ধর্ষণ: বর্তমান সমাজ চিত্র, কারণ ও প্রতিকার

ভূমিকা: আমাদের সমাজে অসংখ্য অন্যায়-অপকর্মের স্রোত-তরঙ্গের মাঝে ধর্ষণ বর্তমানে নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত আসছে ধর্ষণের নানা খবর। মানুষ গড়ার আঙ্গিনায় অমানুষদের হিংস্র থাবায় আমার বোন আজ ক্ষত-বিক্ষত। স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ। বাসের ড্রাইভার আর হেল্পার মিলে জন্তু-জানোয়ারের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে অসহায় নারীর উপর। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে জনসম্মুখে কুপিয়ে হত্যা কিংবা শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার মত ঘটনা দেখে জাতি স্তম্ভিত। এমনকি প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিশোধ নিতে কয়েকজন ধর্ষক গণ ধর্ষণ করার পর ফেসবুক লাইভে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠে। বাদ যায় না প্রতিবন্ধী কিংবা ছয় বছরের শিশুও৷
এই হল, আমাদের বর্তমান সমাজের নির্মম হাল-চিত্র। (আল্লাহ এ জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমিন।)
যাহোক, এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে নিম্নে ধর্ষণ সংক্রান্ত জরুরি কিছু তথ্য, ধর্ষণের প্রকারভেদ, কারণ ও ইসলামে ধর্ষণ রোধে গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ তুলে ধরা হল:
❐ বাংলাদেশ সংবিধানে ধর্ষণের সংজ্ঞা:
বাংলাদেশ সংবিধানে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলক ভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।” [বাংলাদেশ সংবিধান: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০]
অনুমতি প্রদানে অক্ষম (যেমন: কোনও অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি) এরকম কোনও ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়াও ধর্ষণের আওতাভুক্ত। ধর্ষণ শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে কখনো কখনো ‘যৌন আক্রমণ’ শব্দ গুচ্ছটিও ব্যবহৃত হয়। (উইকিপিডিয়া)
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং আঘাত পরবর্তী চাপ বৈকল্যে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ ও যৌন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির পাশাপাশি গুরুতর ভাবে আহত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ধর্ষকের দ্বারা এবং কোনও কোনও সমাজে ভুক্তভোগীর নিজ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়।
❐ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এর ৯ ধারা মতে সাজাসমুহ:
(১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
ব্যাখ্যা৷- যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত [ষোল বৎসরের] অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলক ভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা [ষোল বৎসরের] কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন৷
(২) যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৩) যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে-
(ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন;
(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৫) যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোন নারী ধর্ষিতা হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্ত রূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷ [নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ source: https://bit.ly/3kWfFOO]
❐ ধর্ষণের প্রকারভেদ: (১০ প্রকার)
ধর্ষণের নানা প্রকারভেদ রয়েছে। এগুলো থেকে নিম্নোক্ত প্রকার সমূহ সমধিক সংঘটিত হয়। যেমন:
১) ডেট ধর্ষণ
২) গণ ধর্ষণ
৩) শিশু ধর্ষণ
৪) কারাগারে ধর্ষণ
৫) ধারাবাহিক ধর্ষণ (serial rape)
৬) প্রলোভন ও প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণ
৭) হেফাজত কালীন ধর্ষণ। (যেমন: হাসপাতাল কর্মী, পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা ইত্যাদি কর্তৃক ধর্ষণ)।
৮) আন্তর্জাতিক সংঘাত বা যুদ্ধ কালীন নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও ব্যাপক হারে ধর্ষণ।
৯) চৌর্যবৃত্তিমুলক ধর্ষণ: নারী অথবা পুরুষকে অপহরণ করে এ ধর্ষণ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের যৌন দাসত্বে অথবা দেহব্যবসায় বাধ্য করা হয়।
১০) বিকৃত মস্তিষ্ক নিকটাত্মীয় কর্তৃক ধর্ষণ। যেমন: বাবা, চাচা, ভাই, দাদা ইত্যাদি রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় কর্তৃক এ ঘৃণ্য কাজটি করা হলে তাকে বলা হয় অজাচার।
❐ ধর্ষণে শীর্ষস্থানে থাকা ১০ দেশ:
ধর্ষণ অপরাধে গোটা বিশ্বে এক নম্বরে যে দেশটি অবস্থান করছে তার নাম হল, কথিত ‘সভ্য’ দেশ আমেরিকা/যুক্তরাষ্ট্র। আর ধর্ষণে শীর্ষস্থানে থাকা দশটি দেশের সবগুলোই অমুসলিম দেশ। যদিও এ সব দেশে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ আছে, নারীদের ইচ্ছামত পোশাক পরার স্বাধীনতা আছে, সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে কাজের অনুমতি আছে এবং সেখানে নারী-পুরুষের মাঝে কোন ভেদাভেদ করা হয় না।
● ১. আমেরিকা : আমেরিকার ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিস্টিক অনুযায়ী আমেরিকায় ধর্ষণের শিকার নারীর পরিসংখ্যান ৯১% এবং ৮% পুরুষ।
ন্যাশনাল ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইম্যানের সার্ভে অনুযায়ী আমেরিকার প্রতি ৬ জন মহিলার মধ্যে ১ জন ধর্ষণের শিকার।
পুরুষদের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানটা ৩৩ জনে ১ জন ধর্ষণের শিকার। এই দেশে ১৪ বছর বয়স থেকেই ধর্ষণের মত অপরাধের প্রবণতা তৈরি হয় শিশু মননে।
● ২. দক্ষিণ আফ্রিকা: সন্তান এবং শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা গোটা পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয়। এই দেশে একজন ধর্ষকের শাস্তি মাত্র ২ বছরের কারাবাস। দক্ষিণ আফ্রিকাকে বলা হয় ‘রেপ ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’।
● ৩. সুইডেন : ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে সুইডেনেই সবথেকে বেশি ধর্ষণ হয়। প্রতি বছরই প্রায় ৫৮% হারে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ে সুইডেনে।
● ৪. ভারত : ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো অনুযায়ী ২০১২ সালে ভারতের মত উন্নতশীল দেশে ধর্ষণের অভিযোগ জমা হয়েছে ২৪ হাজার ৯২৩টি। ভারতে ধর্ষণের শিকার হওয়া ১০০ জন নারীর মধ্যে ৯৮ জনই আত্মহত্যা করেন। প্রতি ২২ মিনিটে ভারতে একটি করে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়।
● ৫. ব্রিটেন : ৪ লাখ মানুষ প্রতিবছর ধর্ষণের মত ঘটনার শিকার হন ব্রিটেনে। প্রতি ৫ জন মহিলার (১৬-৫৯ বছর বয়সী) মধ্যে একজন করে ধর্ষণের শিকার হন।
● ৬. জার্মানি : এখনও পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার নারীর মৃত্যু হয়েছে জার্মানিতে। প্রতি বছর জার্মানিতে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয় ৬৫ লাখ ৭ হাজার, ৩৯৪।
● ৭. ফ্রান্স : ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের মত ঘটনা ফ্রান্সে অপরাধ বলেই মানা হত না। ফ্রান্সের সরকারী গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বছরে এই দেশে ধর্ষণের শিকার হন অন্তত ৭৫ হাজার নারী।
● ৮. কানাডা : এই দেশে এখনও পর্যন্ত লিখিত অভিযোগের (ধর্ষণ) সংখ্যা ২৫ লাখ ১৬ হাজার ৯১৮টি (এই সময় পর্যন্ত)। প্রতি ১৭ জন মহিলার মধ্যে ১ জন করে মহিলা এই দেশে ধর্ষিতা হন। যাদের মধ্যে ৬২% শারীরিকভাবে আহত হন।
● ৯. শ্রীলঙ্কা : এই দেশে অপরাধের শতাংশের বিচারে ১৪.৫ শতাংশ অপরাধ সংগঠিত হয় ধর্ষণে। ধর্ষণে অভিযুক্তদের ৬৫.৮% ধর্ষণের মত নারকীয় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকেও কোনও প্রকার অনুশোচনা তাদের মধ্যে হয় না।
● ১০. ইথিওপিয়া : এই দেশের ৬০% নারী ধর্ষণের শিকার।
(সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ)
❐ বাংলাদেশে পরিসংখ্যান:
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮ হাজার ৬৬৮টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ৪ শতাংশ আসামির সাজা হয়। বাকিদের অধিকাংশই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ২৩২২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৬ মাসে ৬ শতাধিক ধর্ষণ। ৩৭ জন হত্যা। (চ্যানেল ২৪)
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,”চলতি ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট এই ৮ মাসে দেশে অন্তত ৮৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ সকল ধর্ষিতা নারীদের মধ্যে অন্তত ৪১ জন আহত অবস্থায় মারা গেছেন এবং অপর ৯ জন আত্মহত্যা করেছেন। এতে আরও বলা হয় এ সময়কালে ১৯২ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল।” (ভয়েস অফ আমেরিকা/voabangla ডট কম)
❐ ধর্ষণ বৃদ্ধির ১৬ কারণ:
নানা কারণে ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়। তাই বিশেষ একটি কারণকে এ জন্য দায়ী বলা যাবে না। আমাদের সমাজে ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য যে সব মৌলিক কারণকে দায়ী করা যায় সেগুলো নিম্নরূপ:
১) আল্লাহর দীন থেকে দুরে সরে যাওয়া, মানুষের অন্তর থেকে আল্লাহ ভীতি উঠে যাওয়া এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।
২) জিনা-ব্যভিচারের শাস্তি সংক্রান্ত আল্লাহর বিধানকে অবমূল্যায়ন।
৩) অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। যৌন আবেদন মূলক সিনেমা, নাটক, কনসার্ট, চলচ্চিত্রে ধর্ষণের দৃশ্য উপস্থাপন, দেয়ালে দেয়ালে অশ্লীল পোস্টার, কাছে আসার গল্প মার্কা অনুষ্ঠান, অশ্লীল ম্যাগাজিন, পাঠ্য বইয়ে যৌন শিক্ষার সুড়সুড়ি, বিদেশী টিভি চ্যানেল, পর্ণ ওয়েব সাইট, ইউটিউব, ফেসবুক সহ সর্বত্র উন্মুক্ত অশ্লীলতা।
৪) পর্দা হীনতা, অশালীন পোশাক, বেপরোয়া চলাফেরা‌ এবং লাজ-লজ্জাকে নির্বাসন।
৫) আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা বা বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রিতা।
৬) বর্তমান যুবসমাজের অসুস্থ ও নোংরা মানসিকতা।
৭) স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে সহশিক্ষা চালু থাকা।
৮) কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা।
৯) পারিবারিক সুশিক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার উদাসীনতা।
১০) যুবক-যুবতীদের উপর সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব ও ধর্ষকদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ না থাকা।
১১) মদ ও নেশার ছড়াছড়ি।
১২) বেকারত্ব।
১৩) অবৈধ প্রেম—বয় ফ্রেন্ড/গার্ল ফ্রেন্ড নামক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন।
১৪) শত্রুতা এবং ক্রোধ বশত প্রতিপক্ষের নারীকে ধর্ষণ।
১৫) রাজনৈতিক কারণে ধর্ষণ।
১৬) নারীবাদী ও সেক্যুলারদের পক্ষ যুবক-যুবতীদেরকে বিয়েতে বিলম্ব করতে উৎসাহিত করণ।
❐ ধর্ষণ ঠেকাতে শুধু মানসিকতা পরিবর্তনই কি যথেষ্ট না কি আরও কিছু করণীয় রয়েছে?
নারী ধর্ষণের জন্য মানসিকতাও দায়ী এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নাই। কোন আলেম কখনোই বলেন নি যে, মানসিক পরিবর্তনের দরকার নাই। কিন্তু দ্বিমত হল, যখন আপনি বলবেন, নারীর পোশাক কোনভাবেই দায়ী নয়! সে যা মনে চায় তাই পরবে। অথবা আপনি যখন ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য নারীকে হিজাব থেকে বের করে কেবল পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তনের ওয়াজ করবেন।
একজন যুবতী মেয়ে যখন খােলামেলা পোশাক পরে, সাজগোজ করে, পারফিউম করে কোন পর পুরুষের কাছে যায় তখন সে পুরুষ যদি সুস্থ হয়ে থাকে তাহলে তার ভিতরে তোলপাড় শুরু করবে- যতই সে তার মানসিক অবস্থা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করুক না কেন। ক্রমান্বয়ে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) সে নিজের প্রবৃত্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। আস্তে আস্তে সে ‘মানসিক পরিবর্তন করার ওয়াজ’ ভুলতে শুরু করে। এটিই স্বতঃ:সিদ্ধ বাস্তবতা-যদিও দ্বিমুখী নীতির লোকেরা মুখে ভিন্ন কথা বলার চেষ্টা করুক না কেন।
এবার আসুন, দেখা যাক, নারীর ধর্ষণ ঠেকাতে ইসলাম কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?
❐ ধর্ষণ, ইভ টিজিং ও অবৈধ যৌন অপরাধ ঠেকাতে ইসলামের গৃহীত ১০টি পদক্ষেপ:
➊ ইসলাম আমাদেরকে যেমন মানসিক পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়েছে ঠিক তেমনটি মহিলাদেরকে হিজাবের নির্দেশ দিয়েছে।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ
“হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদের, তোমার কন্যাদের ও মুমিনদের নারীদের বলে দাও,
তারা যেন তাদের চাদরের একাংশ নিজেদের (মুখের) উপর নামিয়ে দেয়।” (সূরা আহযাব : আয়াত নং ৫৯)
➋ ধর্ষণ এড়াতে ইসলাম মহিলাদেরকে পরপুরুষের সাথে নির্জন স্থানে বা লোকচক্ষুর আড়ালে যেতে নিষেধ করেছে।
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ ‏”‏ ‏.‏ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ ‏”‏ الْحَمْوُ الْمَوْتُ ‏
عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلاَّ كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ
➌ পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সকলকে পর পুরুষ/নারীর দিকে চোখ পড়লে তৎক্ষণাৎ চোখ নিচু করতে নির্দেশ দিয়েছে।
➍ মহিলাদেরকে স্বামী, বাবা, দাদা, ভাই, ভাগিনা ইত্যাদি মাহরাম পুরুষ ছাড়া দূরের সফরে যেতে নিষেধ করেছে।
➎ মহিলাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে যে, প্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে কথার বলার সময় যেন কোমল কণ্ঠ পরিহার করে।
يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِىِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍۢ مِّنَ ٱلنِّسَآءِ ۚ إِنِ ٱتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِٱلْقَوْلِ فَيَطْمَعَ ٱلَّذِى فِى قَلْبِهِۦ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا
➏ জরুরি দরকারে বাইরে যাওয়ার সময় মহিলাদেরকে পারফিউম/সুগন্ধি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
( أَيُّمَا امْرَأَةٍ اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ عَلَى قَوْمٍ لِيَجِدُوا مِنْ رِيحِهَا فَهِيَ زَانِيَةٌ ) رواه الإمام أحمد (19212) والنسائي (5126) وحسنه الألباني في صحيح الجامع .
➐ ইসলাম আরও বলেছে, কারো বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে যেন অনুমতি নেয়া হয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে। অনুমতি না পেলে ফিরে যেতে হবে।
حَدَّثَنَا رَجُلٌ مَنْ بَنِي عَامِرٍ أَنَّهُ اسْتَأْذَنَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ فِي بَيْتٍ فَقَالَ : أَلِجُ ؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِخَادِمِهِ : اخْرُجْ إِلَى هَذَا فَعَلِّمْهُ الِاسْتِئْذَانَ فَقُلْ لَهُ : قُلْ السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَأَدْخُلُ ؟ فَسَمِعَهُ الرَّجُلُ فَقَالَ : السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَأَدْخُلُ ؟ فَأَذِنَ لَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَدَخَلَ .
➑ হাদিসে বিয়েতে সামর্থ্যবান যুবক-যুবতীদেরকে বিয়ে বিয়ে করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বিয়েকে সহজ করার কথা বলা হয়েছে।
➒ সর্বোপরি এতগুলো ইসলামি আইন ও বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোন বিবাহিত ব্যক্তি যদি কোন নারীকে ধর্ষণ করে তাহলে ধর্ষককে কোর্টের মাধ্যমে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ফৌজদারি দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন করা হবে। আর অবিবাহিত ব্যক্তি ধর্ষণ করলে তাকে ১০০ বেত্রাঘাত করা হবে এবং মতান্তরে তৎসঙ্গে এক বছর দেশান্তর (বর্তমানে জেল) প্রদান করা হবে।
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وقيل إن المرأة لا تُغرّب بل تُجلَد فحسب.
➓ অবৈধভাবে দুজনের সম্মতিতে হলেও উপরোক্ত বিধান কার্যকর করা হবে।
বর্তমান সমাজে আল্লাহ প্রদত্ত উপরোক্ত ইসলামী বিধানগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের কারণে চতুর্দিকে ইভ টিজিং এবং নারী-ধর্ষণের ছড়াছড়ি। ঘটছে অসংখ্য অবৈধ গর্ভপাত। নিষ্পাপ নবজাতকের লাশ ডাস্টবিনে কুকুর-বেড়ালের খাবার হচ্ছে। ঘটছে নানা হত্যাকাণ্ড। বাড়ছে অপরাধ।
সুতরাং ধর্ষণ ধর্ষণ করে চিৎকার না করে ধর্ষণ রোধের জন্য ইসলামি অনুশাসন বাস্তবায়ন করতে হবে, ইসলামি ও সু শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে, আমাদের সন্তানদেরকে নারীদের প্রতি সম্মান জনক আচরণ শেখানো ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা ইত্যাদিতে সহশিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা সহ জিনা-ব্যভিচারের সকল রাস্তা বন্ধ করতে হবে, নারীদেরকে সাজসজ্জা সহ আতর-সুগন্ধি মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে কিংবা অশালীন পোশাক পরে খোলামেলা চলাফেরা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে, দূর দূরান্তে বা রাত-বিরেতে স্বামী বা মাহরাম (যাদের সাথে বিয়ে হারাম) পুরুষদের ছাড়া নারীদের চলাফেরা করা যাবে না।
পাশাপাশী নারীদেরকে রক্ষার জন্য এজন্য প্রত্যেক সচেতন অভিভাবক, সচেতন শিক্ষক মণ্ডলী, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবী মানুষ, সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতা-নেতৃ, প্রশাসনের কর্মকর্তা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, আলেম-উলামা, দাঈ, বক্তা, লেখক, গবেষক, মিডিয়া কর্মী, সোশ্যাল এক্টিভিস্ট সহ সর্বস্তরের মানুষকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে এবং গণ সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সর্বপরি, ধর্মীয় অনুশাসনের আলোকে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে সর্বপ্রকার অনিষ্ট, অন্যায়-অপকর্ম, পাপাচার ও ধ্বংসাত্মক বিষয়াদি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
▬▬▬▬◐◯◑▬▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।