ইতিকাফ সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: ইতিকাফ শব্দের অর্থ কি? ইতিকাফের সূচনা এবং উদ্দেশ্য কি? ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত কি? ইতিকাফ কোথায় করতে হবে? ইতিকাফে কখন বসবেন ও কখন বের হবেন?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: মুসলিম উম্মাহর জন্য ইতিকাফ এমন এক ইবাদত, যেটিকে নবীজী শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো ইতিকাফ। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের পাপ মোচনের জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ দিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রামাদান মাসের শেষ দশকের বরকতময় রজনী ‘লায়লাতুল ক্বদর’, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সেই রজনী পাবার জন্য ইতিকাফ এক বিশেষ ব্যবস্থা। এই পোস্টে আমরা ইতিকাফের মৌলিক কিছু বিষয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
❑ ইতিকাফের পরিচয়:
.
ইতিকাফ শব্দটি عكف শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ: নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা,নিজেকে কোনো স্থানে বদ্ধ রাখা ইত্যাদি। পরিভাষায়: ইতিকাফ মানে, দুনিয়াবি সকল কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিজেকে মসজিদে ইবাদত ও তেলাওয়াতের মধ্যে আবদ্ধ রাখা‌। (ফিক্বহুস সুন্নাহ, (শতাব্দী প্রকাশনী,খন্ড :১ পৃষ্ঠা: ৩৮৮)
.
❑ ইতিকাফের বিধান:
.
ইতিকাফ শরীআত নির্দেশিত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন; “এবং আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।” (সূরা বাকারা; ২/১২৫)। আল্লাহর নবী রাসূল (ﷺ) প্রতি রামাযানে শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। এমনকি যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ই‘তিকাফ করেন। আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) প্রতি রামাযানে ১০দিন ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ই‘তিকাফ করেন। (সহীহ বুখারী হা/২০৪৪)। ইতিকাফের মূল বিধান হচ্ছে- এটি সুন্নাত; ওয়াজিব নয়। তবে কেউ মানত করলে তার উপর ওয়াজিব হবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র কোন আনুগত্য পালন করার মানত করে সে যেন সেই আনুগত্য আদায় করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র অবাধ্য হওয়ার মানত করে সে যেন আল্লাহ্‌র অবাধ্য না হয়। (সহিহ বুখারী হা/৬৬৯৬)। ইমাম ইবনুল মুনযির বলেন: আলেমগণ ইজমা করেছেন যে, ইতিকাফ সুন্নাত; ফরয নয়। তবে কেউ যদি মানত করে নিজের উপর ফরয করে নেয় তাহলে ফরয হয়। (ইবনুল মুনযির আল-ইজমা পৃষ্ঠা-৫৩)। বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, কোন সন্দেহ নেই ইতিকাফ আল্লাহ্‌র নৈকট্য হাছিলের একটি মাধ্যম। ইতিকাফ রমযান মাসে পালন করা অন্য সময়ে পালন করার চেয়ে উত্তম…। এটি রামাদান মাসে ও অন্য সময়ে পালন করা শরীয়তসম্মত। (ইমাম বিন বায রাহিমাহুল্লাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/১৫; পৃষ্ঠা:৪৩৭)। জেনে রাখা ভালো যে- আমাদের দেশের প্রচলিত মাযহাবীরা মনে করেন, সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিকাফে বসাতে হবে, তা না হলে সবাই গুণাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। বরং এটি ব্যক্তিগত ইবাদত।
.
❑ ইতিকাফের সূচনা:
.
ইতিকাফের সূচনা হয়েছিলো ইব্রাহিম (আ.)-এর সময় থেকে। আল্লাহ্ বলেন, ‘‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম; তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদা আদায়কারীদের জন্য পরিচ্ছন্ন করো।’’ (সুরা বাকারাহ; আয়াত: ১২৫)
.
❑ ইতিকাফের উদ্দেশ্য:
.
ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো, সৃষ্টির সাথে যাবতীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে একান্ত নিভৃতে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকা যাতে মানবমনের যাবতীয় চিন্তা জুড়ে কেবল আল্লাহর যিকর, তাঁর ভালোবাসা সন্তুষ্টি অর্জন, গুনাহ মাফ এবং লায়লাতুল ক্বদরকে অন্বেষণ করা। (ইমাম ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ: ২/৮৭ ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ১১৬৭)। তাছাড়া ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো: নিজের কামনা-বাসনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, প্রবৃত্তিদমন এবং অহেতুক কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা।
.
❑ ইতিকাফের ফজিলত:
.
ইতিকাফ ইসলামে নির্ধারিত এবং এটি এমন একটি ইবাদত যা একজনকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে। একবার এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, এমন অনেক হাদীস রয়েছে যা আমাদেরকে নফল ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য পেতে উৎসাহিত করে । এই হাদীসগুলোর সাধারণ অর্থ ইতিকাফ সহ সকল প্রকার ইবাদতকে অন্তর্ভুক্ত করে। উদাহরণ স্বরূপ, হাদীসে কুদসিতে রয়েছে; যাতে আল্লাহ বলেন: “আমার বান্দা আমার কাছে প্রিয় কোন কিছু দিয়ে আমার নিকটবর্তী হয় না যা আমি তাকে ফরজ করেছি ধর্মীয় কর্তব্যের চেয়ে, এবং আমার বান্দা উচ্চতর কাজের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে। যে আমি তাকে ভালবাসব। যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণ যা দিয়ে সে শোনে, তার সেই দৃষ্টি যা দিয়ে সে দেখে, তার হাত যা দিয়ে সে আঘাত করে এবং তার পা যা দিয়ে সে চলে। যদি সে আমার কাছে [কিছু] চায় তবে আমি অবশ্যই তাকে দেব এবং যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় তবে আমি অবশ্যই তাকে তা দেব। (সহীহ বুখারী হা/৬৫০২)। কিন্তু ইতিকাফের ফযিলত সম্পর্কে আলাদা কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে; কিন্তু সে হাদীসগুলো দুর্বল কিংবা বানোয়াট; একটিও সহীহ নয়। (বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৯০০৩)
.
❑ ই‘তিকাফের স্থান:
.
যে মসজিদে সালাতের জামাআত হয়, সেই মসজিদে ইতিকাফ করা জায়েয। মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না। তবে কেউ বলেছেন, যে কোন মসজিদে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে যদিও সেখানে সালাতের জামা‘আত না হয়। তার দলীল হলো, এই আয়াত-‘আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না।’ (সূরা আল-বাক্বারাহ; ১৮৭)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা শুধু মসজিদের কথা উল্লেখ করেছেন। আর তাতে কোন শর্ত নেই। কিন্তু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ঐ মসজিদে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে, যে মসজিদে প্রতিনিয়ত সালাতের জামাআত হয়। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, لَا اعْتِكَافَ إِلَّا فِي مَسْجِدِ جَمَاعَةٍ ‘যে মসজিদে জামা‘আত হয় না; সে মসজিদে ইতিকাফ হবে না।’ (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৯৫০৯)।
.
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, لا اعْتِكَافَ إلا فِي مَسْجِدٍ تُقَامُ فِيهِ الصَّلاةُ ‘যে মসজিদে সালাত হয় না সেখানে ই‘তিকাফ হবে না(মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ৫/২১২ পৃ.)। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যে মসজিদে সালাতের জামা‘আত হয়, তবে জুম‘আহ হওয়া শর্ত নয়। আর বিশুদ্ধ অর্থে যে মসজিদে জামা‘আত হয় না; (পরিত্যক্ত) তাকে মসজিদ বলা হয় না। কারণ শুধু জুমু‘আর জন্য অন্য মসজিদে যাওয়াতে তেমন কোন সমস্যা নেই। পক্ষান্তরে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জন্য প্রতিদিন বের হওয়ার যে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে তা জুমু‘আতে নেই। তবে মহিলাদের জন্য যে কোন মসজিদে ইতিকাফ শুদ্ধ; কারণ তাদের উপর যেহেতু জামা‘আতে সালাত পড়া ওয়াজিব নয়।’ (শারহুল মুমতি‘, ৬/৩১২-৩১৩ পৃ.)।
.
❑ ইতিকাফের সর্বনিম্ন সময়কাল:
.
ইতিকাফের সর্বনিম্ন সময় কতক্ষণ এটি নিয় আহালুল আলেমগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ আলেমের মতে ইতিকাফের সর্বনিম্ন সময় এক মুহূর্তের জন্যও হতে পারে। এটি ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমাদের মাযহাব। (দেখুন- আদ দুরুল মুখতার খন্ড:১/৪৪৫ আল মাজমু:৬/৪৮৯)। ইমাম নববী বলেছেন: “আর ইতিকাফের সর্বনিম্ন সময় সম্পর্কে অধিকাংশ আলেম দৃঢ়তার সাথে যে মত ব্যক্ত করেছেন সেটাই সঠিক মত। তা হচ্ছে- ইতিকাফের জন্য মসজিদে অবস্থান করা শর্ত। সেটা বেশি সময়ের জন্য হতে পারে, কম সময়ের জন্যেও হতে পারে। এমনকি সামান্য সময় বা এক মুহূর্তের জন্যেও হতে পারে। (ইমাম নববী আল মাজমূ খন্ড:৬/৫১৪)। ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন; ইতিকাফ হলো আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করা, সময় কম হোক অথবা বেশি হোক। কারণ আমার জানা মতে এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না যা একদিন, দুইদিন বা এর চেয়ে বেশী দিনের জন্য ইতিকাফ করাকে নির্দিষ্ট করবে। ইতিকাফ শরীয়তসম্মত ইবাদত। তবে কেউ যদি মান্নত করে তখন মান্নতের কারণে তার উপর ইতিকাফ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। ইতিকাফের বিধান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/১৫; পৃষ্ঠা:৪৪১)
.
❑ ইতিকাফ কি শুধু রামাদানে করতে হয়? নাকি অন্য মাসেও করা যায়:
.
বছরের যে কোন সময় ইতিকাফ করা সুন্নাত; সেটা রামাদানের মধ্যে হোক অথবা রামাদানের বাইরে হোক। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ)বলেন, ইতিকাফ একটি সুন্নাত ইবাদত। যা ইজমার মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে ইজমার মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে যে, শুধুমাত্র মান্নতের কারণে ইতিকাফ ফরজ হতে পারে। বেশি বেশি ইতিকাফ করা মুস্তাহাব। রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা মুস্তাহাব; এ সময়ে এর মুস্তাহাব হওয়াটা আরও জোরদার হয়। (ইমাম নববী আল মাজমু খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:৫০১)। ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, সন্দেহ নেই যে, মসজিদে ইতিকাফ করা একটি ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। রমযানে এ ইবাদত পালন করা অন্য সময় পালন করার চেয়ে উত্তম। এটি রামাদানে ও রামাদানের বাইরে পালন করা যেতে পারে। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/১৫; পৃষ্ঠা:৪৩৭)
.
❑ রামাদানে ইতিকাফে কখন বসবেন ও কখন বের হবেন?
.
ইতিকাফকারী ব্যক্তি কখন মসজিদে প্রবেশ করবেন যদিও এটি নিয়ে আহালুল আলেমগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে বিশুদ্ধ কথা হলো,২০ রামাদান সূর্য অস্তের অর্থাৎ মাগরিবের পর মসজিদে ইতিকাফের জন্য তৈরি করা জায়গায় প্রবেশ করবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রামাদানের শেষের দশকে ইতিকাফ করতেন। আর শেষের দশক শুরু হয় ২০ রামাদানের সূর্য ডুবার পর থেকে। (সহীহ মুসলিম, হা/১১৭২; মির‘আত, হা/২১২৪-এর আলোচনা দ্র.; ফাতাওয়া উসায়মীন,২০/১২০ পৃ.)। এবং দশম দিন শাওয়ালের চাঁদ অর্থাৎ ঈদের চাঁদ দেখা গেলে ইতিকাফের স্থান থেকে বের হবে। (ফাতাওয়া উসায়মীন, ২০/১৭০ পৃ.)। জেনে রাখা ভাল, যে হাদীসে ফজরের পর ইতিকাফের জায়গায় প্রবেশের কথা বলা হয়েছে (সহীহ মুসলিম, হা/১১৭২; মিশকাত, হা/২১০৪), তার অর্থ হলো, তিনি জনগণ থেকে একাকী হতেন। (ফাতাওয়া উসাইমীন, ২০/১৭০ পৃ.)। একই কথা সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহর আলেমগন বলেছেন। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ খন্ড:১০ পৃষ্ঠা:৪১১)
.
❑ মহিলাদের ই‘তিকাফের বিধান কি এবং কোথায় করবে:
.
মহিলাদের জন্য ইতিকাফ শরীআত সম্মত। আহালুল আলেমগণ এই মর্মে একমত যে, কোন পুরুষের জন্য মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ করা সহীহ নয়। পক্ষান্তরে, নারীর ইতিকাফের ব্যাপারে আহালুল ইমামগণের মধ্যে কিছুটা মতানৈক্য রয়েছে। তবে দলিলের আলোকে জমহুর আলেমের অভিমত হচ্ছে; পুরুষের মত নারীর জন্যেও মসজিদ ছাড়া অন্যত্র ইতিকাফ করা সহীহ নয়। কারণ আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফে থাকা অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে যৌনকর্ম করো না।” (সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৭)। এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ তাঁর কাছে মসজিদে ইতিকাফ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাদেরকে অনুমতি দেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পরেও তাঁরা মসজিদে ইতিকাফ করেছেন। যদি নারীর জন্য নিজ ঘরে ইতিকাফ করা জায়েয হতো তাহলে তিনি তাদেরকে সেই দিক- নির্দেশনা ই দিতেন। কেননা নারীর জন্য মসজিদের চেয়ে নিজের ঘর পর্দায় থাকার জন্য অধিক উপযোগী। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; কোন মহিলা যদি ইতিকাফ করতে চায় তাহলে কোথায় করবে? তিনি জবাব দিলেন: কোন নারী ইতিকাফ করতে চান তাহলে তিনি মসজিদে করবেন; যদি এতে শরয়ী সতর্কীকরণের কিছু না থাকে। আর যদি এতে শরয়ী সতর্কীকরণের কিছু থাকে তাহলে ইতিকাফ করবে না। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড:২০ পৃষ্ঠা:২৬৪)
.
মাওসুআ’ ‘আল-ফিকহিয়্যা’-তে এসেছে- তারা নারীর ইতিকাফের স্থানের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। জমহুর আলেমের মতে, পুরুষের মত নারীর জন্যেও মসজিদ ছাড়া অন্যত্র ইতিকাফ করা সহীহ নয়। অতএব, কোন নারীর তার ঘরের মসজিদে ইতিকাফ করা সহীহ নয়। যেহেতু ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁকে এমন মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যিনি তার নিজ ঘরের মসজিদে ইতিকাফ করার শপথ করেছিলেন। তখন তিনি বললেন; এটি বিদআত আর আল্লাহ্‌র কাছে সর্বাধিক অপছন্দীয় আমল হচ্ছে— বিদআত। সুতরাং যে মসজিদে নামাযগুলো অনুষ্ঠিত হয়; এমন মসজিদ ছাড়া অন্যত্র কোন ইতিকাফ নেই। কেননা ঘরের মসজিদ প্রকৃত অর্থে কিংবা বিধানগত অর্থে মসজিদ নয়। তাই তো সেই মসজিদকে পরিবর্তন করা ও এর মধ্যে জুনুবী ব্যক্তির ঘুমানো জায়েয। অনুরূপভাবে এটি যদি জায়েয হতো তাহলে রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রীগণ সেটি করতেন; এমন কি জায়েয বর্ণনার জন্য একবার হলেও করতেন। (মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা খন্ড:৫ পৃষ্ঠা:২১২; ইসলামী সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৫০০২৫)। ইতিকাফ করার ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য শর্ত হচ্ছে- (১). স্বামীর অনুমতি: স্বামীর অনুমতি ব্যতীত মহিলারা ইতিকাফ করতে পারবে না। যেমন আয়েশা (রাঃ) ইতিকাফের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করছিলেন। তদ্রূপ হাফসাহ ও যায়নাব (রাঃ)ও অনুমতি চেয়েছিলেন। (বুখারী হা/২০৩৩)।

(২). ফিৎনার আশংকা না থাকা: মহিলার জন্য ইতিকাফ করা বৈধ হবে না, যদি তার ব্যাপারে কোন আশংকা কিংবা তার কারণে অন্য কোন পুরুষ ফিৎনায় পড়ার আশংকা থাকে। সব ধরনের ফিৎনা থেকে নিরাপদ হলে মহিলাদের ইতিকাফ করা বৈধ হবে। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ পৃষ্ঠা: ১৫২)। মহিলাদের জন্য পর্দা দিয়ে মসজিদে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রীগণ যখন ইতিকাফ করতেন তখন মসজিদে তাদের জন্য আলাদা তাঁবু টাঙ্গানো হতো। কেননা মসজিদে পুরুষরা সালাতের জন্য উপস্থিত হয়। তাই মসজিদে মহিলাদের জন্য এমন স্থান নির্ধারণ প্রয়োজন যেখানে পুরুষরা তাদেরকে দেখতে পাবে না। মূলতঃ মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকাই উত্তম। (ফিকহুস্ সুন্নাহ ল্লিন্নিসা মাকতাবাতুত্ তাওফিকিয়্যাহপৃষ্ঠা: ২৪৭)

❑ ইতিকাফ সুন্দর করতে করণীয়:
.
(১). মোবাইল ও অনলাইন থেকে দূরে থাকা উচিত। বিশেষ করে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ইতিকাফ অবস্থায় অনলাইনে আসা একদম অনুচিত। কারণ মাসজিদের পরিবেশ ইবাদতময় আর অনলাইনের পরিবেশ গুনাহময়।

(২). আড্ডায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। অধিকাংশ ইতিকাফকারী এই কাজটা করেন। কেউ আড্ডা দিতে আসলে তাকে সরিয়ে দিতে হবে।

(৩). অত্যধিক পরিমাণে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলে ইবাদতে উৎসাহ পাওয়া যাবে।

(৪).যথাসাধ্য কম ঘুমানো উচিত। ঘুমের জন্য সারা বছর পড়ে আছে। অন্তত এই দিনগুলো ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।

(৫). প্রস্রাব-পায়খানা ব্যতীত মাসজিদের বাইরে বা ইতিকাফের স্থান থেকে সরে যাওয়া যাবে না। গেলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই খুব সাবধান!

(৬). ইতিকাফের মাসয়ালাগুলো আগেই ভালো করে জেনে নিতে হবে। না হয় কোনো ভুলের কারণে এই কষ্টের ইবাদত বিফলে যেতে পারে।
.
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইতিকাফের মাসআলা-মাসায়েল যথাযথভাবে উপলব্ধি করে তা মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।