উসূলে ফিকহর পরিচয় ও প্রয়োগ পদ্ধতি

উসূলে ফিকাহর সংজ্ঞা : উসূল শব্দটি আসল এর বহুবচন। শাব্দিক অর্থ মূল বা ভিত্তি অর্থাৎ যে বস্তুর উপর অন্য বস্তুর ভিত্তি স্থাপন করা হয় তাকে বলে আসল। ফিকাহ শব্দের অর্থ জ্ঞান, বুৎপত্তি, পারিভাষিক অর্থ ইসলামী শরিয়াত সম্পর্কিত জ্ঞান, গবেষণার সাহায্যে ইসলামী শরীয়াতের বিধানসমূহ তার উৎস থেকে নির্গত করার শাস্ত্র, এক কথায় ইসলামী আইনের সমষ্টি। অতএব উসূলে ফিকাহ অর্থ আইন শাস্ত্রের ভিত্তি আইনের মূলনীতি, আইনতত্ত্ব। মুহিবুল্লাহ ইবনে আবদুশ শাকুর বিহারী (মৃ.১১১৯ হি/১৭০৭ খৃ.) উসূলে ফিকাহ এর নিম্নোক্ত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যে নীতিমালার জ্ঞান ফিকাহ শাস্ত্রের আইনসমূহ দলীল প্রমাণ দ্বারা উদঘাটন করতে সাহায্য করে তাকে উসূলে ফিকাহ বলে।

বাদরান আবুল আয়নায়ন তাঁর উসূলুল ফিকাহ গ্রন্থে নিম্নোক্ত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, উসূলে ফিকাহ এইরূপ কতগুলো মূলনীতি এবং প্রতিপাদ্যের সমষ্টি যেগুলোর সাহায্যে বিস্তারিত দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে শরীয়াতের ব্যবহারিক বিধান নির্গত (ইসতিম্বাত) করা হয়। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর আল মাহসূল ফী ইলমী উসূলিল ফিকাহ গ্রন্থে বলেন যে শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে সামগ্রিকভাবে ফিকাহ শাস্ত্রের সকল শাখা সম্পর্কে এবং তার অনুকূলে প্রদত্ত দলীল প্রমাণ, তার অবস্থা ও তা প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায় তাকে উসূলে ফিকাহ বলে। [ফখরুদ্দীন আল রাযী প্রণীত আল মাহসূল ফী ইলমী উসূলিল ফিকাহ, ড. তাহা জাবির আল আলওয়ানী, রিয়াদ, ইমাম ইবনে সাউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্পাদিত, ১ম সংস্করণ ১৩৯৯, ১ম খন্ড, পৃ.৯৪]

উসূলে ফিকাহর বিষয়বস্তু : শরীয়াহর মূল উৎসসমূহ থেকে প্রাপ্ত দলীল প্রমাণসমূহ এবং কিভাবে ঐ সকল দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে ইজতিহাদের মাধ্যমে আইন বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে কিংবা দলীল প্রমাণ বর্ণনায় পরস্পর বিরোধী বক্তব্য থাকা সত্বেও কিভাবে অগ্রাধিকার নির্বাচন করা হয়েছে সে সকল বিষয় অধ্যয়নই উসূলে ফিকাহর বিষয়বস্তু। [আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে, শরীয়হ ফ্যাকাল্টির অধ্যাপকবৃন্দ কর্তৃক উসূলে ফিকাহ বিষয়ে প্রণীত টিকাসমূহ দেখুন, শিক্ষাবর্ষ ১৩৮২/১৯৬৩, পৃ.২২]

উসূলে ফিকাহর উপকারিতা : যাঁরা ইজতিহাদ করার যোগ্যতা রাখেন এবং যারা আইনদাতা (আল্লাহ তায়ালা) কর্তৃক নাযিলকৃত দলীল প্রমাণ অনুসারে ইজতিহাদ করার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ করতে পারেন, তাঁরা উসূলে ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে শরীয়াহ সম্পর্কিত রায় বা সিদ্ধান্ত প্রদানে সক্ষম হবেন। যাঁরা ইজতিহাদ করতে সক্ষম নন তাঁরাও উসূলে ফিকাহ অধ্যয়ন করে উপকৃত হতে পারেন। মুজতাহিদগণ (যাঁরা ইজতিহাদ করেছেন) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মাযহাব তথা আইন সম্বন্ধীয় মৌলিক চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হতে পারেন। তিনি এগুলো বিশ্লেষণ করে এবং প্রয়োজনে মুজতাহিদগণ প্রদত্ত ব্যাখ্যাসমূহের মধ্য থেকে যে কোনটি বেচে নিতে বা অগ্রাধিকার নির্বাচন করতে পারবেন। উপরন্তু তারা সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুজতাহিদগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে আইন সম্পর্কীয় নিজস্ব মুক্তিও খাড়া করতে পারবেন।

যে সকল বিজ্ঞান থেকে উসূলে ফিকাহ তাত্ত্বিক ভিত্তি লাভ করেছে : মূলতঃ উসূলে ফিকাহ জ্ঞানের একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র শাখা। অবশ্য এই জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে বিবেচ্য কতগুলো মৌলকথার (মুকাদ্দিমাহ) উপর প্রতিষ্ঠিত, যার জ্ঞান ছাড়া ইসলামী আইনবিদগণ এক পাও অগ্রসর হতে পারেন না। এ মৌলকথাগুলো এসেছে জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস থেকে। যেমন-

এক.কিছু কিছু মৌলকথা এসেছে এ্যরিষ্টটলীয় তর্কশাস্ত্র থেকে, যা সাধারণত ধর্ম দর্শনের লেখকগন। (মুতাকাল্লিমুন) তাঁদের লেখার ভূমিকা হিসেবে বর্ণনা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁরাতাঁদের লেখার ভূমিকা হিসেবে বর্ণনা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁরা তাঁদের এ সকল তাত্ত্বিক আলোচনার শব্দার্থ থেকে তাৎপর্য বিশ্লেষণ করার নিয়মাবলী, ভূত ও ভবিষ্যতের ভিত্তিতে বিষয় বিন্যাস, বিষয়ের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যয়মূলক নীতিমালা প্রণয়ন এবং সে অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা ও প্রকরণ নিরূপণ, আরোহ পদ্ধতিতে যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে উপসংহারের বৈধতা দাবি ও যুক্তি প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করতেন এবং কিভাবে এগুলোকে যুক্তিদাতার দাবির সমর্থনে ব্যবহার করা হয়েছে, অথবা বিরোধ যুক্তিসমূহ খণ্ডন করা হয়েছে ইত্যাদি উল্লেখ করতেন।

দুই. কিছু কিছু মৌলকথা এসেছে ইলমুল কালাম বা ধর্মতত্ত্বের সূক্ষ আলোচনা থেকে। তাঁরা তাঁদের আলোচনায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হাকিমের (আল্লাহ তায়ালা) বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত প্রশ্নের অবতারণা করেন। এভাবে সত্য এবং মিথ্যা কিভাবে নিরূপিত হবে, শরীয়াহ যুক্তি নির্ভর কি না, ওহীর জ্ঞান ব্যতিরেকে কেউ সত্য বা মিথ্যা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারেন কি না, বা সর্বপ্রকার নিয়ামতদাতা সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপণ করা কর্তব্য কি না এ কথা আমরা কি শরীয়াহ থেকে জেনেছি নাকি মানবীয় বুদ্ধি থেকে জেনেছি।

তিন. উসূলের আলিমগণ ভাষাতাত্বিক গবেষণার মাধ্যমে কতগুলো সাধারণ ভাষাতাত্বিক নিয়মের বিকাশ ঘটান এবং এগুলোর পরিশীলিত রূপ দান করেন তাঁরা বিভিন্ন ভাষা ও ভাষার উৎপত্তি, ভাষায় ব্যবহৃত অলংকার ও আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত শব্দের শ্রেণীবিভাগ, শব্দের ব্যুৎপত্তি, প্রতিশব্দ, অনুপ্রাস, সাধারণ অর্থে ও বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত শব্দ সম্পর্কে আলোচনা এবং বিভিন্ন অনুসর্গের বৈয়াকরণিক তাৎপর্য সম্পর্কিত গবেষণা করেন।

চার. কিছু কিছু মৌলকথা গৃহীত হয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কিত মৌলিক গ্রন্থাবলী থেকে। এ সকল গ্রন্থে একজন মাত্র বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত হাদীস (আহাদ) অথবা বহুসংখ্যক নিখুঁত বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত হাদীস (তাওয়াতুর), কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত এবং তিলাওয়াতের নিয়মাবলী, হাদীসের বর্ণনাকারীগণের গ্রহণযোগ্যতা (তাদীল) অথবা অগ্রহণযোগ্যতা (জারহ), কুরআনের কোন আয়াত বা হাদীস রহিত হওয়া সম্বলিত নীতিমালা (আন নাসিখ ওয়াল-মানসুখ), (আন নাসিখ আল মানসুখঃ কুরআনের কোন আয়াতের বিধান বা হাদীস অন্য কোন আয়াত বা একটি হাদীস অন্য একটি হাদীস দ্বারা রহিত করলে উক্ত আয়াত বা হাদীসকে নাসিখ এবং রহিকৃত আয়াত বা হাদীসকে মানসুখ বলা হয়। উসূলের এই শাখা কুরআন বা হাদীসের কোন বিধান অন্য কোন হাদীস বা কুরআনের আয়াত দ্বারা রহিত করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়েঅধ্যয়ন করে। ) হাদীসের বিষয়বস্তু এবং বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

পাঁচ. সবশেষে, উসূলবিদগণ কর্তৃক কোন বিশেষ ফিকাহ সম্পর্কে পেশকৃত যুক্তির সমর্থনে প্রদত্ত ব্যাখ্যাসমূহ এবং একই বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বিস্তারিতভাবে গৃহীত দলিল প্রমাণকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

উসূলবিদগণ নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহকে প্রাথমিকভাবে তাঁদের বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেনঃ

১. যুক্তি এবং স্বতঃসিদ্ধসমূহ। ২. ভাষাতত্ত্ব। ৩.আদেশ ও নিষেধাবলী। ৪.সাধারণ (আল আম) এবং বিশেষ বিষয়ে (আল খাস)। ৫.দ্ব্যর্থক (আল মুজমাল) এবং সুস্পষ্ট (মুবায়্যিন) প্রত্যয়সমূহ। ৬. রহিতকরণ (আন নুসখ)। ৭. কর্ম বা আমল, বিশেষত রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আমলসমূহ এবং তাঁর গুরুত্ব। ৮.ইজমা (সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত)। ৯.সুন্নাহ (আল- আখবার)। ১০.কিয়াস (সাদৃশ্যমূলক যুক্তিবাদ)। ১১.মতদ্বৈততা ও অগ্রাধিকার (তাআরুদ ওয়া তারজীহ)। ১২.ইজতিহাদ। ১৩.তাকলিদ (শরীয়াহ সম্পর্কে কোন বিশেষ চিন্তাধারার অনুসরণ)। ১৪.বিতর্কিত দলীল প্রমাণ (চারটি স্বীকৃত উৎস বহির্ভূত) [হাদীসের সহজ পরিচয়, লেখক: জিলহজ আলী]

উসূলে ফিকাহর উৎপত্তি ও বিকাশ : যে বিশাল দলীল প্রমাণের ভাণ্ডারকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে ইসলামী শরীয়াহর বাস্তব বিধি বিধান প্রণীত হয়েছে সেই ভাণ্ডার অর্থাৎ ফিকাহ শাস্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন না করে উসূলে ফিকাহ এর উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে অধ্যয়ন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।

শাব্দিক অর্থে উসূল হলো ভিত্তি বা মূল (আসল) বহুবচনে উসূলে, যার উপর ভিত্তি করে কোন কিছু নির্মাণ করা হয়। ইসলামী আইন ব্যবস্থায় ফিকাহ শাস্ত্র যে ভিত্তিমূলের (উসূল) উপর প্রতিষ্ঠিত সেগুলো নিয়েই গঠিত উসূলে ফিকাহ যাকে বাংলাভাষায় ইসলামী আইনতত্ত্ব বলা যায়। সুতরাং উসূলে ফিকাহের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে আমাদেরকে ইসলামী শরীয়াহর (তাশরী) ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হবে।

শরীয়াহর আইন প্রণয়ন করা, উক্ত আইনের সুপারিশ করা, বিধি বিধান ঘোষণা করা ইত্যাদি সবই একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাজ। কেউ যদি এ সকল কাজের এখতিয়ার আল্লাহ ছাড়া আর কারো উপর আরোপ করে, তবে তা শিরক হিসেবে গণ্য হবে এবং কার্যত তা আল্লাহর একত্বের (তাওহীদ) ধারণার সাথে বিরোধিতা করার শামিল। আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারগণের সামনে এমন বহু সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং বাস্তব নজীর পেশ করেছেন যাতে আল্লাহর নির্দেশাবলীর (আহকাম) উপকরণ পেতে কোন অসুবিধা না হয়। ইসলামী উম্মাহ এরূপ কিছু কিছু দলীল প্রমাণের বৈধতা এবং আল্লাহর নির্দেশাবলীরসাথে এগুলোর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন তাঁরা সর্বসম্মতভাবে এগুলোকে গ্রহণও করেছেন। আবার কিছু কিছু দলীল প্রমাণের ও তথ্য সূত্রের ব্যাপারে উম্মাহর মধ্যে রয়েছে মতভেদ। দুটি দলীলেরব্যাপারে সমগ্র উম্মাহ ঐকমত্য পোষণ করেন, তাদের বৈধতা সম্পর্কেও রয়েছে সর্বজনগ্রাহ্যতা। রসুলুল্লাহর (সা.) -এর সময়ে এ দুটি উৎস থেকে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। [হাদীসের সহজ পরিচয়, লেখক: জিলহজ আলী]

আইনের উৎস : ১. কুরআন : যে সকল শব্দ বা বাণী রাসূল (সা.) এর নিকট ওহী হিসেবে নাযিল হয়েছিল, যা তেলাওয়াত করা ইবাদত হিসেবে গণ্য, মানবজাতির কাছে যার সংক্ষিপ্ততম সূরার অনুরূপ সূরা রচনা করার জন্য চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করা হয়েছিল, যার প্রতিটি বর্ণ আমাদের কাছে সন্দেহাতীত ও নির্ভুল ধারাবাহিকতার মাধ্যমে (তাওয়াতুর) এসেছে, যা আমাদের নিকট এসেছে পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে (মুসহাফ), যার শুরু হয়েছে সূরা ফাতিহা (ভূমিকা) দিয়ে এবং যার শেষ হয়েছে সূরা নাস দিয়ে।

২. সুন্নাহ : কুরআন ব্যতিরেকে রাসূল (সা.) যা বলেছেন, করেছেন এবং সমর্থন করেছেন তার সবই সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত।

সুতরাং নবুয়তের শুরু থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাসূল (সা.) এর সকল কাজই হচ্ছে সুন্নাহ। সাধারণ অর্থে উম্মাহর সকল সদস্যের উপর প্রযোজ্য অথবা রাসূল (সা.) এর নিজের উপর প্রযোজ্য ইত্যাদি সব কিছুই এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

রাসূল (সা.) স্বভাবগতভাবে করেছেন এমন কোন কাজ বা অন্য যে কোন প্রকার কাজ, তাঁর সব কথা এবং সমর্থন ইত্যাদি সকল কিছুই আইন সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। হতে পারে তাঁর কোন কথা বা কাজ বা আচরণ একই সাথে আদেশ, সুপারিশ, নিষিদ্ধকরণ, অননুমোদন কিংবা অনুমোদন হিসেবে গণ্য। এ রূপও হতে পারে যে, তাঁর কোন কথা বা কাজ কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বের কোন বিধানের উপর ভিত্তি করে বলা বা করা হয়েছে, কিংবা তা নিজেই পৃথক একটি আইনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় শরীয়াহর সকল প্রকার বিধান (আহকাম) , যেমন মৌলিক কোন সিদ্ধান্ত, পর্যালোচনার ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত, মৌল আকীদাসমূহ এবং ব্যক্তিগত জীবনে অনুসরনীয় যাবতীয় বিধি বিধান উক্ত দুটি উৎস যথাক্রমে কুরআন এবং সু্ন্নাহ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।

৩. ইজতিহাদ : রাসূল (সা.) নিজে এবং শরীয়াহ সম্পর্কে অভিজ্ঞ সাহাবীগণ (আহলুন নাযার) ইজতিহাদ করেছেন। রাসূল (সা.) এর ইজতিহাদ কখনো কুরআনের আয়াত দ্বারা সমর্থিত হয়েছে আবার কখনো কখনো আল্লাহ তায়ালা আরো ভাল কোন সিদ্ধান্তদ্বারা রাসূল (সা.) কর্তৃক গ্রহীত ব্যবস্থাকে বাতিল করেছেন। সাহাবীগণ সাধারণত এরূপ পরিস্থিতিতেই ইজতিহাদ করেছেন, যখন কোন ঘটনা তাঁদেরনিজেদের জীবনেই সংঘটিত হয়েছে। এরপর তাঁরা রাসূল (সা.) এর সাথে সাক্ষাত করে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা.) কোন কোন সময় সাহাবীগনের ইজতিহাদকে অনুমোদন করেছেন, তাঁদের এরূপ সিদ্ধান্ত পরে সুন্নাহর অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। আবার রাসূল (সা.) সাহাবাগণের কোন ইজতিহাদকে অনুমোদন দান না করে সঠিক কার্যক্রম সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তাও পরবর্তী সুন্নাহরুপে পরিগণিত হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সেই পর্যায়ে শরীয়াহ সাধারণত দুই ধরনের প্রত্যাদেশের (ওহী) ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে: ক. তিলাওয়াতকৃত বা নাযিলকৃত প্রত্যাদেশ (ওহী মাতলু) অর্থাৎ অনুপম শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী (ইজায) পবিত্র কুরআন এবং  খ. তিলাওয়াত বহির্ভূত প্রত্যাদেশ (ওহী গায়র মাতলু) অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর সু্ন্নাহ।

বস্তুত রাসূল (সা.) কর্তৃক সম্পাদিত ইজতিহাদ সাহাবীগণ এবং তৎপরবর্তী যুগের মুসলমানদের জন্য অনুসরনীয় নজির স্থাপন করেছে এবং ইজতিহাদের বৈধতা প্রদান করেছে। যাতে কোন বিসয়ে কুরআন এবং সুন্নাতে সুস্পষ্ট আইনগত সিদ্ধান্ত পাওয়া না গেলে তাঁরা নিজেরাই ইজতিহাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া সম্ভবত এ ধারাকে আরো শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) তাঁর উপস্থিতিতে কয়েকজন সাহাবীকে কোন কোন বিষয়ে ইজতিহাদ করার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। এরপর তিনি কে ভুল করেছেন এবং কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তা বলে দিয়েছেন। এসব উৎসের ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের পন্থা।

কুরআনের আলোকে ব্যাকরণের সাহায্য ছাড়াই সাহাবীগণ সরাসরি কুরআন শিখেছেন এবং বুঝেছেন। অনুরূপভাবে তাঁরা তাঁদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও সাধারণ জ্ঞানের সাহায্যে আইনদাতা আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য এবং এরঅন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা খুব সহজেই উপলব্ধি করেছেন।

বস্তুত রাসূল (সা.) প্রথমতঃ নিজে কোন বিসয়ে ইঙ্গিত না করলে সাহাবীগণ কদাচিৎ কোন বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, আমি রাসূল (সা.) এর সাহাবীগনের চাইতে উত্তম মানুষ আর কখনো দেখিনি। আল্লাহ তাঁদেরকে কল্যাণ এবং শান্তি দান করুন। তিনি এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত তাঁর সমগ্র জীবনে সাহাবাগণ তাঁকে মাত্র তেরটি বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন যার সবগুলো সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপঃ তারা তোমাকে পবিত্র মাসে জিহাদ করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে (২:২২) । হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, তারা শুধুমাত্র তাদের সাথে বাস্তবিকপক্ষে যে সকল বিষয় প্রাসঙ্গিক কেবল সে সকল বিষয়ে প্রশ্ন করেন। [আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান আদ দারিমী, সুনান, ১খ, ৫১]

এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, যে ঘটনা ঘটেনিসে বিষয়ে প্রশ্ন করো না। কারণ আমি আমার পিতা উমর ইবনুল খাত্তাবকে বলতে শুনেছি, অভিশাপ তাদের উপর, যা ঘটেনি এমন বিষয়ে প্রশ্ন করে। [আদ-দারিমী, পূর্বোক্ত, ১খ, ৫০] কাসিম (রা.) বলেন, তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করা যা আমরা কখনো করিনি, এমন বিসয়ে বিতর্ক কর যা নিয়ে আমরা কখনো বিতর্ক করিনি। তোমরা এমনকি এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন কর, যেগুলোর সাথে আমি আদৌ পরিচিত নই। তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পর আমরা নীরব থাকার অনুমিতও পেতামনা। [আদ-দারিমী, ১খ, ৪৯] । হযরত ইবনে ইসহাক বলেন, আমি অন্য যে কারো অপেক্ষা রাসূল (সা.) এর অধিক সংখ্যক সাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছি। কিন্তু সহজ সরল জীবনযাপনকারী হিসেবে এবং নিজেদের ব্যাপারে সবচাইতে কম চাওয়া পাওয়ার দাবিদার হিসেবে তাঁদের মতো আর কাউকে দেখিনি। [পূর্বোক্ত, ১খ, ৫১] হযরত উবাদাহ ইবনে নুসাই আল–কিন্দী বলেন, আমি যে সকল লোকের কথা জানি, যাদের কৃচ্ছতা তোমাদের মতো এতো কঠোর ছিল না, যাঁদের প্রশ্নগুলো ছিল তোমাদের চাইতে স্বচ্ছ। (পূর্বোক্ত বরাত) । আবু উবায়াদা তাঁর মাজযুল কুরআন গ্রন্থে বলেছেন, আমি এমন কথা কখনো শুনিনি যে, পবিত্র কুরআনে কোন বিষয়ে স্পষ্টভাবে বর্ণিত থাকার পরও সাহাবীগণ সে বিষয়ে রাসূল (সা.) এর নিকট জানতে চেয়েছেন। [শেখ আলী আবদুর রাজ্জাক কর্তৃক প্রণীত তামহীদ লি তারীখিল ফালাসিফা থেকে উদ্ধৃত, পৃ.১৫২]

রাসূল (সা.) -এর কথাগুলো সুন্নাহ হিসেবে পরিগণিত সেগুলো সাহাবীগনের মাতৃভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে তাঁরা এগুলোর অর্থ বুঝতেন এবং বক্তব্য ও বিষয়বস্তু সহজে অনুধাবন করতে পারতেন। রাসূল (সা.) এর যে সকল কাজ সুন্নাহ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে তার সবগুলোই সাহাবীগণের সাক্ষাতে সংঘটিত হয়েছে। এরপর তাঁরা সেগুলো হুবহু অন্যদের নিকট বর্ণনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, রাসূল (সা.) শত শত সাহাবীর উপস্থিতিতে উযু করেছেন, এরপর সাহাবীগণ কোনরূপ জিজ্ঞাসাবাদ না করেই তা অনুরসণ করেছেন। অনুরূপভাবে উযুর মতো রাসূল (সা.) এর আরো অনেক কাজ ছিল যেগুলোর কোনটি ফরজ, কোনটি উপদেশ, আবার কোনটি নিছক অনুমতি কিংবা কোনটির বেলায় তাঁর অনুমতি পাওয়া যায়নি। তেমনিভাবে তাঁরা দেখেছেন রাসূল (সা.) কিভাবে সালাত, হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদত সমূহ আদায় করেছেন।

সাহাবীগণ দেখেছেন যে, লোকেরা রাসূল (সা.) এর নিকট কোন বিষয়ে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করছেন এবং তিনি তা বলে দিচ্ছেন, তাঁরনিকট বিচার প্রার্থনা করা হয়েছে এবং তিনি রায় প্রদান করেছেন। সাহাবীগণের নিজেদের মধ্যে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সে বিসয়ে সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছেন। এ সকল সমস্যার কোনটি হয়তো ছিল তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত আচরণ কিংবা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে। এ সকল পরিস্থিতিতে তাঁরা সকলেই ছিলেন একেকজন সাক্ষী। তাঁরা বুঝতেন বিষয়ের বা ঘটনার প্রেক্ষাপট। ফলে রাসূল (সা.) প্রদত্ত রায়ের বিচক্ষণতা বা এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ইত্যাদি কোন কিছুই তাঁদের অজ্ঞাত ছিল না। লোকেরা দেখেছে, কিভাবে রাসূল (সা.) তাঁর সাহাবী ও অন্যান্যদের আচরণ অবলোকন করেছেন। সুতরাং রাসূল (সা.) যখন কারো প্রশংসা করতেন তখন সাহাবীগণ বুঝতেন যে, ঐ ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট কাজটি ছিল ভাল। যদি তিনি কারো সমালোচনা করতেন তখন তাঁরা বুঝতেন যে, লোকটি যে কাজ করেছে তাতে কোন ভুল ছিল।

উপরন্তু রাসূল (সা.) কর্তৃক বিভিন্ন বিষয়ে প্রদত্ত যাবতীয় ফতোয়া, রায় বা সিদ্ধান্ত অনুমোদন বা অননুমোদন সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে বুঝা যায় যে, অধিকাংশ ঘটনা বহুসংখ্যক লোকের সামনে সংঘটিত হয়েছে। একজন ডাক্তারের সহকর্মী যেমন দীর্ঘদিন ডাক্তারের সাথে থেকে অভিজ্ঞতা দ্বারা বুঝতে পারে যে, কেন রোগীকে বিশেষ ঔষধটি দেয়া হয়েছে। [শাহ ওয়ালিউল্লাহ দিহলবী, হুজ্জাতুল্লাহল বাগিলা (মিসর, ) , ১খ.২৮৯। ]

সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, ঐ পর্যায়ে ইজতিহাদ বা অভিমত সম্পর্কিত ধারণা নিম্নবর্ণিত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অনেক সাহাবীর ইজতিহাদ এতোই নির্ভুল হয়েছিল যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো ওহীর মাধ্যমে কুরআন কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়েছে এবং রাসূল (সা.) সমর্থন করেছেন। নিঃসন্দেহে এটা সম্ভব হয়েছিল রাসূলের (সা.) সাথে তাঁদের অত্যধিক ঘনিষ্ঠতার ফলে। সর্বজ্ঞানী আইনদাতা মহান আল্লাহ তায়ালা যে উদ্দেশ্যে কুরআনের উক্ত আইন জারি করেছিলেন তা তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং এর বক্তব্য ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কোন সুযোগ সুবিধা সামনে আসলেই তাঁরা তা বিচার বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে উপভোগ করেননি।