ঈদুল আযহার ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং এই দিনে করণীয়-বর্জনীয় কাজসমূহ

➤ভূমিকা: মুসলিম উম্মার জন্য বছরে শরী‘আত সম্মত দু’টি ঈদ রয়েছে। আর তা হল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।ঈদ’ (عيد) শব্দটি আরবী,যা ‘আউদুন’ (عود) মাছদার থেকে এসেছে। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো— উৎসব, পর্ব, ঋতু, মৌসুম, প্রত্যাবর্তন, প্রত্যাগমন ইত্যাদি। প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে আসে বলে একে ‘ঈদ’ বলা হয়।(আল-মু‘জামুল ওয়াফী আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান পৃষ্ঠা:৭২৬। আল ফিক্বহুল মানহাজী, ১/২২২)
.
প্রথম হিজরীতেই ঈদ শুরু হয়। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগের নাবীদের সময় ঈদের প্রচলন ছিল না।মুসলিমদের জন্য ঈদ একটা বিশেষ ধর্মীয় উৎসব। এই দিনে ঈদের জামাআতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এক সঙ্গে সালাত আদায় করেন। তারপর বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা, শুভেচ্ছা, দু‘আ এবং আনন্দ ভাগাভাগি করেন সবাই।প্রথম হিজরী সনে সিয়াম ফরয হওয়ার সাথে সাথে ‘ঈদুল ফিত্বর’-এর সূচনা হয়।(মক্কাবাসীরা যখন রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর উপর নানা রকমের অত্যাচার শুরু করল, তখন তিনি হিজরত করে মদীনায় আসেন। এসময় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনার লোকদের দুটি উৎসবে মেতে উঠতে দেখলেন। আর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এ কীসের উৎসব পালন করছ?’ তারা জবাবে বলল, আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে ধারাবাহিকভাবে এ উৎসবদ্বয় পালিত হয়ে আসছে। আমরা তাদের অনুকরণে প্রতিবছর তা উৎযাপন করে আসছি। তখন রাসূল সাঃ বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের এ দু’দিনের বদলে এমন দুটি দিন দান করেছেন, যা তোমাদের নির্বাচিত দিনদ্বয়ের চেয়ে উত্তম। একটি হচ্ছে— ঈদুল ফিত্বর এবং অন্যটি ঈদুল আযহা’।[আবু দাঊদ, হা/১১৩৪; নাসাঈ, হা/১৫৫৬, সহীহ)
.
➤ঈদের নামকরণ:
.
ঈদকে ‘ঈদ’ হিসেবে নামকরণ করার কারণ,হজ্জ মৌসুমে উদযাপিত ঈদকে ইসলামী পরিভাষায় ঈদুল আযহা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সাঃ এ নামকরণ করেছেন। এছাড়া ‘ইয়াওমুন নাহর’ও বলা হয়। আফগানিস্তানসহ এই উপমহাদেশের অধিকাংশ লোকেরা কুরবানীর ঈদ নামে অভিহিত করেন।এছাড়া ও ১) ঈদের দিনে আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ অবতীর্ণ হতে থাকে। ২) অথবা এ দিনের মধ্যে লোকেরা একের পর এক পরস্পরে মিলিত হয় বলে। ৩) প্রতি বছর পুনরায় আগমন করে বলে। ৪) বার বার আনন্দ ফিরে আসে। ৫) কারও মতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ওপর ক্ষমা ও রহমত পুনরাবৃত্তি করেন। ৬) কারও মতে ঈদের সালাতে বারবার তাকবীর বলতে হয় বিধায় একে ঈদ (عَيْدٌ) নামে আখ্যায়িত করেছে।(বুখারী ৯৫৬, মুসলিম ৮৮৯, মিশকাত, ১৪২৪)
.
‘আযহা’ শব্দটিকে আরবীতে ‘কুরব’ও বলা হয়ে থাকে, যা ফারসী বা উর্দূতে ‘কুরবানী’রূপে পরিচিত হয়েছে। কুরব-এর শাব্দিক অর্থ হল ১. নৈকট্য অর্জন করা। ২. কাছাকাছি যাওয়া। পরিভাষায় ‘কুরবানী’ ওই মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়। প্রচলিত অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ ত্বরীকায় যে পশু যবেহ করা হয়, তাকে কুরবানী বলা হয়।
.
◾➤ঈদুল আযহার লক্ষ্য:
.
সমাজের ধনী-গরীব এতিম-মিসকিন সকলের সাথে সদ্ভাব, আন্তরিকতা এবং বিনয়-নম্র আচরণ করা। মুসলিমদের জীবনে এই সুযোগ সৃষ্টি হয় বছরে মাত্র দু’বার। ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা একই কাতারে দাঁড়িয়ে পায়ে পা এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুই রাকআত ঈদের সালাত আদায়ের মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে যায়। পরস্পরে কুশল বিনিময় করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়, জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং আন্তরিক মহানুভবতায় পরিপূর্ণ করে। মূলত ঈদুল আযহার লক্ষ্য, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে দৈন্য, হতাশা তা দূরীকরণ। যারা অসুখী এবং দরিদ্র তাদের জীবনে সুখের প্রলেপ দেওয়া।
.
◾➤ঈদুল আযহার গুরুত্ব:
.
ঈদুল আযহার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে যথেষ্ট তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন, ‘আর কুরবানীর পশুসমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (আল-হজ্জ, ২২/৩৬)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরও বলেন,‘আর আমরা তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম।’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০৭-১০৮)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরও বলেন, ﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ﴾ ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করো এবং কুরবানী করো’ (আল-কাওছার, ১০৮/২)। নবী করীম সাঃ বলেছেন,সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’।[ইবনে মাজা,৩১২৩ বুলবুল মারাম,১৩৪৮) তাই ঈদুল আযহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতির এই সুন্নাত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে। যিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষ্যে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলিম সমবেত হয় ইব্রাহীম আঃ-এর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদীনায়। হজ্জ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য উদাহরণ। যা প্রতি বছরই আমাদেরকে তাওহীদী প্রেরণায় উজ্জীবিত করে। আমরা নিবিড়ভাবে অনুভব করি বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব।
.
◾➤ঈদুল আযহাকেন্দ্রিক আমল:
.
কুরআনুল কারীমের ভাষ্যমতে চারটি মাস অধিক সম্মানিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত’ (আত–তাওবা, ৯/৩৬)।এই চারটি মাসের অন্যতম হলো যিলহজ্জ মাস। আর এ মাসের ফযীলতপূর্ণ সময় হল ‘আশারায়ে যিলহজ্জ’ অর্থাৎ যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই দশকের রাত্রির শপথ করেছেন, وَالْفَجْرِ – وَلَيَالٍ عَشْرٍ ‘শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির’ (আল-ফাজর, ৮৯/১-২)। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লা-হু আনহু) ও মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ)সহ অনেক ছাহাবী, তাবেঈ ও মুফাসসির বলেন, এখানে ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা যিলহজ্জের প্রথম দশ রাতকে বুঝানো হয়েছে।(তাফসীরে ইবনু কাছীর, ৪/৫৩৫)।
.
➤(১). ঈদগায়ে যাওয়ার পূর্বে গোসল করা:
.
পুরুষগণ ঈদুল আযহার দিন সকালে মিসওয়াক ও ওযূ-গোসল করে, তৈল-সুগন্ধি ব্যবহার ও সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করে সুসজ্জিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর পাঠ করতে করতে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।(সহীহ বুখারী, হা/৮৮৬; মিশকাত, হা/১৩৮১)
.
এক ব্যক্তি আলী (রাঃ) কে গোসল করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল: “তিনি বললেন: তুমি চাইলে তো প্রতিদিন গোসল করতে পার। সে বলল: না; যে গোসল আসলেই গোসল (অর্থাৎ যে গোসলের ফযিলত আছে)। তিনি বললেন: জুমাবারের গোসল, আরাফার দিনের গোসল, কোরবানীর ঈদের দিনের গোসল এবং ঈদুল ফিতরের দিনের গোসল।”[মুসনাদে শাফেয়ি (পৃষ্ঠা-৩৮৫), আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’, ১/১৭৬ সনদ বিশুদ্ধ)
.
আল্লামা ইবনু কাইয়িম (রহ.) তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ যাদুল মা‘আদে লিখেছেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। তাঁর এক জোড়া পোশাক ছিল যা দু’ ঈদ ও জুমু‘আর দিন পরিধান করতেন। অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দার উপর তার প্রদত্ত নি‘আমাতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন। (তিরমিযী: ২৮১৯ রিয়াদুস সালেহীন, ৮০৭)
.
সহিহ সূত্রে ইবনে উমর (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, “ঈদুল ফিতরের দিন তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন”।[যেমনটি এসেছে ‘ফারইয়াবি’ রচিত ‘আহকামুল ঈদাইন” গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৮৩) ইবনে রজব হাম্বলি (রহঃ) বলেন:মালেক বলেছেন: আমি শুনেছি আলেমগণ প্রত্যেক ঈদের সময় সাজসজ্জা করা ও সুগন্ধি ব্যবহার করাকে মুস্তাহাব মনে করেন। শাফেয়িও মুস্তাহাব মনে করতেন।[ইবনে রজব রচিত ‘ফাতহুল বারী’ (৬/৬৮)]
.
➤(২). নারীরা ঈদগাহ যাওয়ার সময় সুগন্ধি বর্জন করবে:
.
মহিলারা অভ্যন্তরীণভাবে সুসজ্জিত হবে। তারা সুগন্ধি মেখে ও বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রদর্শনী করে বের হবে না। তারা উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর পাঠ করবে না।(তিরমিযী, হা/২৭৮৭; নাসাঈ, হা/৫১১৭-১৮; মিশকাত, হা/৪৪৪৩, সনদ সহীহ)
.
➤(৩). নারীরা পরিপূর্ণ পর্দা করে ঈদগাহ যাওয়া:
.
মহিলাগণ প্রত্যেকে বড় চাদরে শরীর আবৃত করে তথা পর্দার বিধান মেনে পুরুষদের পিছনে ঈদের জামাআতে শরীক হবে। ঋতুবতী মহিলারা কাতার থেকে সরে ঈদগাহের এক পার্শ্বে অবস্থান করবে। তারা কেবলমাত্র খুৎবা শ্রবণ এবং দু‘আয় অংশ গ্রহণ করবেন।(সহীহ বুখারী, হা/৯৭১; সহীহ মুসলিম, হা/৮৯০)এখানে দু‘আ বলতে সম্মিলিত দু‘আ বুঝানো হয়নি।
.
➤(৪). সকাল সকাল ঈদগাহ যাওয়া:
.
ঈদগাহে তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিৎ যাতে ইমাম সাহেবের কাছাকাছি বসা যায়, প্রথম কাতারে সালাত আদায় করা যায়। তাছাড়া সালাতের জন্য অপেক্ষা করা এসব অতীব সওয়াবের কাজ।(আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৭)
.
➤(৫). পায়ে হেটে ঈদগাহ যাওয়া:
.
পায়ে হেঁটে এক পথে ঈদগাহে যাওয়া এবং ভিন্ন পথে ফিরে আসা সুন্নাত। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন এক পথ দিয়ে (ঈদগাহে) আসতেন। আবার অন্য পথ দিয়ে (বাড়ীতে) ফিরতেন।[ইবনু মাজাহ, হা/১৩০১; দারেমী, হা/১৬১৩; আহমাদ, হা/৮১০০; মিশকাত, হা/১৪৩৪ ও১৪৪৭)
.
➤(৬). ঈদুল আযহার সালাতের আগে কিছু না খাওয়া:
.
হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঈদুল ফিতরে কিছু না খেয়ে ছালাতের জন্য বের হতেন না, আর কুরবানীর ঈদে ছালাতের আগে কিছু খেতেন না।(জামে‘ তিরমিযী, ১/৭১, হা/৫৪২) কেননা রাসূল (ﷺ) স্বীয় কুরবানীর গোশত হতে খেতেন (আহমাদ, হা/২৩০৩৪)। অপর বর্ণনায় আছে, ‘…তিনি ঈদুল আযহার দিন খেতেন না (পশু) যবেহ না করা পর্যন্ত।’ (ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/১৪২৬; বায়হাক্বী, হা/৫৯৫৪; ছহীহুল জামে‘, হা/৪৮৪৫, সনদ ছহীহ)। অবশ্য কুরবানীর গোশত দিয়ে খাওয়া উত্তম। বিদায় হজ্জের দিন তিনি ১০০টি উটের প্রতিটি থেকে একটু করে অংশ নিয়ে এক পাত্রে রান্না করে সেখান থেকে গোশত খেয়েছিলেন ও ঝোল পান করেছিলেন।(সহীহ মুসলিম, হা/৩০০৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩০৭৪; মিশকাত, হা/২৫৫৫)
.
➤(৭). খালি মাঠে ঈদের সালাত আদায় করা:
.
ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা বিনা অপারগতায় মসজিদে আদায় না করা।সহীহ বুখারী হা/৯৫৬, আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৮]
.
➤(৮). শুভেচ্ছা বিনিময় করা:
.
শুভেচ্ছা জ্ঞাপন সেটি যে কোন বৈধ ভাষায় হতে পারে। তবে, সর্বোত্তম ভাষা হচ্ছে‑ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরামের পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন, تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ ‘তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’। অর্থাৎ ‘আল্লাহ আমাদের ও আপনার পক্ষ হতে কবুল করুন!’[তামামুল মিন্নাহ, ১/৩৫৪, সনদ হাসান)মালেক (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে এক মুসলিম যদি অপর মুসলিমকে বলে: ‘তাকাব্বালাহু মিন্না ও মিন্‌ক, ওয়া গাফারাল্লাহু লানা ও লাক’ (আল্লাহ্‌ আমাদের ও আপনার নেক আমলগুলো কবুল করে নিন। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ও আপনাকে ক্ষমা করে দিন) সেটা কি মাকরুহ হবে? তিনি বলেন: মাকরুহ হবে না।[আল-মুনতাকা শারহুল মুয়াত্তা (১/৩২২)]
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন:
ঈদের দিন শুভেচ্ছা জ্ঞাপন হচ্ছে নামায পড়া শেষে একজন অপরজনকে বলবে: ‘তাকাব্বালাহু মিন্না ও মিনকুম’ (আল্লাহ্‌ আমাদের ও আপনাদের নেক আমলগুলো কবুল করে নিন) এবং “আহালাহুল্লাহু আলাইক” (আল্লাহ্‌ ঈদকে আপনার জীবনে পুনরায় ফিরিয়ে আনুন) বা এ ধরণের কোন কথা। একদল সাহাবী থেকে এ ধরণের শুভেচ্ছা বর্ণিত আছে যারা এভাবে করতেন। ইমাম আহমাদ ও অন্যান্য আলেমগণ এ ধরণের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের অবকাশ দিয়েছেন। কিন্তু আহমাদ বলেন: আমি শুরুতে কাউকে শুভেচ্ছা জানাই না। যদি কেউ আমাকে শুভেচ্ছা জানায় তখন আমি তাকে জবাব দেই। কেননা শুভেচ্ছার জবাব দেয়া ওয়াজিব।পক্ষান্তরে, শুরুতে শুভেচ্ছা জানানো: এটি কোন নির্দেশিত সুন্নাহ্‌ নয় এবং নিষিদ্ধও নয়। যে ব্যক্তি তা করেন তার পূর্বসূরি রয়েছে। যে ব্যক্তি করেন না তারও পূর্বসূরি রয়েছে।(মাজমুউল ফাতাওয়া ২৪/২৫৩)
.
➤(৯). সামর্থ্য অনুযায়ী দান সদকা করা:
.
দান-সাদাক্বা করা ঈদের দিনের অন্যতম নফল ইবাদত। এদিনে দান-সাদাক্বার গুরুত্ব এত বেশি যে, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেই খুৎবা শেষ করে বেলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নিয়ে মহিলাদের সমাবেশে গেলেন ও তাদেরকে দান-সাদাক্বার নির্দেশ দিলেন। মহিলারা নেকীর উদ্দেশ্যে নিজেদের গয়না খুলে বেলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাতে দান করলেন।(সহীহ বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, হা/১৪২৯)
.
➤(১০). বিশেষ তাকবীর পাঠ করা:
.
তাকবীর পড়া এবং তা বেশি বেশি ও উচ্চস্বরে পড়া সুন্নাত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে ঈদগাহ পর্যন্ত তাকবীর দিতে দিতে যেতেন। যেমন,
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
তবে ঈদুল আযহায় যাবার সময় পথে এ তাকবীর আওয়াজ করে পড়তে থাকবে।(মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং-১১০৫)
.
➤(১১). বৈধ খেলা-ধুলা করা:
.
ঈদের দিনগুলো আনন্দ প্রকাশ করা দ্বীনেরই প্রতীক।ঈদের দিন কেউ চাইলে বৈধ খেলাধুলা করতে পারে। যেমন: পরিবারকে নিয়ে কোন স্থল ভ্রমণ বা নৌ-ভ্রমণে যাওয়া, সুন্দর সুন্দর স্থানগুলো পরিদর্শন করা বা এমন কোন স্থানে যাওয়া যেখানে বৈধ খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে‑ এসবে কোন আপত্তি নেই। অনুরূপভাবে মিউজিকমুক্ত নাশিদ শুনতেও বাধা নেই।(বিস্তারিত জানতে সহীহ বুখারী ৯৮৭, ৩৫২৯, মুসলিম ৮৯২, নাসায়ী ১৫৯৩, ইবনু হিব্বান ৫৮৭৬) আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যাতে এসেছে যে: ঈদের দিনগুলোতে পরিবার ও সন্তানদের জন্য নানা মাধ্যমে চিত্ত বিনোদন দেওয়া এবং ইবাদতের ক্লান্তি ও ক্লেশ থেকে শরীরকে আরাম দেওয়ার ক্ষেত্রে উদার হওয়া শরিয়ত স্বীকৃত। অনুরূপভাবে ঈদ-উৎসবে আনন্দ প্রকাশ করা ইসলামী নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। ঈদের দিনগুলোতে খেলাধুলা করা বৈধ; সেটা মসজিদের ভেতরে হোক কিংবা মসজিদের বাহিরে হোক। যেহেতু আয়েশা (রাঃ) এর হাদিসে হাবাশার লোকদের অস্ত্র নিয়ে খেলাধুলা করা উদ্ধৃত হয়েছে।(আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যাতে,১৪/১৬৬)
.
(১২). বাড়তি খাবার-দাবারের আয়োজন:
.
বাড়তি খাবার-দাবার ও ভাল খাবার-দাবার খেতে কোন অসুবিধা নেই। সেটা নিজ বাসায় হোক কিংবা বাসার বাহিরে কোন রেস্টুরেন্টে হোক। তবে, যে সব রেস্টুরেন্টে মদ সরবরাহ করা হয় কিংবা যে রেস্টুরেন্ট মিউজিকের ধ্বনিতে প্রকম্পিত এমন রেস্টুরেন্টে নয়। কিংবা যেখানে বেগানা পুরুষেরা নারীদেরকে দেখতে পায় সেখানেও নয়।

কোন কোন দেশের ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে: স্থল ভ্রমণ বা নৌ-ভ্রমণে বের হওয়া। যাতে করে ঐ স্থানগুলো থেকে দূরে থাকা যায় যেখানে নারী-পুরুষের বেপরোয়া মেলামেশা ঘটে থাকে কিংবা শরয়ি বিধানগুলো লঙ্ঘনের মহোৎসব যেখানে চলে।নুবাইশা আল-হুযাইলি (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তাশরিকের দিনগুলো পানাহার ও আল্লাহ্‌র যিকির দিন।(সহিহ মুসলিম হা/১১৪১)
.
➤(১২). ঈদের দিনগুলোতে দায়িত্বশীলগণ তাদের পরিবারের ওপর উদারতা প্রকাশ করবেন যাতে পরিবারে সদস্যরা চিত্তবিনোদন ও আনন্দোৎসব করতে পারে।
.
➤(১৩). ঈদের মাঠে কুরবানী করা:
.
কুরবানী ঈদগাহের মাঠে করা মুস্তাহাব বা ভাল আর হিকমাত হলঃ দরিদ্র ও ফকীররা যেতে পারে এবং কুরবানীর গোশ্‌ত (গোশত/গোস্ত/গোশত) গ্রহণে অংশীদার হতে পারে। কারও মতে কুরবানী হল সাধারণ নৈকট্য। সুতরাং প্রকাশ করাই উত্তম। কেননা সেখানে সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করা হয়।(সহীহ বুখারী ৫৫৫২, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৯১১৯। মিশকাত,১৪৩৮)
.
⛔➤ঈদের দিন বর্জনীন কাজ:
_____________________________
➤(১). ঈদের দিনকে কবর যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া এবং কবরে গিয়ে দলবদ্ধভাবে দু’হাত তুলে মুনাজাত করা শরী‘আত সম্মত নয়। তবে নিদিষ্ট না করে যেকোন দিন সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকে নিজে নিজে দো‘আ পড়বে। এক্ষণে কারো যদি ঈদের দিন বা জুম‘আর দিন ব্যতীত অন্য দিন কবর যিয়ারতের সময় না হয়, তবে সেক্ষেত্রে তিনি করতে পারেন। জানা আবশ্যক যে, জুম‘আর দিন কবর যিয়ারতের বিশেষ কোন ফযীলত নেই।(বিন বায,মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/৩৩৬; উছায়মীন, আল-লিক্বাউশ শাহরী ৮/২)।

➤(২). উভয় ঈদের দিন সিয়াম পালন করা নিষিদ্ধ- হারাম। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহার দিন ছিয়াম পালন করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী হা/১৯৯১, মুসলিম হা/১১৩৭, মিশকাত হা/২০৪৮)।
.
➤(৩). এছাড়া আইয়্যামে তাশরীক্ব তথা ঈদুল আযহার পরবর্তী তিনদিনও সিয়াম পালন নিষিদ্ধ। (মুসলিম হা/১১৪১, মিশকাত হা/২০৫০; আবুদাঊদ হা/২৪১৯)। তবে কুরবানীদাতার জন্য ঈদের দিন কুরবানীর গোশত খাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত না খেয়ে থাকা সুন্নাত। (তিরমিযী হা/৫৪২, মিশকাত হা/১৪৪০)।
.
➤(৪). ঈদুল আযহার সালাতের পূর্বে কুরবানী না করা: যে ব্যক্তি সালাতের আগে যবেহ করেছে সে যেন এর পরিবর্তে (সালাতের পরে) আর একটি যবেহ করে। আর যে ব্যক্তি আমাদের সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায়ের পূর্ব পর্যন্ত যবেহ করেনি সে যেন (সালাতের পর) আল্লাহর নামে যবেহ করে।এটাই প্রকৃত কুরবানী।(সহীহ: বুখারী ৫৫০০; মুসলিম: ১৯৬০; মিশকাত: ১৪৩৬)
.
➤(৫). অমুসলিমদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক পরিধান করা ও আচার-আচরণ না করা:প্রিয় নবী সাঃ বলেন যে কেউ অন্য জাতির অনুসরণ করবে সে সেই কওমের (বা ধর্মের) লোক বলে বিবেচিত হবে।’’ (আবূ দাউদ: ৪০৩১)
.
➤(৬). ছেলেরা মেয়েদের এবং মেয়েরা ছেলেদের বেশ ধারণ না করা:কারণ এ ধরনের ছেলে ও মেয়েদেরকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। (সহীহ বুখারী ৫৮৮৪)
.
➤(৭). বেগানা নারী পুরুষ একত্রে দেখা সাক্ষাৎ না করা।(তিরমিযী হা/২১৬৫; মিশকাত হা/৩১১৮)।
.
➤(৮). মহিলাদের বেপর্দা ও খোলামেলা অবস্থায় রাস্তাঘাট ও বাজার বন্দরে চলাফেলা না করা:যে সকল মেয়েলোক যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ মানুষের মত থাকবে, অন্য পুরুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করবে, এরা জান্নাতের সুগন্ধিও তারা পাবে না যদিও জান্নাতের সুগন্ধী বহুদূর থেকে পাওয়া যায়। (সহীহ মুসলিম: ২১২৮)
.
➤(৯). গানবাদ্য করা ও সিনেমা-নাটক না দেখা: কারন গান ও বাদ্যযন্ত্র শরী‘আতে নিষিদ্ধ। এটা সম্পূর্ণ হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
আমার উম্মাতের মধ্যে এমন একদল লোক থাকবে যারা যেনা-ব্যভিচার, রেশমী পোশাক পরিধান, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল (বৈধ) মনে করবে। (বুখারী: ৫৫৯০)
.
ঈদুল আযহার মূল আহ্বান হলো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক হতে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজূ হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ ও স্ত্রীর মহব্বত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি আত্মসমর্পণ করে দেওয়াই হলো ঈদুল আযহার মূল শিক্ষা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর, তাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (আল-মুমতাহিনা, ৬০/৪-৬)।

পরিশেষে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করছি। হে আল্লাহ! দেশে দেশে মহামারি করোনার কবল থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করো। ঈদুল আযহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝে সবাইকে উৎসবটি পালন করার তাওফীক্ব দাও- আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।