একজন মুমিনের মৃত্যুর পূর্ব সময় থেকে শুরু করে কবরস্থ করার পর পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে করনীয় ও বর্জনীয় দ্বিতীয় পর্ব

একজন মুমিন ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্ব প্রস্তুতি কেমন হওয়া প্রয়োজন বিস্তারিত বর্ননাসহ।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
জন্ম নিলে মরিতে হইবে এটা চিরন্তন সত্য বাণী। মহান আল্লাহ বলেন, জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। [সূরা আল ইমরান:১৮৫] .অপর আয়াতে বলেন,
প্রত্যেক প্রাণীর মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়ে হবে।[সূরা নূহ,৪] . আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, ‘তিনি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত মানুষকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন সেই মেয়াদকাল এসে যায়, তখন তারা তা মুহূর্তকাল দেরী বা এগিয়ে আসতে পারে না। [সূরা নাহল ১৬/৬১]
.
মানুষের মৃত্যু এক অবধারিত ও সুনিশ্চিত বিষয়। মৃত্যু থেকে কেউ পলায়ন করতে পারবে না।কার মৃত্যু কোথায় হবে কিভাবে হবে, কখন হবে এ কথাও কেউ জানে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-নিশ্চয় আল্লাহ্ তাঁর কাছেই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা মাতৃগর্ভে আছে। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।(সুরা লোকমান :৩৪)এ আয়াতে পাঁচটি বস্তুর জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে আল্লাহরই জন্য নির্দিষ্ট থাকা এবং অপর কোন সৃষ্টির সে জ্ঞান না থাকার কথা বলা হয়েছে।
.
সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, জিব্রীল এসে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যতদিন খুশী জীবন যাপন কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি মৃত্যুবরণ করবে। যার সাথে খুশী বন্ধুত্ব কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি তাকে ছেড়ে যাবে। যা খুশী তুমি আমল কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি তার ফলাফল পাবে। জেনে রেখ, মুমিনের মর্যাদা হ’ল ইবাদতে রাত্রি জাগরণে এবং তার সম্মান হ’ল মানুষের মুখাপেক্ষী না হওয়ার মধ্যে।’(মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৭৯২১; সিলসিলা সহীহাহ হা/৮৩১)
.
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে ও তার উপরেই জীবন শেষ হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সিয়াম রাখে ও তার উপরেই জীবন শেষ হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাদাক্বা করে ও তার উপরেই জীবন শেষ হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।(আহমাদ হা/২৩৩৭২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৯৮৫)
.
আদী বিন হাতেম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তার প্রতিপালক অতিসত্বর বাক্যালাপ করবেন। তার ও আল্লাহর মাঝখানে কোন দোভাষী থাকবে না এবং কোন পর্দা থাকবে না। এরপর সে তাকাবে ডান দিকে, তখন তার অতীত কৃতকর্ম ছাড়া আর কিছুই দেখবে না। অতঃপর তাকাবে বাম দিকে, তখনো তার কৃতকর্ম ছাড়া আর কিছুই দেখবে না। তখন সে সামনে তাকাবে, কিন্তু সেখানে সে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। অতএব তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো একটা খেজুরের টুকরা দিয়ে হ’লেও’। বর্ধিত বর্ণনায় এসেছে, ‘নির্দোষ কথা দ্বারা হ’লেও’।(সহীহ বুখারী হা/৭৫১২; মুসলিম হা/১০১৬; মিশকাত হা/৫৫৫০)
.
আর এ কারণেই সচেতন মুমিন মুসলমান সব সময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করে।মৃত্যুর সময় যখন নিকটবর্তী হয়, তখন বহু মানুষ বুঝতে পারে যে, এবার তার আর সময় নেই। সুতরাং জ্ঞানী ও সৎ সেই ব্যক্তি, যে তা বুঝতে না পারলেও মরণের জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। সর্বদা ধ্যানে-মনে রেখে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থেকে পরকালের অন্ততকালের কথা স্মরণ করে নিজেকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে।ইবনে উমার (রাঃ) (মানুষদেরকে) বলতেন, “সন্ধ্যা হলে আর সকালের অপেক্ষা করবে না। আর যখন সকাল হবে, সন্ধার অপেক্ষা করবে না। নিজের সুস্থতার সুযোগ গ্রহন করবে অসুস্থতার আগে ও জীবনের সুযোগ গ্রহন করবে মৃত্যুর আগে।(সহীহ বুখারী ৬৪১৬ তিরমিযী ২৩৩৩, সুনা সিলসিলাহ্ আস্ সহীহাহ্ ১১৫৭, সহীহ আত্ তারগীব ৩৩৪১, সহীহ আল জামি‘ আস্ সগীর ৪৫৭৯ মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ১৬০৪)
.
ওমর (রাঃ) যখন আততায়ী কর্তৃক যখমী হন এবং জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে পড়েন, তখন তিনি বলেন,যদি পৃথিবী ভরা স্বর্ণ আমার থাকত এবং তা দিয়ে আখেরাতে আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যেত, তাহ’লে আমি সেটাই করতাম, উক্ত শাস্তি দেখার পূর্বে’ (বুখারী হা/৩৬৯২)। ইবনুল জাওযী বলেন, ওমরের মত মানুষের আল্লাহভীতি আর তোমাদের মত মানুষের নিশ্চিন্ততা দেখে আমি বিস্মিত হই!(আবু নু‘আইম ইছফাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৫/৩১৪।)
.
খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৯৯-১০১ হিঃ) একদিন কাঁদতে থাকেন। তখন স্ত্রী ফাতেমা ও পরিবারের সবাই কাঁদতে শুরু করে। এক সময় স্ত্রী তাঁকে বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন আমি ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর বিচার দেখছি। তিনি একদলকে জান্নাতে পাঠাচ্ছেন ও এক দলকে জাহান্নামে পাঠাচ্ছেন। হায়! যদি আমি সেদিন জাহান্নামীদের দলভুক্ত হয়ে যাই! বলেই তিনি চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান’।(ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/৩৬৮।আল্লাহ বলেন, আর যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দু’টি উদ্যান(’সূরা আর-রহমান ৫৫/৪৬)।
.
আখিরাতে সেই পরম সুখ ও অনাবিল শান্তির আশায় ও লোভে সে পথের উৎকৃষ্ট প্রয়োজনীয় সম্বল সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়। কারণ, মানুষের মৃত্যুর পর ঈমান ও আমল ছাড়া আর কিছু উপকারে আসতে পারে না।তাই সবার উচিত সব ধরনের নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড বর্জন করে একনিষ্ঠ ভাবে তওবা ও ইস্তেগফার করে আল্লাহর পথে ফিরে আসা এবং বেশী বেশী নেক আমল সম্পাদন করা।মহান আল্লাহ বলেন,তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে। পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(সূরা ফুরকান,২৫/৭০)
আল্লাহ আরো বলেন,আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তিনি তার পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য।(সূরা আত তাগাবুন ৬৪/০৯)
.
মহান আল্লাহ আরো বলেন,যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে আমরা তার জন্য তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে তা থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু আখেরাতে তার জন্য কোন অংশ থাকে না’ (সূরা শূরা ৪২/২০)।
.
মহান আল্লাহ বলেন,পুরুষ হৌক নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’(সূরা নাহল ১৬/৯৭)
.
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন,আখেরাত যে ব্যক্তির একমাত্র চিন্তার বিষয় হবে, আল্লাহ তার অন্তরকে অভাবমুক্ত করে দেন। তার বিক্ষিপ্ত বিষয়গুলিকে সমাধান করে দেন। আর দুনিয়া তার কাছে তুচ্ছ হয়। পক্ষান্তরে দুনিয়া যার একমাত্র চিন্তার বিষয় হবে, আল্লাহ তার অভাবসমূহ সামনে এনে দেন। আর তার সমস্যাগুলিকে বিক্ষিপ্ত করে দেন। অথচ তার নিকট কিছুই আসে না অতটুকু ব্যতীত যতটুকু তার তাক্বদীরে নির্ধারিত আছে’ (সুনানে তিরমিযী হা/২৪৬৫)।
.
