ধিজীবি মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্যেশ্যে পোষ্টার এবং বিলবোর্ড সহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মৌখিক প্রচার প্রচারনাতেও উক্ত বাক্যটি ব্যবহার করে থাকেন।“ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” বাক্যটি কতখানি যৌক্তিক আর কতটুকু মুসলিম বিদ্বেষী তা নিয়ে সামান্য আলোচনা করা দরকার।
.
“ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”-সবার আগে এই বাক্যের বাহ্যিক অর্থটা সবার জানা দরকার। কথাটির বাহ্যিক অর্থ হলো, ‘ধর্মীয় দিক থেকে এক ধর্মের লোকের সাথে অন্য ধর্মের ভিন্নতা থাকলেও উৎসবের দিক দিয়ে সবাই এক। অর্থাৎ ধর্মের আচার-আচরণ সবাই নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী পালন করবে আর উৎসবগুলো সবাই একত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পালন করবে। সে হিসেবে মুসলমানরা হিন্দুদের পূজায় শরীক হবে আর হিন্দুরা অংশ গ্রহণ করবে ঈদের সালাতে।এমনকি বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনটা বৌদ্ধদের পাশাপাশি মুসলমানরাও উৎযাপন করবে। তবে বাইরের দিক ছাড়াও শ্লোগানটির ভেতরগত আরেকটি অর্থ আছে। সেটা হলো- অন্যান্য ধর্মের লোকেরা মুসলমানদের উৎসবে যোগ দিক আর না দিক; মুসলমানদের দায়িত্ব হলো সব ধর্মের উৎসবে যোগ দেয়া। প্রতি বছর পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা বা বড়দিন এলে কথাটা খুব বেশি শোনা যায়। পূজা বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের লোকেরা কথাটা বিভিন্ন ভাবে বলেন। এমনকি সেসব অনুষ্ঠানে আগত রাজনৈতিক বক্তারাও কথাটা খুব গর্বের সাথে বলে থাকেন। এর দ্বারা বুঝা যায়, এ শ্লোগানের প্রবক্তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ‘মুসলমানগণ’। অন্যান্য ধর্মলম্বীদের কার্যক্রম যাই হোক না কেন, মুসলমানরা যেন নিজ নিজ ধর্ম স্বস্থানে রেখে অন্য সব ধর্মের উৎসবে যোগদান করে; ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ ‘শ্লোগান দ্বারা মূলত এটাই উদ্দেশ্য। অথচ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এটি সরাসরি ইসলাম বিরোধী কুফুরি বক্তব্য।
.
আমরা যারা বিশ্বাস করি যে, নিজের ধর্ম পালন করার পাশাপাশি কা-ফি-রদের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করলেও কোন সমস্যা নেই, তারাতো আমাদেরই প্রতিবেশী। তাদের উক্ত ধারণা যেমন ভুল, তেমনি ইসলামী সংস্কৃতিকে বিধর্মীয় সভ্যতা দ্বারা বিকৃত করার ষড়যন্ত্রের অংশ। কারণ ইসলামী শরী‘আতে কা-ফি-রদের কুফরী ও শিরকী উৎসবে সহযোগিতা করা ও অংশগ্রহণ করা হারাম‌। মহান আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ও গ্রহণযোগ্য দ্বীন ইসলাম। এছাড়া আর যত ধর্ম আছে তা সবই মিথ্যা ও বাতিল। পবিত্র কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেনঃ ‘’নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলাম।’’(আলে ইমরান ৩/১৯)। মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেনঃ ‘’যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম গ্রহন করতে চাইলে, কখনো তার নিকট থেকে তা গ্রহন করা হবে না। এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’’(আলে ইমরান ৩/৮৫)
.
এমনকি কি বাতিল ধর্মের উৎসবও বাতিল। এই মর্মে মহান আল্লাহ মুমিনদের সম্পর্কে বলেন, ‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না, আর অনর্থক কর্মকান্ডের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলে সসম্মানে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৭২)।

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহর সৎ বান্দাদের আরো বিশেষণ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না অর্থাৎ শিরক করে না, মূর্তিপূজা হতে তারা বেঁচে থাকে। তারা মিথ্যা কথা বলে না, পাপাচারে লিপ্ত হয় না, কুফরী করে না, অসার ক্রিয়া-কলাপ হতে দূরে থাকে, গান শুনে না এবং মুশরিকদের আনন্দ উৎসবে যোগদান করে না।’ (তাফসীর ইবনু কাছীর, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ১৩০ ‘সূরা আল-ফুরক্বানের ৭২নং আয়াতের ব্যাখ্যা’ দ্র.)।

ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মুসলিমগণ কাফিরদের কোন উৎসবে অংশ নিবে না, যা কিনা তাদের ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ঠিক যেমন করে কোন মুসলিম অন্য ধর্মের অনুশাসন এবং উপাসনার লক্ষ্যবস্তুগুলোকে গ্রহণ করতে পারে না।’ (তাশাব্বুহুল খাসিস বি আহলিল খামিস, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৯৩)।
.
