যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হল বেশি বেশি তাকবির তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা

যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হলো বেশি বেশি তাকবির তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা। তাকবির কখন এবং কিভাবে দেওয়া উচিত?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর যিলহজ্জের প্রথম দশ দিন বরকতময় ও মহিমান্বিত দিন। ইসলামি বর্ষপঞ্জির অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাস হলো যিলহজ্জ, আর এর প্রথম দশ দিনকে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলোর গুরুত্ব বোঝাতে শপথ করেছেন। তিনি বলেন: “শপথ ফজরের, এবং শপথ দশ রজনীর।”(সূরা আল-ফজর: ১-২) ইবনে আব্বাস, ইবনে যুবাইর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) এবং বহু প্রখ্যাত তাফসিরকারক একমত যে, এখানে “দশ রজনী” বলতে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনকেই বোঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:“এই ব্যাখ্যাই সবচেয়ে সঠিক।”(তাফসিরে ইবনে কাসির খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৪১৩) এই দশ দিন আল্লাহর কাছে এতটাই প্রিয় যে, এতে করা নেক আমল অন্য সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বেশি মর্যাদাসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: “আল্লাহর কাছে এমন কোনো দিন নেই, যাতে সৎকর্ম করা যিলহজ্জের এই দশ দিনের চেয়ে অধিক প্রিয় ও উত্তম।” সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন,“হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়?” তিনি বললেন,“আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়; তবে সে ব্যক্তি ব্যতিক্রম, যে নিজের জান ও মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে না আসে।”(সহিহ বুখারি: হা/৯৬৯; তিরমিযি: হা/৭৫৭)।
.
যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনের আমলগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হল তাকবীর তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা। ঈদুল আযহার তাকবীর দুই ধরনের: (১).মুত্বলাক্ব বা সাধারণ তাকবীর, (২).মুকায়্যাদ বা নির্দিষ্ট সময়ে পঠিতব্য তাকবীর।
.
❑ (১).তাকবিরে মুত্বলাক্ব বা সাধারণ তাকবির:
.
তাকবিরে মুত্বলাক্ব বা সাধারণ তাকবির জিলহজ্জ মাসের প্রথম দিন থেকে তাশরিকের সর্বশেষ দিন সূর্য ডোবা পর্যন্ত যে কোনো সময়ে উচ্চারণ করা সুন্নত। এটিই ‘তাকবিরে মুতলাক’ নামে পরিচিত। এটি যিলহজ্জ মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলোর মধ্যে একটি। তাকবিরের এই সময়সীমা শুরু হয় যিলহজ্জ মাসের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ যিলক্বদ মাসের শেষ দিনের সূর্যাস্তের পর থেকেই। এই আমল চলতে থাকে ১৩ যিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত, যা তাশরিকের শেষ দিন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে। এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করতে পারে”(সূরা হজ্জ, আয়াত: ২৮)‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ হচ্ছে- যিলহজ্জের দশদিন। অপর আয়াতে বলেন, মহান আল্লাহ বলেন,”আর তোমরা গণনাকৃত দিনগুলিতে আল্লাহকে স্মরণ করবে’ (সূরা বাক্বারাহ ২/২০৩)।উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, وَاذْكُرُوا اللهَ فِي أَيَّامٍ مَعْدُودَاتٍ (সূরা বাক্বারাহ ২/২০৩) দ্বারা (যিলহজ্জ মাসের) দশ দিন বুঝায় এবং والأَيَّامٍ المَعْدُودَات দ্বারা ‘আইয়ামুত-তাশরীক’ বুঝায়। এবং যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তাশরিকের দিনগুলো হচ্ছে- পানাহার ও আল্লাহ্‌কে স্মরণ করার দিন।”(সহিহ মুসলিম হা/১১৪১ ও ২৫৪৭) ।
.
❑ (২).তাকবিরে মুকায়্যাদ বা নির্দিষ্ট তাকবির:
.
তাকবিরে মুকায়্যাদ বা নির্দিষ্ট তাকবির দেওয়ার সময় শুরু হয় আরাফার দিন তথা ৯ই জিলহজ্জ ফজর থেকে তাশরিকের সর্বশেষ দিন তথা ১৩ই জিলহজ্জ সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত (এর সাথে সাধারণ তাকবীর তো থাকবেই)। এই সময়ের মধ্যে প্রত্যেক ফরয সালাতের পর একাকী বা জামাআতে সালাত আদায়কারী নারী অথবা পুরুষ প্রত্যেকে প্রথমে তিনবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়বে, এরপর ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম, ওয়া মিনকাস সালাম,তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম’ বলবে, এরপর তাকবীর দিবে। পুরুষরা উচ্চ আওয়াজে তাকবির দিবে, আর নারীরা নিচু আওয়াজে। জেনে রাখা ভালো তাকবিরের সময়কালের এ বিধান যিনি হাজী নন তার জন্য প্রযোজ্য। আর হাজীসাহেব কুরবানীর দিন যোহরের সময় থেকে বিশেষ তাকবীর শুরু করবেন। প্রত্যেকে নিজে নিজে (পুরুষরা) একাকী উচ্চস্বরে তাকবীর দিবে।সম্মিলিতভাবে নয়; কেননা নবী (ﷺ)- থেকে সম্মিলিতভাবে তাকবীর দেয়া সাব্যস্ত হয়নি। অথচ তিনি বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যাতে আমাদের অনুমোদন নেই সেটি প্রত্যাখ্যাত।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমু‘উ ফাতাওয়া: ২৪/২২০; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ: ২/৩৬০; মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায, ১৩/১৭) ও বিন উসাইমীনের ‘আল-শারহুল মুমতি খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২২০-২২৪; ফাতওয়া লাজনাদ দায়মা; খন্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩১০)।
.
❑ তাকবিরের ফযিলত:
.
(ক).যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন মহান দিন। আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে এ দিনগুলোকে দিয়ে শপথ করেছেন। কোনো কিছুকে দিয়ে শপথ করা সে বিষয়ের গুরুত্ব ও মহান উপকারিতার প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “শপথ ফজরের ও দশরাত্রির”। ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে যুবাইর (রাঃ) ও অন্যান্য পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলেম বলেন: এ দিনগুলো হচ্ছে- যিলহজ্জ মাসের দশদিন। ইবনে কাসির (রহঃ) বলেন: “এটাই সঠিক”।(তাফসিরে ইবনে কাছির; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৪১৩)
.
(খ).এ দিনগুলোর নেক আমল আল্লাহর কাছে প্রিয়। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “অন্য যে কোন সময়ের নেক আমলের চেয়ে এ দশদিনের নেক আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তারা (সাহাবীরা) বলেন: আল্লাহর পথে জিহাদও নয়?! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আল্লাহর পথে জিহাদও নয়; তবে কোনো লোক যদি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং কোন কিছু নিয়ে ফেরত না আসে সেটা ভিন্ন কথা।”(সহিহ বুখারী হা/৯৬৯; ও সুনানে তিরমিযি হা/৭৫৭); হাদিসের এ ভাষ্যটি তিরমিযির,ইমাম আলবানী ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হা/৬০৫ হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন)।
.
(গ).এ দিনগুলোর নেক আমলের মধ্যে রয়েছে- তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) উচ্চারণ করে আল্লাহর যিকির করা। দলিল হচ্ছে নিম্নরূপ: আল্লাহ তাআলা বলেন: “যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে। এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করতে পারে”[সূরা হজ্জ, আয়াত: ২৮] ‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ হচ্ছে- যিলহজ্জের দশদিন।অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: “আর নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে আল্লাহকে স্মরণ করো…”[সূরা বাকারা, আয়াত: ২০৩] এগুলো হচ্ছে- তাশরিকের দিন।নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:“তাশরিকের দিনগুলো হচ্ছে- পানাহার ও আল্লাহকে স্মরণ করার দিন”(সহিহ মুসলিম হা/১১৪১)
.
❑ তাকবিররে শব্দাবলী;
.
তাকবিরের শব্দরূপের ব্যাপারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল (ﷺ)-থেকে কোনো বিশুদ্ধ মারফূ‘ হাদীস বর্ণিত হয়নি;তাই এ ক্ষেত্রে প্রশস্ততা রয়েছে। তাকবিরের ব্যাপারে সবচেয়ে বিশুদ্ধ বর্ণনা হলো মুহাদ্দিস ‘আব্দুর রাযযাক্ব বর্ণিত হাদীস, যা তিনি বিশুদ্ধ সনদে সালমান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেছেন, كَبِّرُوا اللهَ: اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا “তোমরা আল্লাহ’র বড়োত্ব ঘোষণা করে বলো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার কাবীরা’।”(ইমাম বাইহাক্বী “ফাদ্বাইলুল আওক্বাত” হা/২২৭;ইবনু হাজার “ফাতহুল বারী” খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৬২) অপব বর্ননায় ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলতেন, اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ وَللهِ الحَمْدُ، اللهُ أَكْبَرُ وَأَجَلُّ، اللهُ أَكْبَرُ عَلَى مَا هَدَانَا “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ, আল্লাহু আকবার ওয়া আজাল, আল্লাহু আকবার ‘আলা মা হাদানা।”(ইমাম বাইহাক্বী “সুনানুল কুবরা” হা/৬২৭০; ইমাম আলবানী “ইরওয়াউল গালীল” খণ্ড:  ৩; পৃষ্ঠা: ১২৬-তে হাদীসটিকে সহীহ’ বলেছেন) আরেক বর্ননায় ইবনু মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে তাকবীরের আরেকটি বিশুদ্ধ শব্দরূপ বর্ণিত হয়েছে। সেটা হলো, اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَللهِ الحَمْدُ “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।”(ত্বাবারানী “মু‘জামুল কাবীর” হা/৯৫৩৮; মুসান্নাফে ইবনু আবী শাইবাহ ”হা/৫৬৩৩)। ইমাম আলবানী “ইরওয়াউল গালীল” হা/৬৫৪) উক্ত শব্দরূপ সংবলিত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র মারফূ‘ হাদীসকে “দ্ব‘ঈফ (দুর্বল)” বলেছেন এবং ইবনু আবী শাইবাহ কর্তৃক ইবনু মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত মাওকূফ হাদীসকে ‘সাহীহ’ বলেছেন)।
.
❑ তাকবির দেয়ার পদ্ধতি কেমন হবে?
.
আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি নবী (ﷺ)-থেকে তাকবীর দেয়ার সুনির্দিষ্ট কোন ভাষা বর্ণিত হয়নি। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রশস্ততা রয়েছে।তাই যে কোনো শব্দে তাকবীর দেয়া হোক না কেন এতেই সুন্নাহ পালন হবে।সাধারণভাবে এই দশ দিন সংক্ষেপে ‘আল্লাহু আকবার’ বেশি বেশি পড়ুন। সাথে উপরোক্ত তাকবীর থেকে পছন্দ অনুযায়ী তাকবির পাঠ করুন। পুরুষদের উচ্চ আওয়াজে বলতে হবে, আর নারীরা নিচু আওয়াজে বলবে, যাতে শুধু নিজে শুনতে পায়। হায়েজ নেফাসে থাকা নারীদের জন্য এই তাকবির পাঠ করা জরুরি নয়। কারণ এটি ফরজ নামাজের পর পাঠ করতে হয়। তবে, তাঁরা পড়লে নেকি পাবেন। মহান আল্লাহ বলেন: “তিনি চান তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি যে তোমাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন সে জন্য তাকবীর উচ্চারণ করো (আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করো) এবং যাতে তোমরা শোকর করো।”(সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৫) তাকবীর উচ্চারণ করো মানে: তোমাদের অন্তর দিয়ে ও মুখ দিয়ে আল্লাহ্‌র মহত্ব ঘোষণা করো। সেটি তাকবীরের শব্দাবলীর মাধ্যমে হতে পারে। যেমন আপনি এভাবে বলতে পারেন: كَبِّرُوا اللهَ: اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا “তোমরা আল্লাহ’র বড়োত্ব ঘোষণা করে বলো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার কাবীরা’। অথবাالله أكبر ، الله أكبر ، لا إله إلا الله ، والله أكبر ، الله أكبر ، ولله الحمد (উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ)(অনুবাদ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ্‌ মহান, আল্লাহ্‌ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য) প্রখ্যাত সাহাবী ইবনু ওমর ও আবূ হুরায়রা (রাঃ) এই দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতেন এবং তাদের তাকবীরের সঙ্গে অন্যরাও তাকবীর বলত। মুহাম্মাদ ইবনু আলী (রাহিমাহুল্লাহ) নফল সালাতের পরেও তাকবীর বলতেন।(সহীহ বুখারী হা/৯৬৯-এর অনুচ্ছেদ দ্র.) উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) ও তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ্‌ মীনার দিনগুলোতে মসজিদে ও তাবুতে তাকবীর দিতেন। তাঁরা উচ্চস্বরে তাকবীর দিতেন। এতে করে তাকবীরের শব্দে মীনা প্রকম্পিত হয়ে উঠত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও একদল সাহাবীর আমল বর্ণিত আছে যে, তাঁরা আরাফার দিন ফজরের নামাযের পর থেকে ১৩ ই যিলহজ্জ আসরের নামায পর্যন্ত পাঁচওয়াক্ত নামাযের শেষে তাকবির দিতেন।” ওয়ালিদ বিন মুসলিম বলেন: আমি আওযায়ি ও মালেক বিন আনাসকে দুই ঈদের দিন উচ্চস্বরে তাকবির দেওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। তাঁরা উভয়ে বলেছেন: হ্যাঁ। আব্দুল্লাহ্‌ বিন উমর (রাঃ) ঈদুল ফিতরের দিন ইমাম আসার আগ পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবির দিতেন। আবু আব্দুর রহমান আস-সুলামি থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “তাঁরা ঈদুল আযহার তাকবিরের চেয়ে ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে বেশি কঠোর ছিলেন।” ওকী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: বুঝাতে চাচ্ছেন: তাকবিরের ব্যাপারে।(দেখুন: ইরওয়াউল গালিল খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১২২) ইমাম দ্বারা কুতনী ও অন্যান্য গ্রন্থাকার বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে উমর (রাঃ) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন সকালে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর দিতে থাকতেন। এরপরও ইমাম আসার আগ পর্যন্ত তাকবির দিতে থাকতেন।ইবনে আবু শাইবা সহিহ সনদে যুহরী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: লোকেরা ঈদের সময় যখন তাদের ঘর থেকে বের হতো তখন থেকে ঈদগাহে আসা পর্যন্ত এবং ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবির দিতে থাকত। যখন ইমাম এসে যেত তখন সবাই চুপ হয়ে যেত। ইমাম যখন তাকবির দিতেন তখন তারাও তাকবির দিতেন।(দেখুন: ইমাম আলবানী; ইরওয়াউল গালিল খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১২১)।
.
উল্লেখ যে, উপরোক্ত বিধান যারা হাজি নন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে, হাজীসাহেব ইহরাম করার পর থেকে ঈদের দিন জমরাতে আকাবাতে কংকর নিক্ষেপ করা পর্যন্ত তালবিয়া যথা:-لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيكَ لَكَ- উচ্চারণ:লাব্বাইকাল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকালা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।অর্থ:”আমি হাযির হে আল্লাহ, আমি হাযির। আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাযির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সাম্রাজ্য সবই তোমার; তোমার কোন শরীক নেই’।(সহীন বুখারী হা/১৫৪৯; মুসলিম হা/১১৮৪) পড়ায় মশগুল থাকবেন। এরপর তাকবির দেয়ায় মশগুল হবেন। উল্লেখিত জমরাতে প্রথম কংকরটি নিক্ষেপ করার সময় থেকে তিনি তাকবির দেয়া শুরু করবেন। যদি তাকবির বলার সাথে তালবিয়াও বলেন তাতে কোন অসুবিধা নেই। যেহেতু আনাস (রাঃ) এর উক্তি হচ্ছে: “আরাফার দিন কেউ তালবিয়া দিত; আর কেউ তাকবীর দিত; কাউকে বারণ করা হত না”।[সহিহ বুখারী] তবে, উল্লেখিত দিনগুলোতে মুহরিম ব্যক্তির জন্য তালবিয়া পড়া উত্তম। আর হালাল ব্যক্তির জন্য তাকবীর বলা উত্তম।”(দেখুন: শাইখ বিন বায এর ‘মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত মুতানাউয়্যিআ’ খণ্ড: ১৩ ও পৃষ্ঠা: ১৭)
.
❑ সম্মিলিতভাবে তাকবীর দেওয়ার বিধান:
.
তাকবির দেওয়া এটি একটি ইবাদত। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ আমাদেরকে অধিক পরিমাণে তাকবির পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু কোথাও সম্মিলিতভাবে তাকবীর দেওয়ার কথা বলা হয়নি।তাই আমাদের ফিকাহবিদ আলেমগণ বর্তমান যামানার সম্মিলিত তাকবীর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তারা এর সপক্ষে দলিলের সমর্থন পাননি বিধায় এটাকে বিদআত ফতোয়া দিয়েছেন। কারণ যে কোনো ইবাদত নতুনভাবে চালু করা কিংবা কোনো ইবাদতের পদ্ধতি ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নতুনত্ব আনা নিন্দিত বিদআত হিসেবে গণ্য এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানী: “যে ব্যক্তি আমাদের এ বিষয়ের মধ্যে (ধর্মের মধ্যে) নতুন কিছু চালু করে যা তাতে নেই সেটা প্রত্যাখ্যাত”।(সহিহ মুসলিম হা/১৭১৮)।
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.] বলেছেন,” التكبير الذي كان يعمل في المسجد الحرام يوم العيد ، يجلس شخص أو أشخاص في سطح زمزم ويكبرون ، وأناس يجاوبونهم في المسجد ، فقام الشيخ عبد العزيز بن باز وأنكر عليهم هذه الكيفية وقال : إنها بدعة . ومقصود الشيخ أنها بدعة نسبية بهذا الشكل الخاص ، ولا يقصد أن التكبير بدعة ، فتذمر من ذلك بعض عوام أهل مكة ، لأنهم قد ألفوا ذلك ، وهذا هو الذي حدا .. على رفعه هذه البرقية ، وسلوك هذه الكيفية في التكبير لا أعرف أنا وجهها ، فالمدعي شرعية ذلك بهذا الشكل عليه إقامة الدليل والبرهان ، مع أن هذه المسألة جزئية لا ينبغي أن تصل إلى ما وصلت إليه”মসজিদে হারামে যে তাকবীর দেয়ার প্রচলন ছিল সেটা হচ্ছে‑ এক বা একাধিক ব্যক্তি যমযম পানির ছাউনির বসে তাকবীর দিতেন এবং মসজিদে অবস্থিত অন্য লোকেরা তাদের সাথে সাড়া দিত। তখন শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায (রহঃ) এই পদ্ধতিতে তাকবীর দেয়ার বিরোধিতা করলেন এবং বললেন: এটি বিদআত। শাইখের উদ্দেশ্য হচ্ছে‑ এই বিশেষ পদ্ধতিটা বিদআত। তাকবীর দেয়া বিদআত নয়। তখন মক্কার কিছু সাধারণ লোক এতে ক্ষুব্ধ হল। কেননা তারা এভাবে তাকবীর দিতে অভ্যস্ত ছিল। এ কারণে তিনি এই ফ্যাক্সটি পাঠিয়েছিলেন যে, এ পদ্ধতিতে তাকবীর দেয়ার কোন দলিল আমি জানি না। কেউ যদি এ পদ্ধতিতে তাকবীর দেয়াকে শরিয়তসম্মত দাবী করেন তাহলে তার কর্তব্য দলিল-প্রমাণ পেশ করা। যদিও এটি একটি মামুলি মাসয়ালা। এ মাসয়ালাকে নিয়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা কাম্য ছিল না।”(মাজমুউ ফাতাওয়াল আল্লামা মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১২৭, ১২৮)। সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,” يكبر كل وحده جهرا ، فإنه لم يثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم التكبير الجماعي ، وقد قال : ( من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد ) “”প্রত্যেকে নিজে নিজে উচ্চস্বরে তাকবীর দিবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সম্মিলিতভাবে তাকবীর দেয়া সাব্যস্ত হয়নি। অথচ তিনি বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করে যাতে আমাদের অনুমোদন নেই সেটি প্রত্যাখ্যাত।”(ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩১০) স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আরেক ফতোয়াতে আরও এসেছে যে, ‑التكبير الجماعي بصوت واحد ليس بمشروع بل ذلك بدعة؛ لما ثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : ( من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد ) ، ولم يفعله السلف الصالح ، لا من الصحابة ، ولا من التابعين ، ولا تابعيهم ، وهم القدوة ، والواجب الاتباع وعدم الابتداع في الدين “একই সুরে সম্মিলিতভাবে তাকবীর দেয়া শরিয়তসম্মত নয়; বরং বিদআত। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করে যাতে আমাদের অনুমোদন নেই সেটি প্রত্যাখ্যাত”। সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণ তথা স্বলাফে সালেহীনদের কেউ এটি করেননি। তাঁরাই হচ্ছেন‑ আদর্শ। আমাদের কর্তব্য হল‑ অনুসরণ করা; অভিনব কিছু চালু করা নয়।”(ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩১১) স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আরেক ফতোয়াতে আরও এসেছে যে,”التكبير الجماعي بدعة ؛ لأنه لا دليل عليه ، وقد قال النبي صلى الله عليه وسلم : ( من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد ) وما فعله عمر رضي الله عنه ليس فيه دليل على التكبير الجماعي ، وإنما فيه أن عمر رضي الله عنه يكبر وحده فإذا سمعه الناس كبروا ، كل يكبر وحده ، وليس فيه أنهم يكبرون تكبيرا جماعيا”সম্মিলিতভাবে তাকবীর দেয়া বিদআত। কেননা এর পক্ষে কোন দলিল নেই। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করে যাতে আমাদের অনুমোদন নেই সেটি প্রত্যাখ্যাত”। উমর (রাঃ) যা করেছেন তাতে সম্মিলিতভাবে তাকবীর দেওয়ার পক্ষে কোনো দলিল নেই। বরং তাতে রয়েছে যে, উমর (রাঃ) নিজে তাকবীর দিতেন এবং তাঁর তাকবীর দেওয়া শুনলে লোকেরাও তাকবীর দিত। প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে তাকবীর দিত। তারা সম্মিলিতভাবে তাকবীর দিত না।”(ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ২৬৯)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Share: