ইসলামে বায়‘আতের বিধান

প্রশ্ন: ইসলামে বায়‘আতের বিধান কী? কার হাতে বায়‘আত হতে হবে? বায়‘আত সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সবার একটি বিষয় জানা উচিত। আসমানের নিচে জমিনের উপরে একমাত্র রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্য কারো কথা পরিপূর্ণ অনুসরণীয়-অনুকরণীয় নয়। কারণ আসমানের নিচে এবং জমিনের উপরে যত নবী-রাসূল এসেছেন সকল নবী-রাসূলের মাঝে আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মর্যাদা হলো তারাভরা রাতের আকাশে একটি রূপালী চাঁদের মত। তিনি সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ রাসূল। তিনি পৃথিবীবাসীর জন্য রহমত হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন (সূরা আম্বিয়া; ২১/১০৭)। আল্লাহ আরো বলেন, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সূরা আল-আহযাব; ২১)। যারা নবী করীম (ﷺ)-এর নির্দেশ অমান্য করে তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘কাজেই যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, তাদের উপর পরীক্ষা নেমে আসবে কিংবা তাদের উপর নেমে আসবে ভয়াবহ শাস্তি।’ (সূরা আন-নূর; ৬৩)।একদা ইমাম মালেক (রহঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ববরের দিকে ইশারা করে বলেন, ‘এ ক্ববরের অধিবাসী ব্যতীত পৃথিবীর সকল ব্যক্তির কথা গ্রহণীয় ও বর্জনীয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি আদেশ নিষেধ গ্রহণীয়।
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের উপর আবশ্যক হলো, নবী করীম (ﷺ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর অনুসরণ ব্যতীত দ্বীনের কোন বিষয়ে কোন কথা না বলা এবং যা তাঁর সামনে আসে না সে বিষয়েও কোন কথা না বলা। বরং সে যেন লক্ষ্য করে নবী করীম (ﷺ) কী বলেছেন। অতঃপর তাঁর কথাটি যেন হয় নবী করীম (ﷺ)-এর অনুকূলে। তার আমলটি যেন হয় নবী করীম (ﷺ)-এর নির্দেশ অনুসারে। সাহাবী, তাবেঈ ও মুসলিমদের ইমামগণ এরূপই ছিলেন। একারণেই তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ বুদ্ধি দিয়ে কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধিতা করেননি। আর নবী করীম (ﷺ) যা নিয়ে এসেছেন তা ব্যতীত অন্য কোন দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করেননি। তাঁরা যখনই দ্বীনের কোন বিষয়কে জানার ইচ্ছা করেছেন তারা লক্ষ্য করেছেন সে ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) কী বলেছেন। অতঃপর তা থেকেই শিক্ষা অর্জন করেছেন। তা দিয়েই কথা বলেছেন এবং তাঁর মধ্যেই দৃষ্টি রেখেছেন। আর তাঁকেই প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপণ করেছেন। আর এটাই আহলুস সুন্নাহর মূলনীতি। (ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৬৩)। আর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা (কুরআন মাজীদে) চল্লিশটি স্থানে আদেশ করেছেন। (শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৯ খন্ড পৃ,৮৩)
.
ইসলামে বায়‘আতের বিধান কী? কার হাতে বায়‘আত হতে হবে?
_______________________________________
বায়‘আত (بَيْعٌ) শব্দটি একটি ইসলামিক পরিভাষা। বায়‘আত শব্দের

অর্থ: অঙ্গীকার, বিক্রয় করা, লেনদেন করা, শপথ করা, চুক্তি করা ইত্যাদি। তবে, ইসলামে অনেক সময় বায়‘আত বলতে শপথ পাঠ বা চুক্তিকে বুঝানো হয়েছে। বাইআতের পারিভাষিক সংজ্ঞায় ইবনে খালদুন তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে বলেন: আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ; যেন বাইআতকারী আমীরের সাথে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন যে, তার নিজের ব্যাপারে ও মুসলমানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার আমীরকে প্রদান করা হলো। এ ব্যাপারে তার সাথে দ্বন্দ করবে না। এমনকি সুখ-দুঃখ সর্বাবস্থায় আমীর কর্তৃক যে দায়িত্ব প্রদান করা হয় সেক্ষেত্রে তার আনুগত্য করবে। লোকেরা যখন আমীরের হাতে বাইআত করত তখন তারা আমীরের হাতে হাত রাখত। তাই এটি যেন বিক্রেতা ও ক্রেতার চুক্তির মত। হাতে হাত রেখে মুসাফাহা এর মাধ্যমে বাইআত সংঘটিত হয়। (আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা গ্রন্থ; ৯/২৭৪) ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, ইসলামের উপরে কৃত অঙ্গীকারকে বায়‘আত এজন্য বলা হয়েছে যে, ব্যবসায়িক চুক্তির বিপরীতে যেমন সম্পদ লাভ হয়, আমীরের নিকটে বায়‘আতের মাধ্যমে আনুগত্যের বিপরীতে তেমনি পুণ্য লাভ হয়। সে যেন আমীরের নিকটে তার খালেছ হৃদয় ও আনুগত্য বিক্রয় করে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান ও মাল খরীদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে…সূরা তাওবাহ ৯/১১১ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২২-১৪১৪ হিঃ/১৯০৪-১৯৯৪ খৃঃ), মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাছাবীহ (বেনারস, ভারত : ৪র্থ সংস্করণ ১৪১৯/১৯৯৮ খৃঃ) হা/১৮-এর ব্যাখ্যা ১/৭৫ পৃঃ)
.
দুনিয়াবী সমাজ ব্যবস্থায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য শপথ ও অঙ্গীকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুসলিম-অমুসলিম সব সমাজেই এটি রয়েছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতা এবং কার্যের ধরণ অনুযায়ী অঙ্গীকারের ধরণ ও ভাষা পরিবর্তিত হয়। ইসলামী জীবন ও সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নেতা ও কর্মীর মধ্যে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করতে হয়। ইসলামী পরিভাষায় যাকে বায়‘আত বলা হয়। এর একমাত্র লক্ষ্য থাকে ইসলামী বিধান মেনে নিজের জীবন, পরিবার ও সমাজ গঠনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং আখেরাতে জান্নাত লাভ করা। ইসলামী শরীয়তে বায়‘আতের বিধান হলো ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলিম শাসকের হাতে মুসলিম নারী পুরুষের বায়‘আত করা অপরিহার্য। ইসলামী খলীফা বা মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান ব্যতীত অন্য কোন অমুসলিম শাসক বা পীর অথবা ইসলামী সংগঠনের সাধারণ নেতা বা আমীরের হাতে বায়‘আত করা নিষিদ্ধ। এই মর্মে দলিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আমার পরে কোনও নবী‎র আগমন ঘটবে না। বরং খলীফাগণ হবেন এবং তাঁরা সংখ্যায় অনেক হবেন। তখন সাহাবীগণ বললেন, ‘তাহলে আপনি (এ ব্যাপারে) আমাদেরকে কী নির্দেশ দিচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘যার হাতে প্রথম বায়‘আত বা আনুগত্যের শপথ করবে, তাঁরই আনুগত্য করবে এবং তাদেরকে তাদের হক প্রদান করবে। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ঐ সকল বিষয়ে, যার দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল।’ (সহীহ বুখারী, হা/৩৪৫৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৪২; ইবনু মাজাহ, হা/২৮৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৯৬০)
.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,‘যে ব্যক্তি (বৈধ কাজে শাসকের) আনুগত্য করা থেকে হাত গুটিয়ে নিল, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এ অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তার জন্য কোন প্রমাণ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি (রাষ্ট্রনেতার হাতে) বায়‘আত না করে মৃত্যুবরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মরা মরল।’ এর অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে, ‘‘যে (রাষ্ট্রীয়) জামাআত ত্যাগ করে মারা গেল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।’ (সহীহ মুসলিম হা/ ১৮৫১, মুসনাদে আহমাদ হা/৫৩৬৩, ৫৫২৬, রিয়াদুস সালেহীন হা/৬৭০)। উক্ত হাদীসের অর্থ হলো, মুসলিম খলীফার কাছে বায়‘আত না করা এবং জামা‘আত থেকে বেরিয়ে যাওয়া। যেমন ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন, فَقَدْ ذَكَرَ ﷺ الْبُغَاةَ الْخَارِجِينَ عَنْ طَاعَةِ السُّلْطَانِ وَعَنْ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উক্ত হাদীসে ঐ সমস্ত বিদ্রোহীদের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, যারা (মুসলিম) শাসকের আনুগত্য ও মুসলিম জামাআত থেকে বেরিয়ে গেছে।’ (ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ ২৮/৪৮৭ ও ৩৫/১৩ পৃঃ)।
.
অন্যত্রে ফিতনা ও বিশৃঙ্খলার যুগ সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তখন তোমরা মুসলিমদের দল ও তাঁদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, ‘যদি মুসলিমদের কোন দল ও ইমাম না থাকে?’ তিনি বলেন, তখন তুমি তাদের সকল দল-উপদল ও বিচ্ছিন্নতা
বাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে এবং আমৃত্যু বৃক্ষমূল দাঁতে আঁকড়ে ধরে হলেও দ্বীনের উপর অটল থাকবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/৩৬০৬, ৩৬০৭, ৭০৮৪; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৪৭; আবু দাঊদ, হা/৪২৪৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৭৯, ৩৯৮১)। উপরিউক্ত দুটি হাদীসে ‘ইমাম’ বলতে ইসলামী খলীফা বা শাসককে বুঝানো হয়েছে। (সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৭৩৯)। শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] ‘শারহু সহীহিল মুসলিম’-এর মধ্যে বলেন, হাদীসসমূহের মধ্যে বায়‘আত সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার অর্থ ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বায়‘আত করা…। নিঃসন্দেহে সব হাদীসই মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের বায়‘আতের সাথে সম্পর্কিত। (সহীহ মুসলিম, হা/১৮৪৪, ১৪৫১, ১৮৫৩-এর ব্যাখ্যা দ্র.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৩২০)। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইসলামী খলীফা বা আমীরুল মুমিনীন নির্বাচিত হলে সেদিনই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে (এবং তার আনুগত্যের বায়‘আত নিতে হবে)। (আল-আহকামুস সুলতানিয়্যা, পৃ. ২০-২৩)
.
🔹বায়‘আত সম্পর্কে যুগ শ্রেষ্ঠ কয়েকজন ইমাম ফাতওয়া দেখুন। যেমন:
_______________________________________
▪️(১). সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেন, ‘মুসলিমদের রাষ্ট্র প্রধান ব্যতীত অন্য কারো হাতে বায়‘আত করা যাবে না। বিভিন্ন সংগঠনের আমীরের হাতে বায়‘আত করা বিদ‘আত। এটিই বিভক্তির মূল কারণ। একই শহর ও দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের উপর অপরিহার্য যে, তাঁদের বায়‘আত একই শাসকের জন্য নির্দিষ্ট হবে। একাধিক বায়‘আত জায়েয নয়।’(আল-মুনতাক্বা ফাতাওয়া শায়খ ছালিহ আল-ফাওযান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৭)
.
▪️(২). বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, ‘…তবে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান বা মুসলিম দেশের সরকার ছাড়া অন্য কারো হাতে বায়‘আত করা বৈধ নয়। কেননা আমরা যদি প্রত্যেকের পৃথক পৃথক বায়‘আতের কথা বলি, তাহলে মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত হয়ে যাবে এবং প্রত্যেকটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত আমীর সৃষ্টি হবে। মূলত এটিই হচ্ছে বিভক্তি…।(লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪১-১৪৩, প্রশ্ন নং-৮৭৫ এবং প্রশ্ন নং-২৭, ৫৪,১৬২ দ্র.)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন,‘সফরে থাকা অবস্থায় আমীর বা দলনেতা নির্বাচন করার দলীল পাওয়া যায়। কিন্তু মুক্বীম অবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক মানুষের আমীর নির্বাচনের প্রমাণে কোন দলীল পাওয়া যায় না। … তাই মুক্বীম অবস্থায় আমীর হিসাবে কারো হাতে বায়‘আত করে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের মত তার অনুসরণ করা বিদ‘আত।’(শারহু সহীহিল বুখারী, পৃ. ৪৮৮-৪৮৯)
.
▪️(৩). সঊদী আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, মুক্বীম অর্থাৎ শহর বা দেশে অবস্থান কালে রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁর নিযুক্ত কোন ব্যক্তিই আমীর হবে।’(ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২৩তম খণ্ড, পৃ. ৪০২-৪০৩)। শায়খ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, البيعة لا تكون إلا لولي أمر المسلمين ‘মুসলিমদের রাষ্ট্রপ্রধান ব্যতীত অন্য কারো হাতে বায়‘আত করা যাবে না।’(ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৩২০)। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘শারহু ছহীহিল মুসলিম’-এর মধ্যে বলেন, হাদীসসমূহের মধ্যে বায়‘আত সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার অর্থ ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বায়‘আত করা…। নিঃসন্দেহে সব হাদীসই মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের বায়‘আতের সাথে সম্পর্কিত। (সহীহ মুসলিম, হা/১৮৪৪, ১৪৫১, ১৮৫৩-এর ব্যাখ্যা দ্র.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৩২০)।
.
▪️(৪). বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,‘কোন দল কর্তৃক কাউকে আমীর বানিয়ে তার অনুসরণ করা মারাত্মক ভুল। ওলামায়ে কিরামের উচিত জনসম্মুখে প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরা। প্রত্যেকটি জামা‘আত ও সংগঠনের সাথে আলোচনা করা এবং সবাইকে আল্লাহ নির্দেশিত ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত সরল পথে চলার আহ্বান করা। যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করবে এবং ব্যক্তিস্বার্থে বা অন্য কোন কারণে নিজের একগুঁয়েমি বজায় রাখবে, তার বিষয়টি জনগণের সামনে প্রকাশ করে দেয়া এবং তাদেরকে তার থেকে সতর্ক করা অপরিহার্য। তাহলে যারা তার সম্পর্কে জানে না, তারা তার থেকে দূরে থাকতে পারবে। ফলে সে কাউকে আল্লাহ নির্দেশিত সরল পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।’(ইবনু বায, মাজমূউ ফাতাওয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৩৬-১৩৭)
.
▪️(৫). রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমন অবস্থায় যে, তার গর্দানে বায়‘আত নেই, সে জাহেলী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল। (সহীহ মুসলিম হা/১৮৫১)। বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] উক্ত হাদীস উল্লেখ করে বলেন, واعلم أن الوعيد المذكور إنما هو لمن لم يبايع خليفة المسلمين وخرج عنهم وليس كما يتوهم البعض أن يبايع كل شعب أو حزب رئيسه بل هذا هو التفرق المنهي عنه في القرآن الكريم ‘জেনে নিন যে, উক্ত শাস্তি কেবল তার জন্য, যে ব্যক্তি মুসলিমদের খলীফার কাছে বায়‘আত করেনি এবং তাদের থেকে বের হয়ে গেছে। আর এর অর্থ সেটা নয়, যা কিছু লোক ধারণা করেছে যে, প্রত্যেক গোত্রের লোক বা দলের অনুসারীরা তার নেতার কাছে বায়‘আত করবে; বরং এটা ফের্কাবাজি, যা কুরআনুল কারীমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’ (সিলসিলা সহীহাহ (সংক্ষিপ্ত) হা/৯৮৪-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ মাসিক আল ইখলাস)
.
#বিশেষদ্রষ্টব্য: আমাদের দেশে একদল পীরের হাতে আবার কিছু ভাইয়েরা বিভিন্ন সংগঠনের আমীরের হাতে বায়’আত গ্রহণ জায়েজ বলে থাকেন। আর দলিল হিসেবে বলেন, রাসূল (ﷺ) মদীনার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার আগেও মক্কায় বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহাবাদের কাছ থেকে খুসুসী বায়’আত নিয়েছিলেন। আর বর্তমানে যেহেতু কোনো ইসলামী শাসক বা খলীফা নেই, তাই সংগঠনে খুসুসী বায়’আত নেওয়া হয়ে থাকে এটি জায়েজ। তাদের উক্ত যুক্তি সঠিক নয়। কারণ রাসূল (ﷺ) ছিলেন আল্লাহর নবী, এই উম্মতের প্রদর্শক এবং রাষ্ট্রনায়ক। তিনি আল্লাহর আদেশ নিষেধের বাহিরে কোন কিছুই করেন না। সুতরাং তিনি বিভিন্ন সময়ে সাহাবিদের কাছ থেকে বায়’আত নিয়েছেন।বর্তমানে রাসূল (ﷺ) এর ন্যায় যে কোন মুসলিম দেশের মুসলিম সরকার চাইলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বায়’আত নিতে পারেন,আবার ধর্মীয় ক্ষেত্রে বায়’আত নিতে পারেন। এটি শাসকের জন্য জায়েজ।কিন্তু রাসূল ﷺ রাষ্ট্রনেতা হওয়ার পূর্বে মক্কায় বায়’আত নেওয়ার দলিল দিয়ে বর্তমানে পীরের হাতে বায়’আত অথবা বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের আমীরদের হাতে বায়’আত গ্রহণের দলিল নয় এবার সংগঠন সহীহ আক্বীদার হোক আর বিদাআতী আক্বীদার হোক। হ্যাঁ, দলিল তখন হতো যখন রাসূল (ﷺ) এর সময় কোন সাহাবী যেমন- আবু বকর, উমার,আবু হুরায়রা,ইবনে আব্বাস (রাঃ) তারা বায়’আত নিতেন। প্রশ্ন হলো তারা কি কখনো রাসূলের জীবনকালে এমন বায়’আত নিয়েছেন? যদি না নিয়ে থাকেন তাহলে কোন দলিলের আলোকে আপনি দেশে মুসলিম শাসক থাকার পরেও আলেদা করে বায়’আত নিবেন? একটি দেশের একজন মাত্র শাসক থাকে,আর বায়’আত চাইলে তিনি নিতে পারেন অন্য কেউ নয়। একাধিক ব্যক্তির হাতে বায়’আত গ্রহণ প্রসিদ্ধ উলামায়ে কেরাম বিদআত বলেছেন। মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপনাঃ
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।