মহান আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে আরো বলেন,আর তারা যখন অনর্থক কথাবার্তা শুনে তখন তা থেকে বিমুখ হয় এবং বলে “আমাদের কাজের ফল আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের জন্য।”(সূরা আল-কাসাস: ৫৫, আশ-শুরা:১৫)। এর সারমর্ম এই যে, ইবনে-কাসীর دين শব্দকে দ্বীনী ক্রিয়াকর্মের অর্থে নিয়েছেন। যার অর্থ, প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মের প্রতিদান ও শাস্তি ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ আমার দ্বীন আলাদা এবং তোমাদের দ্বীন আলাদা। আমি তোমাদের মাবুদদের পূজা-উপাসনা-বন্দেগী করিনা এবং তোমরাও আমার মাবুদের পূজা-উপাসনা করো না। আমি তোমাদের মাবুদের বন্দেগী করতে পারি না এবং তোমরা আমার মাবুদের বন্দেগী করতে প্রস্তুত নও। তাই আমার ও তোমাদের পথ কখনো এক হতে পারে না।
.
ইসলাম সব ধরনের বিজাতীয় অপসংস্কৃতি অমুসলিম ইহুদী-খ্রিস্টানদের অনুসরণ-অনুকরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।(আবূদাঊদ হা/৪০৩১, তিরমিযী হা/২৬৯৫ সিলসিলা সহীহাহ হা/২১৯৪)। অপর বর্ণনায় রাসূল (ﷺ) স্বীয় উম্মতকে সাবধান করে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বই বলে গেছেন, তোমরা ইহূদী-নাসারাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে হাতে হাতে ও বিঘ’তে বিঘ’তে। তারা যদি গুই সাপের গর্তে ঢুকে পড়ে, তোমরাও সেখানে ঢুকবে।’ (ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৪, সনদ হাসান)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! ইসলাম শান্তির ধর্ম।ইসলাম একটি অত্যন্ত সামাজিক, ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণমুখী জীবনাদর্শের নাম।এ ধর্মে আল্লাহ মানুষের জন্য যে সকল আচরণবিধি নির্দেশ করেছেন, তা সবই মানুষের শান্তি, মঙ্গল এবং সুশৃংখল জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে। তার ব্যতিক্রম হ’লে ইহকালে অশান্তি, পরকালে কঠিন আযাব অবধারিত।আমাদের সমাজে যদি অমুসলিম বসবাস করে তাহলে ইসলাম তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ বসবাস, সু-সম্পর্ক, সামাজিক যোগাযাগ ইত্যাদিতে বাধা দেয় না। তারা যদি বিপদগ্রস্ত হয় মুসলিমরা তাদের সাহায্যে ছুটে যাবে, অভাবীকে ঋণ দিবে, কেউ অভুক্ত থাকলে তার খাবার ব্যবস্থা করবে, আচার-আচরণে মানবিক ও চারিত্রিক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে, তাদের প্রতি কোন ধরণের জুলুম-অবিচার করবে না, তাদের কে কথা ও কাজে কষ্ট দিবে না, প্রতিবেশী সুলভ ভদ্রতা রক্ষা করবে ইত্যাদি, যদি তারা প্রকাশ্যে মুসলিমদের সাথে শত্রুতা, যুদ্ধ ও হানাহানিতে লিপ্ত না হয়। এটাই ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যের মাধ্যমেই যুগে যুগে ইসলাম পৃথিবীর দিকে দিকে অমুসলিমদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলো। মোটকথা ইসলামের দৃষ্টিতে অমুসলিমদের সাথে ক্রয়-বিক্রয় এবং দুনিয়াবি লেনদেন করায় শরিয়তে কোন আপত্তি নাই।তবে কোনো অবস্থাতেই মুসলিম নারী-পুরুষ তাদের ধর্মীয় উৎসবে যোগদান করা কোনো ভাবে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা জানানো যাবে না। কারণ ধর্ম আর উৎসব একটাকে অন্যটা থেকে পৃথক করে দেখার কোন সুযোগ নেই। অন্য ধর্মের উৎসবে একাত্মতা ঘোষণা করা মানে সে ধর্মের মাঝে নিজেকে একাকার করে দেয়া। যা ইসলাম সমর্থন করেনা। তবে হা, যদি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল হিসাবে বাধ্য-বাধকতা থাকে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোন কর্মচারী যিম্মীদের অধিকার রক্ষার্থে সেখানে যাওয়া তাদের নিরাপত্তা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোন অবস্থায় যেন তাদের শিরকী আক্বীদা ও আমলের প্রতি সমর্থন সূচক কোন বক্তব্য না দেওয়া হয়। বরং তাদেরকে ঈমানের পথে দাওয়াত প্রদানের সদিচ্ছা থাকতে হবে। (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২/১১৫ পৃ.)।আল্লাহই আমাদেরকে হেফাজত করুক, আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।