বারসিসার কাহিনী যেভাবে শয়তান মানুষকে ধোঁকা দেয়

বনী ইসরাইলের সময় এক ছোট্ট গ্রামে বারসিসা নামে অত্যন্ত ধার্মিক এক ব্যক্তি ছিল। তাকে সন্ন্যাসী বলা যেতে পারে। সে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করত এবং বিশ্বাস করত যে ঈসা আলাহিসসালাম আল্লাহর একজন রাসুল।*

সেই গ্রামে তিন ভাই ও এক বোন থাকতো । সেই ভাইদের জিহাদের জন্য ডাকা হল । কিন্তু তারা বোনকে একা রেখে যেতে চাইল না। কার কাছে রাখবে চিন্তা করতে লাগলো। গ্রামবাসি বারসিসার কথা বলল। কারণ গ্রামের সবাই বারসিসাকে উত্তম চরিত্রবান হিসাবে জানতো । তো তারা বারসিসার কেছে গেল, যখন তার কাছে তাদের বোনকে রাখতে চাইলে সে রাজি হল না এবং বলল ‘আমি অভিশপ্ত শয়তানের কাছ থেকে পানাহ চাই।*

কারণ সে ভয় করছিল যে সে গুনাহে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। তখন শয়তান বারসিসার মনে কুমন্ত্রণা (ওয়াসওয়াসা) দিতে আসল। চালাক শয়তান জানতো যে বারসিসার মন খুবই নরম। সে কানে কানে বারসিসাকে বলল – “তারা যদি ভাল কাউকে তাদের বোনের জন্য খুঁজে না পায় এবং খারাপ কারো কাছে মেয়েটিকে রেখে যায় তখন কি হবে ! এই পরিণতি কি তোমার ভুলের জন্য নয়?”

বারসিসা বুঝতে পারেনি যে এটা শয়তানের কুমন্ত্রণা। মানুষের প্রতি দরদের কারনে মেয়েটিকে সে সাহায্য করতে রাজি হল।

সে মেয়েটিকে গির্জার বিপরীতে একটি ঘরে থাকতে দিল। গির্জার সামনে মেয়েটির জন্য খাবার রেখে আসত, মেয়েটি নিজে এসে খাবার নিয়ে যেত। বারসিসার সাথে তার দেখা হত না।

শয়তান বারসিসার কাছে আবার আসল এবং বলল, “তুমি কেন মেয়েটির খাবার তার ঘরের সামনে রেখে আসো না? এর ফলে মেয়েটাকে ঘর থেকে কেউ এতটা পথ একা একা হেঁটে বের হতে বা ফিরে যেতে দেখবে না!”

বারসিসা রাজি হল এবং মেয়েটির ঘরের সামনে খাবার রেখে আসতে শুরু করল। শয়তান এতেও খুশি হল না, সে আবার আসলো এবং কানে কানে বলল – ‘কেন তুমি তার ঘরে ভিতরে খাবার দিয়ে আসো না? ফলে মানুষ তাকে ঘর থেকে একা একা বের হতে আর ঢুকতে দেখত না!’ এবার বারসিসা তার ঘরের মধ্যে খাবার দিয়ে আসতে শুরু করল। শয়তান আবার আসলো এবং বলল – ‘মেয়েটার সাথে তোমার কথা বলা উচিত ,এভাবে একা থাকলে তো সে পাগল হয়ে যাবে’। বারসিসা মেয়েটির কথা চিন্তা করে তার সাথে রুমের আড়ালে কথা বলতে শুরু করল ।

শয়তানের কুমন্ত্রণায় এক সময় তারা একই রুমে কথা বলতে লাগল।

এভাবে শয়তান তার কাজের কঠিন অংশ বাস্তবায়ন করল। এই পর্যায়ে বারসিসা এবং মেয়েটা একে অপরের প্রতি দুর্বল হল এবং এক সময় ব্যভিচারে লিপ্ত হল। মেয়েটি গর্ভবতী হল , একটি বাচ্চা জন্ম দিল। বাচ্চা জন্মের সময় শয়তান বারসিসার কাছে আবার আসল এবং বলল, “এটা তুমি কি করলে? তোমার পাপের প্রমাণ সরিয়ে ফেল, না হলে মেয়েটির ভাইরা ফিরে আসলে তোমাকে খুন করবে!”

বারসিসা বাচ্চাটিকে খুন করল এবং ঐ ঘরের মেঝেতে পুতে ফেলল।

শয়তান এবার বলল , “তুমি এক নারীর সন্তান হত্যা করেছ এবং আশা করছ যে সে এটা কাউকে বলবে না?”

তখন বারসিসা মেয়েটিকেও খুন করল এবং তাকেও ঐ ঘরের মেঝেতে পুতে রাখল। মেয়েটির ভাইরা ফিরে আসলে তাদেরকে একটা মিথ্যা কবর দেখিয়ে বলল “তোমাদের বোন অসুখে মারা গিয়েছে এবং ঐ কবরে দাফন করা হয়েছে”। তারা বারসিসার কথা বিশ্বাস করল।

সেই রাতে শয়তান তিন ভাইকে একই স্বপ্ন দেখাল যে “বারসিসা তোমাদের বোনকে হত্যা করেছে, প্রমান হিসাবে তোমাদের বোন যে ঘরে থাকত তার মেঝে খুঁড়ে দেখতে পারো”। ঘুম ভাঙ্গলে তারা একে অপরকে স্বপ্নের কথা বলল এবং বুঝতে পারল তারা তিনজন একই স্বপ্ন দেখেছে।

যাচাই করার জন্য তারা বারসিসার এলাকায় যেয়ে প্রথমে বারসিসার দেখানো কবর খুঁড়ল, দেখল কিছু নেই, এর পর যে ঘরে তাদের বোন থাকত তারা ঐ ঘরের মেঝে খুঁড়ে তাদের বোনের এবং বাচ্চার লাশ পেল। তারা বারসিসাকে ধরল এবং বলতে বাধ্য করলো আসলে কি হয়েছিল।

তারপর তারা তাকে রাজার কাছে নিয়ে গেলে রাজা তাকে শিরচ্ছেদ করতে আদেশ দিল। যখন বারসিসাকে শিরচ্ছেদ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন শয়তান কাছে আবার আসল। এবার ওয়াসওয়াসা না, মানুষের রূপ নিয়ে সে আসল। এসে বলল, “শুনো বারসিসা, আমি হলাম শয়তান, তোমার এই অবস্থা তোমার নিজের চিন্তায় হয়নি, আমিই করেছি আর একমাত্র আমিই তোমাকে বাঁচাতে পারি যদি তুমি আমার কথা মেনে চল।” বারসিসা বলল, “আমাকে কি করতে হবে?”

শয়তান বলল” আমাকে সেজদা কর আমি তোমাকে রক্ষা করবো” তো বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে বারসিসা শয়তানকে সিজদা করল এবং কাফের হয়ে গেল। সিজদা করার সাথে সাথে শয়তান তাকে বলল – ‘আমি এখন তোমার থেকে মুক্ত। আমি আল্লাহকে ভয় করি যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক’। এই বলে শয়তান সেখান থেকে পালালো , এবং বারসিসার শিরচ্ছেদ করা হল। কেয়ামতের দিন বারসিসাকে যখন জীবিত করা হবে তখন সে শয়তানকে সিজদা করতে করতে উঠে দাঁড়াবে!

দেখুন শয়তান কিভাবে বারসিসাকে ফাঁদে ফেলেছিল। সে এসেছিল বন্ধুর বেশে, ভালো ভালো কথা বলতে আর আপাত:দৃষ্টিতে ভালো কাজে উৎসাহ দিতে, কিন্তু আসলে সে ছিলো সবচেয়ে বড় শত্রু!

আল্লাহ বলেন,

তাদের দৃষ্টান্ত শয়তান যে মানুষকে বলে কুফরি করো। অতঃপর যখন সে কুফরি করে , তখন শয়তান বলে: আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।

[সুরা হাশর ৫৯:১৬]

*রেফারেন্স : বইঃ নেক সুরতে শয়তানের ধোকা
(তালবিসুল ইবলিস)
লেখক : ইমাম ইবনুল জাওযী (রহ:)
হিজরী ৫০৮-৫১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণ করেন*

*ঘটনা থেকে শিক্ষাঃ*

(1)শয়তান কখনোই আপনাকে সরাসরি এসে শিরক করতে বলবে না। সে সব সময়ই আপনাকে ভালো ভালো কারণ দেখিয়ে ধোঁকায় ফেলবে, এবং শয়তান আমাদের যে কারো চাইতেই বেশী ধৈর্য্যশীল, তাই সে বার বার ফিরে আসবে। কাজেই আমরা সবসময়ই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবো শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

(2)কখনোই ভাববেন না যে আপনার অনেক জ্ঞান আছে, বিচার-বুদ্ধি আছে, শয়তান কিছুতেই আপনাকে ধোঁকায় ফেলতে পারবে না। বরং, প্রকৃত জ্ঞানীরা শয়তানের ফাঁদে পড়ার ভয় সবচাইতে বেশী করে। এই কারণেই আপনি দেখবেন আলেমদের তাকওয়া (আল্লাহভীতি) সবচাইতে বেশী।

(3) কাহিনীটা নিয়ে চিন্তা করুন। শয়তান যদি প্রথমেই এসে বারসিসাকে বলত – ‘আমাকে সিজদা কর’ – বারসিসা কখনোই তা করতো না। কিন্তু শয়তান তার পরিকল্পনা মাফিক ধীরে ধীরে একটার পর একটা ছোট ছোট ধাপে বারসিসাকে দিয়ে ভুল করিয়ে অবশেষে তাকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যে জীবন রক্ষার তাগিদে সে অবশেষে শিরক করে ফেলে, যে পাপ আল্লাহ কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।

(4) শেষ কথা, আল্লাহ যা করতে আমাদের নিষেধ করেছেন, তা থেকে আমরা বিরত থাকবো। নিজে থেকে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করব না যে – এটা করলে কি হয়? এ আর এমন কি? আল্লাহ নিষেধ করলে কি হবে দেখতে তো মনে হয় এটা একটা ভালো কাজ! এটা তো ছোট্ট একটা পাপ! না, আল্লাহর যে কোন অবাধ্যতাই পাপের পথে নিয়ে যায়, আপাত:দৃষ্টিতে পাপটা যত ছোটই হোক না কেন, ছোট পাপই বড় পাপের দিকে টানে, বড় পাপ টানে কুফরীর দিকে।

*নারী ফিতনা*

(5)খালি চোখে বারসিসার কাহিনী থেকে যে শিক্ষাটা আমাদের প্রথমে মনে আসে সেটা হল “নারী ফিতনা”। নারী ফিতনার প্রকটতা বুঝতে হলে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে কেননা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলে গেছেন

عَنْ أُسَامَـةَ بْـنِ زَيْـدٍ رَضِـيَ اللهُ عَـنْـهُمَـا عَـنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ مَا تَرَكْتُ بَـعْـدِي فِـتْـنَـةً أَضَرَّ عَلَـى الرِّجَـالِ مِنْ الـنِّـسَاءِ
(২৬১৯) উসামা বিন যায়দ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমার গত হওয়ার পরে পুরুষের পক্ষে নারীর চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর কোন ফিতনা অন্য কিছু ছেড়ে যাচ্ছি না।’’ (আহমাদ, বুখারী ৫০৯৬, মুসলিম ৭১২২, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

عَنْ أَبِىْ سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِى إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِى النِّسَاءِ
(২৬২০) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘দুনিয়া হল সুমিষ্ট ও শ্যামল। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে তাতে খলীফা বানিয়েছেন, যাতে তিনি দেখে নেন যে, তোমরা কেমন আমল কর। অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারীর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর জেনে রেখো যে, বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা যা ছিল, তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে।’’ (আহমাদ, মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১, ইবনে মাজাহ ৪০০০)

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, ‘‘কোন পুরুষ যেন কোন নারীর সাথে একান্তে গোপনে অবস্থান না করে। কারণ, শয়তান উভয়ের কুটনী হয়।’’[

শুধু তাই নয় স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে(নারীদের প্রতি)”। [সূরা নিসাঃ ২৮]

যখন এখানে নারীদের প্রতি দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে এটা বলা হয় তখন নলেজেবল ভাই বোনেরাও অবাক হন! কিন্তু তাফসীরে নারীর প্রতি দুর্বলতার কথাই বলা হয়েছে। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহর রাহে যুদ্ধকরা থেকে যেসব বিষয় মানুষকে বিরত রেখেছে তার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বলেছেন, “মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী…”। [সূরা আলে ইমরানঃ১৪]। সুবাহানাল্লাহ! আমরা যারা নিজেদের ইসলামপন্থী বলে পরিচয় দিই, ইসলামের খাতিরে ফেসবুক, ব্লগ কিংবা ভার্চুয়াল জগতে দাওয়া দিয়ে বেড়ায় খুবই দুঃখজনক সত্যি এই যে নারী ফিতনার এই হাদিস আর কুরানের আয়াতগুলো কখনো আমাদের মনে থাকেনা কিংবা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা জানিই না! দেদারছে ছেলে মেয়ে মাখামাখি, হাসি তামাশা, রসালো কমেন্ট বিনিময় করেই যাচ্ছি। আর ইনবক্সের কি অবস্থা আল্লাহই ভাল জানেন। এখন সবার সামনে আমি এত সাধু কিন্তু একটু চিন্তা করেন তো কেমন লাগবে যদি দেখেন আমি একটা নন মাহরাম মেয়েকে চোখ মারছি, ভেংচি কাটছি, মুচকি হাসি-অট্ট হাসি দিচ্ছি কিংবা কাগজে করে একটা লাল রঙের হার্টের চিহ্য একে দিলাম!! কি ভণ্ড মনে হবে না আমাকে? Exactly আমি একজন ভণ্ড বলে বিবেচিত হব।

সুবাহানাল্লাহ এই ভণ্ডামিটাই কোন রাখ ঢাক না রেখে করে যাচ্ছে আমাদের মুসলিম ভাইবোনেরা যারা নাকি আবার দাওয়াও দেন। আঙ্গুলের একটা খোঁচা দিলেই ফেসবুকের স্ট্যাটাসে, ছবিতে কমেন্ট চলে যাচ্ছে ভেংচি কাটা, চোখ মারা, অট্টহাসি, মুখ বাঁকানো ইমুশন! সুবাহানাল্লাহ! নেট জগত বলে কি নন মাহরাম আপনার জন্য মাহরাম হয়ে গেল Dear Muslims? নাকি নিজেকে সব ফিতনা থেকে নিরাপধ ভাবেন? নাকি জান্নাতের টিকেট পকেটে নিয়ে ঘুরছেন? আল্লাহু আকবর! মৃত্যু খুব নিকটেই ভাই, খুব নিকটেই! নিজের ঈমান নিয়ে সচেতন হন। এত এত ইসলামিক জ্ঞান, দাওয়া, ইবাদাত নিয়ে শেষ পর্যন্ত যেন বারসিসার মত করে মরতে না হয়! আল্লাহ রহম করুন।

(6)বারসিসার এই কাহিনী থেকে আরেকটা জিনিস লক্ষণীয়সেটা হল “Good Intention”। আমি তো ভালোর জন্যই কাজটা করছি এই সান্ত্বনা দিয়ে শয়তান আমাদের ফাঁদে ফেলে। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো শয়তান বারবার বারসিসাকে মেয়েটির ভালোর জন্য ওয়াসওয়াসা দিয়েছে। তুমি এমন না করলে মেয়েটির এই হবে, তুমি তেমন না করলে মেয়েটির সেই হবে এই ওয়াসওয়াসা। এবং বারসিসা প্রতিবার সেই ফাঁদে পা দিয়েছে আর তার ফল সে পেয়েছে অবশেষে! এই বিষয়টা খুব সূক্ষ্মভাবে আমাদের লক্ষ্য করা উচিত। আমাদের মধ্যে একটা কমন Tendency থাকে আমরা ইসলাম পালনের চেয়ে এক ধাক্কায় দাঈ হয়ে যেতে চাই। একটু আধটু জেনে মানুষজনকে ধুমাইয়া দাওয়া করে বেড়াই। সেখানে শয়তানের এসব ওয়াসওয়াসা আর নারী ফিতনার বিষয়ে কোন ধারণা না থাকায় এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার। এক মেয়ে স্ট্যাটাস দিল, “ইশ! কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে!”। ছেলে গিয়ে সেখানে চান্দের ফজিলত বর্ণনা করে বিশাল দাওয়া প্রগ্রাম শুরু করে দিল! শয়তানের ওয়াসওয়াসা কি? “আমি তো দাওয়া দিচ্ছি”। মেয়ে স্ট্যাটাস দিল ‘আমার মন খুব খারাপ”। ছেলে গিয়ে Islam এর ফতোয়ায় কমেন্ট বক্স ভরিয়ে ফেলল, মন খারাপ হলে কি করতে হবে, হতাশ হওয়া চলবেনা, জীবনে আসলে এসব ঘটেই তারপরও মুসলিমদের এই করতে হবে সেই করতে হবে! বিশাল এক শায়খ (Only for Girls)!! মেয়ে তো মহা খুশি! ‘ভাইয়া আপনি এত কিছু জানেন, সব প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে পাওয়া যায়, আপনি একটা জিনিয়াস ব্লা ব্লা ব্লা’। এখন শয়তান এই আলাপ যে ইনবক্সে নিয়ে যায়নি তার গ্যারান্টি কি!!

সুবাহানাল্লাহ! আমরা যেটা মাথায় রাখব দাওয়ার কিছু Rules and Regulations আছে। নিজে জানার এবং মানার বিষয় আছে। শয়তানের ফাঁদ নিয়ে উপলব্ধির বিষয় আছে। অনেক ভাই বোনদের আমি দেখেছি তাদের ফেসবুক পোষ্টের কমেন্ট অপশন পাবলিক থাকলেও সেখানে কোন নন মাহরাম কমেন্ট করেনা। কেন?? কেন তারা সেই সুযোগটা কখনো দেন না! আপনি একটা ফান পোস্ট দিলেন। আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে নন মাহরামনা থাকলেও কমেন্ট অপশন পাবলিক থাকার কারনে নন মাহরামরা সেখানে ফান কমেন্ট করা শুরু করল! জাহেলরা যে কায়দায় কথাবার্তা বলে অবিকল সেই কায়দায় লুতুপুতু আর ইমুশনের জোয়ার! এখানে শয়তানের সাথে আপনার বোঝাপড়া! সেই নন মাহরাম ছেলে কিংবা মেয়ে একবার কমেন্ট করবে, দুইবার কমেন্ট করবে কিন্তু যখন দেখবে আপনি তাতে কোন রেসপন্সই দিচ্ছেন না তখন সে বুঝেযা বে এবং কেটে পড়বে। কিন্তু আপনি যদি তার সমান তালে রেস্পন্স করা শুরু করেন তাহলে ঘটনা গড়াতে থাকবে এবং শয়তান আপনাদের নিয়ে খেলতে থাকবে। ফেসবুক দিয়ে উদাহরন দিলাম মাত্র এবার এটাকে বাস্তব জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন ফলাফল এক ও অভিন্ন! আপনাকে মনে রাখতে হবে শয়তান স্বভাবতই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আপনাকে আকৃষ্ট করবে তাই শয়তান যার দিকে আপনাকে আকৃষ্ট করছে তার দিকে “দাওয়ার” অজুহাত নিয়ে এগিয়ে যাবেন না! সবাইকে দাওয়া দেওয়ার জন্য আপনি Responsible নন। এটামনে করার কোন কারন নেই যে আপনি দাওয়া না নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বরং সর্বনাশটা হবে আপনি শয়তানের ফাঁদে পা দিলে। সর্বনাশ হবে আপনি ফিতনায় জড়িয়ে গেলে! শয়তানের হাতে নিজের প্রবৃত্তিকে সঁপে দেওয়ার আগেতাই খুব গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা উচিত। সামনে তো বারসিসার কাহিনী আছেই Reminder হিসেবে!

(7) সর্বশেষ একটা Lesson আমরা বারসিসার কাহিনী থেকে নিতে পারি সেটা হল বৈরাগ্য বা একাকীত্বের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হয়ে। একটুচিন্তা করুন মেয়েটি যদি বারসিসার স্ত্রী হত, কিংবা বারসিসার যদি পরিবার থাকত তাহলে হয়ত শয়তান এত সুযোগ পেত না তাকে পথভ্রষ্ট করার। একটি কথা আমার খুব ভাল লাগে আপনি একা থাকলে যা করেন সেটাই আপনার চরিত্র! একাকীত্ব শয়তানকে খুব বেশী সুযোগ করে দেয় তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার। যে কারনে দ্বীনের পথে থাকতে চাওয়া ভাই বোনদের সবসময় একটা Motivation এর মধ্যে থাকা উচিত। বারসিসার ক্ষেত্রে শয়তান এই সুযোগটা নিয়েছিল! তাকে ওয়াসওয়াসা দিয়েছিল যা বারসিসা এড়িয়ে চলতে পারেনি। একাকিত্বের সময়ের শয়তানী ওয়াসওয়াসা মানুষের তাক্বওয়ার লেভেলকেও নিচে নামিয়ে দেয় খুব সহজে। আল্লাহ ক্ষমা করুন আমাদের। আমাদের উপর রহম করুন।

শেষকথাঃ একটা বিষয় ইদানীং আমাকে খুব ভাবায় সেটা হল ইসলামের ব্যাপারটা আসলে পুরোটা উপলব্ধির! যে কারনে অনেক নলেজেবল ভাই বোনকেও দেখবেন ইসলামের অনেক কিছু জানা সত্বেও আমল করার ব্যাপারে তারা উদাসীন। সেসব ভাই বোনদের জন্য আমরা দোয়া করি যাদের অর্জিত জ্ঞান তাদের জীবনবোধের কোন পরিবর্তন করতে পারেনি। যারা কুরআন অধ্যয়ন করেছে, ইসলামের অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে আর এই জ্ঞান জাহির করে বেড়িয়েছে কিন্তু নিজের জীবনে তার কোন Reflection পড়েনি। আল্লাহর কাছে এমন ভণ্ডামি আর মুনাফেকি থেকে পানাহ চাই। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আল্লাহ আমাদের ভুলগুলো শুধরে সত্যকে আঁকড়ে ধরার তৌফিক দান করুন।

বারসিসার যে কাহিনীটা বর্ণনা করলাম এটা হয়ত অনেকেই জানেন। কিন্তু হয়ত এভাবে ভেবে দেখেননি। এখান থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাটুকু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশগুলোকে Purify করার কাজে লাগতে পারে ইনশাআল্লাহ। ভুলকে মেনে নিয়ে তার জন্য অনুতপ্ত হয় মানুষ আর ভুলের উপর অবিচল থেকে তার জন্য অজুহাত দেখায় শয়তান। আমরা আশরাফুল মাখলুকাত আমরা আমাদের ভুলের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব ইনশাআল্লাহ। এই লেখায় উপলব্ধি করার মত কিছু থাকলে আল্লাহ যেন আমাদেরকে তা উপলব্ধি করার তৌফিক দেন। যেন আমাদের পাপগুলো মুছে দেন। বিগত দিনের ভুলগুলো যেন আজকের দিনের শুদ্ধতার অনুপ্রেরণা হয় ইনশাআল্লাহ! ইসলামের শিক্ষা আর উপলব্ধি যেন আমাদের জান্নাতের পথের পথিক হতে সাহায্য করে। শয়তান যেন দুর্ভাগা বারসিসার মতো আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামের কঠিন আগুনে নিয়ে না যায়। সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য চাই। আল্লাহ রহম করুন। আল্লাহ ক্ষমা করুন। ইহদিনাস সিরাত্বাল মুস্তাকিম, আমীন।

#শিক্ষামূলক_গল্প

#বনী ইসরাইলের সময় এক ছোট্ট গ্রামে বারসিসা নামে অত্যন্ত ধার্মিক এক ব্যক্তি ছিল। তাকে সন্ন্যাসী বলা যেতে পারে। সে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করত এবং বিশ্বাস করত যে ঈসা আলাহিসসালাম আল্লাহর একজন রাসুল।*

*সেই গ্রামে তিন ভাই ও এক বোন থাকতো । সেই ভাইদের জিহাদের জন্য ডাকা হল । কিন্তু তারা বোনকে একা রেখে যেতে চাইল না। কার কাছে রাখবে চিন্তা করতে লাগলো। গ্রামবাসি বারসিসার কথা বলল। কারণ গ্রামের সবাই বারসিসাকে উত্তম চরিত্রবান হিসাবে জানতো । তো তারা বারসিসার কেছে গেল, যখন তার কাছে তাদের বোনকে রাখতে চাইলে সে রাজি হল না এবং বলল ‘আমি অভিশপ্ত শয়তানের কাছ থেকে পানাহ চাই।*

কারণ সে ভয় করছিল যে সে গুনাহে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। তখন শয়তান বারসিসার মনে কুমন্ত্রণা (ওয়াসওয়াসা) দিতে আসল। চালাক শয়তান জানতো যে বারসিসার মন খুবই নরম। সে কানে কানে বারসিসাকে বলল – “তারা যদি ভাল কাউকে তাদের বোনের জন্য খুঁজে না পায় এবং খারাপ কারো কাছে মেয়েটিকে রেখে যায় তখন কি হবে ! এই পরিণতি কি তোমার ভুলের জন্য নয়?”

বারসিসা বুঝতে পারেনি যে এটা শয়তানের কুমন্ত্রণা। মানুষের প্রতি দরদের কারনে মেয়েটিকে সে সাহায্য করতে রাজি হল।

সে মেয়েটিকে গির্জার বিপরীতে একটি ঘরে থাকতে দিল। গির্জার সামনে মেয়েটির জন্য খাবার রেখে আসত, মেয়েটি নিজে এসে খাবার নিয়ে যেত। বারসিসার সাথে তার দেখা হত না।

শয়তান বারসিসার কাছে আবার আসল এবং বলল, “তুমি কেন মেয়েটির খাবার তার ঘরের সামনে রেখে আসো না? এর ফলে মেয়েটাকে ঘর থেকে কেউ এতটা পথ একা একা হেঁটে বের হতে বা ফিরে যেতে দেখবে না!”

বারসিসা রাজি হল এবং মেয়েটির ঘরের সামনে খাবার রেখে আসতে শুরু করল। শয়তান এতেও খুশি হল না, সে আবার আসলো এবং কানে কানে বলল – ‘কেন তুমি তার ঘরে ভিতরে খাবার দিয়ে আসো না? ফলে মানুষ তাকে ঘর থেকে একা একা বের হতে আর ঢুকতে দেখত না!’ এবার বারসিসা তার ঘরের মধ্যে খাবার দিয়ে আসতে শুরু করল। শয়তান আবার আসলো এবং বলল – ‘মেয়েটার সাথে তোমার কথা বলা উচিত ,এভাবে একা থাকলে তো সে পাগল হয়ে যাবে’। বারসিসা মেয়েটির কথা চিন্তা করে তার সাথে রুমের আড়ালে কথা বলতে শুরু করল ।

শয়তানের কুমন্ত্রণায় এক সময় তারা একই রুমে কথা বলতে লাগল।

এভাবে শয়তান তার কাজের কঠিন অংশ বাস্তবায়ন করল। এই পর্যায়ে বারসিসা এবং মেয়েটা একে অপরের প্রতি দুর্বল হল এবং এক সময় ব্যভিচারে লিপ্ত হল। মেয়েটি গর্ভবতী হল , একটি বাচ্চা জন্ম দিল। বাচ্চা জন্মের সময় শয়তান বারসিসার কাছে আবার আসল এবং বলল, “এটা তুমি কি করলে? তোমার পাপের প্রমাণ সরিয়ে ফেল, না হলে মেয়েটির ভাইরা ফিরে আসলে তোমাকে খুন করবে!”

বারসিসা বাচ্চাটিকে খুন করল এবং ঐ ঘরের মেঝেতে পুতে ফেলল।

শয়তান এবার বলল , “তুমি এক নারীর সন্তান হত্যা করেছ এবং আশা করছ যে সে এটা কাউকে বলবে না?”

তখন বারসিসা মেয়েটিকেও খুন করল এবং তাকেও ঐ ঘরের মেঝেতে পুতে রাখল। মেয়েটির ভাইরা ফিরে আসলে তাদেরকে একটা মিথ্যা কবর দেখিয়ে বলল “তোমাদের বোন অসুখে মারা গিয়েছে এবং ঐ কবরে দাফন করা হয়েছে”। তারা বারসিসার কথা বিশ্বাস করল।

সেই রাতে শয়তান তিন ভাইকে একই স্বপ্ন দেখাল যে “বারসিসা তোমাদের বোনকে হত্যা করেছে, প্রমান হিসাবে তোমাদের বোন যে ঘরে থাকত তার মেঝে খুঁড়ে দেখতে পারো”। ঘুম ভাঙ্গলে তারা একে অপরকে স্বপ্নের কথা বলল এবং বুঝতে পারল তারা তিনজন একই স্বপ্ন দেখেছে।

যাচাই করার জন্য তারা বারসিসার এলাকায় যেয়ে প্রথমে বারসিসার দেখানো কবর খুঁড়ল, দেখল কিছু নেই, এর পর যে ঘরে তাদের বোন থাকত তারা ঐ ঘরের মেঝে খুঁড়ে তাদের বোনের এবং বাচ্চার লাশ পেল। তারা বারসিসাকে ধরল এবং বলতে বাধ্য করলো আসলে কি হয়েছিল।

তারপর তারা তাকে রাজার কাছে নিয়ে গেলে রাজা তাকে শিরচ্ছেদ করতে আদেশ দিল। যখন বারসিসাকে শিরচ্ছেদ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন শয়তান কাছে আবার আসল। এবার ওয়াসওয়াসা না, মানুষের রূপ নিয়ে সে আসল। এসে বলল, “শুনো বারসিসা, আমি হলাম শয়তান, তোমার এই অবস্থা তোমার নিজের চিন্তায় হয়নি, আমিই করেছি আর একমাত্র আমিই তোমাকে বাঁচাতে পারি যদি তুমি আমার কথা মেনে চল।” বারসিসা বলল, “আমাকে কি করতে হবে?”

শয়তান বলল” আমাকে সেজদা কর আমি তোমাকে রক্ষা করবো” তো বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে বারসিসা শয়তানকে সিজদা করল এবং কাফের হয়ে গেল। সিজদা করার সাথে সাথে শয়তান তাকে বলল – ‘আমি এখন তোমার থেকে মুক্ত। আমি আল্লাহকে ভয় করি যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক’। এই বলে শয়তান সেখান থেকে পালালো , এবং বারসিসার শিরচ্ছেদ করা হল। কেয়ামতের দিন বারসিসাকে যখন জীবিত করা হবে তখন সে শয়তানকে সিজদা করতে করতে উঠে দাঁড়াবে!

দেখুন শয়তান কিভাবে বারসিসাকে ফাঁদে ফেলেছিল। সে এসেছিল বন্ধুর বেশে, ভালো ভালো কথা বলতে আর আপাত:দৃষ্টিতে ভালো কাজে উৎসাহ দিতে, কিন্তু আসলে সে ছিলো সবচেয়ে বড় শত্রু!

আল্লাহ বলেন,

তাদের দৃষ্টান্ত শয়তান যে মানুষকে বলে কুফরি করো। অতঃপর যখন সে কুফরি করে , তখন শয়তান বলে: আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।

[সুরা হাশর ৫৯:১৬]

*রেফারেন্স : বইঃ নেক সুরতে শয়তানের ধোকা
(তালবিসুল ইবলিস)
লেখক : ইমাম ইবনুল জাওযী (রহ:)
হিজরী ৫০৮-৫১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণ করেন*

*ঘটনা থেকে শিক্ষাঃ*

(1)শয়তান কখনোই আপনাকে সরাসরি এসে শিরক করতে বলবে না। সে সব সময়ই আপনাকে ভালো ভালো কারণ দেখিয়ে ধোঁকায় ফেলবে, এবং শয়তান আমাদের যে কারো চাইতেই বেশী ধৈর্য্যশীল, তাই সে বার বার ফিরে আসবে। কাজেই আমরা সবসময়ই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবো শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

(2)কখনোই ভাববেন না যে আপনার অনেক জ্ঞান আছে, বিচার-বুদ্ধি আছে, শয়তান কিছুতেই আপনাকে ধোঁকায় ফেলতে পারবে না। বরং, প্রকৃত জ্ঞানীরা শয়তানের ফাঁদে পড়ার ভয় সবচাইতে বেশী করে। এই কারণেই আপনি দেখবেন আলেমদের তাকওয়া (আল্লাহভীতি) সবচাইতে বেশী।

(3) কাহিনীটা নিয়ে চিন্তা করুন। শয়তান যদি প্রথমেই এসে বারসিসাকে বলত – ‘আমাকে সিজদা কর’ – বারসিসা কখনোই তা করতো না। কিন্তু শয়তান তার পরিকল্পনা মাফিক ধীরে ধীরে একটার পর একটা ছোট ছোট ধাপে বারসিসাকে দিয়ে ভুল করিয়ে অবশেষে তাকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যে জীবন রক্ষার তাগিদে সে অবশেষে শিরক করে ফেলে, যে পাপ আল্লাহ কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।

(4) শেষ কথা, আল্লাহ যা করতে আমাদের নিষেধ করেছেন, তা থেকে আমরা বিরত থাকবো। নিজে থেকে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করব না যে – এটা করলে কি হয়? এ আর এমন কি? আল্লাহ নিষেধ করলে কি হবে দেখতে তো মনে হয় এটা একটা ভালো কাজ! এটা তো ছোট্ট একটা পাপ! না, আল্লাহর যে কোন অবাধ্যতাই পাপের পথে নিয়ে যায়, আপাত:দৃষ্টিতে পাপটা যত ছোটই হোক না কেন, ছোট পাপই বড় পাপের দিকে টানে, বড় পাপ টানে কুফরীর দিকে।

*নারী ফিতনা*

(5)খালি চোখে বারসিসার কাহিনী থেকে যে শিক্ষাটা আমাদের প্রথমে মনে আসে সেটা হল “নারী ফিতনা”। নারী ফিতনার প্রকটতা বুঝতে হলে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে কেননা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলে গেছেন

عَنْ أُسَامَـةَ بْـنِ زَيْـدٍ رَضِـيَ اللهُ عَـنْـهُمَـا عَـنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ مَا تَرَكْتُ بَـعْـدِي فِـتْـنَـةً أَضَرَّ عَلَـى الرِّجَـالِ مِنْ الـنِّـسَاءِ
(২৬১৯) উসামা বিন যায়দ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমার গত হওয়ার পরে পুরুষের পক্ষে নারীর চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর কোন ফিতনা অন্য কিছু ছেড়ে যাচ্ছি না।’’ (আহমাদ, বুখারী ৫০৯৬, মুসলিম ৭১২২, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

عَنْ أَبِىْ سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِى إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِى النِّسَاءِ
(২৬২০) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘দুনিয়া হল সুমিষ্ট ও শ্যামল। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে তাতে খলীফা বানিয়েছেন, যাতে তিনি দেখে নেন যে, তোমরা কেমন আমল কর। অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারীর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর জেনে রেখো যে, বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা যা ছিল, তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে।’’ (আহমাদ, মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১, ইবনে মাজাহ ৪০০০)

হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, ‘‘কোন পুরুষ যেন কোন নারীর সাথে একান্তে গোপনে অবস্থান না করে। কারণ, শয়তান উভয়ের কুটনী হয়।’’[

শুধু তাই নয় স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে(নারীদের প্রতি)”। [সূরা নিসাঃ ২৮]

যখন এখানে নারীদের প্রতি দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে এটা বলা হয় তখন নলেজেবল ভাই বোনেরাও অবাক হন! কিন্তু তাফসীরে নারীর প্রতি দুর্বলতার কথাই বলা হয়েছে। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহর রাহে যুদ্ধকরা থেকে যেসব বিষয় মানুষকে বিরত রেখেছে তার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বলেছেন, “মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী…”। [সূরা আলে ইমরানঃ১৪]। সুবাহানাল্লাহ! আমরা যারা নিজেদের ইসলামপন্থী বলে পরিচয় দিই, ইসলামের খাতিরে ফেসবুক, ব্লগ কিংবা ভার্চুয়াল জগতে দাওয়া দিয়ে বেড়ায় খুবই দুঃখজনক সত্যি এই যে নারী ফিতনার এই হাদিস আর কুরানের আয়াতগুলো কখনো আমাদের মনে থাকেনা কিংবা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা জানিই না! দেদারছে ছেলে মেয়ে মাখামাখি, হাসি তামাশা, রসালো কমেন্ট বিনিময় করেই যাচ্ছি। আর ইনবক্সের কি অবস্থা আল্লাহই ভাল জানেন। এখন সবার সামনে আমি এত সাধু কিন্তু একটু চিন্তা করেন তো কেমন লাগবে যদি দেখেন আমি একটা নন মাহরাম মেয়েকে চোখ মারছি, ভেংচি কাটছি, মুচকি হাসি-অট্ট হাসি দিচ্ছি কিংবা কাগজে করে একটা লাল রঙের হার্টের চিহ্য একে দিলাম!! কি ভণ্ড মনে হবে না আমাকে? Exactly আমি একজন ভণ্ড বলে বিবেচিত হব।

সুবাহানাল্লাহ এই ভণ্ডামিটাই কোন রাখ ঢাক না রেখে করে যাচ্ছে আমাদের মুসলিম ভাইবোনেরা যারা নাকি আবার দাওয়াও দেন। আঙ্গুলের একটা খোঁচা দিলেই ফেসবুকের স্ট্যাটাসে, ছবিতে কমেন্ট চলে যাচ্ছে ভেংচি কাটা, চোখ মারা, অট্টহাসি, মুখ বাঁকানো ইমুশন! সুবাহানাল্লাহ! নেট জগত বলে কি নন মাহরাম আপনার জন্য মাহরাম হয়ে গেল Dear Muslims? নাকি নিজেকে সব ফিতনা থেকে নিরাপধ ভাবেন? নাকি জান্নাতের টিকেট পকেটে নিয়ে ঘুরছেন? আল্লাহু আকবর! মৃত্যু খুব নিকটেই ভাই, খুব নিকটেই! নিজের ঈমান নিয়ে সচেতন হন। এত এত ইসলামিক জ্ঞান, দাওয়া, ইবাদাত নিয়ে শেষ পর্যন্ত যেন বারসিসার মত করে মরতে না হয়! আল্লাহ রহম করুন।

(6)বারসিসার এই কাহিনী থেকে আরেকটা জিনিস লক্ষণীয়সেটা হল “Good Intention”। আমি তো ভালোর জন্যই কাজটা করছি এই সান্ত্বনা দিয়ে শয়তান আমাদের ফাঁদে ফেলে। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো শয়তান বারবার বারসিসাকে মেয়েটির ভালোর জন্য ওয়াসওয়াসা দিয়েছে। তুমি এমন না করলে মেয়েটির এই হবে, তুমি তেমন না করলে মেয়েটির সেই হবে এই ওয়াসওয়াসা। এবং বারসিসা প্রতিবার সেই ফাঁদে পা দিয়েছে আর তার ফল সে পেয়েছে অবশেষে! এই বিষয়টা খুব সূক্ষ্মভাবে আমাদের লক্ষ্য করা উচিত। আমাদের মধ্যে একটা কমন Tendency থাকে আমরা ইসলাম পালনের চেয়ে এক ধাক্কায় দাঈ হয়ে যেতে চাই। একটু আধটু জেনে মানুষজনকে ধুমাইয়া দাওয়া করে বেড়াই। সেখানে শয়তানের এসব ওয়াসওয়াসা আর নারী ফিতনার বিষয়ে কোন ধারণা না থাকায় এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার। এক মেয়ে স্ট্যাটাস দিল, “ইশ! কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে!”। ছেলে গিয়ে সেখানে চান্দের ফজিলত বর্ণনা করে বিশাল দাওয়া প্রগ্রাম শুরু করে দিল! শয়তানের ওয়াসওয়াসা কি? “আমি তো দাওয়া দিচ্ছি”। মেয়ে স্ট্যাটাস দিল ‘আমার মন খুব খারাপ”। ছেলে গিয়ে Islam এর ফতোয়ায় কমেন্ট বক্স ভরিয়ে ফেলল, মন খারাপ হলে কি করতে হবে, হতাশ হওয়া চলবেনা, জীবনে আসলে এসব ঘটেই তারপরও মুসলিমদের এই করতে হবে সেই করতে হবে! বিশাল এক শায়খ (Only for Girls)!! মেয়ে তো মহা খুশি! ‘ভাইয়া আপনি এত কিছু জানেন, সব প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে পাওয়া যায়, আপনি একটা জিনিয়াস ব্লা ব্লা ব্লা’। এখন শয়তান এই আলাপ যে ইনবক্সে নিয়ে যায়নি তার গ্যারান্টি কি!!

সুবাহানাল্লাহ! আমরা যেটা মাথায় রাখব দাওয়ার কিছু Rules and Regulations আছে। নিজে জানার এবং মানার বিষয় আছে। শয়তানের ফাঁদ নিয়ে উপলব্ধির বিষয় আছে। অনেক ভাই বোনদের আমি দেখেছি তাদের ফেসবুক পোষ্টের কমেন্ট অপশন পাবলিক থাকলেও সেখানে কোন নন মাহরাম কমেন্ট করেনা। কেন?? কেন তারা সেই সুযোগটা কখনো দেন না! আপনি একটা ফান পোস্ট দিলেন। আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে নন মাহরামনা থাকলেও কমেন্ট অপশন পাবলিক থাকার কারনে নন মাহরামরা সেখানে ফান কমেন্ট করা শুরু করল! জাহেলরা যে কায়দায় কথাবার্তা বলে অবিকল সেই কায়দায় লুতুপুতু আর ইমুশনের জোয়ার! এখানে শয়তানের সাথে আপনার বোঝাপড়া! সেই নন মাহরাম ছেলে কিংবা মেয়ে একবার কমেন্ট করবে, দুইবার কমেন্ট করবে কিন্তু যখন দেখবে আপনি তাতে কোন রেসপন্সই দিচ্ছেন না তখন সে বুঝেযা বে এবং কেটে পড়বে। কিন্তু আপনি যদি তার সমান তালে রেস্পন্স করা শুরু করেন তাহলে ঘটনা গড়াতে থাকবে এবং শয়তান আপনাদের নিয়ে খেলতে থাকবে। ফেসবুক দিয়ে উদাহরন দিলাম মাত্র এবার এটাকে বাস্তব জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন ফলাফল এক ও অভিন্ন! আপনাকে মনে রাখতে হবে শয়তান স্বভাবতই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আপনাকে আকৃষ্ট করবে তাই শয়তান যার দিকে আপনাকে আকৃষ্ট করছে তার দিকে “দাওয়ার” অজুহাত নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে।।