ইনগেইজমেন্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কনেকে আংটি বা সোনার চেইন পরানো সম্পর্কে শরী‘আতের বিধান

প্রশ্ন: বর্তমান মুসলিম সমাজে বিবাহের পূর্বে ছেলে-মেয়ে দেখা উপলক্ষে ইনগেইজমেন্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কনেকে আংটি বা সোনার চেইন পরানো হয়। এ সম্পর্কে শরী‘আতের বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: বর্তমান পৃথিবীতে যতই দিন যাচ্ছে ততই শিরক, বিদআত, জুলুম-অত্যাচার, অজ্ঞতা-কুসংস্কার ইত্যাদির আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান-স্বল্পতা বিশুদ্ধ শরীয়তের উপর আমল করার প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞা, স্বার্থান্বেষিতা এবং দেশী বিদেশী অপসংস্কৃতির কুপ্রভাবের ফলে মুসলিম সমাজে বিভিন্ন কুসংস্কার, কুপ্রথা, কুআচার ও অনাচারের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। আখিরাতের প্রতি ক্ষীণ ঈমান তথা অসৎ পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে অধিকাংশ মানুষের ইচ্ছা নেই নিজেকে কুসংস্কার-মুক্ত করার, তাদের মন নেই আত্মশুদ্ধির, তাদের চেষ্টা নেই দ্বীন শিক্ষার, তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই কুরআন-সুন্নাহর ধর্মীয় বাণীর প্রতি, এবং নেই সমাজকে কুপ্রথা ও অনাচারমুক্ত করার কোন চেষ্টা বা সৎসাহস! যার ফলে কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের মুসলমানগণ ইসলামী সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে অমুসলিম বিজাতীয় সংস্কৃতির রসম-রেওয়াজের সাথে মিশে গেছে।
.
বিবাহের ক্ষেত্রে এনগেজমেন্ট অর্থাৎ কনেকে আংটি বা চেইন বিনিময় করার বিষয়টি অমুসলিম খ্রিষ্টান থেকে চলে আসা প্রচলিত রীতি মাত্র। যা প্রাচীন গ্রীকদের থেকে আগত। তারা বিশ্বাস করত যে, বামহাতের অনামিকায় আংটি পরালে হবু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়, কোন মুসলিম যদি এমন অঙ্গুরীয়কে শুভাশুভ কিছু ধারণা করে বা বিশ্বাস করে তাহলে তা হারাম এবং বিদআত ও শিরকের পর্যায়ভুক্ত হবে। (এই মর্মে শাইখ ইবনে উসায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৮/১১২ দেখতে পারেন)। আর স্বাভাবিক ভাবেও বিবাহের পূর্বে এরূপ কোন ইনগেইজমেন্টের প্রমাণ ইসালমী শরী‘আতে পাওয়া যায় না। সুতরাং আংটি পড়ানো ইসলামী সংস্কৃতি নয়। বরং এটি অমুসলিম বিধর্মীদের কালচার থেকে মুসলিমরা গ্রহণ করেছে। আর অমুসলিমদের অনুসরণ-অনুকরণ ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না। (সূরা মায়েদাহ; ৫/৫১)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং এমন ব্যক্তি পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’(আলে ইমরান; ৩/৮৫)
.
অমুসলিমদের অনুসরণ সম্পর্কে আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় উম্মতকে সাবধান করে বলেন, তোমরা ইহূদী-নাসারাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে হাতে হাতে ও বিঘতে বিঘতে। তারা যদি গুই সাপের গর্তে ঢুকে পড়ে, তোমরাও সেখানে ঢুকবে।’(ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৪,সনদ হাসান) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছেড়ে অন্যের অনুকরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয় অতএব তোমরা ইহূদী এবং খৃষ্টানদের অনুসরণ করো না।’ (তিরমিযী হা/২৬৯৫; সিলসিলা সহীহাহ হা/২১৯৪) তাই কোন মুসলিমের উচিত নয় কোন বেদ্বীন কাফের-মুশরিকের অনুসরণ করা। কেননা যে ব্যক্তি যে দলের সাথে সাদৃশ্য রাখবে ক্বিয়ামতের দিন সে তাদের দলভুক্ত হবে। রাসূলুল্লাহ( ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। (আবু দাউদ হা/৪০৩১; সহীহুল জামে হা/৬১৪৯; মিশকাত হা/৪৩৪৭)। বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) কনেকে ইনগেইজমেন্ট বা আংটি পড়ানো কাফেরদের অন্ধ অনুকরণ বলে উল্লেখ করেছেন। (আদাবুয যিফাফ, মাসআলা নং ৩৮)
.
উল্লেখ্য যে, বিবাহের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে এই সময় পাত্রীর মন বড় করার জন্য এবং বিবাহের আগ্রহ প্রকাশার্থে পাত্রীকে কিছু টাকা বা কোনও উপহার সামগ্রী দেওয়া দূষণীয় নয়। এটা আমাদের সামাজিক রীতি ও দেশাচার। আর ইসলামী শরীয়তে দেশাচার ও সামাজিক প্রথা, ও আঞ্চলিক রীতিনীতিকে হারাম সাব্যস্ত করে নি যতক্ষণ না তাতে শরিয়া বিরোধী কিছু থাকে। কথায় আছে, ‘স্মৃতি দিয়ে বাঁধা থাকে প্রীতি, প্রীতি দিয়ে বাঁধা থাকে মন, উপহারে বাঁধা থাকে স্মৃতি, তাই দেওয়া প্রয়োজন।’’ তবে এই উপহার পাত্রীর পরিবারের উপস্থিতিতে বা তাদের জ্ঞাতসারে হওয়া উচিত। কেননা বিয়ের পূর্বে গোপনে পাত্র-পাত্রীর মাঝে উপহার লেনদেন তাদের উভয়কে ফিতনার দিকে নিয়ে যেতে পারে। উপহার দেওয়া নেওয়া সম্পর্কে আয়িশা (রা.) বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপহার গ্রহণ করতেন এবং এর প্রতিদানও দিতেন। (ইমাম বুখারী, আস-সহিহ: ২৫৮৫)। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা পরস্পরকে হাদিয়া দাও ও মহব্বত বৃদ্ধি কর।’ (সহীহুল জামে; হা/৩০০৪)। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন, যদি আকদ এর পূর্বে উপহার দেওয়া হয় এবং কনের পরিবার তার সাথে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে অন্য কারও সাথে তার বিয়ে দেয় তাহলে তা ফেরত নিতে পারে।”(আল ফাতাওয়া আল কুবরা ৫/৪৭২)
.
পরিশেষে, প্রতিটি মুসলিম পরিবারের উচিত এনগেজমেন্ট তথা আংটি পরানোর মত বিজাতি প্রথা পরিত্যাগ করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পথ অনুসরণ করে পবিত্র কুরআন-সহীহ হাদীস মেনে চলা। আর আংটি পড়ানো মানে বিয়ে সম্পন্ন নয়। আকদ তথা ইজাব-কবুল ছাড়া বিয়ে সংঘটিত হয় না। আক্দ হলো দু’জন স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে অভিভাবকের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বরের কবুল বলা। আর আক্দ হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে মেলামেশা ও সাক্ষাত করা সবই জায়েয। এমনকি স্বামী মারা গেলে স্ত্রী মোহরানাসহ যাবতীয় মীরাছের অংশীদার হবে। (আবু দাঊদ হা/২১২৪; মিশকাত হা/৩২০৭; ইরওয়া হা/১৯৩৯, সনদ সহীহ)। সুতরাং, বিবাহ সম্পাদনের আগ পর্যন্ত আংটি পড়ানো হলেও তাদের পরস্পরের মধ্যে পর্দার বিধান পরিপূর্ণ বলবৎ থাকবে। কোন ভাবেই একত্রে থাকা বা চলাফেরা করা জায়েয নয়। (সূরা নূর; ২৪/৩০-৩১ সুনানে দারেমী হা/২২০২; মিশকাত হা/৩১৪৯) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।