ইসলামে মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে সন্তান প্রতি পালনের ২২ হক

ইসলামে মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে সন্তান প্রতি
পালনের ২২ হক যা পালন করা প্রত্যেক পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।
________________🔰🌓🔰__________________
ভূমিকা: সন্তান মানুষের জন্য মূল্যবান সম্পদ ও দুনিয়ার সৌন্দর্য স্বরূপ। পৃথিবীর প্রতিটি গৃহে প্রত্যেক ব্যক্তি সন্তান কামনা করে সন্তানের উপস্থিতি যেমন কল্যাণ বয়ে আনে, তেমনি গৃহের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করে। যে গৃহে নিষ্পাপ শিশুর কল-কাকলি থাকে না, সে গৃহের শোভা ও সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। মহান আল্লাহ যাদের দান করেছেন তাদের এই অমূল্য সম্পদকে ছোট থেকে যেভাবে প্রতিপালন করা হবে সেভাবে গড়ে উঠবে। ছেলে-মেয়েকে ইসলামী আদর্শে গড়ে তুললে তারা দুনিয়াতে যেমন উপকারে আসবে তেমনি পিতা মাতার জন্য তারা পরকালে মুক্তির কারণ হবে মহান আল্লাহ বলেন, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন’[সূরা আল-কাহ্ফ :৪৬]।

🔰🔰এক নজরে গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তানকে সুসন্তান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য পিতা-মাতার কিছু দায়িত্ব ও কর্ত্বব্য রয়েছে। সেগুলো নিম্নে ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা করা হল:
_____________________________________________
🌓1️⃣ সন্তানের জন্য প্রার্থনা করাঃ

সুসন্তান লাভ করতে হলে স্বামী স্ত্রীর জন্য যেই কাজটি সর্বপ্রথম করা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে দোয়া হাদিসে দোয়াকে ইবাদত বলা হয়েছে তাছাড়া আল্লাহর নিকট বান্দার দোয়ার চেয়ে অধিক প্রিয় ও মর্যাদাপূর্ণ জিনিস আর নেই।’ [তিরমিজি : ৩৩৭০]। তাই সন্তান জন্ম গ্রহণ করার পূর্বে সুসন্তান লাভের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে। নবী-রাসূলগণ সুসন্তানের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছেন। ইবরাহীম (আঃ) বৃদ্ধ বয়সে সন্তান প্রার্থনা করে বলেছিলেন, হে আমার রব! আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান কর’ [সূরা ছাফ্ফাত ৩৭/১০০]। মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল তারা সন্তানদের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের মাধ্যমে চক্ষুশীতলকারী বংশধারা দান কর এবং আমাদেরকে আল্লাহভীরুদের জন্য আদর্শ বানাও’ [সূরা ফুরক্বান ২৫/৭৪]।

🌓2️⃣গর্ভধারণ : মহান আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে গর্ভে অনাগত সন্তানকে মা অত্যন্ত আনন্দচিত্তে গ্রহণ করবেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গর্ভে ধারন করবেন। এজন্য তিনি তার দেহ-মনকে সুস্থ, পূত-পবিত্র ও কলুষমুক্ত রাখবেন। সন্তানের মঙ্গলের নিমিত্তে নিজ স্বাস্থ্যের প্রতি সদা সতর্ক থাকবেন। সন্তানকে আপদ মনে করে বিনষ্ট করার চেষ্টা করবেন না। প্রয়োজনে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিবেন গর্ভস্থ সন্তানের জন্য এবং সাগ্রহে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট মাথা পেতে নিতে প্রস্ত্তত থাকবেন। তবেই সন্তানের প্রতি মায়ের যথাযথ কর্তব্য পালন করা হবে। মায়ের এ কঠিন দায়িত্ব সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে,তার মাতা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছেন’[ সূরা লোকমান ৩১/১৪]।

🌓3️⃣গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি, সুস্থতা ও সেবাযত্নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ:

শিশু সুস্থ ও শক্তি-সামর্থ্যবান হওয়া প্রতিটি পরিবারের কাম্য। এজন্য গর্ভবতী মায়ের প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে পিতাকে। গর্ভবতী মায়ের প্রতি পিতার যথাযথ দায়িত্ব ও কর্তব্যই গর্ভস্থ সন্তানের অধিকার। এই দায়িত্ব পিতা নিষ্ঠার সাথে পালন করলে সম্পূর্ণ সুস্থভাবে শিশু জন্মলাভ করার যথার্থ অবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সাধারণ অবস্থার চেয়ে গর্ভকালীন সময়ে মায়ের পুষ্টিকর খাদ্যের বেশী প্রয়োজন হয়। মা সুস্থ সবল না থাকলে, সুস্থ সবল সন্তান জন্ম দিতে পারে না। কাজেই যে সমস্ত খাদ্যে বেশী পরিমাণ ভিটামিন রয়েছে, সেরূপ খাদ্য সরবরাহ করতে পিতা সদা সচেষ্ট থাকবেন।আধুনিক বিজ্ঞানের মতে ফলমূলে অধিক পরিমাণে সুগার আছে যা সহজে হজম হয় এবং এ থেকে শরীর গ্রহণ করে জীবনী শক্তি ও খাদ্যপ্রাণ। ফলমূল দেহের ক্ষয়প্রাপ্ত শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। এ কারণে মহান আল্লাহ মারয়াম (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, তোমার দিকে খেজুর বৃক্ষের কান্ডকে ঝুঁকিয়ে নাও, সে তোমার উপর পতিত করবে তাজা উপাদেয় খেজুর, তা তুমি খাও ও পান কর এবং নয়ন জুড়াও’[সূরা মারয়াম ১৯/২৫-২৬]।

সন্তানের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে রামাযানের ছিয়াম থেকে বিরত থাকার বিষয়ে শরী‘আতের অনুমোদন আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
আল্লাহ তা‘আলা মুসাফির হ’তে অর্ধেক ছালাত, স্তন্যদানকারিনী মাতা ও গর্ভবতী স্ত্রী লোক হ’তে ছিয়াম উঠিয়ে নিয়েছেন’। অর্থাৎ ছিয়ামের বাধ্যবাধকতা থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছেন যা পরে কাযা আদায় করে নিতে পারবে। [আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/২০২৫, সনদ জাইয়িদ বা উত্তম]।

🌓4️⃣ শিশু জন্মের পর তাহনীক্ব করা: তাহনীক শব্দের অর্থ হল, খেজুর বা কোনো মিষ্টান্ন বস্তু কোনো সুস্থ ব্যক্তি চিবিয়ে সেটি সদ্য ভূমিষ্ট বাচ্চার জিহ্বায় ঘষে দেওয়া, আয়েশা [রাঃ] বলেন, রাসূল [সাঃ] এর কাছে শিশুদেরকে আনা হ’ত। তিনি তাদের জন্যে বরকত ও কল্যাণের দো‘আ করতেন এবং ‘তাহনীক্ব [খেজুর চিবিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিতেন] করতেন। [মুসলিম হা/২৮৪; মিশকাত হা/৪১৫০]।

আবু মূসা আশ‘আরী [রাঃ]বলেন, আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মালে আমি তাকে নিয়ে নবী করীম [সাঃ] এর কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইব্রাহীম। তারপর খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং তার জন্য বরকতের দো‘আ করলেন অতঃপর আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। [বুখারী হা/৫৪৬৭, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৮৪০; আহমাদ হা/২৪৬৬৩]।

উল্লেখ্য যে সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেওয়া’ সম্পর্কিত হাদীছটি শায়খ আলবানী [রহঃ] পূর্বে ‘হাসান’ [আবু দাঊদ হা/৫১০৫, ইরওয়া হা/১১৭৩] হিসাবে গণ্য করলেও পরবর্তীতে তিনি এটিকে ‘যঈফ’ হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, আমি ইতিপূর্বে আবু রাফে‘ বর্ণিত এ হাদীছটি ‘হাসান’ বললেও এখন আমার নিকটে বর্ণনাটি যঈফ হিসাবে স্পষ্ট হয়েছে [সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১২১]। এ ব্যাপারে অপর মুহাক্কিক শু‘আইব আরনাউত্বও ঐক্যমত পোষণ করেছেন [তাহকীক মুসনাদে আহমাদ হা/২৭২৩০] তবে আযান দেয়ার উপরোক্ত হাদিসটি অনেক মুহাদ্দিস যেমন ইমাম তিরযিমী, নববী, ইবনে মুলক্বিন প্রমুখ হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন যেহেতু মতানৈক্য আছে তাছাড়া যুগে যুগে মুসলিমদের মাঝে এই আমল চলে আসছে। সুতরাং নব জাতক শিশুর কানে আযান দেয়া জায়েজ রয়েছে-এটাই অধিক গ্রহণযোগ্য মত। [আরো বিস্তারিত রয়েছে- আল-মাজরূহীন, ২য় খ-, পৃ. ১১০; আল-মাজমূ‘ শরহে মুহাযযাব, ৮ম খ-, পৃ. ৪৩৪; আল-বাদরুল মুনীর, ৯ম খ-, পৃ. ৩৪৮; আল-কালিমুত তাইয়্যিব, পৃ. ২১১।] এজন্য অনেক আলেমই মুস্তাহাব মনে করেন যে, যখন কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তখন তার কানে আযান দেয়া হবে, যাতে শয়তান তার থেকে বিতাড়িত হয় এবং তার শোনা প্রথম কথা যেন আল্লাহর যিকির হয়।

🌓5️⃣মায়ের বুকের দুধ পান করানা: গাছের শাখা যেমন মূলের মুখাপেক্ষী, তেমনি শিশু জন্মের পর মায়ের উপর নির্ভরশীল। শিশুর জন্মের সাথে সাথে আল্লাহর রহমতে মাতৃস্তনে সৃষ্টি হয় শিশুর উপযোগী খাবার। সুতরাং পৃথিবীতে কোন মা যেন বিশেষ কারণ ছাড়া স্বীয় দুধপান থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করে শিশুর অধিকার অস্বীকার না করেন। সন্তানকে দুধপান করানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন‘যে সকল জননী সন্তানদের পুরো সময় পর্যন্ত দুগ্ধ দান করতে ইচ্ছা রাখে, তারা নিজেদের শিশুদেরকে পুরো দু’বছর ধরে দুগ্ধ পান করাবে’ [সূরা বাক্বারাহ ২/২৩৩]।

তবে দু’বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও দুধ পান করালে কোন দোষ নেই। মূলতঃ আয়াত সমূহে দু’বছর দুধ পান করানোর সময়সীমা নির্ধারণের উদ্দেশ্য হ’ল, দু’বছর পর যদি কোন বাচ্চা অন্য কোন মহিলার দুধ পান করে, তাহ’লে ঐ বাচ্চা তার দুধ সন্তান হিসাবে গণ্য হবে না। বরং তা সাধারণ খাদ্য হিসাবে গণ্য হবে’ [তাফসীর ইবনে কাছীর; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩৪/৬৩]।

🌓6️⃣শিশুর সুন্দর নাম রাখা: শিশুর জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।সন্তানের সুন্দর ও ভাল অর্থবোধক নাম রাখতে হবে। কারণ তার এ নামই জীবন চলার পথে প্রভাব ফেলতে পারে। জন্মের পরেই সন্তানের নাম রাখা যাবে এবং সপ্তম দিনে আক্বীকার সময়েও নাম রাখা যায়। রাসূল [সাঃ] সুন্দর নাম রাখার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেন,তোমরা যখন আমার কাছে কোন দূত পাঠাবে তখন সুন্দর চেহারা ও সুন্দর নাম বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পাঠাবে’। [ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৩৬৭৯; ছহীহাহ হা/১১৮৬] রাসূলুল্লাহ [সাঃ] মন্দ নাম পরিবর্তন করে দিতেন। [তিরমিযী হা/২৮৩৯; মিশকাত হা/৪৭৭৪; ছহীহাহ হা/২০৭] এমনকি কোন গ্রাম বা মহল্লার অপসন্দনীয় নামও তিনি পরিবর্তন করে দিতেন। [ত্বাবারাণী, ছহীহাহ হা/২০৮]রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সবচেয়ে উত্তম নাম হ’ল আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৭৫২]।

🌓7️⃣. আক্বিকা ও সদকা করা:

সন্তান জন্মের ৭ম দিনে আক্বীক্বা করা সুন্নাত। এটা পিতা বা অভিভাবকের দায়িত্ব। ৭ম দিনের আগে কিংবা পরে কেউ আক্বীক্বা করলে সেটা সুন্নাত মোতাবেক হবে না। আক্বীকার ক্ষেত্রে ছেলের জন্য ২টি ও মেয়ের জন্য ১টি ছাগল দ্বারা আক্বীক্বা করাই সুন্নাত [তিরমিযী, আবূদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৪১৫২,৫৬]। অবশ্য সমস্যা থাকলে ছেলের জন্য একটাও দেয়া যায় [আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৪১৫৫]।

অর্থাৎ সুন্নাত হ’ল সপ্তম দিনে শিশুর জন্য আক্বীক্বা দেওয়ার পরে তার মাথা মুন্ডন করা। সপ্তম দিনে শিশুর নাম রাখবে, এরপর আক্বীক্বা করবে, এরপর মাথা ন্যাড়া করবে এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য ছাদাক্বা করবে [আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৬/১০৭; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১০/১৫]।

উল্লেখ্য যে ১৪ ও ২১ দিনে আক্বীক্বা সম্পর্কে ত্বাবারাণী ও বায়হাক্বী বর্ণিত হাদীছটি নিতান্তই যঈফ[তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৮৭ পৃঃ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ]।

🌓8️⃣. খাতনা করা: খাৎনা করা ইসলামের স্বভাবগত সুন্নাত এবং অন্যতম নিদর্শন [মুত্তাফাক্ব মিশকাত হা/৪৪২০] ইবরাহীম [আঃ] আল্লাহর হুকুমে আশি বছর বয়সে নিজের খাৎনা করেছিলেন[বুখারী হা/৩৩৫৬] জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সপ্তম দিবসে আকীকা এবং খাতনা করিয়েছেন। [আল-মু‘জামুল আওসাত: ৬৭০৮]। কিন্তু খাৎনার অনুষ্ঠান করা যাবে না। রাসূল [সাঃ]-এর স্বর্ণ যুগে এর কোন প্রচলন ছিল না। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, ওছমান ইবনুল আ‘ছ [রাঃ]-কে এক খাৎনার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে তিনি বললেন, আমরা রাসূল [সাঃ]-এর যুগে কোন খাৎনার অনুষ্ঠানে যেতাম না, এমনকি ডাকাও হত না [আহমাদ হা/১৭৯০৮; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭২২-এর আলোচনা দ্রঃ, ২/২২১ পৃঃ]।

🌓9️⃣. সন্তানের প্রথম শিক্ষা: সন্তান জন্মগ্রহণের পর চারমাস বয়স থেকে পিতা-মাতার কথা বুঝতে শেখে এবং সাত-আট মাস বয়স থেকে আব্বু-আম্মু বলে ডাকতে শেখে। দু’বছর বয়সে সন্তান আল্লাহর রহমতে সুন্দরভাবে সব কথা বলা শিখে যায়। আপনার-আমার সবার প্রাণপ্রিয় সোনামণিটা প্রথম যখন আধো আধোভাবে সুমধুর কণ্ঠে কথা বলা শুরু করে, তখন আমাদের হৃদয়ের গভীরে অপূর্ব এক আনন্দের ফোয়ারা অনুভূত হয়। সেই মোক্ষম সময়ে মহান আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছোট ছোট শব্দ, বাক্য, তাসবীহ ও দু‘আর মাধ্যমে। এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহয় অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর’ [সূরা আল-আহযাব : ৪১-৪২] আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় বাক্য ৪টি। (ক) সুবহা-নাল্লাহ (খ) আল-হামদুলিল্লাহ (গ) লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (ঘ) আল্লাহু আকবার। তুমি এগুলোর যেকোন একটি দ্বারা শুরু করলে তোমাকে কোন ক্ষতি করবে না’। [ছহীহ মুসলিম, হা/২১৩৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩৮১১; মিশকাত হা/২২৯৪]।

🌓🔟. বিশুদ্ধ আক্বীদার প্রশিক্ষণ: পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সের সন্তানদের আক্বীদার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। মূলত কর্ম ছাড়া কোন বিষয়ে সন্দেহাতীত চূড়ান্ত বিশ্বাসই আক্বীদা। তাই আল্লাহকে না দেখে, ফেরেশতা, জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর, ক্বিয়ামত, কবরের আযাব ইত্যাদি অদৃশ্য বিষয় না দেখে শুধু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনা সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করার নাম আক্বীদা।[ছালেহ ফাওযান আল-ফাওযান, আক্বীদাতুত তাওহীদ, পৃ.১]।

যার আক্বীদা নষ্ট, সে পথভ্রষ্ট। কেননা আক্বীদা মুসলিম জীবনের মূল সম্বল। আক্বীদা বিশুদ্ধ হলে মুসলিম জীবনের সকল আমল বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে কুফরী করবে তার আমল নষ্ট হয়ে যাবে’[সূরা আল-মায়িদাহ :৫]।

রাসূলুল্লাহ [ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বলেন,নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল কবুল করবেন না, যদি তার জন্য তা খালেছ হৃদয়ে ও তার সন্তুষ্টির জন্য না করা হয়’।[নাসাঈ, হা/৩১৪০, সনদ ছহীহ]।

🌓1️⃣1️⃣. কুরআন শিক্ষা দান: কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্যই হ’ল পরিপূর্ণ বুঝা, অনুধাবন করা ও সে অনুযায়ী কাজ করা। শুধুমাত্র পাঠ করা ও মুখস্ত করা নয়। যদিও তাতে রয়েছে অশেষ নেকী তাই ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। কেননা কুরআন শিক্ষা করা ফরয। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কুরআনের জ্ঞান দাও। [জামিউল কাবীর] কুরআন তেলোয়াতে প্রতিটি হরফের বিনিময়ে দশটি নেকী রয়েছে [তিরমিযী হা/২৯১০; মিশকাত হা/২১৩৭]। কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’’ [সহীহ বুখারী:৫০২৭]।

🌓1️⃣2️⃣.শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া: পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব হ’ল সন্তানকে আদব শিক্ষা দেওয়া। পায়খানা পেশাব করার পদ্ধতি, বাড়ীতে প্রবেশ ও বের হওয়ার দো‘আ, সকলের সাথে সদাচারণ, সালাম বিনিময়, শিক্ষক ও গুরুজনদের সম্মানসহ সকল বিষয়ে সন্তানকে শিক্ষা দিবে পিতা-মাতা। প্রয়োজনে শাসন করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি তোমার পরিবারের উপর হ’তে শিষ্টাচারের লাঠি উঠিয়ে নিও না’। [আহমাদ হা/২২১২৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৭০; মিশকাত হা/৬১]।

তিনি আরো বলেন তোমরা লাঠি ঐ জায়গায় লকটিয়ে রাখ যেখানে গৃহবাসীর দৃষ্টি পড়ে। কারণ এটা তাদের জন্য আদব তথা শিষ্টাচারের মাধ্যম’। [মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৩২১৭; ছহীহাহ হা/১৪৪৭]।

শাসন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। শারীরিক শাসনের ক্ষেত্রে দশ বেত্রাঘাতের বেশী করা যাবে না। তবে তিন বেত্রাঘাতে সীমাবদ্ধ থাকা ভাল। এমন আঘাত করা যাবে না যাতে সন্তানের দেহ ক্ষত হয়ে যায়। রাসূল [সাঃ] বলেন, আল্লাহর দন্ডবিধি ব্যতীত কোন ক্ষেত্রে দশ বেত্রাঘাতের বেশী শাস্তি নেই।[বুখারী হা/৬৮৪৯; মিশকাত হা/৩৬৩০]।

ইবনু ওমর [রাঃ] কুরআন পাঠের উচ্চারণে ভুল করার কারণে স্বীয় সন্তানকে প্রহার করছিলেন।[আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৮৮০, সনদ ছহীহ]।

🌓1️⃣3️⃣.সন্তানকে পর্দা ও ইবাদত পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া: সন্তানকে ছোট থেকেই যাবতীয় ইবাদত পালনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাকে আক্বাঈদ, তাওহীদ, রিসালাত ও শিরক-বিদ‘আত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। বিশেষতঃ পর্দা সালাত ও সিয়ামের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘আর তুমি তোমার পরিবারকে ছালাতের আদেশ দাও এবং তুমি এর উপর অবিচল থাক’[সূরা ত্বাহা ২০/১৩২]।

তিনি আরো বলেন,আর তুমি তোমার নিকট আত্মীয়দের সতর্ক কর’ [সূরা শু‘আরা ২৬/২১৪]।

রাসূলুল্লাহ [সাঃ] বলেন, আমর ইবনু শু‘আইব [রাঃ] তার পিতা অতঃপর দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘তোমাদের সন্তান যখন সাত বৎসরে পদার্পণ করে তখন তাকে ছালাতের প্রশিক্ষণ দাও। আর দশ বছর হ’লে তাকে ছালাতের জন্য শাসন কর এবং তাদের পরস্পরের বিছানা আলাদা করে দাও’। [বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/৩০৫৩, আবু দাঊদ হা/৪৯৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪০২৬; মিশকাত হা/৫৭২]।

পশাপাশি শারীরিক গঠনে পরিবর্তন দেখা দিলে এবং মেয়েদের ক্ষেএে সাবালিকা হ’লে তাদের উপর পর্দা ফরয হয়ে যায়। তবে সাবালিকা হওয়ার পূর্ব থেকেই পর্দার সালাত সিয়ামের অভ্যাস গড়ে তোলা যরূরী [ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৭/২১৯]।

ছাহাবায়ে কেরাম ছোট বাচ্চাদের ছালাত ও ছিয়ামের প্রশিক্ষণ দিতেন। তারা ছোট শিশুদের সাথে করে ছালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে যেতেন। রুবা‘ই বিনতে মু‘আবিবয [রাঃ] বলেন, পরবর্তীতে আমরা ঐ দিন [আশূরার] ছাওম পালন করতাম এবং আমাদের শিশুদের ছাওম পালন করাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরী করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ঐ খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত। [বুখারী হা/১৯৬০
মুসলিম হা/১১৩৬]।

🌓1️⃣4️⃣ব্যবহারিক শিক্ষা দান: মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এমন গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ রয়েছে, যা একজন মানুষ জীবনের বাল্যকাল হ’তে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হ’লে বড় হয়ে তা পালনে ব্যর্থ হয়। নিজের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় গোছানো, ঘর-দুয়ার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, অযূ-গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করা ইত্যাদি বিষয়ে সন্তানকে শিক্ষা দিতে হবে। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানকে গৃহস্থালী কাজ-কর্মে অভ্যস্ত করে তোলা, রান্না-বান্না ও অন্যান্য কাজের শিক্ষা দিয়ে দক্ষ ও সুনিপুণ করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে তারা স্বামীর ঘরে আদর্শ গৃহিনী হ’তে পারে। মানুষের চলার পথে ব্যবহারিক জীবনের কাজগুলি শিক্ষা দিয়ে সন্তানকে ভবিষ্যৎ জীবনের সোপান তৈরী করে দিতে পিতা-মাতার একটি উত্তম প্রতিষ্ঠান। একথা স্মরণ রেখে প্রত্যেক পিতা মাতার স্বীয় দায়িত্ব পালন করাই সন্তানের অধিকার। তাছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সৌন্দর্যের মূল ভিত্তি। কোন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত তার শরীরকে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করার ব্যাপারে সচেষ্ট না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ইসলামের মানদন্ডে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত এবং সর্বদিকে সম্মানিত ব্যক্তি বলে বিবেচিত হবে না।মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কারীদের ভালবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরকেও ভালবাসেন’ [সূরা বাক্বারাহ ২/২২২]। যেমনিভাবে নিজের শরীর ও মনকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, তেমনিভাবে ঘর-দরজা, বাড়ীর চারপাশের পরিবেশ, রাস্তা-ঘাট, পরিষ্কার রাখতে হবে। একথা মা তার সন্তানকে শৈশব থেকে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলবেন। রাসূল [সাঃ] এ সম্পর্কে বলেন, তোমরা তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনা ও সম্মুখ ভাগ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখ’।[তিরমিযী হা/২৭৯৯; মিশকাত হা/৪৪৮৭, হাদীছ হাসান]।

🌓1️⃣5️⃣.সন্তানের প্রতি খরচ করা: সন্তান স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত তাদের যাবতীয় খরচ পিতা-মাতাকে বহন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর জন্মদাতা পিতার দায়িত্ব হ’ল ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রসূতি মায়েদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। রাসূল [সাঃ] বলেন,তোমার পরিবারেরও তোমার প্রতি অধিকার রয়েছে। অতএব প্রত্যেক হক্বদারকে তার হক্ব প্রদান কর’।[বুখারী হা/১৯৬৮; মিশকাত হা/২০৬১]।

রাসূল [সাঃ] আরো বলেন, আর তুমি সাধ্যমত তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ কর’।[আহমাদ হা/২২২১২৮; মিশকাত হা/৬১; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৭০]।

তিনি আরো বলেন,প্রথমে তাদেরকে দিবে যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব’। [বুখারী হা/১৪২৬; মুসলিম হা/১০৩৪’ মিশকাত হা/১৯২৯]।

🌓1️⃣6️⃣.আদর স্নেহ ও ভালবাসা দেয়া: সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসতে হবে, সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করা মানব জীবনে বন্ধু বা সাথীর প্রয়োজন অপরিসীম। বন্ধু অর্থ সাথী, মিত্র, স্বজন, কল্যাণকামী। উত্তম বন্ধু সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, যারা ভুল করার পর তওবা করে, ছালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, তারাই তোমার দ্বীনি ভাই বা বন্ধু’ [সূরা আত-তওবাহ :১১] বন্ধু ছাড়া শিশু-কিশোর তথা যুবব-যুবতীরা নিজেদেরকে অসহায় মনে করে। একজন ভাল বন্ধু জীবনে অনেক উপকার করতে পারে আবার একজন খারাপ বন্ধু জীবনটাকে শেষ করে দিতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশুনার সময় ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এটা জীবন গড়ার সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এ সময় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। একবার ভুল পথে পা বাড়ালে জীবনের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। আমাদের ছেলে-মেয়েরা কলেজ-ভার্সিটির জীবনকে মুক্ত ও স্বাধীন বলে মনে করে। এটাও জীবনের কঠিন সময়। এ সময় নৈতিকতা, আদর্শ ও তদারকীর মধ্যে রাখতে না পারলে ৯০% যুবসমাজ খারাপের দিকে চলে যায়। তাই সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। পিতা-মাতাও তাদের আচরণ শিষ্টাচার ও ভাল ব্যবহারের মাধ্যমে সন্তানের আদর্শ ও ভাল বন্ধু হতে পারে। রাসূল [সাঃ] বলেন,সে আমার দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান জানে না।’’ আবু দাঊদের এক বর্ণনায় আছেঃ আমাদের বড়দের অধিকার জানে না। [তিরমিযি ১৯২০, আহমদ ৬৮৯৬, ৭০৩৩]।

🌓1️⃣7️⃣. সহীহ দ্বীনের পথে পরিচালিত করা:
বর্তমান পৃথিবীতে বাতিল ফিরকার অভাব নেই কেননা উম্মাতে মুহাম্মাদী ৭৩ দলে বিভক্ত হবে।
একটি দল ব্যতীত সমস্ত দলই জাহান্নামে প্রবেশ করবে [তিরমিযী হা/২৬৪১, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২]। তাই পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব হলো সন্তানদেরকে সালফে সালেহীনের মানহাজের অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালনা করা, দ্বীনের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত করে তোলা। কুরআনে এসেছে,মহান আল্লাহ রাসূল সাঃ কে উদেশ্য করে বলেন বল, এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’। [সূরা ইউসুফ :১০৮]।

সন্তানকে দ্বীনের পথে পরিচালনার মাধ্যমে সওয়াব অর্জন করার এক বিরাট সুযোগ রয়েছে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, তোমার মাধ্যমে একজনও যদি হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়, তবে তা হবে তোমার জন্য লালবর্ণের অতি মূল্যবান উট থেকেও উত্তম। [আবু দাউদ৩৬৬১]।

🌓1️⃣8️⃣. সহশিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত না রাখাঃ ছেলে আর মেয়েদেরকে নেগেটিভ আর পজেটিভ দু’টি তারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তার দু’টি যখন প্লাষ্টিক কভারের মাধ্যমে পৃথক থাকে, তখন শুধু কথ্যমূলক কাজই হয়। ঘটে না কোন দুর্ঘটনা। দু’টি তার যখন নিয়মতান্ত্রিকভাবে একত্রিত হয়, তখন লাইট জ্বলে, ফ্যান ঘুরে, ট্রেন চলে। অনেক ভারী মেশিন চলার মাধ্যমে অনেক কল্যাণমূলক কাজ সংঘটিত হয়। তদ্রুপ ছেলে ও মেয়েরা ছাত্রজীবনে পৃথকভাবে থেকে ভালভাবে পড়াশুনা করে উপযুক্ত বয়স হলে বৈধভাবে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সমাজে বহু কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে। অএতব পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে চরিত্র গঠনের নিমিত্তে ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা অত্যাবশ্যক। অন্ততপক্ষে প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক শিফটিং ব্যবস্থা চালু করা দরকার। এক কথায় বলা যায় যে, আদর্শ চরিত্রবান সুসন্তান গড়তে হলে সহ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন ধরনের সম্পৃক্ত করা যাবে না। কেননা একই শ্রেণীতে একই রুমে পড়াশুনার প্রেক্ষিতে উভয়েরই লজ্জা কমে যায়, একে-অপরের সাথে বই ও নোট বিনিময় করে, একই সঙ্গে চা নাস্তা খায়, গল্প-গুজব ও খেলা-ধুলা করে মিটিং-সমাবেশে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অপরের ঘনিষ্ঠ থেকে আরও ঘনিষ্ঠতর হয়। বড় হলে পূর্ব পরিচিতির জের ধরে ছেলে-মেয়ে, ছাত্র-ছাত্রী ও নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ ও মেলামেশাই তাদেরকে অবৈধ, অশ্লীল, ধর্ষণ ও হয়রানিমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করে। পত্রিকার পাতা খুললেই অসংখ্য ধর্ষণ ও অবৈধ মেলামেশার খবর দেখা যায়, যা খুবই দুঃখজনক ও হতাশাব্যাঞ্জক।

সহ-শিক্ষার কুফল সমূহ:

(১) ছেলে ও মেয়ে উভয়ের লজ্জা কমে যায়। (২) অবাধ মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

(৩) সর্বদা কল্পনার জগতে অবস্থান করে।

(৪) উভয়ের পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। তবে ছেলেদের ক্ষতির পরিমাণ বেশী হয়।

(৫) উভয়েরই আর্থিক ক্ষতি হয়।

(৬) সর্বোপরি চরম চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে। অথচ ইসলামে সহশিক্ষার সম্পূর্ণরূপে হারাম অবশ্যই কোন পুরুষ যখন কোন নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হয়, তখন তৃতীয়জন হয় শয়তান’। [তিরমিযী, হা/১১৭১,মিশকাত, হা/৩১১৮; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/২৫৪৬]।

অপর বর্ননায় বলা হয়েছে, লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের স্থান জান্নাত। পক্ষান্তরে নির্লজ্জতা দুশ্চরিত্রের অঙ্গ। আর দুশ্চরিত্রের স্থান জাহান্নাম’। [তিরমিযী, হা/২০০৯; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৮৪ ছহীহুল জামে‘, হা/৩১৯৯]।

🌓1️⃣9️⃣. সন্তানকে যাবতীয় পাপকাজ, অশ্লিলতা, অপসংস্কৃতি থেকে বিরত রাখা: সন্তান দুনিয়ার আসার সাথে সাথে শয়তান তার পেছনে লেগে যায় এবং বিভিন্ন ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন রুপে,পোশাক-পরিচ্ছেদের মাধ্যমে, বিভিন্ন ফ্যাশনে,প্ররোচিত করে, টিভি, স্যাটেলাইট, ইউটিউব মোবাইল ফোন বিজ্ঞাপনে নারী-পুরুষের, যুবক-যুবতীদের একত্রে নাচ-গানের অনুষ্ঠান, অশালীন পোষাক পরিহিত চিত্র বা ছায়াছবি এবং যৌন উত্তেজনাধর্মী চলচ্চিত্র দেখা থেকে সন্তান হেফাজতে রাখতে হবে আমাদের দেশে আধুনিকতার নামে দিন দিন নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষার নামে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করে। তাই পিতা-মাতাকে অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন,হে মুমিনগণ, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের দুশমন। অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর যদি তোমরা মার্জনা কর, এড়িয়ে যাও এবং মাফ করে দাও তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। [সূরা তাগাবুন-১৪]।

হাদীসে এসেছে, ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী ও নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন। [সহীহ বুখারী:৫৮৮৫]।

রাসূল সাঃ আরো বলেন, যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সা-দৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। [সুনান আবূ দাউদ:৪০৩১]।

🌓2️⃣0️⃣.সন্তানদের সক্ষম করে তোলা ও যথা সময়ে তাদের বিবাহ সম্পন্ন করা: সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন,তোমাদের সন্তান সন্ততিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম। [সহীহ বুখারী:১২৯৫]।

মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা স্বামীহীন তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও [সূরা নূর ২৪/৩২]।

রাসূল সাঃ বলেন, যার দ্বীনদারী এবং উত্তম আচরণে তোমরা সন্তুষ্ট, তার সাথে বিবাহ দাও’ [তিরমিযী, মিশকাত হা/৩০৯০]।

বিবাহ করা দ্বীনের পূর্ণতা অর্জনের পরিচায়ক। রাসূল [সাঃ] বলেন, ‘যখন কোন ব্যক্তি বিবাহ করল, তখন সে দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করল’।[বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৩০৯৬, সনদ হাসান]। সুতরাং বিবাহ না করলে ব্যক্তি গোনাহগার না হ’লেও এতে শরী‘আতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে অগ্রাহ্য করা হয়।

🌓2️⃣1️⃣.সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা: দয়াশীলতা ইমানদারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সন্তানরা পিতামাতার কাছ থেকে ইনসাফ আশা করে এবং তাদের মাঝে ইনসাফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তাদের মাঝে ইনসাফ করো’। [সহীহ বুখারী: ২৫৮৭]।

কোথাও কোথাও পুত্রসন্তানদের মধ্যে এক ছেলেকে অন্য ছেলের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। ইসলামে এটিও নিষিদ্ধ। নুমান ইবনে বশির [রা.] থেকে বর্ণিত, ‘একবার তাঁর পিতা তাঁকে নিয়ে রাসুল [সা.] এর কাছে গেলেন এবং বললেন, আমি আমার এ ছেলেকে একটি গোলাম [চাকর] দান করেছি। রাসুল [সা.]তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি তোমার সব সন্তানকেই এমন দান করেছ? পিতা উত্তর দিলেন, না। রাসুল [সা.]বললেন, তাহলে এ গোলাম ফেরত নিয়ে নাও।’ [বুখারি, হাদিস :২৫৮৬]।

🌓2️⃣2️⃣.সন্তানদের জন্য কল্যানের দো‘আ করা বদদোয়া না করা: আমাদের সন্তানদের জন্য দো‘আ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে, আল্লাহর নেক বান্দা তারাই যারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন। [সূরা আলফুরকান-৭৪]।

আবূ হুরাইরাহ [রাঃ] থেকে বর্ণিতঃ নবী [সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বলেন, তিন ব্যক্তির দু‘আ নিঃসন্দেহে কবুল হয়:

[এক] পিতার দু‘আ,

[দুই] মুসাফিরের দু‘আ,

[তিন] মজলুমের দু‘আ। [ আবু দাউদ, হাদিস নং ১৫৩৬]।

সন্তান কোন অন্যায় করলেও সন্তানের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করা সমীচীন নয়। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের জন্য বদ দো‘আ করো না, নিজ সন্তানদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করো না এবং নিজেদের অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে বদ দো‘আ করো না, যাতে তোমরা এমন এক সময়ে না পৌঁছে যাও, যে সময় দো‘আ করা হ’লে তা তোমাদের জন্য কবুল করা হয় [মুসলিম হা/৩০০৯, মিশকাত হা/২২২৯]। অর্থাৎ এর ফলে বদ দো‘আ কার্যকর হয়ে যেতে পারে।

পরিশেষে আমাদের আহবান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সন্তানকে প্রকৃত ইসলামী আদর্শে গড়ে তুলতে হলে প্রতিটি পিতা-মাতার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলো পরিপূর্ণ অনুসরণ করার বিকল্প কিছু নেই। আদর্শ পিতা মাতার আদর্শ সন্তান তৈরি করতে হলে রাসূল
[ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এর আদর্শ ভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে সন্তানকে গড়তে তুলতে হবে পাশাপাশি মহান রাব্বুল ‘আলামীনের নিকট দু‘আ করতে হবে। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন না করলে আখিরাতে তাদেরকে মহান আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। রাসূল [সাঃ] বলেন, মহিলা ও তার স্বামী তার সন্তানের দায়িত্বশীল। অতএব তাদেরকে স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে [বুখারী হা/২৪০৯, মুসলিম হা/৪৮২৮]। আল্লাহু আলাম।

উপস্থাপনায়: “জুয়েল মাহমুদ সালাফি”
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী
লিন্নাস: মদিনা ইউনিভার্সিটি সৌদি আরব।