যাকাতুল ফিতর কাদের উপর ও কখন ফরজ হয় এবং বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী ফিতরা কখন আদায় করতে হয়

রামাদানের সর্বশেষ দিন সূর্যাস্থের পর অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের রাত ও ঈদের দিনে একজন মুসলিমের কাছে তার নিজের ও তার দায়িত্বে যাদের ভরণপোষণ অর্পিত তাদের খাদ্যের চেয়ে অতিরিক্ত এক সা’ (প্রায় ৩ কেজি) বা তদুর্ধ পরিমাণ খাবার থাকে তাহলে তার উপর সদাকাতুল ফিতর ফরয। যাকাতুল ফিতর আবশ্যক হওয়ার সময় রামযানের শেষ দিনের সূর্যাস্তের পর এজন্য নির্ধারণ করা হয়েছে যে, তখন থেকে ফিতর তথা খাওয়ার মাধ্যমে রমযানের সিয়াম সমাপ্ত হয়। এ কারণেই একে রমযানের যাকাতুল ফিতর বা সিয়াম ভাঙ্গার যাকাত বলা হয়। এতে বুঝা গেল যে, ফিতর তথা সিয়াম শেষ হওয়ার সময়টাই যাকাতুল ফিতর ফরজ হওয়ার সময়। সুতরাং রমাদানের সর্বশেষ দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে যদি কোন মুসলিম বিবাহ করে তাহলে তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে, কিংবা বিবাহিত কোন দম্পত্তির সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাহলে সেই সন্তানের পক্ষ থেকে, কিংবা কোন ব্যক্তি অমুসলিম থেকে মুসলিম হয় তাহলে সেই মুসলিমের নিজের পক্ষ থেকে, কিংবা কোন মুসলিম নারী-পুরুষ যুবক-বৃদ্ধ, শিশু, স্বাধীন, গোলামসহ অন্যান্যরা যদি রমাদানের শেষ দিন অর্থাৎ ঈদের রাতে সূর্যাস্তের সময় কিংবা সূর্যাস্তের এক মিনিট পূর্বেও জীবিত থাকে তাহলে উপরোক্ত সবার উপর যাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ।সুতরাং কোন মুসলিম রমাদানের শেষদিন সুর্যাস্তের এক মিনিট পূর্বে মারা গেলে কিংবা যদি কোনো শিশু সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পর ভূমিষ্ট হলে কিংবা কেউ নতুন মুসলিম হলে, কিংবা কোন নারীর পেটে বাচ্চা থাকলে, তাহলে তাদের উপর যাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ নয়। কিন্তু কেউ চাইলে ফিতরা আদায় করতে পারে ইহা মুস্তাহাব।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইবনে কুদামাহ আল মুগনী খন্ড: ২ অধ্যায়: যাকাতুল ফিতির আদায়ের সময়।ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৬৪; ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২০৭২২৫)
.
জেনে রাখা ভাল যে, যাকাতুল ফিতর ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের নির্দিষ্ট নেসাব পরিমাণ থাকা শর্ত নয়, বছর পূর্তি শর্ত নয়, যাকাতের ক্ষেত্রে আরও যে সব শর্ত প্রযোজ্য সেগুলোও শর্ত নয়। ফিতরার সাথে ব্যক্তি যা কিছুর মালিক যেমন অর্থকড়ি, স্থাবর সম্পত্তি বা গাড়ী এগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। কেননা ফিতরা ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে ও তার পরিবারের যাদের ভরনপোষণ করা আবশ্যক তাদের পক্ষ থেকে আদায় করে থাকে। দলিল হচ্ছে, আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ عَلَى العَبْدِ وَالحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيرِ وَالكَبِيرِ مِنَ المُسْلِمِينَ»‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে স্বাধীন, গোলাম, নারী, পুরুষ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের ওপর এক সা‘ খেজুর, বা এক সা‘ যব যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন।(সহীহ বুখারী হা /১৫০৩ সহীহ মুসলিম হা/২১৬৯)
.
কার উপর এবং যাকাতুল ফিতর ফরজ এমন একটি প্রশ্ন সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তারা বলেন,

كاة الفطر واجبة على كل مسلم تلزمه مؤنة نفسه إذا فضل عنده عن قوته وقوت عياله يوم العيد وليلته صاع. والأصل في ذلك ما ثبت عن ابن عمر رضي الله عنهما قال: (فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر صاعاً من تمر أو صاعاً من شعير، على العبد والحر والذكر والأنثى والصغير والكبير من المسلمين، وأمر بها أن تؤدى قبل خروج الناس إلى الصلاة) متفق عليه، واللفظ للبخاري.

ঈদের রাত ও ঈদের দিনে যার কাছে তার নিজের ও তার দায়িত্বে যাদের পোষণ অর্পিত তাদের খাদ্যের অতিরিক্ত এক সা’ বা তদুর্ধ পরিমাণ খাবার থাকে তার উপর সাদাকাতুল ফিতর ফরয। দলিল হচ্ছে এ বিষয়ে ইবনে উমর (রাঃ) থেকে সাব্যস্ত হাদিস তিনি বলেন: “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক স্বাধীন-ক্রীতদাস, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় মুসলমানের উপর যাকাতুল ফিতর বা ফিতরা ফরজ করেছেন: এক সা’ পরিমাণ খেজুর কিংবা যব। মানুষ ঈদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বেই তিনি তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন।[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম, ভাষ্যটি সহিহ বুখারীর সংক্ষিপ্ত ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৬৪)
.
◽বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী ফিতরা কখন আদায় করতে হয়?
.
শরীয়তের দলিল প্রমানের আলোকে চিন্তা ভাবনা করলে যা প্রতিমান হয় তা হচ্ছে, যাকাতুল ফিতর আদায় করার সময় দু’ধরনের। একটি সুন্নাহ তথা উত্তম সময় আর অপরটি মুবাহ তথা জায়েয সময়।

▪️(ক) যাকাতুল ফিতর আদায়ের সুন্নাহ তথা উত্তম সময়ের প্রারম্ভ সম্পর্কে চার মাযহাবের মধ্যে তিন মাযহাবের শাফিঈ, হাম্বালী, মালিকী মাযহাবত্রয়ের অধিকাংশ আলেমগণ, সালাফে সালিহীন,বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এবং সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেন, ‘রামাযানের শেষ দিনের সূর্যাস্তের পর থেকে অর্থাৎ শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার পর থেকেই ফিতরাহ আদায় করতে শুরু করা অপরিহার্য। অর্থাৎ ফিতরা আদায়ের সুন্নাহসম্মত সময় হলো শেষ রমাদানে ইফতারের পর থেকে ঈদের সালাতের জন্য ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।(বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইমাম নববী আল-মাজমু খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১২৬; ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী,খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৮৯; মুগনীউল মুহতাজ, খন্ড: ১পৃষ্ঠা: ৪০১; আল-ইনছাফ, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১২৫; শারহু মুখতাছার খালীল, খন্ড: ২পৃষ্ঠা: ২২৮; হাশিয়াতুল ‘আদাবী, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৫১৪; ফাৎহুল বারী, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৬৮; উসাইমীন আশ-শারহুল মুমতি‘,খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৬৬; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমা, খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ৩৭৩)। পক্ষান্তরে সুন্নাহ সম্মত তথা উত্তম সময়ের সমাপ্তি সম্পর্কে ইমাম নববী, ইমাম ইবনে হাযম, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম, ইমাম সানা‘আনী, ইমাম শাওকানী,ইমাম ইবনে বায ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ফিতরা আদায়ের শেষ সময় হল ঈদের সালাত পর্যন্ত। ঈদের সালাতের পর পর্যন্ত বিলম্ব করা হারাম। যদি কেউ বিলম্ব করে, সেক্ষেত্রে তা যাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে না। বরং এটি তার জন্য সাধারণ সাদাক্বা হিসাবে বিবেচিত হবে’ (আল-মাজমূ, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৪২; ইবনে হাযম; আল-মুহাল্লা, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৪২; হাশিয়াতু আর-রাওজিল মুরবি‘,খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ২৮২; ইবনুল কাইয়ুম যাদুল মা‘আদ,খন্ড: ২ পৃষ্ঠা:২১-২২; সুবুলুস সালাম,খন্ড:২ পৃষ্ঠা: ১৩৮; আস-সাইলুল জার্রার, পৃ. ২৬৬; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায,খন্ড: ১৪ পৃষ্ঠা: ২০১; উসাইমীন আশ-শারহুল মুমতি‘,খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৭২)।

এই মতের পক্ষে দলিল হচ্ছে, ইবনু উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) প্রত্যক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক সকল মুসলিমের উপর সাদাকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতে বের হবার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন (সহীহ বুখারী, হা/১৫০৩, ১৫০৪, ১৫০৬, ১৫০৭, ১৫০৮, ১৫১০, ১৫১১, ১৫১২;সহীহ মুসলিম, হা/৯৮৪-৯৮৬)। অপর বর্ননায়, ইবনু ‘আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন অশ্লীল কথা ও বেহুদা কাজ হতে সিয়ামকে পবিত্র করার লক্ষ্যে এবং মিসকীনদের খাদ্য স্বরূপ। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বে তা আদায় করবে সেটা ক্ববুল সাদাক্বাহ্ হিসাবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতের পরে আদায় করবে, তা সাধারণ দান হিসাবে গৃহীত হবে (আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭; সহীহুল জামি‘, হা/৩৫৭০)। এ হাদীসটি ইঙ্গিত করে যে, রামাযানের শেষ দিনের সূর্যাস্তের সময় থেকে সাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। কেননা তিনি সাদাক্বাকে ফিতরের (অর্থাৎ ইফতারের) সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। সুতরাং যোগসূত্রের কারণে ইফতারের সঙ্গে সাদাক্বার বিশেষীকরণ প্রয়োজন। আর এ কথা বহু প্রসিদ্ধ যে, দিনের শেষে সূর্যাস্তের পর থেকেই ইফতারের সময় শুরু হয়’ (আল-হাবীউল কাবীর, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৬২; আল-মুগনী, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৮৯; আশ-শারহুল মুমতি, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৬৬)।দ্বিতীয়তঃ ফিতরা আদায়ের কারণ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, (সিয়ামের পবিত্রকরণ) অর্থাৎ এখানে ফিতরাকে সিয়ামের পবিত্রকরণের মাধ্যম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সিয়ামের পরিসমাপ্তি ঘটে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে’ (আল-মাজমূ: খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১২৫; আল-হাবীউল কাবীর, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৬২; আল-মুগনী, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৮৯)। হাদীসটির বিশ্লেষণ হল: প্রথমতঃ যদি কেউ লোকেরা সালাত আদায় করা পর্যন্ত বিলম্ব করে, তবে সে এমন একটি কাজ করল যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ মোতাবেক নয়। আর এটিই অগ্রহণযোগ্য (আশ-শারহুল মুমতি‘,খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৭২)। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক ইবাদতের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত আছে। সুতরাং যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সময় অতিবাহিত করে ফেলে তাহলে তার ঐ ইবাদত ক্ববুল হবে না।(উসাইমীন,আশ-শারহুল মুমতি‘,খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৭৪)। তৃতীয়তঃ এটিকে কুরবানীর উপর ক্বিয়াস করা হয়েছে। যেমন কুরবানীর পশু সালাতের পূর্বে যব্হ করা যাবে না, ঠিক তেমনি যাকাতুল ফিতর সালাতের পরে আদায় করা যাবে না।(ইবনুল কাইয়ুম যাদুল মা‘আদ, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২১-২২)।
.
সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ও মুহাদ্দিস শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,

والواجب أيضاً إخراجها قبل صلاة العيد، ولا يجوز تأخيرها إلى ما بعد صلاة العيد، ولا مانع من إخراجها قبل العيد بيوم أو يومين. وبذلك يعلم أن أول وقت لإخراجها في أصح أقوال العلماء هو ليلة ثمان وعشرين؛ لأن الشهر يكون تسعًا وعشرين ويكون ثلاثين، وكان أصحاب رسول الله ﷺ يخرجونها قبل العيد بيوم أو يومين.

“ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। ঈদের নামাজের পর পর্যন্ত দেরি করে ফিতরা আদায় করা জায়েজ নয়। তবে ঈদের এক দিন বা দুই দিন পূর্বে ফিতরা বের করায় কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। এর মাধ্যমে জানা যায়, ‘আলিমদের সবচেয়ে বিশুদ্ধ মতানুসারে ফিতরা বের করার প্রথম সময় হলো ২৮শে রমজানের রাত। কেননা মাস ত্রিশে হয়, আবার ঊনত্রিশেও হয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাহাবীগণ ঈদের এক দিন বা দুই দিন পূর্বে ফিতরা বের করতেন।”(ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ২০১-২০২; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন:ফিতরা আদায় করার সময় কি ঈদের নামাযের পর থেকে সেই দিনের শেষ পর্যন্ত?

উত্তরে তারা বলেন,

لا يبدأ وقت زكاة الفطر من بعد صلاة العيد ، وإنما يبدأ من غروب شمس آخر يوم من رمضان, لا يبدأ وقت زكاة الفطر من بعد صلاة العيد، وإنما يبدأ من غروب شمس آخر يوم من رمضان، وهو أول ليلة من شهر شوال، وينتهي بصلاة العيد؛ لأن النبي صلى الله عليه وسلم أمر بإخراجها قبل الصلاة، ولما رواه ابن عباس رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: من أداها قبل الصلاة فهي زكاة مقبولة، ومن أداها بعد الصلاة فهي صدقة من الصدقات أخرجه أبو داود 2/262-263 برقم (1609)، وابن ماجه 1/585 برقم (1827)، والدار قطني 2/138، والحاكم 1/409

.ويجوز إخراجها قبل ذلك بيوم أو يومين لما رواه ابن عمر رضي الله عنهما قال: فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم صدقة الفطر من رمضان..، وقال في آخره: وكانوا يعطون قبل ذلك بيوم أو يومين. فمن أخرها عن وقتها فقد أثم، وعليه أن يتوب من تأخيره وأن يخرجها للفقراء.

“ফিতরা আদায় করার সময় ঈদের নামাযের পর থেকে শুরু হয় না; বরং রমযান মাসের সর্বশেষ দিনের সূর্য ডোবার মাধ্যমে শুরু হয়। আর সেটি হচ্ছে শাওয়াল মাসের প্রথম রাত্রি। ঈদের নামায শেষ হওয়ার মাধ্যমে ফিতরা আদায় করার সময় শেষ হয়ে যায়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের আগেই ফিতরা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি নামাযের আগে আদায় করেছে সেটা মকবুল (কবুলযোগ্য) ফিতরা। আর যে ব্যক্তি নামাযের পরে আদায় করেছে সেটা সাধারণ সদকার মত একটি সদকা।” [সুনানে আবু দাউদ; ২/২৬২-২৬৩) নং ১৬০৯, সুনানে ইবনে মাজাহ: ১/৫৮৫) নং ১৮২৭, সুনানে দারে ক্বুতনি;২/১৩৮), মুসতাদরাকে ‘হাকেম’:১/৪০৯)।

একদিন বা দুইদিন আগে ফিতরা আদায় করা জায়েয আছে। যেহেতু ইবনে উমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন: “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরা) ফরয করেছেন…”। সে হাদিসের শেষে বলেছেন: “সাহাবীরা উক্ত সময়ের একদিন বা দুইদিন আগে দিয়ে দিত।”সুতরাং যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরী করেছে সে গুনাহগার করেছে। এ দেরীর কারণে তাকে তওবা করা উচিত এবং গরীবদেরকে দিয়ে দেয়া উচিত। আল্লাহ্‌ই তাওক্বিফদাতা। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; ফাতাওয়া নং: ২৮৯৬)
.
▪️(খ) ফিতরা আদায়ের জায়েয সময় সম্পর্কে মালিকী ও হাম্বালী মাযহাবের আলেমগণ, ইমাম শাওকানী,বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, ইমাম ইবনে বায ও ইমসম মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবীগণ থেকে প্রমাণিত সময়ের একদিন অথবা দু’দিন পূর্বেও ফিতরা আদায় করা জায়েয’ কিন্তু দুই দিনের চেয়ে বেশি আগে বের করা জায়েজ নয়।কারণ ফিতরাকে ‘যাকাতুল ফিত্বর’ তথা ‘রোজা ভাঙার যাকাত’ বলা হয়। কেননা রমজানের রোজা ভাঙার কারণে ফিতরা ফরজ হয়। আর রমজানের রোজা ভাঙা বা সমাপ্ত করা হয় মাসের শেষে। সুতরাং মাস শেষ হওয়ার আগে ফিতরা বের করা ফিতরাকে আবশ্যককারী বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক। তবে সুস্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে ঈদের একদিন বা দুইদিন পূর্বে ফিতরা বের করা জায়েজ সাব্যস্ত হয়েছে। অতএব এর চেয়ে বেশি আগে বের করা যাবে না। বিস্তারিত জানতে দেখুন; মিনহুল জালীল, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ১০৬; আয-যাখীরাহ, খন্ড; ৩ পৃষ্ঠা: ১৫৭; কিফায়াতুত্ব ত্বালীব আর-রাব্বানী, খন্ড: ১পৃষ্ঠা: ৬৪৬; শারহু মুনতাহাল ইরাদাত, খন্ড: ১পৃষ্ঠা: ৪৪২; ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৮৯; আস-সাইলুল জার্রার, পৃষ্ঠা: ২৬৮-২৬৯; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, খন্ড: ১৪ পৃষ্ঠা; ৩২; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল ইবনে উসাইমীন, খন্ড: ১৮ পৃষ্ঠা: ২৭০)।
.
এই মতামতের পক্ষ দলিল হচ্ছে,সাহাবীগণের কর্ম ও রাসূল ﷺ এর যুগের আমল থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, ঈদুল ফিতরের এক দিন বা দুই দিন পূর্বে ফিতরা দেওয়ার অনুমতি আছে। যেমন;ইবনে ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) লোকেরা সালাতের উদ্দেশ্যে (ঈদগাহে) যাওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে যাকাতুল ফিতর প্রদান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। নাফি‘ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,كَانَ ابْنُ عُمَرَ يُؤَدِّيهَا قَبْلَ ذَلِكَ بِالْيَوْمِ وَالْيَوْمَيْنِ.“ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) ঈদের এক দিন ও দুই দিন পূর্বেই তা (ফিতরা) আদায় করতেন।” (আবূ দাঊদ, হা/১৬১০)। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ يُعْطِيْهَا الَّذِيْنَ يَقْبَلُوْنَهَا وَكَانُوْا يُعْطُوْنَ قَبْلَ الْفِطْرِ بِيَوْمٍ أَوْ يَوْمَيْنِ ‘আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ঈদের একদিন অথবা দু’দিন পূর্বেই ফিতরার খাদ্যদ্রব্য গ্রহীতাদেরকে দিয়ে দিতেন। (সহীহ বুখারী, হা/১৯১১; সহীহ মুসলিম, হা/৯৮৪)।
.
বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,

ويجوز أن تقدم قبل العيد بيوم أو يومين، ولا يجوز أكثر من ذلك لأنها تسمى زكاة الفطر، فتضاف إلى الفطر، ولو قلنا بجواز إخراجها بدخول الشهر كان اسمُها زكاةَ الصيام.

“ঈদের এক দিন বা দুই দিন পূর্বে ফিতরা আদায় করা জায়েজ। এরচেয়ে বেশি পূর্বে আদায় করা জায়েজ নয়। কেননা এটাকে যাকাতুল ফিত্বর বা রোযা ভাঙার যাকাত বলা হয়, আর তা ফিত্বর তথা রোযা ভাঙার দিকে সম্বন্ধিত করে বলা হয়। আমরা যদি রমজান মাস প্রবেশ করা মাত্র ফিতরা বের করা জায়েজ বলি, তাহলে এর নাম ‘যাকাতুস সিয়াম’ তথা ‘রোজার যাকাত’ (রাখাই সার্থক) হতো।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ২৭০)
.
শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেছেন,

أما لو أخرجها قبل اليومين من آخر الشهر؛ فإنها لا تجزئه؛ لأنه لم يأت وقت الوجوب؛ ولأن هذا لم يعرف عن السلف أنهم كانوا يخرجونها قبل اليومين من آخر الشهر.

“পক্ষান্তরে সে যদি মাস শেষ হওয়ার (অর্থাৎ, ঈদের) দুই দিন পূর্বে ফিতরা বের করে, তবে তা যথেষ্ট হবে না। কেননা এখনও (ফিতরা) ওয়াজিব হওয়ার সময় উপস্থিত হয়নি। আর যেহেতু সালাফদের থেকে এটা জানা যায় না যে, তাঁরা মাসের শেষদিক থেকে (অর্থাৎ, ঈদের নামায থেকে) দুই দিনের আগে ফিতরা বের করতেন।” [ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), শারহু যাদিল মুস্তাক্বনি‘; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৯৯; দারুল ‘আসিমাহ, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৪ হি./২০০৪ খ্রি. (১ম প্রকাশ। অনুবাদ: আব্দুল্লাহ মৃধা)]
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, প্রথমত: রমজান মাসের সর্বশেষ দিন সূর্যাস্থের পর অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের রাত ও ঈদের দিনে একজন মুসলিমের কাছে তার নিজের ও তার দায়িত্বে যাদের ভরণপোষণ অর্পিত তাদের খাদ্যের চেয়ে অতিরিক্ত এক সা’ (প্রায় ৩ কেজি) বা তদুর্ধ পরিমাণ খাবার থাকে, তাহলে তার উপর সদাকাতুল ফিতর ফরয। দ্বিতীয়ত: যাকাতুল ফিতর আদায় করার উত্তম সময় হল, ঈদের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকে ঈদগাহে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। তবে প্রয়োজনে ঈদের এক দিন বা দুই দিন আগে ফিতরা দেওয়া জায়েজ আছে, তবে ঈদের দুই দিনের চেয়ে বেশি আগে ফিতরা আদায় করা জায়েজ নয়। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
__________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।