একজন মুমিনের মৃত্যুর পূর্ব সময় থেকে শুরু করে কবরস্থ করার পর পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে করনীয় ও বর্জনীয় চতুর্থ পর্ব

প্রশ্ন: মৃত্যু পথযাত্রী মুমূর্ষু রোগীর করনীয় কি?এবং একজন মুমূর্ষু রোগীর নিকটে উপস্থিত ব্যক্তিদের কী কী কাজ করা শরী‘আত সম্মত?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা :জন্ম নিলে মরিতে হইবে এটা চিরন্তন সত্য বাণী কেননা মানুষের মৃত্যু এক অবধারিত ও সুনিশ্চিত বিষয়। মৃত্যু থেকে কেউ পলায়ন করতে পারবে না।জীবন মৃত্যুর একমাত্র মালিক মহান আল্লাহ তাআলা এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক প্রাণীর জীবনকাল আল্লাহ তাআলার নিকট সুনির্ধারিত।আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মরতে পারে না। সেজন্য একটা নির্ধারিত সময় রয়েছে…’ (আলে ইমরান ৩/১৪৫)।তিনি আল্লাহ বলেন,যে মৃত্যু হ’তে তোমরা পলায়ন করছ তা অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবে। তারপর তোমাদেরকে অদৃশ্য ও দৃশ্য সম্পর্কে পরিজ্ঞাত আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নেয়া হবে।’ (সূরা জুমু‘আ ৬২/৮)। সুতরাং সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও মৃত্যু কাউকে ছাড় দিবে না।’ (সূরা নিসা ৪/৭৮)।
.
অতএব,কেউ ব্যাধিগ্রস্ত ও অসুস্থ থাকলে প্রত্যেক মুসলিমের উচিত তাকে দেখা করতে যাওয়া এবং তাকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা, সাহস ও ধৈর্যধারণে উৎসাহ দেওয়া। এটা প্রত্যেক মুসলিমের অপরের নিকট হতে প্রাপ্য অধিকার, যা পালন করলে অসংখ্য ফজিলত রয়েছে।আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের পাঁচটি অধিকার রয়েছেঃ
▪️(১) সালামের জবাব দেওয়া
▪️(২) রোগীকে দেখতে যাওয়া
▪️(৩) জানাযায় অংশ গ্রহণ করা
▪️(৪) দাওয়াত গ্রহণ করা এবং
▪️(৫) কেউ হাঁচি দিলে তার জবাব দেওয়া।’’
মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘মুসলিমের উপর মুসলিমের অধিকার ছয়টিঃ তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তাকে সালাম দাও, সে তোমাকে দাওয়াত দিলে তার দাওয়াত গ্রহণ কর, সে তোমার কাছে উপদেশ চাইলে তুমি তাকে উপদেশ দাও, সে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বললে তার জবাব দাও, সে অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাও এবং সে মারা গেলে তার জানাযায় অংশ গ্রহণ কর।(সহীহুল বুখারী ১২৪০, মুসলিম ২১৬২, তিরমিযী ২৭৩৭, নাসায়ী ১৯৩৮, আবূ দাউদ ৫০৩০, ইবনু মাজাহ ১৪৩৫, আহমাদ ২৭৫১১, ১০৫৮৩ রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ২৪৩)
.
সওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃনবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “কোন মুসলিম যখন তার অন্য কোন মুসলিম ভাইয়ের রোগ জিজ্ঞাসা করতে যায়, সে না ফিরা পর্যন্ত জান্নাতের ‘খুরফার’ মধ্যে সর্বদা অবস্থান করে।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! খুরফাহ কী?’ তিনি বললেন, “জান্নাতের ফল-পাড়া।” (আহমাদ ২১৮৬৮, মুসলিম ৬৭১৭-৬৭১৯, তিরমিযী ৯৬৭ হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ১২০৮)
.
কোন মুসলিম সকালে কোন মুসলিম (রোগীকে) সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। আর সন্ধ্যা বেলায় সাক্ষাৎ করলে সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং জান্নাতে তার জন্য এক বাগান রচনা করা হয়।” (সুনানে তিরমিযী, ১৮৩নং, সহীহ ইবনে মাজাহ ১১৮৩)
.
◾মৃত্যু পথযাত্রী মুমূর্ষু রোগীর করনীয়:
_____________________________
রোগীর উচিত,আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকা, নিজের ভাগ্যের মসীবতে ধৈর্য রাখা অধিকাধিক তওবা-ইস্তিগফার করা এবং অনুশোচনার সাথে আল্লাহ-অভিমুখী হওয়া।এবং আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখা যে, আল্লাহর রহমত ও করুণা অসীম, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন ইত্যাদি। কারণ আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তাআলার প্রতি সুধারণা রাখা ছাড়া অন্য অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন মৃত্যুবরণ না করে।”(সহীহ মুসলিম ২৮৭৭, ইবনে মাজাহ ৪১৬৭)
রোগী তার মরণের সময় একান্ত নিকটবর্তী বুঝতে পারলে আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর অনুকরণে নিম্নের দুআ করবে।
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَارْحَمْنِي وَأَلْحِقْنِي بِالرَّفِيقِالأَعْلَى
উচ্চারণ:আল্লা-হুম্মাগফিরলী অরহামনী অআলহিক্বনী বিররাফীক্বীল আ’লা।অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, দয়া কর এবং সুমহান বন্ধুর সাথে মিলিত কর। (সহীহ বুখারী ৪০৮৬ সহীহ মুসলিম ৪৪৭৪তিরমিজি,৩৪৮ ইবনে মাজাহ ১৬০৮)
◾মৃত্যুপথযাত্রী মুমূর্ষু রোগীর নিকটে উপস্থিত ব্যক্তির করণীয়:
_____________________________________
মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর প্রতি পরিবারের কর্তব্য হ’ল তাকে তালক্বীন করানো। তালক্বীন (التلقين) অর্থ কথা বুঝানো বা দ্রুত মুখস্থ করিয়ে দেওয়া। মৃত্যুর আলামত দেখা গেলে রোগীর শিয়রে বসে তাকে কালেমায়ে ত্বাইয়িবা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ পড়ানো উচিত (সহীহ মুসলিম হা/৯১৭ মিশকাত হা/১৬১৬)। যাতে সে দ্রুত মুখস্থ বা স্মরণ করে নেয়।যে ব্যক্তি তাওহীদের স্বীকৃতিবাচক এই কালেমা মুখে উচ্চারণ করে ও হৃদয়ে এর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় রেখে মরণের হাতে আত্মসমর্পণ করতে পারে তাহলে সে শুরু থেকে না হলেও কোন এক সময়ে জান্নাতে প্রবেশ করে সেখানে চিরস্থায়ী হবে ইনসাআল্লাহ। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন, যে ব্যক্তির সর্বশেষ বাক্য হবে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’
(আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই), সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে’(আবুদাঊদ হা/৩১১৬; মিশকাত হা/১৬২১)। নবী (ﷺ) বলেন, তোমরা তোমাদের মরণাপন্ন ব্যক্তিকে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ স্মরণ করিয়ে দাও. (তিরমিযী ৯৭৬, নাসাঈ ১৮২৬, ইবন মাজাহ ১৪৪৪)
.
অপর বর্ননায় নবী রাসূল (ﷺ) বলেন,যে ব্যক্তির মৃত্যুর সময় সর্বশেষ কথা “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ হবে সে একদিন জান্নাত প্রবেশ করবে – যদিও সে তার পূর্বে কিছু আযাব ভোগ করবে।” (মাওয়ারিদুয যামআন ৭১৯ ইরওয়াউল গালীল ৬৭৯)
.
জমহুর বিদ্বানগণ কেবল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ পড়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। কেননা হাদীসে কেবল এতটুকুই এসেছে(ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৫৬)। উল্লেখ্য যে, তালক্বীনের অর্থ কেবল কালেমা শুনানো নয়। বরং তাকে কালেমা পড়ানোর চেষ্টা করা (মুসনাদে আহমাদ হা/১২৮৯৯, সনদ সহীহ; তালখীছ ১১ পৃঃ)। কিন্তু কালেমা পড়ানোর জন্য চাপাচাপি করা উচিত নয়। কারণ সেই কঠিন মৃত্যু যন্ত্রণার সময় বিরক্ত হয়ে তা বলতে অস্বীকার করতে পারে অথবা বিরক্ত হয়ে কোন অসমীচীন কথাও বলে ফেলতে পারে। সুতরাং কলেমার প্রতি বিরক্তিভাব প্রকাশ পেলে মৃতের শেষ পরিণাম অশুভ হয়ে যাবে। অতএব নম্রতার সাথে ধীরে ধীরে তাকে কলেমা উচ্চারণ করাতে চেষ্টা করতে হবে এবং একবার বলানোর পরে দ্বিতীয়বার চেষ্টা না করা উচিত। যাতে এই কালেমাই তার শেষ বাক্য হয় কিন্তু অনেক চেষ্টা করার পরেও যদি সে একবারও না বলে, তাহলে তার ব্যাপার আল্লাহর হাতে। আল্লাহর নিকট আমরা শুভ পরিণাম প্রার্থনা করি।
.
মরণাপন্ন ব্যক্তি কলেমা পাঠ করে নিলে তার নিকট উপস্থিত সকল ব্যক্তিবর্গের উচিত, আর কিছু না বলে চুপ থাকা এবং তার সাথে অন্য কথা না বলা; যাতে তার সর্বশেষ কথা ঐ কলেমাই হয়। নচেৎ তারপর কথা বললে পুনরায় কলেমার তালকীন করা কর্তব্য। (সাবউনা সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ইবনে উষাইমীন ৪ পৃঃ)
.
আর মাইয়েতের শিয়রে বসে সূরা ইয়াসীন পাঠ করার হাদীসটি যঈফ এই বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ। (আহমাদ হা/২০৩১৬; আবুদাঊদ হা/৩১২১; ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৬২২)।
________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি