ফজরের দুই রাক‘আত সুন্নত সালাত

প্রশ্ন: ফজরের পূর্বে দুই রাক‘আত সুন্নত সালাত দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু তা হতে উত্তম। আজ আমরা এই দুই রাকাআত সুন্নত সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: ফরয ব্যতীত সকল সালাতই নফল বা অতিরিক্ত। যে সকল সালাত পড়া বাধ্যতামূলক নয়, যা ত্যাগ করলে গুনাহ হয় না, কিন্তু পড়লে সওয়াব হয় সেই সকল সালাতকে শরীয়তের পরিভাষায় নফল বা অতিরিক্ত সালাত বলা হয়। নফল সালাত মূলত দুই প্রকার। যেমন:

(ক) সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ বা সুন্নাতে রাতেবাহ (খ) গায়ের মুওয়াক্কাদাহ। আর সুন্নতে মুওয়াক্কাদাহ সালাত সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত সালাত। এমনকি উক্ত সালাত ক্বাযা হলে তা ফজরের সালাতের পরেই পড়তে হয়। এই সালাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ফজরের দুই রাক‘আত সালাত দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু তা হতে উত্তম। (মুসলিম হা/১৭২১, ১/২৫১ পৃঃ; মিশকাত হা/১১৬৪, পৃঃ ১০৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৯৬, ৩/৯২ পৃঃ)। অপর বর্ননায় আম্মাজান আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের দু’ রাকআত সুন্নতের প্রতি যেরূপ যত্নবান ছিলেন, সেরূপ অন্য কোনো নফল নামাযের প্রতি ছিলেন না। (সহীহুল বুখারী ১১৬৩, মুসলিম ৭২৪, আবূ দাঊদ ১২৫৪, আহমাদ ২৩৭৫, ২৪৮৩৬ রিয়াদুস সলেহিন,১১০৮)। হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, “(ফজরের সময়) যে ব্যক্তি (স্বগৃহে) ওযু করে। অতঃপর মসজিদে এসে ফজরের (ফরয) নামাযের পূর্বে দুই রাকআত নামায পড়ে। অতঃপর বসে (অপেক্ষা করে) ফজরের নামায (জামাআতে) পড়ে, সেই ব্যক্তির সেদিনকার নামায নেক লোকদের নামাযরুপে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তার নাম পরম করুণাময় (আল্লাহর) প্রতিনিধিদলের তালিকাভুক্ত হয়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৪১৩)।

◾সুন্নাত ও নফল সালাত বাড়িতে আদায় করা উত্তম
_______________________________________
পুরুষদের জন্য ফরয ছাড়া সকল প্রকার সুন্নাত, নফল ইত্যাদি বাড়িতে পড়া অধিক উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এগুলো নিয়মিত তাঁর ঘরেই আদায় করতেন। অথচ বর্তমানে বাড়িতে সুন্নাত ও নফল সালাত আদায়ের আমলটি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, فَعَلَيْكُمْ بِالصَّلَاةِ فِىْ بُيُوْتِكُمْ فَإِنَّ خَيْرَ صَلَاةِ الْمَرْءِ فِىْ بَيْتِهِ إِلَّا الصَّلَاةَ الْمَكْتُوْبَةَ ‘বাড়িতে সালাত আদায় করাকে তোমরা নিয়ম বানিয়ে নাও। কেননা পুরুষের জন্য ফরয সালাত ব্যতীত ঘরে সালাত আদায় করা উত্তম।’ (সহীহ বুখারী, হা/৬১১৩; সহীহ মুসলিম, হা/৭৮১)।

অন্যত্র তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যখন সালাত আদায় করে, তখন সে যেন ঘরের জন্য সালাতের কিয়দাংশ রেখে দেয়। কেননা ঘরে সালাত আদায়ের ফলে আল্লাহ তাতে কল্যাণ দান করেন।’ (ইবনু মাজাহ, হা/১৩৭৬; সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৩৯২)। আব্দুল্লাহ ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করলাম, কোনটি উত্তম, আমার ঘরে সালাত আদায় করা, নাকি মসজিদে? তিনি বললেন, তুমি কি দেখ না আমার ঘর মসজিদের কত নিকটে? তা সত্ত্বেও মসজিদে সালাত আদায় করার চেয়ে ঘরে সালাত আদায় করা আমার নিকটে অধিক প্রিয়; ফরয সালাত ব্যতীত।’ (ইবনু মাজাহ, হা/১৩৭৮; সনদ সহীহ, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৪৩৯)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরও বলেন, اجْعَلُوْا فِىْ بُيُوْتِكُمْ مِنْ صَلَاتِكُمْ وَلَا تَتَّخِذُوْهَا قُبُوْرًا ‘তোমাদের ঘরেও কিছু সালাত আদায় করবে এবং ঘরকে তোমরা কবর বানিয়ে নিও না।’ (সহীহ বুখারী, হা/৪৩২, ১১৮৭)। ইমাম নববী বলেন, বাড়ীতে নফল সালাত আদায়ে উৎসাহ দানের উদ্দেশ্য এটা হতে পারে যে, সেটা গোপনে হয় এবং ‘রিয়া’ মুক্ত হয়, বাড়ীতে বরকত হয়, আল্লাহর রহমত এবং ফেরেশতা মন্ডলী নাযিল হয় ও শয়তান পালিয়ে যায়। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৩৬ পৃঃ)।

এখন কেউ যদি ফজরের দুই রাকাআত সুন্নত বাড়িতে আদায় না করে ফজরের আযানের পর মসজিদে এসে ফজরের নির্দিষ্ট সুন্নাত আদায় করে তাহলে উক্ত সালাত তাহিইয়াতুল মসজিদ ও তাহিইয়াতুল ওযূর জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য বাড়িতে সুন্নাত আদায় করে মসজিদে আসলে তাহিইয়াতুল মসজিদ আদায় করা সুন্নাত। কেননা রাসূল (ﷺ) মসজিদে এসে দু’রাক‘আত সালাত আদায় না করে বসতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/১১৬৩; শায়খ বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব ৮/১৮৯)।

◾ফজরের পূর্বে দুই রাকআত সুন্নত সালাতের ক্বিরাআত:
_______________________________________
ফজরের পূর্বে দুই রাকআত সুন্নত সালাতের প্রথম রাকআতে নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস (ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ) পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, সহীহ ৭২৬, আবূদাঊদ, সুনান ১২৫৬, তিরমিযী, সুনান ৪১৭, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৪৯)। তিনি বলতেন, “উত্তম সূরা সে দুটি, যে দুটি ফজরের পূর্বে দুই রাকআতে পড়া হয়; ‘ক্বুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন’ এবং ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৫০, ইবনে হিব্বান, সহীহ, বায়হাকী শুআবুল ঈমান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬৪৬)। আবার কখনো কখনো তিনি এই নামাযের প্রথম রাকআতে সূরা বাক্বারার ১৩৬ নং আয়াত এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা আলে ইমরানের ৬৪নং আয়াত পাঠ করতেন। (সহীহ মুসলিম,৭২৭ ইবনে খুযাইমাহ্‌)। আবার কোন কোন সময়ে প্রথম রাকআতে সূরা বাক্বারার ১৩৬নং আয়াত এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা আলে ইমরানের ৫২ নং আয়াত পড়তেন। (সুনানে আবূদাঊদ,১২৫৯)। এ ছাড়া ফজরের সুন্নত হালকা করে পড়া সুন্নত। অতএব তাতে যদি কেবল সূরা ফাতিহা পড়া যায়, তাহলেও বৈধ। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌) প্রকাশ থাকে যে, ফজরের সুন্নত পড়ার পর নির্দিষ্ট কোন দুআ পড়ার হাদীস সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৩৮-২৩৯পৃ:)।

◾ফজরের পূর্বে দুই রাকআত সুন্নত বাড়িতে আদায় করে কিছু সময় ডান কাতে শয়ন করা উত্তম:
_______________________________________
আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নবী (ﷺ) যখন ফজরের সুন্নত পড়ে নিতেন, তখন ডান কাতে শয়ন করতেন। (সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১৯০)। তিনি আরো বলেন, ‘নবী (ﷺ) ফজরের সুন্নত পড়তেন। তারপর যদি আমি ঘুমিয়ে থাকতাম তাহলে তিনি শয়ন করতেন। নচেৎ, আমি জেগে থাকলে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন।’ (সহীহ বুখারী, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত ১১৮৯)। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন ফজরের দুই রাকআত সুন্নত পড়ে নেয়, তখন সে যেন ডান কাতে শয়ন করে।” (আবু দাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, জামে ৬৪২)। সম্ভবত: উক্ত শয়ন যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদ পড়বে তার জন্য সুন্নত। যাতে একটানা নামায পড়ার পর ফরয নামায পড়ার আগে একটু জিরিয়ে নিতে পারে। পরন্তু তার জন্য সুন্নত নয়, যে একবার মাটিতে পার্শ্ব রাখলে চট করে ঘুমিয়ে পড়ে এবং তার ফলে ফজরের জামাআতই ছুটে যায়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১০০)।

তদনুরুপ উক্ত শয়ন যে ব্যক্তি বাসায় সুন্নত পড়বে তার জন্য সুন্নত ও মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে যে মসজিদে সুন্নত পড়বে তার জন্য মুস্তাহাব নয়। কারণ, মহানবী (ﷺ)-এর শয়নের কথা তাঁর বাসায় থাকা অবস্থায় উল্লেখ হয়েছে। মসজিদে সুন্নত পড়ে যে তিনি শয়ন করতেন, তার উল্লেখ নেই। ইবনে উমার উক্ত মত পোষণ করতেন। তাই মসজিদে কেউ ফজরের সুন্নতের পর শয়ন করলে তাকে কাঁকর ছুঁড়ে উঠিয়ে দিতেন। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার, ইবনে আবী শাইবা, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/১৬৬)। এই জন্যই ফজরের সুন্নতের পর মসজিদে শয়নকে অনেকে বিদআত বলে মন্তব্য করেছেন। (মু’জামুল বিদা’৩৩৭পৃ:)।

◾ফজরের দুই রাকাআত সুন্নাত সালাত আদায়কালে ফরয সালাত শুরু হয়ে গেলে করনীয় কি?
_______________________________________
সুন্নত সালাত পড়া অবস্থায় ফরজ সালাতের ইকামত শুরু হলে করনীয় কি হবে এটি মুসল্লীর অবস্থার উপর নির্ভর করবে। জামা‘আত শুরু হওয়ার পর সুন্নাত সালাত আদায়কারী যদি বুঝতে পারে যে, ইমাম রুকূতে যাওয়ার পূর্বে সে জামা‘আতে শরীক হতে পারবে এবং সূরা ফাতিহা পাঠ করতে পারবে, তাহলে সে সংক্ষেপে উক্ত সুন্নাত শেষ করে জামা‘আতে শরীক হবে। (বুখারী হা/৫৮০; মুসলিম হা/৬০৭; মিশকাত হা/৬৮৬, ১৪১২)। কিন্তু এমনটি সম্ভব না হলে অর্থাৎ ইমাম রুকূতে যাওয়ার পূর্বে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে তাহলে উক্ত সুন্নাত সালাত ছেড়ে জামা‘আতে শরীক হতে হবে (সহীহ মুসলিম হা/৭১০; মিশকাত হা/১০৫৮)। এজন্য তাকে সালাম ফিরাতে হবে না। আর ফরয সালাত শুরু হয়ে গেলে নতুনভাবে সুন্নাত সালাত শুরু করা যাবে না। (শায়খ বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/৩৮৯; উসাইমীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/১০১)।

◾ফজরের পূর্বে দুই রাকআত সুন্নত সালাতের কাযা:
_______________________________________
অন্যান্য সুন্নাতে মুআক্কাদাহ সালাতের তুলনায় ফজরের দুই রাকাআত সুন্নত সালাতের এত বেশী গুরুত্ব যে, রাসূল (ﷺ) ঘরে-সফরে তা পড়তেন এবং তা ছুটে গেলে কাযা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। একদা মহানবী (ﷺ) সাহাবাবর্গের সাথে এক সফরে ছিলেন। ফজরের নামাযের সময় সকলে গভীরভাবে ঘুমিয়ে থাকলে সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেল। সূর্যের ছটা তাঁদের মুখে লাগলে চেতন হলেন। অতঃপর একটু সরে গিয়ে মহানবী (ﷺ) বিলাল (রাঃ) কে আযান দিতে বললেন। এরপর ফজরের দুই রাকআত সুন্নত পড়লেন। তারপর ইকামত দিয়ে ফজরের ফরয পড়লেন। (সহীহ বুখারী,সহীহ মুসলিম ৬৮১)।
.
উক্ত নামায কাযা করার দুটি সময় হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ফজরের পর কোন নফল পড়া নিষিদ্ধ হলেও ফজরের আগে ছুটে যাওয়া সুন্নতকে ফরযের পর পড়া যায়। আর এটি হল ব্যতিক্রম নামায। ক্বায়েস ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা ফজরের সালাতের পর এক ব্যক্তিকে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করতে দেখলেন। তখন তিনি বললেন, ফজরের সালাত দুই রাক‘আত। তখন ঐ ব্যক্তি বলল, আমি ফজরের পূর্বের দুই রাক‘আত আদায় করিনি। তাই এখন সেই দুই রাক‘আত আদায় করলাম। অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চুপ থাকলেন। (আবুদাঊদ হা/১২৬৭, ১/১৮০ পৃঃ; মিশকাত হা/১০৪৪, পৃঃ ৯৫; তিরমিযী হা/৪২২, সনদ সহীহ)। উক্ত হাদীস প্রমাণ করে ফজরের সালাতের পরই ছুটে যাওয়া সুন্নাত পড়া যাবে। আর এক হাদীসে মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের ২ রাকআত (সুন্নত) না পড়ে থাকে, সে যেন তা সূর্য ওঠার পর পড়ে নেয়।” তিরমিযী হা/৪২৩,সিলসিলাহ সহীহাহ ২৮৩,সহীহুল জামে ৬৫৪২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।