তাক্বলীদ সম্পর্কে বিস্তারিত

তাক্বলীদ শব্দের অর্থ কি? কখন থেকে তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটেছে? শরীয়তের আলোকে তাক্বলীদ করা কি সবার জন্য হারাম? এ ব্যাপারে চার মাযহাবের ইমামগনসহ সালাফদের বক্তব্য কী?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
‘তাক্বলীদ’ (اَلتَّقْلِيْدُ) শব্দটি ‘ক্বালাদাতুন’ (قِلاَدَةٌ) হতে গৃহীত। যার শাব্দিক অর্থ কণ্ঠহার বা রশি। যেমন বলা হয় قَلَّدَ الْبَعِيْرَ ‘সে উটের গলায় রশি বেঁধেছে’। সেখান থেকে মুক্বাল্লিদ (مُقَلِّدٌ) অর্থ যিনি কারো আনুগত্যের রশি নিজের গলায় বেঁধে নিয়েছেন।

পারিভাষিক অর্থে নবী (ﷺ) ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির কোন শারঈ সিদ্ধান্তকে বিনা দলীলে মেনে নেওয়াকে ‘তাক্বলীদ’ বলা হয়। মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন, اَلتَّقْلِيْدُ قُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ بِلاَ دَلِيْلٍ فَكَأَنَّهُ لِقُبُوْلٍهِ جَعَلَهُ قِلاَدَةً فِىْ عُنُقِهِ ‘অন্যের কোন কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করার নাম ‘তাক্বলীদ’। এইভাবে গ্রহণ করার ফলে ঐ ব্যক্তি যেন নিজের গলায় রশি পরিয়ে নিল।’(হাকীকাতুল ফিক্বহ, বোম্বাইঃ তাবি, পৃঃ ৪৪)। আল্লামা জুরজানী (রহঃ)-এর মতে, اَلتَّقْلِيْدُ هُوَ قَبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ بِلاَ حُجَّةٍ وَلاَ دَلِيْلٍ ‘বিনা দলীল-প্রমাণে অন্যের কথা গ্রহণ করাই হচ্ছে তাক্বলীদ।’(জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত, পৃঃ ৬৪)
.
খাত্বীব আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘তাক্বলীদ হল দলীল ছাড়া কারো কোন কথা মেনে নেয়া।’ (আল-ফাক্বীহ্ ওয়াল-মুতাফাক্কিহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৬)। হাফিয ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ), হাফিয ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- শরীআতে তাক্বলীদের অর্থ হলো, এমন কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, যে কথার পক্ষে কথকের কাছে কোন দলীল নেই। এটি শরীআতে নিষিদ্ধ। আর ইত্তিবা হল যার উপর দলীল সাব্যস্ত হয়েছে। (জামিউ বায়ানিল ইলম্ ওয়া ফাযলিহি, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৭; ইলামুল মুওয়াক্কিঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৭)।
.
ইমাম ইবনে কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- ফক্বীহদের নিকটে তাক্বলীদ হল, বিনা দলীলে কারো কথা গ্রহণ করা। এই অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে নবী কারীম (ﷺ)-এর কথা এবং ইজমা গ্রহণ করাকে তাক্বলীদ বলা হয় না। (রাওযাতুন নাযির ওয়া জুন্নাতুল মুনাযির, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৫০)।
.
ইবনু হাযম্ আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- প্রকৃতপক্ষে তাক্বলীদ হল, নবী কারীম (ﷺ) ছাড়া অন্য কারো কথাকে দলীল ছাড়াই গ্রহণ করা। এটির নাম তাক্বলীদ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। আর এটি বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৬৯)। হাফিজ ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- উলামায়ে কেরামের ঐকমত্য অনুযায়ী তাক্বলীদ কোন জ্ঞান নয়। (ইলামুল মুওয়াক্কিঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৮)

মোটকথা তাক্বলীদ বলতে বুঝায়, দলীল এবং প্রমাণ ছাড়া কারো কথা ও কাজের আনুগত্য করা, বিনা দলীলে অনুসরণ করা, চোখ বন্ধ করে কারো পিছনে চলা, চিন্তা-ভাবনা না করে বা বিনা দলীলে কারো অনুসরণ, অনুকরণ। (আল-মুজামুল ওয়াসীত্ব, পৃ. ৭৫৪; আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ, পৃ. ১৩৪৬; আল-মুনজিদ, পৃ. ৮৩১)।

তাক্বলীদের আবির্ভাবঃ সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযামের যুগ শেষে দ্বিতীয় শতাব্দী হিজরীর পরে মুসলিম সমাজে সৃষ্ট অনৈক্য ও বিভ্রান্তির যুগে তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে। তবে বিভিন্ন উসতায ও ইমামের তাক্বলীদের ভিত্তিতে সৃষ্ট বিভিন্ন মাযহাবী দলের উদ্ভব ঘটে চতুর্থ শতাব্দী হিজরীতে। যেমন ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ/১৭০৩-১৭৬২ খৃঃ) বলেন- জেনে রাখ (হে পাঠক!) চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর আগের লোকেরা কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির একক মাযহাবী তাক্বলীদের উপরে সংঘবদ্ধ ছিল না।'(শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, মিসরঃ খায়রিয়াহ প্রেস, ১৩২২ হিঃ, ১ম খন্ড, পৃঃ ১২২)

তাক্বলীদের বিরোধিতায় সাহাবীগণ: ওমর ফারূক (রাঃ) যখন কোন বিষয়ে নিজের পক্ষ থেকে ফৎওয়া দিতেন তখন বলতেন- هَذَا رَأْىُ عُمَرَ فَإِنْ كَانَ صَوَابًا فَمِنَ اللهِ وَإِنْ كانَ خَطَاءً فَمِنْ عُمَرَ-এটি ওমরের রায়। যদি এটা সঠিক হয়, তাহলে আল্লাহর পক্ষ হতে। আর যদি ভুল হয় তাহলে তা ওমরের পক্ষ হতে। ’(আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, কিতাবুল মীযান, ১ম খন্ড, পৃঃ ৬১)। সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন,..فَإِنْ يَّكُنْ صَوَابًا فَمِنَ اللهِ وَ إِنْ يَكُنْ خَطاَءً فَمِنِّىْ وَمِنَ الشَّيْطَانِ- যদি আমার রায় সঠিক হয়, তবে তা আল্লাহর পক্ষ হতে, আর যদি ভুল হয় তাহলে আমার পক্ষ হতে ও শয়তানের পক্ষ হতে। (হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কেঈন ১/৫৭ পৃঃ)।

তাক্বলীদের বিরোধিতায় আহলে সুন্নাহর ইমামগণঃ
_______________________________________
(১). ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ)-এর বক্তব্যঃ তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে নিজ নিজ রায় অনুযায়ী কথা বলা হতে বিরত থাক, তোমাদের জন্য সুন্নাতের অনুসরণ করা অপরিহার্য। যে ব্যক্তি সুন্নাতের অনুসরণ থেকে বেরিয়ে যাবে, সে পথভ্রষ্ট হবে।’(আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী [৮৯৮-৯৭৩হিঃ] কিতাবুল মীযান, দিল্লীঃ আকমালুল মাতাবে, ১২৮৬ হিঃ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৬৩, লাইন ১৮)। তিনি আরও বলেন, আমার কথা অনুযায়ী ফৎওয়া দেওয়া হারাম ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আমার গৃহীত দলীল সম্পর্কে অবগত নয়।’(তিনটি মতবাদ, পৃঃ ১৫।)

(২). ইমাম মালিক (৯৩-১৭৯ হিঃ)-এর বক্তব্যঃ
আমি একজন মানুষ মাত্র। আমি ভুল করি, সঠিকও বলি। অতএব আমার সিদ্ধান্তগুলি তোমরা যাচাই করো। যেগুলি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী পাও, সেগুলি গ্রহণ করো, যেগুলি না পাও, সেগুলি পরিত্যাগ করো।’(ইউসুফ জয়পুরী, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, বোম্বাইঃ পরিবর্ধিত সংস্করণ, তাবি, পৃঃ ৭৩)। তিনি মূলনীতির আকারে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ব্যতীত দুনিয়াতে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার সকল কথা গ্রহণীয় অথবা বর্জনীয়।(শাহ ওয়ালিউল্লাহ, ইক্বদুল জীদ উর্দূ অনুবাদসহ, লাহোরঃ তাবি, ৯৭ পৃঃ, ৩য় লাইন)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, إلا صاحبُ هذه الروضة ‘এই কবরবাসী ব্যতীত।'(কিতাবুল মীযান ১/৬৪ পৃঃ)

(৩). ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ)-এর বক্তব্যঃ
যখন তোমরা আমার কোন কথা হাদীসের বরখেলাফ দেখবে, তখন হাদীসের উপর আমল করবে এবং আমার কথাকে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারবে।’ তিনি একদা স্বীয় ছাত্র ইবরাহীম মুযানীকে বলেন- ‘হে ইব্রাহীম! তুমি আমার সকল কথার তাক্বলীদ করবে না। বরং নিজে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবে। কেননা এটা দ্বীনের ব্যাপার।’(ইক্বদুল জীদ ৯৭ পৃঃ, ৭ম লাইন)। তিনি আরো বলেন, আমি যেসব কথা বলেছি, তা যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহীহ হাদীসের বিপরীত হয়, তবে রাসূল (ﷺ)-এর হাদীসই অগ্রগণ্য। অতএব তোমরা আমার তাক্বলীদ কর না।’(ইবনু আবী হাতেম, পৃঃ ৯৩)। তিনি আরো বলেন- كُلُّ حَدِيْثٍ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَهُوَ قَوْلِىْ، وَإِنْ لَمْ تَسْمَعُوْهُ مِنِّى- ‘রাসূল (ﷺ)-এর প্রত্যেকটি হাদীসই আমার কথা, যদিও আমার নিকট থেকে তোমরা না শুনে থাক।’(ইবনু আবী হাতেম, পৃঃ ৯৩; সনদ সহীহ)

(৪). ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ)-এর বক্তব্যঃ তুমি আমার তাক্বলীদ করো না। তাক্বলীদ করো না ইমাম মালেক, আওযাঈ, নাখ্ঈ বা অন্য কারও। বরং নির্দেশ গ্রহণ কর কুরআন ও সুন্নাহর মূল উৎস থেকে, যেখান থেকে তাঁরা সমাধান গ্রহণ করতেন।’(ইক্বদুল জীদ, ৯৮ পৃঃ ৩য় লাইন)

◾তাক্বলীদের ব্যাপারে সালাফদের বক্তব্য নিম্নরূপ:
_______________________________________
(১). ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন- প্রত্যেক বিদ্বান এ কথা জানেন যে, সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন কেউ কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। ছিলেন না কেউ কোন বিদ্বানের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত। বরং জাহিল ব্যক্তি আলেমের নিকট থেকে কিতাব ও সুন্নাহ হতে প্রমাণিত শরীআতের হুকুম জিজ্ঞেস করতেন। আলেমগণ সেই মোতাবেক ফৎওয়া দিতেন। কখনও শব্দে শব্দে বলতেন, কখনও মর্মার্থ বলে দিতেন। সে মতে লোকেরা আমল করত (কুরআন ও হাদীসের) রেওয়ায়াত (বর্ণনা) অনুযায়ী, কোন বিদ্বানের রায় অনুযায়ী নয়। বলা বাহুল্য, কারও তাক্বলীদ করার চেয়ে এই তরীকাই সহজতর।’(শাওকানী, আল-ক্বাওলুল মুফীদ, মিসরী ছাপা,১৩৪০/১৯২১ খৃঃ], পৃঃ ১৫)।

(২). ইমাম আশ-শা‘বী তাবিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- ‘এরা তোমার নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যা বর্ণনা করে সেগুলো গ্রহণ কর। আর যা তাদের রায় হতে (কুরআন-সুন্নাহর বিপরীতে) বলে সেগুলোকে আবর্জনায় নিক্ষেপ কর।’ (আদ-দারিমী, হা/২০৪, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৭, সনদ সহীহ)।

(৩). ইমাম হাকাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নবী (ﷺ) ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির কথা আপনি গ্রহণ বা বর্জন করতে পারেন।’ (ইবনু হাযম, আল-ইহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯৩, সনদ সহীহ)।

(৪). ইবরাহীম নাখঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সামনে কোন এক ব্যক্তি তাবিঈ সাঈদ বিন জুবায়ির (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্য পেশ করলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসের মুকাবিলায় সাঈদ বিন জুবায়িরের বক্তব্য দিয়ে তুমি কী করবে? (ইবনু হাযম, আল-ইহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯৩, সনদ সহীহ)।

(৫). ইমাম মুযানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- ইমাম শাফিঈ নিজের ও অন্যের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করে বলেন, ‘আমার এমন প্রত্যেক বক্তব্য, যা রাসলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহীহ হাদীসের বিপরীত হবে (তাকে বর্জন কর)। কারণ নবীর কথা সবচেয়ে উত্তম। আর তোমরা আমার তাক্বলীদ কর না।’ (আল-উম্ম- মুখতাছারুল মুযানী, পৃ. ১; আদাবুশ শাফিঈ ওয়া মানাকিবুহ, পৃ. ৫১, সনদ হাসান)।

(৬). ইমাম আবু দাঊদ সিজিস্তানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- ‘আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইমাম আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) কি ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর চেয়ে বেশি হাদীসের অনুসারী? তিনি বলেন, তোমার দ্বীনের ব্যাপারে এদের একজনেরও তাক্বলীদ করবে না।’ (মাসায়িলে আবু দাঊদ, পৃ. ২৭৭)।

(৭). ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) একদিন কাজী আবু ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বললেন, ‘হে আবু ইউসুফ! তোমার জন্য আফসোস! আমার থেকে যা শ্রবণ করবে তার সবকিছুই লিখে রাখবে না। কারণ আমি আজকে একটি রায় দিই এবং আগামীকাল তা পরিত্যাগ করি। আবার আগামীকাল একটা রায় দিই পরশু তা বর্জন করি।’ (তারীখু ইয়াহ্ইয়া ইবনু মাঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৭, ক্রমিক নং-২৪৬১, সনদ সহীহ; তারীখু বাগদাদ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৪২৪)।

(৮). ইমাম ইবনু হাযম্ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাক্বলীদ করা হারাম’। তাক্বলীদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ও আলিম উভয়-ই সমান। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল সাহাবী এবং সকল তাবিঈ-এর ইজমা সাব্যস্ত রয়েছে যে, নবী (ﷺ) ব্যতীত তাদের মধ্য হতে বা তাদের আগের কোন ব্যক্তির সকল কথাকে গ্রহণ করা নিষেধ ও নাজায়েয। যে ব্যক্তি আবু হানীফা, মালিক, শাফিঈ ও আহমাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ)-এর মধ্য হতে কোন একজনের তাক্বলীদ করে এবং তার জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্য হতে যার অনুসরণ করে তার কোন কথাকে বর্জন করে না, তবে সে জেনে রাখুক যে, সে পুরো উম্মতের ইজমার বিপরীত করে। সে মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথের অনুসরণ করেছে। আমরা এ অবস্থা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। তাছাড়া এ সকল সম্মানিত আলিমগণ নিজেরাই তাঁদের ও অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তাদের তাক্বলীদ করল সে তাদের বিরোধিতা করল। (আন-নুবযাতুল কাফিয়া ফী আহকামি উছূলিদ দ্বীন, পৃ. ৭০-৭১, আর-রদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃ. ১৩১-১৩২)।

(৯). হাফিজ ইবনু হাযম্ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘কারো জন্য জীবিত অথবা মৃত কারো-ই তাক্বলীদ করা বৈধ নয়।’ (কিতাবুদ দুর্রাহ ফীমা ইয়াজিবু ই‘তিকাদুহু, পৃ. ৪২৭)।

(১০). ইমাম আবু জাফর ত্বাহাবী হানাফী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘গোঁড়া ও নির্বোধ ছাড়া কেউ তাক্বলীদ করে কি?’ (লিসানুল মীযান, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮০)।

(১১). আইনী হানাফী ও যাইলাঈ হানাফী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন- ‘মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং মুক্বাল্লিদ জাহিল হয়। আর সকল কিছুর বিপদ তাক্বলীদ থেকে শুরু হয়। (আল-বিনায়া শারহুল হিদায়াহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৭; নাছবুর রায়াহ্, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৯)।

(১২). শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- ‘কেউ যদি এ কথা বলে যে, সাধারণ মানুষের উপর অমুক অমুকের তাক্বলীদ ওয়াজিব। তাহলে এ কথা কোন মুসলিম বলতে পারে না।’ আর তিনি নিজেও তাক্বলীদ করতেন না। (মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২২তম খণ্ড, পৃ. ২৪৯; ইলামুল মুওয়াক্কি‘ঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪১-২৪২)। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি একজন ইমামকে নির্ধারণ করে নিঃশর্তভাবে তার আনুগত্য করাকে আবশ্যক আখ্যা দিয়েছে, বিশ্বাসগতভাবে হোক বা আমলগতভাবে, সে ব্যক্তি ভ্রান্ত রাফিযী ইমামিয়্যাদের নেতাদের মত গোমরাহ। (মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ৬৯)।

(১৩). আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন- ‘এটি বলে দেয়া ওয়াজিব যে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ব্যতীত অন্য কোন ইমামের দিকে সম্বন্ধিত হয় এবং এই সম্বন্ধকরণের উপর ভিত্তি করে সে বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা পোষণ করে, তবে সে অবশ্যই বিদআতী এবং আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআত থেকে খারিজ। চাই সে সম্বন্ধ মূলনীতিতে হোক বা শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে হোক।’ (আল-কানযুল মাদফূন ওয়াল ফুলকুল মাশহূন, পৃ. ১৪৯)।আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।