আবূ যার্র জুন্দুব ইবনু জুনাদাহ (রাঃ) ও মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তুমি যেখানেই থাক না কেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং পাপের পরে পূণ্য কর, যা পাপকে মুছে ফেলবে। আর মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর।(তিরমিযী ১৯৮৭, আহমাদ ২০৮৪৭, ২০৮৯৪, ২১০২৬, দারেমী ২৭৯১ রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ৬২)
.
আবু উমামাহ বাহেলী (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে তিনি বলেন,১) ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় কর (২) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় কর (৩) রামাযান মাসের সিয়াম পালন কর (৪) তোমাদের সম্পদের যাকাত প্রদান কর এবং (৫) আমীরের আনুগত্য কর; তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ কর’।(তিরমিযী হা/৬১৬; আহমাদ হা/২২২১৫; মিশকাত হা/৫৭১; ছহীহাহ হা/৮৬৭)
.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদিন জনৈক বেদুঈন এসে রাসূল (ছাঃ)-কে বলল,আপনি আমাকে এমন আমলের সন্ধান দিন যা করলে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। ফরয ছালাত আদায় কর। ফরয যাকাত আদায় কর ও রামাযানের ছিয়াম পালন কর’। একথা শুনে বেদুঈন বলল, যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম করে বলছি, আমি এর চেয়ে কিছু বেশীও করব না, কিছু কমও করব না’। (রাবী আবু হুরায়রা বলেন) অতঃপর যখন লোকটি চলে গেল, তখন রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি কেউ কোন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখে খুশী হ’তে চায়, তবে সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, লোকটি সফলকাম হবে, যদি সে সত্য বলে থাকে’।(সহীহ বুখারী হা/১৩৯৭, ৪৬; মুসলিম হা/১৪, ১১; মিশকাত হা/১৪, ১৬) উক্ত হাদীসটির কোন কোন বর্ণনায় হজ্জ বা ছিয়ামের উল্লেখ নেই। বর্ণনাকারীদের সেটি বর্ণনা করা বা না করার ভিত্তিতে (মিরক্বাত)। যুগে যুগে জান্নাতী বান্দাদের প্রকৃত লক্ষণ হবে এটাই যে, তারা বলবে আমি কুরআন-হাদীছে যা আছে তার চাইতে বাড়াবোও না, কমাবোও না। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন
.
আনাস ইবনে মালিক বলেন প্রিয় নবী (ﷺ) বলেছেন, তিনটি জিনিস মৃত ব্যক্তির অনুসরণ করে (সঙ্গে যায়)। দাফনের পর দু’টি ফিরে আসে, আর একটি তার সাথেই থেকে যায়। সে তিনটি হল তার পরিবারবর্গ, তার মাল ও তার আমল। দাফনের পর তার পরিবারবর্গ ও মাল ফিরে আসে। আর তার আমল (কৃতকর্ম) তার সাথেই থেকে যায়।’’ [বুখারি ৬৫১৪, মুসলিম ২৯৬০, তিরমিযি ২৩৭৯, নাসায়ি ১৯৩৭, আহমদ ১১৬৭০]
.
হে মানুষ! মৃত্যু আসার আগেই প্রস্ত্ততি গ্রহণ করো। দুনিয়ার চাকচিক্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। অবিশ্বাসীদের ধোঁকায় পড়ো না।মহান আল্লাহ বলেন,(হে নবী) তুমি তাদের বিষয়ে ব্যস্ত হয়ো না। আমরা তো তাদের জন্য নির্ধারিত (মৃত্যুর) সময়কাল গণনা করছি’ (সূরা মারিয়াম ১৯/৮৪)। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষের প্রতিটি নিঃশ্বাস গণনা করেন। বান্দা কোন কাজে সেটি ব্যয় করছে, তার হিসাব রাখেন। সে তার মৃত্যুর দিকে আলোর গতিতে প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কি.মি. বেগে এগিয়ে চলেছে।
.
অতএব হে মানুষ! তুমি দ্রুত সৎকর্ম সম্পাদন কর। বলো না যে, কাজটি আমি আগামীকাল করব। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেছেন,‘আর তুমি কোন বিষয়ে বলো না যে, ওটা আমি আগামীকাল করব’। ‘যদি আল্লাহ চান’ বলা ব্যতিরেকে…’(সূরা কাহফ ১৮/২৩-২৪)। তিনি আল্লাহ বলেন,হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেকে ভেবে দেখুক আগামীকালের (ক্বিয়ামতের) জন্য সে কি অগ্রিম পাঠিয়েছে। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (হাশর ৫৯/১৮)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের নিকট দায়বদ্ধ’। ‘(আনুগত্যের কারণে) ডান সারির লোকেরা ব্যতীত’। ‘তারা জান্নাতে থাকবে। তারা পরস্পরে জিজ্ঞেস করবে’- ‘পাপীদের বিষয়ে’। ‘কোন বস্ত্ত তোমাদেরকে সাক্বারে (জাহান্নামে) প্রবেশ করিয়েছে’? ‘তারা বলবে, আমরা মুছল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না’। ‘আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য দিতাম না’। ‘আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনায় মগ্ন থাকতাম’। ‘আমরা বিচার দিবসকে মিথ্যা বলতাম’। ‘অবশেষে আমাদের কাছে এসে গেল মৃত্যু’। ‘ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না’। ‘অতঃপর তাদের কি হ’ল যে, তারা কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়’? ‘তারা যেন পলায়নপর বন্য গাভী।যে শিকারী সিংহ দেখে পালায়।’(সূরা মুদ্দাছছির ;৭৪/৩৮-৫১)।
.
মরণের প্রস্তুতি স্বরূপ কারো কাছে ঋণী থাকলে সম্ভব হলে পরিশোধ করে দেবে। কারণ ঋণ এমন এক বোঝা যা ঋণদাতা ব্যতীত কেউ হালকা করতে পারবে না।রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,মুমিন ব্যক্তির রূহ তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়’।(ইবনু মাজাহ হা/২৪১৩; মিশকাত হা/২৯১৫।)অপর বর্ননায় বলেন,ঋণ ব্যতীত শহীদের সকল গুনাহ্ই মাফ করে দেওয়া হবে’।(মুসলিম হা/১৮৮৬; মিশকাত হা/২৯১২; ছহীহুল জামে‘ হা/৮১১৯) এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে ঋণগ্রস্ত কোন মৃত ব্যক্তিকে (জানাযার জন্য) আনা হ’লে, তিনি জিজ্ঞেস করতেন, সে কি ঋণ পরিশোধ করার মত অতিরিক্ত কিছু রেখে গেছে? যদি বলা হ’ত যে, সে ঝণ পরিশোধ করার মত সম্পদ রেখে গেছে, তাহ’লে তিনি তার জানাযা পড়তেন। অন্যথা তিনি মুসলমানদের বলতেন, তোমরা তোমাদের সাথীর জানাযা পড়। তারপর আল্লাহ যখন তার জন্য বহু দেশ বিজয়ের দ্বার খুলে দিলেন, তখন তিনি বললেন, আমি মুমিনদের নিজেদের চেয়েও বেশী ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং মুমিনদের মধ্যে কেউ ঋণ রেখে মারা গেলে, তা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমারই। আর যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে যাবে তা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে’।(বুখারী হা/২২৯৮; মুসলিম হা/১৬১৯; মিশকাত হা/২৯১৩)তারপর কারো অধিকার ছিনিয়ে থাকলে, কারো হক আত্মসাৎ করে থাকলে অথবা কারো প্রতি কোন অন্যায় ও অত্যাচার করে থাকলে তার অধিকার ফিরিয়ে দেবে এবং তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেবে।কেননা মহান আল্লাহ জেনে শুনে হাক্কুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দর হক নষ্ট করার গুনাহ ক্ষমা করবেন না।বান্দার হক বিনষ্টকারীগণ ক্বিয়ামতের দিন সর্বাধিক অসহায় ও নিঃস্ব হিসাবে গণ্য হবে। তাদের সালাত,সিয়াম, যাকাত, হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদত কবুল হবে। তবে তার ইবাদতগুলোর সওয়াব যেসব মানুষের অধিকার নষ্ট করেছে তাদেরকে দিয়ে দেওয়া হবে এবং নেকী নিঃশেষ হলে বা না থাকলে তাদের গোনাহ নিয়ে এই ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়া হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর যুলুম করেছে সে যেন তা থেকে আজই মাফ চেয়ে নেয়, তার ভাইয়ের জন্য তার কাছ থেকে নেকী কর্তন করে নেওয়ার পূর্বে। কেননা সেখানে (হাশরের ময়দানে) কোন দীনার বা দেরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি নেকী না থাকে তবে তার (মযলূম) ভাইয়ের গোনাহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।(সহীহ বুখারী হা/৬৫৩৪ মুসনাদে আহমাদ ২/৫০৬, বাইহাকী ৩/৩৬৯)
.
বান্দা তওবা করলে আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন, এমনকি কারো পাপ জমীন থেকে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেও আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন ইনশা-আল্লাহ।কিন্তু ইচ্ছাকৃত বান্দার হক নষ্টকারীর গুনাহ ক্ষমা করবেন না।আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ বান্দাহর তওবা কবুল করেন, বান্দাহর রূহ কণ্ঠনালীতে আসা পর্যন্ত।’ (তিরমিযী হা/৩৫৩৭; ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৩; মিশকাত, হা/২৩৪৩)
.
তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কোন অসুবিধার কারণে কারো প্রাপ্য হক পরিশোধ করতে অক্ষম হলে রোগী তার
উত্তরাধিকারীদের অসিয়ত করে যাবে, যেন তারা তার মৃত্যুর পর তা পরিশোধ করে দেয়। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, “উহুদ যুদ্ধের সময় উপস্থিত হলে রাত্রিকালে আমার আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে যে, নবী (ﷺ) এর সাহাবাবর্গের মধ্যে যারা খুন হবেন তাদের মধ্যে আমি প্রথম। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ছাড়া আমার সবচেয়ে প্রিয়তম জিনিস আমি তোমাকেই ছেড়ে যাব। আমার কিছু ঋণ আছে, তা তুমি পরিশোধ করে দিও। আর ভাইদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। অতঃপর সকাল হলে দেখলাম, তিনিই প্রথমে খুন হয়েছেন।” (সহীহ বুখারী ১৩৫১)।
মৃত্যুর প্রস্তুতিস্বরূপ রোগী তার নখ কেটে, বগল ও নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করে রাখবে। মরণ আসন্ন বুঝে খুবাইব (রাঃ) এরূপ করেছিলেন। (সহীহ বুখারী ৩৯৮৯, আবুদাউদ ২৬৬০)
.
পরিশেষে বলব,মরণের প্রস্তুতি স্বরূপ যাবতীয় পাপ কর্ম বর্জন করে আল্লাহর অনুগত বান্দা হয়ে ইখলাসের সাথে যেকোন ধরনের সৎকর্ম ছোট হ’লেও তাকে সর্বদা জীবনের বৈশিষ্ট্য ও প্রধান নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করা উচিৎ। আল্লাহ তুমি আমাদের অন্তরে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের আকুলতা সৃষ্টি করে দাও এবং আমাদেরকে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও! -আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি