ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়া কি সাহাবী ছিলেন নাকি তাবেঈ ছিলেন এবং উনার সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করতে হবে

প্রশ্ন: ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়া কি সাহাবী ছিলেন, নাকি তাবেঈ ছিলেন? কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার সাথে কি ইয়াযীদ সরাসরি জড়িত ছিলেন? ইয়াযীদ ইবনু মু‘আবিয়া সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: তার সম্পন্ন নাম হল ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান ইবনে হারব ইবনে উমাইয়া আল-উমাবি আল-দিমাশকি।তিনি সাহাবী ছিলেন না। বরং তিনি (২৭-৬৪ হিঃ) তাবেঈ ছিলেন। ইয়াযীদকে তার পিতা মুয়াবিয়া (রা:) তার উত্তরাধিকারী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, তার পিতা ৬০ হিজরি রজব মাসে মৃত্যুবরন করার পর ইয়াজিদ ৩৩ বছর বয়সে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তার শাসনকাল চার বছরেরও কম সময় স্থায়ী হয়। তার শাসনামলে ৬১ হিজরীতে ১০ই মুহাররম রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কনিষ্ঠ নাতি হুসাইন বিন আলী (রাঃ) শাহাদতের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে তবে এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য তিনি অর্থাৎ ইয়াযীদ সরাসরি দায়ী নন। এজন্য মূলতঃ দায়ী বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসী ও নিষ্ঠুর গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ নিজে। (আল্লাহই ভালো জানেন) হুসাইনের ভাষণই প্রমান বহন করে এর জন্য ইয়াযীদ নয় বরং ইরাকবাসীরাই দায়ী। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি পত্রের মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে আহবান করোনি? আমাকে সাহায্য করার ওয়াদা করোনি? অকল্যাণ হোক তোমাদের! যেই অস্ত্র দিয়ে আমরা ও তোমরা মিলে ইসলামের শক্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। এখন সেই অস্ত্র তোমরা আমার বিরুদ্ধে চালাতে যাচ্ছ! মাছি যেমন উড়ে যায় তেমনি তোমরা আমার পক্ষের কৃত বায়‘আত থেকে সরে যাচ্ছ! পোঁকা-মাকড়ের ন্যায় তোমরা উঠে যাচ্ছ এবং সকল ওয়াদা-অঙ্গীকার ভঙ্গ করছ। ধ্বংস হোক এই উম্মতের তাগুতের দলেরা’।(আল-ইরশাদ নিলমুদীদ পৃষ্ঠা: ২৪১)
.
হুসাইনের এই ভাষণ কোন ভাবেই ইয়াযীদকে দায়ী করেননি। বরং ঘুরেফিরে ইরাকবাসীকেই দায়ী করা হয়েছে। অতঃপর হুসাইন (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করেন; ‘হে আল্লাহ! আপনি যদি তাদের হায়াত র্দীঘ করেন, তাহ’লে তাদের দলেন মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে দিন। তাদের দলে দলে বিচ্ছিন্ন করে দিন। তাদের শাসকদের উপর কখনোই সন্তুষ্ট করবেন না। তারা আমাদের সাহায্য করবে বলে ডেকে এনেছে। অতঃপর আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা বশত হত্যার জন্য উদ্যত হয়েছে’।(আল-ইরশাদ নিলমুদীদ পৃষ্ঠা: ২৪১) পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছিলো এমনকি ওবাইদুল্লাহকে নিকৃষ্টভাবে হত্যা করা হয়েছিল’।(কারবালার প্রকৃত ঘটনা পৃষ্ঠা: ২৬) আর হুসাইনের ছিন্ন মাথা যখন ইয়াযীদের সম্মুখে আনা হয়। তখন তিনি কেঁদে উঠে বলেছিলেন, ‘ওবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ উপরে আল্লাহ পাক লা‘নত করুন। আল্লাহর কসম যদি হুসাইনের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহ’লে সে কিছুতেই হুসাইনকে হত্যা করত না। তিনি আরও বলেন, হুসাইনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকবাসীকে আমার অনুগত্যে রাযী করাতে পারতাম’।(ইবনু তাইমিয়াহ, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ ৩৫০ পৃঃ) এমনকি হুসাইনকে পরিবারের স্ত্রী কন্যা ও শিশুগণ ইয়াযীদের প্রসাদে প্রবেশ করলে প্রাসাদে কান্নার রোল পড়ে যায়। ইয়াযীদ তাঁদেরকে বিপুলভাবে সম্মানিত ও মূল্যবান হাদিয়া দিয়ে সম্মানের সাথে মদীনায় প্রেরণ করেন’।[ইবনু তাইমিয়াহ, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ ৩৫০ পৃঃ)
.
এমনকি তার পিতা মু‘আবিয়া (রাঃ) হুসাইনের (রাঃ) সম্পর্কে অছীঅত করে বলেছিলেন; ‘যদি তিনি (হুসাইন) তোমার বিরুদ্ধে উত্থান করেন ও তুমি তার উপরে বিজয়ী হও, তাহ’লে তাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। কারণ তার রয়েছে রক্তের সম্পর্ক, যা অতুলনীয় এবং রয়েছে মহান অধিকার’।[তারীখে ইবনে খালদূন ৩/১৮ পৃঃ] স্বীয় পিতার অছিয়ত অনুযায়ী তিনি হুসায়েনকে সর্বদা সম্মান করেছেন এবং তখনও করতেন কেননা ইয়াযীদ কেবল হুসায়েন (রাঃ)-এর আনুগত্য চেয়েছিলেন, তাঁর খুন চাননি। হুসায়েন (রাঃ) সে আনুগত্য দিতেও প্রস্ত্তত ছিলেন। হুসায়েন (রাঃ)-এর ছিন্ন মস্তক ইয়াযীদের সামনে রাখা হ’লে তিনি কেঁদে বলে ওঠেন, ‘ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের উপর আল্লাহ লা‘নত করুন। আল্লাহর কসম! যদি হুসায়েনের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহ’লে সে কিছুতেই তাঁকে হত্যা করত না। তিনি আরো বলেন, হুসায়েনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকীদেরকে আমার আনুগত্যে রাযী করাতে পারতাম [ইবনু তায়মিয়া, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ, ১/৩৫০; আল-বিদয়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/১৭৩] কূফার নেতাদের লিখিত ১৫০টি পত্র পেয়ে হুসায়েন (রাঃ) কূফায় আসলে বছরার গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ কূফার গভর্ণর মুসলিম বিন আকীলকে গ্রেফতার করে হত্যা করে। এদিকে হুসায়েন (রাঃ) প্রদত্ত তিনটি প্রস্তাবের কোনটি গ্রহণ না করায় দুষ্টমতি ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের সাথে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এতে হুসায়েন (রাঃ) সপরিবারে নিহত হন।[ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ ২/২৫২; ইবনু কাসীর, আল-বিদায়াহ ৮/১৫৪, ১৭১)
.
◾ইয়াযীদ ইবনু মু‘আবিয়া সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইয়াযীদ সম্পর্কে মানুষেরা তিনভাগে বিভক্ত।

➤প্রথমতঃ রাফেযী শী‘আদের মতে, সে কাফির ও মুনাফিক। সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দৌহিত্রকে হত্যা করার প্রয়াস চালিয়েছিল। যে শী‘আরা আবূ বকর ছিদ্দীক, ওমর ফারূক ও ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-দেরকে কাফির বলতে পারে, তাদের পক্ষে ইয়াযীদকে কাফির বলা খুবই সহজ।

➤দ্বিতীয়তঃ অন্য এক দলের ধারণা হল, ইয়াযীদ সৎ ব্যক্তি ও ন্যায়বিচারক ছিলেন। তিনি ছাহাবী ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ও জ্ঞানীগুণীদের নিকট উক্ত দু’টি মন্তব্যই ভ্রান্ত।

➤তৃতীয়তঃ পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকটে, তিনি মুসলিমদের শাসক ছিলেন। তার কিছু সৎ কাজ ছিল, আবার কিছু অসৎ কাজও ছিল। তিনি ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খিলাফাতকালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি কাফির ছিলেন না এবং ছাহাবী ও কোন অলী-আওলিয়াও ছিলেন না’(ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৮১-৪৮৪)

ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,وكان أمير ذلك الجيش في غزو القسطنطينية وفيهم مثل أبي أيوب الأنصاري …فكانت دولته أقل من أربع سنين…ويزيد ممن لا نسبُّه ولا نحبه ইয়াযীদ কুস্তুনতুনিয়া যুদ্ধের সৈনিকদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। সৈনিকদের মধ্যে আবূ আইয়ূব আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মত সাহাবীও ছিলেন। তার শাসনকাল চার বছরের কাছাকাছি ছিল। অতএব ইয়াযীদ এমন একজন ব্যক্তি, যাকে আমরা গালিও দিব না এবং ভালোও বাসব না’[সিয়ারু ‘আলামিল নুবালা, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮]
.
হাদীসে এসেছে উম্মু হারাম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,আমার উম্মতের প্রথম যে দলটি নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, তারা যেন জান্নাত অবধারিত করে ফেলল। উম্মু হারাম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি কি তাদের মধ্যে হব? তিনি বললেন, তুমিও তাদের মধ্যে হবে। অতঃপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমার উম্মতের প্রথম যে দলটি কায়সার-এর রাজধানী (কনস্ট্যান্টিনোপল বা কুস্তুনতানিয়া) আক্রমণ করবে, তারা সকলেই ক্ষমাপ্রাপ্ত। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি কি তাদের অন্তর্ভুক্ত হব?’ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, না।(সহীহ বুখারী, হা/২৯২৪)

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,في هذا الحديث منقبة لمعاوية لأنه أول من غزا البحر ومنقبة لولده يزيد لأنه أول من غزا مدينة قيصر এই হাদীসে মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কৃতিত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা তিনিই সর্বপ্রথম সমুদ্রপথে যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর সন্তান ইয়াজিদের কৃতিত্ব। কেননা তিনিই সর্বপ্রথম কায়সার-এর রাজধানী (অর্থাৎ কনস্ট্যান্টিনোপল) আক্রমণ করেন’(ফাৎহুল বারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১০২) মুহাল্লাব বলেন,এই হাদীসের মধ্যে মু‘আবিয়া (রাঃ) ও তাঁর পুত্র ইয়াযীদ-এর মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (২৩-৩৫ হিঃ) সিরিয়ার গভর্ণর থাকাকালীন সময়ে মু‘আবিয়া (রাঃ) ২৭ হিজরী সনে রোমকদের বিরুদ্ধে ১ম সমুদ্র অভিযান করেন। অতঃপর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (৪১-৬০হিঃ) ৫১ হিজরী মতান্তরে ৪৯ হিজরী সনে ইয়াযীদের নেতৃত্বে রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের উদ্দেশ্যে যুদ্ধাভিযান প্রেরিত হয় [ইবনু হাজার, ফৎহুল বারী ৬/১২০-২১] (নোট আল ইখলাস)
.
ইমাম ইবনু কাসীর বলেন,ইয়াযীদের সেনাপতিত্বে পরিচালিত উক্ত অভিযানে স্বয়ং হুসায়েন (রাঃ) অংশ গ্রহণ করেন (আল-বিদায়াহ ৮/১৫৩ পৃঃ)। এতদ্ব্যতীত যোগদান করেছিলেন আব্দুল্লাহ বিন ওমর, আব্দুল্লাহ বিন আববাস, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, আবু আইয়ূব আনছারী প্রমুখ খ্যাতনামা ছাহাবীগণ [ইবনুল আছীর, ‘আল-কামেল ফিত-তারীখ’ ৩/৫৭; দ্রষ্টব্যঃ] ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়াহ-র চরিত্র সম্পর্কে হুসায়েন (রাঃ)-এর অন্যতম বৈমাত্রেয় ছোট ভাই ও শী‘আদের খ্যাতনামা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিইয়াহ (রাঃ) বলেন, ‘আমি তাঁর মধ্যে ঐ সব বিষয় দেখিনি, যেসবের কথা তোমরা বলছ। অথচ আমি তাঁর নিকটে হাযির থেকেছি ও অবস্থান করেছি এবং তাঁকে নিয়মিতভাবে ছালাতে অভ্যস্ত ও কল্যাণের আকাংখী দেখেছি। তিনি ‘ফিক্বহ’ বিষয়ে আলোচনা করেন এবং তিনি সুন্নাতের পাবন্দ ছিলেন’(আল-বিদায়াহ খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ২৩৬)
.
ইয়াযীদের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ’র অবস্থান সম্পর্কে সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফতোয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটি (আল-লাজনাতুদ দা’ইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) প্রদত্ত ফতোয়ায় বলা হয়েছে, ইয়াযীদ বিন মু‘আউয়িয়াহর ব্যাপারে মানুষ দুটো প্রান্তিক ও একটি মধ্যপন্থি দলে বিভক্ত। ইয়াযীদের ব্যাপারে তিনটি অভিমতের মধ্যে সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ মত হলো—সে মুসলিমদের একজন রাজা ছিল, তার ভালোকর্ম ছিল, আবার মন্দকর্মও ছিল। সে ‘উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র খেলাফত-আমলে জন্মগ্রহণ করে। সে কাফির ছিল না। কিন্তু তার কারণে হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র হত্যাকাণ্ড ও হার্রাহ’র যুদ্ধের মতো ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। সে না ছিল সাহাবী, আর না ছিল সৎকর্মপরায়ণ আল্লাহ’র ওলি। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “এটাই অধিকাংশ প্রাজ্ঞ ও বিবেকবান আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অভিমত।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪০৯ ও ৪১৪; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪৪৩, ৪৮৪ ও ৫০৬)
.
আর ইয়াযীদকে লানত করার ব্যাপারেও মানুষ তিনটি দলে বিভক্ত। একদল ইয়াযীদকে লানত করে। একদল ইয়াযীদকে ভালোবাসে। আরেক দল ইয়াযীদকে গালি দেয় না, আবার ভালোও বাসে না। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “ইমাম আহমাদ এই মত ব্যক্ত করেছেন। আর এই মতের ওপরই রয়েছেন ইমাম আহমাদের অনুসারী ও অন্যান্য মুসলিমদের মধ্য থেকে মধ্যপন্থি ব্যক্তিবর্গ।” এই মধ্যপন্থি মত এ বিষয়ের ওপর ভিত্তিশীল যে, ইয়াযীদের এমন কোনো পাপকাজ প্রমাণিত হয়নি, যা তাকে লানত করার দাবি করে; অথবা নির্দিষ্টভাবে একজন পাপী লোককে লানত করা হয় হারাম আর নাহয় মাকরূহে তানযীহী (অপছন্দনীয় কর্ম)। সাহীহ বুখারীতে ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বিন হিমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বেশ কয়েকবার মদ্যপান করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বেত্রাঘাত করেছিলেন। এ কারণে জনৈক সাহাবী ওই মদ্যপায়ী সাহাবীকে লানত করেন। তখন নাবী ﷺ বলেন, “তুমি ওকে লানত কোরো না। নিশ্চয় সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে। (সাহীহ বুখারী, হা/৬৭৮০) অপর বর্ননায় নাবী (ﷺ) বলেছেন, “মুমিনকে লানত করা হত্যার সমতুল্য। (সাহীহ বুখারী, হা/৬১০৫; সাহীহ মুসলিম, হা/১১০)।
.
ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, জেনায় লিপ্ত হওয়া, চুরি করা প্রভৃতি পাপের ক্ষেত্রে যেসব ব্যাপকার্থবোধক ও শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞাযুক্ত দলিল বর্ণিত হয়েছে, সেসব দলিলের ভিত্তিতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে এরকম সাক্ষ্য দেওয়া যায় না যে, সে ব্যক্তি জাহান্নামী। কেননা বিভিন্ন অগ্রাধিকারযোগ্য কারণে এরকম বিষয় বিমোচিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হয়তো সে তওবা করেছে, অথবা তার পুণ্যকর্ম আছে, কিংবা সে পাপমোচনকারী দুর্যোগে পতিত হয়েছে, অথবা তার জন্য কারও কৃত শাফায়াত (সুপারিশ) গৃহীত হয়েছে, কিংবা এগুলো ছাড়াও তার অন্য কোনো পাপমোচনকারী বিষয় সংঘটিত হয়েছে। এটা গেল গালি না দেওয়া ও লানত না করার প্রসঙ্গ। পক্ষান্তরে ইয়াযীদকে না ভালোবাসার কারণ তার থেকে এমন কোনো ভালো কাজ প্রকাশিত হয়নি, যা তার ভালোবাসাকে জরুরি করে। সে একজন শাসক বা রাজা মাত্র। এ ধরনের লোককে ভালোবাসা শরিয়তসম্মত (বিধেয়) নয়। তাছাড়া ইয়াযীদের জীবনীতে এবং হুসাইন ও হার্রাহ-সংক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের ঘটনায় তার নিকট থেকে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা দাবি করে যে, সে একজন ফাসেক ও জালেম ছিল। আর আল্লাহই তৌফিকদাতা। হে আল্লাহ, আমাদের নাবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর আপনি দয়া ও শান্তি বর্ষণ করুন।” ফতোয়া প্রদান করেছেন— চেয়ারম্যান: শাইখ ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)। ডেপুটি চেয়ারম্যান: শাইখ ‘আব্দুর রাযযাক্ব ‘আফীফী (রাহিমাহুল্লাহ)। মেম্বার: শাইখ ‘আব্দুল্লাহ বিন গুদাইয়্যান (রাহিমাহুল্লাহ)।(ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৮৫-২৮৬; ফতোয়া নং: ১৪৬৩)
.
ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়া ৬৪ হিজরীর ১৪ই রবীঊল আউয়াল ৩৫ বা ৩৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/২৪৭)। মৃত্যুকালে ইয়াযীদের শেষ কথা ছিল, ‘হে আল্লাহ! আমাকে পাকড়াও করো না ঐ বিষয়ে যা আমি চাইনি এবং আমি প্রতিরোধও করিনি এবং আপনি আমার ও ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের মধ্যে ফায়ছালা করুন’[আল-বিদায়াহ খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ২৩৯)
.
অতএব, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ‘তারা সকলেই ক্ষমাপ্রাপ্ত’। তাই আমরা তার ব্যাপারে এই ধারণা পোষণ করতে পারি যে, এটি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন বিষয়, তিনি চাইলে তাকে ক্ষমা করতেও পারেন, আবার নাও পারেন। তার নামের শেষে আমরা ‘রাহিমাহুল্লাহ’ বা ‘লা‘আনাহুল্লাহ’ কোন কিছুই বলব না। আমরা সালাফে সালিহীনের মতানুযায়ী নীরব থাকব ইনশাআল্লাহ। এটাই আমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর ও নিরাপদ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।