একজন মুমিনের মৃত্যুর পূর্ব সময় থেকে শুরু করে কবরস্থ করার পর পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে করনীয় ও বর্জনীয় একাদশ পর্ব

প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তিকে দাফনের হুকুম কি? মৃতের কবর খনন ও দাফনের সঠিক পদ্ধতি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
মৃতদেহ দাফন করা ওয়াজিব। আবু তালেব মারা গেলে নবী (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে বললেন, “তোমার বৃদ্ধ চাচা তো মারা গেল। এখন যাও ওকে কবরস্থ করে এস—।”(আহমাদ ৮০৭নং, আবু দাউদ ৩২১৪ নাসাঈ ২০০৫ সহীহ আবু দাউদ ২৭৫৩) যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কবর খনন করবে আল্লাহ তাকে এমন একটি ঘর তৈরি করে (সাদকা করে) দেওয়ার সাওয়াব দান করবেন যেন সে ঘরটি কিয়ামত পর্যন্ত বসবাসের জন্য তৈরি করে দিল। (হাকেম- ১/৩৫৪, ৩৬২, বাইহাকী- ৩/৩৯৫)যে ব্যক্তি কোন মুসলিম মাইয়েতকে গোসল করালো। অতঃপর তার গোপনীয়তাসমূহ গোপন রাখল, আল্লাহ তাকে চল্লিশ বার ক্ষমা করবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতের জন্য কবর খনন করল, অতঃপর দাফন শেষে তা ঢেকে দিল আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত জান্নাতের একটি বাড়ীর সমপরিমাণ পুরস্কার দিবেন, যেখানে আল্লাহ তাকে রাখবেন। যে ব্যক্তি মাইয়্যেতকে কাফন পরাবে,আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের মিহি ও মোটা রেশমের পোশাক পরাবেন।’(বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, হা/৬৯০০, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৯৫; হাকেম, হা/১৩৪০; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৪৯২, সনদ ছহীহ)
.
মুসলিম মাইয়্যেতকে মুসলিম কবরস্থানে দাফন করতে হবে,ইহুদী-নাসারা ও কাফের-মুশরিকদের সাথে নয়। যাতে তারা মুসলিম যিয়ারত কারীদের দো‘আ লাভে উপকৃত হন। শিরক ও বিদ‘আতপন্থী ব্যক্তির পাশে সহীহ হাদীসপন্থী মুসলমানের কবর দেওয়া উচিৎ নয়। হযরত জাবের (রাঃ) তাঁর পিতার লাশ অন্য মুসলিমের পাশ থেকে যাকে তিনি অপছন্দ করতেন,৬ মাস পরে উঠিয়ে অন্যত্র দাফন করেছিলেন।(বুখারী হা/১৩৫২ ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০০, ৩০২) মুসলমান যেখানে মৃত্যুবরণ করেন, সেখানকার মুসলিম কবরস্থানে তাকে দাফন করা উচিৎ। তবে সঙ্গত কারণে অন্যত্র নেওয়া যাবে।(ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০৩।)রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাঁর শয়ন কক্ষে দাফন করা হয়েছিল। এটা ছিল তাঁর জন্য ‘খাছ’। তাছাড়া তাঁর পাশে তাঁর দুই মহান সাথীকে কবর দেওয়া হয়েছিল, যাতে কেউ পৃথকভাবে তাঁর কবরকে সিজদার স্থানে পরিণত করতে না পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমানগণ যেখানে শহীদ হবেন, সেখানেই কবরস্থ হবেন।(তালখীছ ৫৯-৬০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০১-০২)
.
মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়ার জন্য ‘লাহদ’ বা ‘শাক্ব’ দু’ধরনের কবর জায়েয আছে। যাকে এদেশে যথাক্রমে ‘পাশখুলি’ ও ‘বাক্স কবর’ বলা হয়।আর নবী (ﷺ) এর যুগে উভয় প্রকার কবরই প্রচলিত ছিল। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, মদীনায় কবর খননকারী ২টি লোক ছিল। একজন লাহাদ এবং অপরজন শাক্ব কবর খনন করত। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর ইন্তিকাল হলে সকলে বলল, আমরা আমাদের প্রভুর নিকট মঙ্গল প্রার্থনা করব এবং দুজনকেই ডেকে পাঠাব। অতঃপর ওদের মধ্যে যে প্রথম উপস্থিত হবে তাকেই কবর খুঁড়তে দেব। তারপর উভয়কে ডেকে পাঠানো হলে লাহদ কবর খননকারী আগে এসে উপস্থিত হল। সুতরাং নবী (ﷺ) এর জন্য খনন করা হল লাহদ কবর। (ইবনে মাজাহ ১৫৫৭, আহমাদ ৩/৯৯ সহীহ ইবনে মাজাহ ১২৬৪ নং)।তবে উভয় প্রকার কবরের মধ্যে লাহাদ বা বগলী কবরই আফযাল বা উত্তম। কারণ এই কবরেই মহানবী (ﷺ)-কে দাফন করা হয়েছিল।উহুদ যুদ্ধের শহীদদের একই ধরনের কবরে দাফন করা হয়েছিল।
.
কবর উত্তর-দক্ষিণে লম্বা, গভীর, প্রশস্ত, সুন্দর ও মধ্যস্থলে বিঘত খানেক উঁচু করে দু’দিকে ঢালু হওয়া বাঞ্ছনীয়।অধিক উঁচু করা নাজায়েয।অবশ্য মাইয়্যেতের দেহ অনুসারে কবরের পরিমাপ ছোট বড় হওয়াই স্বাভাবিক। কবর খুঁড়তে কোন পুরাতন (মাইয়্যেতের) হাড় বাহির হলে তা যত্নের সাথে পুনরায় দাফন করা জরুরী। হাড় যেন কোন প্রকারে ভেঙ্গে না যায় – তা খেয়াল রাখা আবশ্যক। কারণ,নবী (ﷺ) বলেন, “মৃত মুমিনের হাড় ভাঙ্গা জীবিতের হাড় ভাঙ্গার সমান।” (আবু দাউদ ৩২০৭, ইবনে মাজাহ ১৬ ১৬ নং আহমাদ ৬/৫৮, বাইহাকী ৪/৫৮ প্রমুখ, সহীহ আবু দাউদ ২৭৪৬)।মৃতের সংখ্যা বেশি এবং জায়গা কম থাকলে দুই বা ততোধিক লাশ একই কবরে দাফন করা বৈধ। (সহীহ বুখারী: ১৩৪৮)।এক্ষেত্রে দাফনের সময় এদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক দ্বীনদার ও কুরআন পাঠকারী লোককে আগে কবরে (কেবলার দিকে) রাখা হবে। জাবের (রাঃ) বলেন, উহুদের দিন নবী (ﷺ) শহীদদেরকে দাফন করার সময় জিজ্ঞাসা করলেন, “ওদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কুরআন হিফযকারী কে? অতঃপর কারো একজনের প্রতি ইঙ্গিত করা হলে তাকেই সর্বপ্রথম লাহদে রাখা হল। (বুখারী ১৩৪৭, আবু দাউদ ৩১৩৮, তিরমিযী ১০৩৬)।মহিলা ও পুরুষ একই কবরে দাফন করবে না। অবশ্য একান্ত নিরুপায় অবস্থায় যদি নারী ও পুরুষকে একই কবরে দাফন করতেই হয়, তাহলে আগে পুরুষকে তারপর মহিলাকে রেখে উভয়ের মাঝে ইট, পাথর, বালি অথবা মাটির পর্দা (আড়াল) করে দিতে হবে।(আহকামুল জানাইয ১৪৭পৃঃ টীকা, ইআশাঃ ১১৮৮৯- ১১৮৯৩)।দূর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে মারা যাওয়ায় পূর্ণাঙ্গ দেহ পাওয়া না গেলে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুই গোসল, কাফন ও জানাযা শেষে দাফন করে নেবে। (ফাতাওয়া তাযিয়াহ পৃ. ২৩)।তবে মৃতার গর্ভে জীবিত সন্তান থাকলে তা অপারেশন করে বের করা ওয়াজিব। (আহকামুল জানাইয ২৩৪পৃঃ)
.
মাইয়্যেতকে কবরে নামানোর দায়িত্ব পুরুষদের।মৃতে ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নিকটবর্তীগণ ও সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তিগণ এই দায়িত্ব পালন করবেন।আলী (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে গোসল দিলাম। অতঃপর মরণের প্রভাব তার চেহারায় দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। তিনি জীবন ও মরণ উভয় অবস্থাতেই ছিলেন চির সুন্দর।তার দাফন কার্যের ভার অর্পিত ছিল চার ব্যক্তির উপর; আলী, আব্বাস, ফাযল এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর স্বাধীনকৃত ক্রীতদাস সালেহ। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর জন্য লাহদ তৈরী করে তাতে তাকে রেখে (কাঁচা) ইট গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। (হাকেম ১/২৬২, বাইহাকী ৪/৫৩)
স্ত্রীর লাশ তার স্বামী নামাতে পারে। তবে শর্ত হল যিনি পূর্বরাতে (বা দাফনের পূর্বে) স্ত্রী সহবাস করেননি। তা করে থাকলে তার জন্য লাশ নামানো জায়েজ নয়। বরং এ ক্ষেত্রে অন্য কোন আত্মীয় অথবা কোন বেগানাই লাশ নামাবে। অবশ্য তাদের ক্ষেত্রেও এ শর্ত পালনীয়। কারণ,আনাস (রাঃ) বলেন-নবী (ﷺ) এর এক কন্যা (উম্মে কুলসুম) এর দাফন কার্যের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কবরের পাশে বসে আছেন। আর তার চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত ছিল। অতঃপর (লাশ নামানোর সময়) তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে (গত) রাত্রে স্ত্রী সহবাস করেনি?” আবু তালহা বললেন, আমি আছি, হে আল্লাহর রাসূল!” তিনি বললেন, “তাহলে তুমি ওর কবরে নামো।” এ শুনে আবু তালহা কবরে নামলেন। (বুখারী ১২৮৫নং, হাকেম ৪/৪৭, বাইহাকী ৪/৫৩, আহমাদ ৩/১২৬ প্রমুখ।)
অবশ্য মহিলার লাশের ক্ষেত্রে যদি তার বেগানা কোন পুরুষ কবরে নামে তাহলে একান্ত সৎ ও বৃদ্ধ লোক হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাহরাম হওয়া শর্ত নয়। কবরের পায়ের দিক হতেই লাশ নামানো সুন্নত। (অসুবিধা হ’লে যেভাবে সুবিধা সেভাবে নামাবে)। আবু ইসহাক বলেন, হারেস অসিয়ত করেছিলেন যে, তার জানাযার নামায যেন আব্দুল্লাহ বিন যায়দ পড়ে। সুতরাং আব্দুল্লাহ তার জানাযা পড়লেন। অতঃপর কবরের পায়ের দিক হতে তাকে কবরে নামালেন এবং বললেন, এভাবে লাশ নামানো সুন্নাহ(নবী (ﷺ) এর তরীকা)।” (ইবনে আবী শাইবাহ ৪/১৩০, আবু দাউদ ৩২১১, বাইহাকী ৪/৫৪) অনুরূপ ছিল আনাস (রাঃ)-এর আমলও। (আহমাদ ৪০৮ ১নং, ইআশা ৪/ ১৩০)।বলা বাহুল্য, লাশের মাথার দিক হতে লাশ নামানোর হাদীস সহীহ নয়। (আকামুল জানাইয, আলবানী ১৫০- ১৫১পৃঃ) মোর্দাকে ডান কাতে ক্বিবলামুখী করে শোয়াবে।মাইয়্যেতকে তার কবরে (পিঠ ও মাথার নিচে কিছু মাটি বা ঢেলা রেখে) ডান পার্শ্বে শায়িত করবে। তার মুখমন্ডল হবে কেবলার প্রতি, মাথা হবে কেবলার ডানে এবং পা দুটি কেবলার বামে (উত্তর-দক্ষিণে)। (শায়খ বিন বায, মাজমূউ ফাতাওয়া ১৩/১৯০ পৃ.; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৮/৪২৬ পৃ.মুহাল্লা ৫/ ১৭৩, আহকামুল জানাইয ১৫১পৃঃ)।লাশ রাখার পর কাফনের বাঁধনগুলো খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে যদিও কোন সহীহ হাদীস মহানবী (ﷺ) কর্তৃক বর্ণিত হয়নি,তবুও কিছু সংখ্যক আছার দ্বারা বুঝা যায় যে, এমন আমল সলফের যুগে প্রচলিত ছিল। সুতরাং বাঁধন খোলা জায়েজ।(দেখুন ইবনে আবী শাইবাহ ১ ১৬৬৯- ১১৬৭৩নং, সিলসিলাহ যয়ীফাহ ৪/২৫৭, ফিকহুস সুন্নাহ ১/৪৮১)।বলা বাহুল্য, লাশের মাথার দিক হতে লাশ নামানোর হাদীস সহীহ নয়। (আকামুল জানাইয, আলবানী ১৫০-১৫১পৃঃ)।পক্ষান্তরে মাইয়্যেতের চেহারা খুলে রাখার কোন ভিত্তি বা দলীল সুন্নাহতে নেই। মাইয়্যেত মুহরিম হলে তার চেহারা ও মাথা খোলা থাকবে। (মহিলা হলে পর্দার আবরণ থাকা জরুরী।)অনেকে (পুরুষ মাইয়্যেতের) ডান গাল খুলে মাটিতে লাগিয়ে দেওয়া বিধেয় মনে করেন। কারণ, এরূপ করতে উমার (রাঃ) অসিয়ত করেছিলেন। সুতরাং তা সত্য হলেও পূর্ণ চেহারা খুলে রাখার কথা প্রমাণ হয় না। (দেখুন, আশারহুল মুমতে’, ইবনে উষাইমীন ৫/৪৫৬)।কবরে শোয়ানোর সময় بِسْمِ اللهِ وَعَلَى مِلَّةِ رَسُوْلِ اللهِ বিসমিল্লা-হি ওয়া ‘আলা মিল্লাতে রাসূলিল্লা-হ’ (অর্থ: ‘আল্লাহর নামে ও আল্লাহর রাসূলের দ্বীনের উপরে’) বলবে। ‘মিল্লাতে’-এর স্থলে ‘সুন্নাতে’ বলা যাবে। এই সময় কোন সুগন্ধি বা গোলাপ পানি ছিটানো বিদ‘আত।(তালখীছ, পৃঃ ১০২)
.
এরপর মাথার দিক থেকে কাঁচা ইট পরস্পর থাকিয়ে কাদা লেপে বগলী কবরের ফাঁক বন্ধ করবে।
কবর বন্ধ করার পরে উপস্থিত সকলে (বিসমিল্লাহ বলে) তিন মুঠি করে মাটি কবরের মাথার দিক থেকে পায়ের দিকে ছড়িয়ে দেবে।(তালখীছ, পৃঃ ৫৮-৬৫, ৬৯; মির‘আত ৫/৪২৬-৫৭)।এ সময় ‘মিনহা খালাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নু‘ঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তা-রাতান উখরা।’(সূরা ত্বোয়াহা ২০/৫৫)।পড়ার কোন দলিল সহীহ নয়।(আহমাদ হা/২২২৪১, সনদ যঈফ; তালখীছ পৃঃ ১০২; আলবানী, আহকামুল জানায়েয, টীকা দ্রঃ, মাসআলা নং ১০৬ দ্রঃ)।অনুরূপভাবে আল্লা-হুম্মা আজিরহা মিনাশ শায়ত্বা-নি ওয়া মিন ‘আযা-বিল ক্বাবরে… পড়ার কোন সহীহ ভিত্তি নেই।(ইবনু মাজাহ হা/১৫৫৩, সনদ যঈফ)
দাফন চলাকালীন সময়ে কবরের নিকটে বসে কবরের আযাব, জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন ও জান্নাতের সুসংবাদের উপরে কুরআন ও সহীহ হাদীস থেকে আলোচনা করবে। এই সময় প্রত্যেকে দু’তিনবার করে পড়বে- اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন ‘আযা-বিল ক্বাবরি।’(হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকটে কবরের আযাব হ’তে পানাহ চাই)।(আহমাদ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৩০ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫ অনুচ্ছেদ-৩)
দাফনের পরে মাইয়্যেতের ‘তাছবীত’ (التثبيت) অর্থাৎ মুনকার ও নাকীর (দু’জন অপরিচিত ফেরেশতা)-এর সওয়ালের জওয়াব দানের সময় যেন তিনি দৃঢ় থাকতে পারেন,সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে সকলের দো‘আ করা উচিৎ। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِسْتَغْفِرُوْا لِأَخِيْكُمْ وَسَلُوا اللهَ لَهُ التَّثْبِيْتَ فَإِنَّهُ اَلْآنَ يُسْأَلُ ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার দৃঢ় থাকার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ কর। কেননা সত্বর সে জিজ্ঞাসিত হবে।’(আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৩৩, ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘কবর আযাবের প্রমাণ’ অনুচ্ছেদ-৪)
অতএব এ সময় প্রত্যেকের নিম্নোক্ত ভাবে দো‘আ করা উচিৎ। যেমন,(১) اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَثَبِّتْهُ ‘আল্লা-হুম্মাগফির লাহূ ওয়া ছাব্বিতহু।’(অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন ও তাকে দৃঢ় রাখুন’)।(আবুদাঊদ, হাকেম, হিছনুল মুসলিম, দো‘আ নং ১৬৪)।অথবা(২) اَللَّهُمَّ ثَبِّتْهُ بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ ‘আল্লা-হুম্মা ছাব্বিতহু বিক্বাউলিছ ছা-বিত।’(হে আল্লাহ! আপনি তাকে কালেমা শাহাদাত দ্বারা সুদৃঢ় রাখুন)। এই সময় ঐ ব্যক্তি দো‘আর ভিখারী। আর জীবিত মুমিনের দো‘আ মৃত মুমিনের জন্য খুবই উপকারী। আরবী দুআ না জানলে নিজের ভাষাতেই অনুরূপ দুআ করবে সকলেই। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের একাকী দুআ করতে হবে। পক্ষান্তরে জামাআতী দুআ,অর্থাৎ একজন বা ইমামের দুআ করা এবং বাকী সকলের (হাত তুলে) ‘আমীন-আমীন’ বলা আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর সুন্নত নয়। আর না-ই তা খোলাফায়ে রাশেদীন বা কোন সাহাবার তরীকা। এখানে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কেবল সকলকে উক্তরূপ দুআ করতে নির্দেশ দিতেন। এতে প্রত্যেকে নিজে নিজের মনে দুআ করতেনএ স্থলে এও খেয়াল রাখা উচিত যে,যে দুআ করা হবে তা যেন মৃতের আত্মার জন্য কল্যাণমূলক হয়।অপ্রাসঙ্গিক লম্বা দুআও এখানে জায়েজ নয়।এই সময় মাইয়েতের তালক্বীনের উদ্দেশ্যে সকলের লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ পাঠের কোন দলীল নেই। যেটা শাফেঈ মাযহাবে ব্যাপকভাবে চালু আছে।(মিরক্বাত ১/২০৯; মির‘আত ১/২৩০)
দাফন চলাকালে বসে বসে ইমামের নসীহত করা এবং মৃত্যু সম্পর্কে সকলকে অবহিত ও সতর্ক করা,রূহের অবস্থা ও অবস্থান প্রসঙ্গে আলোচনা করা বৈধ।যেমন পুর্বেই আলোচনা হয়েছে। অন্যথা এই সময় বিতর্কিত কোন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অথবা কোন পার্থিব বিষয় নিয়ে হৈ-হাল্লা করা বৈধ নয়। বরং এ সময়ে কেবল পরপারের পথিকের পথ ও যাত্রা নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় নীরব ও শান্ত থাকাই উচিত। (ফাতাওয়াত তা’যিয়াহ ৩৪ পৃঃ)
দাফনের পর কোন সঠিক কারণ ও প্রয়োজনে কবর খুলে লাশ বের করা ও পুনঃ দাফন করা বৈধ। জাবির (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে দাফন করার পর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তার কবরের কাছে এলেন। অতঃপর তিনি তার লাশ বের করতে আদেশ করলেন। সে লাশ তাঁর হাঁটুর উপরে রেখে তার উপর থুথু মারলেন এবং তাঁর নিজের কামীস পরিয়ে দিলেন। জাবির (রাঃ) আরো বলেন, ‘অতঃপর তিনি তার জানাযা পড়লেন। আর এর কারণ আল্লাহই অধিক জানেন। তবে আব্দুল্লাহ আব্বাস (রাঃ)-কে একটি কামীস পরিয়েছিল।(বুখারী ১৩৫০, মুসলিম ২৭৭৩নং)
প্রস্তুতি স্বরূপ পূর্বে নিজের জন্য কবর খুঁড়ে রাখা বিদআত।কবরের উপর খেজুর ডাল গাড়া আমাদের জন্য বিধেয় নয়।আল্লাহর রাসূল (ﷺ) দুটি কবরের পাশ দিয়ে পার হওয়ার সময় ওহী মারফৎ জানতে পারলেন যে, উভয় মাইয়্যেতের আযাব হচ্ছে।— অতঃপর তিনি একটি ভিজে খেজুর ডাল মাঝামাঝি ফেড়ে দুই ভাগ করে কবরে গেড়ে দিলেন।আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং উক্ত দুই কবরের জন্য খাস(বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র ব্যাপার সবার জন্য নয়)।(বুখারী ১৩৬১, মুসলিম ৩০১২)।বাকী জন্তু-জানোয়ারের ঘোড়ার ভয়ে কবরের উপর কাটা ইত্যাদি রাখা দূষণীয় নয়। তদনুরূপ কবরের উপর মসুর ডাল ছড়ানো উক্ত উদ্দেশ্যে বৈধ। নচেৎ বিদআত।
অমাবস্যার সন্ধ্যায় বা রাত্রে দাফন হলে নাকি কবর পাহারা দিতে হয়। এটা কোন শরয়ী বিধান নয়। তবে লাশের মাথা চুরি হওয়ার কথা যদি সত্য হয়, তবে পাহারা দেওয়াই উচিত। যেমন-যেখানে কাফন চোরের ভয় থাকে সেখানে অমাবস্যা না হলেও পাহারা দেওয়া কর্তব্য। যাতে লাশের কোন প্রকার ক্ষতি ও সম্মানহানি না হয়।
মৃতদেহের মাংসাদি নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত যদি কবর ধসে গিয়ে লাশ বের হয়ে যায়, তবে নবরূপে কবর পুনর্নিমাণ করা উচিত। যাতে দুর্গন্ধ না ছড়ায় ও জন্তু জানোয়ার লাশের ক্ষতি না করতে পারে। এরূপ করলে মৃতের আযাব বাড়বে ধারণা ভিত্তিহীন।কবরের উপর কোন প্রকারের গাছ অথবা ফুল গাছ লাগানো বৈধ নয়। কারণ এই গাছেই পরবর্তী কালে শির্কের আড়ডা হতে পারে। পক্ষান্তরে কবর চিহ্নিত করার জন্য পাথর ব্যবহারে অনুমতি আছে। বৃক্ষ রোপণে নয়। (মু’জামুল বিদা” ১৪৮ পৃঃ)।নোট জানাজা দর্পন ও সালাতুর রাসূল সাঃ)(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
____________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি