যিলহজ্জ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত

যিলহজ্জ (আরবি: ذو الحجة )আরবী চন্দ্রমাসের সর্বশেষ অর্থাৎ ১২ তম মাস। এটি মুসলিমদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা এই মাসে মুসলিমগণ হজ্ব পালন করেন। আর, এর প্রথম দশ দিনেই হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন হয়। যিলহজ্জের প্রথম দশক রামাদানের শেষ দশকের সাথে তুলনীয়।আল্লাহ তা‘আলা কিছু মাস, দিন ও রাতকে ফযীলতপূর্ণ করেছেন। যেমন রামাযান মাসকে অন্য সকল মাসের উপর মহিমান্বিত করেছেন। আরাফাতের দিন ও ঈদের দিনকে অন্য দিনের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। ক্বদরের রাতকে অন্যান্য রাতের চেয়ে মর্যাদামন্ডিত করেছেন। আসন্ন যিলহজ্জ মাস অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মাস। যে মাসে হজ্জ ও কুরবানী করা হয়ে থাকে। এই মাসের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে বিস্তর আলোচনা এসেছে।

▪️যিলহজ্জ মাসের ফযীলত: উম্মতে মুহাম্মাদীর বয়স ষাট থেকে সত্তর বছর। এত্থেকে অধিক বয়স কম লোকেরই হয়।(তিরমিযী হা/৩৫৫০; ইবনু মাজাহ হা/৪২৩৬) তাই অল্প সময়ে অধিক নেকী উপার্জনের জন্য মহান আল্লাহ বিভিন্ন মাস ও দিবসকে ফযীলতপূর্ণ করেছেন। অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস হচ্ছে যিলহজ্জ মাস। এ মাসেরও অনেক ফযীলত রয়েছে।

◾যিলহজ্জ মাস পুরোটাই ফযীলতপূর্ণ হ’লেও প্রথম দশ দিনের বিশেষ ফযীলত রয়েছে তাই এই দশ দিনের সুমহান মর্যাদা ও ফজিলতের ১০ টি দিক সম্পর্কে জানি।
_______________________________________
▪️(১). আল্লাহ তা‘আলা জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাতের শপথ করেছেন:
.
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘শপথ ভোর বেলার, শপথ দশ রাতের।’’ [সুরা ফাজর, আয়াত: ১-২] সাহাবিদের মধ্যে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইবনু আব্বাস (রা.), শীর্ষ তাবি‘য়িগণ ও মুফাসসিরগণের মতে, এখানে ‘দশ রাত’ দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনু কাসির (রাহিমাহুমুল্লাহ্) বলেন,এটিই বিশুদ্ধ মত। [ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম: ৪/৫৩৫-৫৩৬; আলুসি, রুহুল মা‘আনি: ২০/৪২২] রাসূল (ﷺ) বলেন,দশম হ’ল ঈদুল আযহার দিন, বেজোড় হ’ল আরাফার দিন আর জোড় হ’ল কুরবানী দিন’।(আহমাদ হা/১৪১০২; বাযযার হা/২২৮৬। হাকিম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইমাম যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। শু‘আইব আরনাঊত এটিকে সহীহ বলেছেন। দ্র. আহমাদ হা/১৪৫১১ তবে শায়খ আলবানী (রহঃ) একে যঈফ বলেছেন। দ্র. যঈফুল জামে‘ হা/১৫০৮)

▪️(২). যিলহজ্জের প্রথম দশদিন বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন:

জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,أَفْضَلُ أَيَّامِ الدُّنْيَا أَيَّامُ الْعَشْرِ، ‘দুনিয়ার দিন সমূহের মধ্যে যিলহজ্জের প্রথম দশদিন সর্বোত্তম দিন।(সহীহুল জামে‘ হা/১১৩৩; ছহীহুত তারগীব হা/১১৫০)

▪️(৩). এই দিনগুলোর আমল আল্লাহর নিকট সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ:
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট জিলহজের (প্রথম) দশ দিনের আমলের চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও প্রিয় অন্য কোনো আমল নেই।’’ সাহাবিগণ বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ রাস্তায় জিহাদও কি এর চেয়ে উত্তম নয়?’ তিনি বললেন, ‘‘না। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান ও মাল নিয়ে (জিহাদে) ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং এর কোনোটি নিয়েই আর ফিরে এলো না (অর্থাৎ, শহিদ হয়ে গেলো, তার কথা ভিন্ন)।’’ [বুখারি, আস-সহিহ: ৯৬৯; আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৬৫০৫; আবু দাউদ, আস-সুনান: ২৪৩৮]এই দশদিনের ফরজ ইবাদত অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের তুলনায় অধিক মর্যাদার। এই দশদিনের নফল ইবাদত অন্যান্য মাসের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। [ইবনু রজব, ফাতহুল বারি: ৯/১৫]
.
▪️(৪). এগুলো সেই ‘নির্দিষ্ট দিন’, যেগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় বিশেষভাবে:
.
আল্লাহ তা‌‘আলা বলেন, ‘‘যেন তারা নিজেদের কল্যাণের স্থানসমূহে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজিক দিয়েছেন, তার ওপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’’ [সুরা হজ, আয়াত: ২৮] ইবনু আব্বাস (রা.), ইবনু উমার (রা.), হাসান বাসরি, আত্বা, ইবরাহিম নাখাঈ এবং ফিকহের প্রধান ইমামগণ (রাহিমাহুমুল্লাহ্) সহ অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, এখানে ‘নির্দিষ্ট দিনসমূহ’ দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনই উদ্দেশ্য। [ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম: ৩/২৮৯; বাগাবি, শারহুস সুন্নাহ: ৫/৩৭৯]
.
▪️(৫). এই দশ দিনে সকল মৌলিক ইবাদত একত্রিত হয়:
.
এই দশদিন আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত প্রায় সকল ইবাদত একত্রিত হয়, যা অন্য কোন সময়ে একত্রিত হওয়া সম্ভব নয়। যেমন হজ্জ, কুরবানী, ছালাত, ছিয়াম, দান-ছাদাক্বাসহ সকল ইবাদত এই দশ দিন একত্রিত করা যায়। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন,এ কথা স্পষ্ট হয় যে, যিলহজ্জের প্রথম দশ দিনের বিশেষ গুরুত্বের কারণ; যেহেতু ঐ দিনগুলিতে মৌলিক ইবাদতসমূহ একত্রিত হয়েছে। যেমন সালাত,সিয়াম, সাদাক্বাহ এবং হজ্জ, যা অন্যান্য দিনগুলিতে এভাবে একত্রিত হয় না’।(ফাতহুল বারী ২/৪৬০।)

▪️(৬). এই দিনগুলোর মধ্যেই আছে ঈদ তথা কুরবানির দিন, যা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ:
.
কুরবানীর একমাত্র মাস হ’ল যিলহজ্জ মাস। এই মাসের ১০ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত মোট চারদিন কুরবানী করার সময়। প্রথম দিন তথা ১০ই যিলহজ্জ ছালাতুল ঈদের পর কুরবানী করতে হবে। ঈদের ছালাতের আগে কুরবানী করলে কুরবানী হবে না। রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি ছালাতের পূর্বে যবহ করেছে, সে যেন তদস্থলে আরেকটি যবহ করে নেয়। আর যে ব্যক্তি আমাদের ছালাত আদায় করা পর্যন্ত যবহ করেনি, সে যেন এখন আল্লাহর নাম নিয়ে যবহ্ করে’।(সহীহ বুখারী হা/৫৫০০; নাসাঈ হা/৪৪১০) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ দিন হলো কুরবানির দিন, অতঃপর স্থিরতার দিন।’’ (অর্থাৎ কুরবানির পরবর্তী দিন, যেদিন হাজিগণ বিশ্রাম করেন) [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৭৬৫; হাদিসটি সহিহ]
.
▪️(৭). এই দিনগুলোতেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত—হজ পালন করা হয়:
.
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘হজের মাসগুলো সুবিদিত/সুনির্ধারিত।’’ [সুরা বাকারাহ, আয়াত: ১৯৭]। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, হজ্জের সুবিদিত মাসগুলি হ’ল শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ্জ। আল্লাহ এ মাসগুলি হজ্জের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আর ওমরা সারা বছর আদায় করা যায়। এ মাসগুলি ব্যতীত হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধলে হজ্জ হবে না।(তাফসীরে তাবারী, সূরা বাক্বারাহ ১৯৭ নং আয়াতে তাফসীর দ্রঃ)

▪️(৮). এই দিনগুলোর মধ্যেই আরাফার সুমহান দিনটি রয়েছে, যে দিনটি অনন্য ও অসাধারণ:
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘অন্যান্য দিনের তুলনায় আরাফার দিনে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।’’ [মুসলিম, আস-সহিহ: ৩৩৫৪; নাসাঈ, আস-সুনান: ৩০০৩] (আরাফাহ সম্পর্কে একটি আলেদা পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ)
.
▪️(৯). জিলহজ মাস সম্মানিত চার মাসের একটি:
.
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সংরক্ষিত ফলকে (বছরে) মাসের সংখ্যা বারোটি—আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তার মধ্যে, চারটি (মাস) সম্মানিত।” [সুরা তাওবাহ, আয়াত: ৩৬]
আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,আল্লাহ যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হ’তে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-কা‘দাহ, যুল-হিজ্জাহ ও মুহাররাম। তিনটি মাস পর পর রয়েছে। আর একটি মাস হ’ল রজব-ই মুযার,যা জুমাদা ও শা‘বান মাসের মাঝে অবস্থিত’।(বুখারী হা/৩১৯৭;মুসলিম হা/১৬৭৯ আবুদাঊদহা/১৯৪৭)
.
▪️(১০). সালাফে সালিহিন তথা পূর্বসূরি নেককার ব্যক্তিগণ এই দিনগুলোর বিশেষ কদর করতেন:
.
বিখ্যাত তাবি‘য়ি সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহিমাহুল্লাহর অভ্যাস ছিল, যিনি পূর্বে বর্ণিত ইবনে আব্বাসরে হাদিস বর্ণনা করেছেন: যখন যিলহজ মাসরে ১ম দশ দিন প্রবেশ করত, তখন তিনি খুব মুজাহাদা করতেন, যেন তার উপর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলবেন(দারামী: ২৫৬৪ সনদ হাসান)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।