অনেকে দু’আ-মুনাজাতে বলেন আমরা আল্লাহর কুদরতি পায়ে সিজদাহ করি এই বক্তব্য কতটুকু সঠিক

ভূমিকা: ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে আমরা আল্লাহর ‘কুদরতি পায়ে’ সিজদাহ করি এই বক্তব্য বা আক্বীদা বিশ্বাস সঠিক নয়। কারন মহান আল্লাহর সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদাহ হল, আল্লাহ তাআলাকে ঐ গুণে গুণান্বিত করা যে গুণে আল্লাহ নিজেকে গুণান্বিত করেছেন অথবা রাসূল (ﷺ) বিশুদ্ধ হাদীসে আল্লাহকে যে গুণে গুণান্বিত করেছেন। এবং তাতে কোনো প্রকার বিকৃতি, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান, সাদৃশ্য বর্ণনা বা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, রূপক অর্থ করা এবং স্বরূপ নির্ধারণ করা যাবে না।পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে জানা যায়, আল্লাহর চেহারা আছে, হাত আছে, পা আছে, চক্ষু আছে, নফস আছে, তিনি শুনেন এবং সবকিছু দেখেন, তিনি কথা বলেন, তাঁর সুন্দর সুন্দর নাম ও গুণাবলী রয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহর দেখা তার হাত, পা, চেহারা কেমন তিনি কিভাবে কথা বলেন, সে সম্পর্কে আমরা কোন ধারণাও করতে পারি না চিন্তাও করতে পারি না কোন কিছুর সাথে তুলনাও করতে পারিনা। কারন সৃষ্টিজগতে তাঁর কোন তুলনা নেই। মহান আল্লাহ তা‘আলা নিজের সম্পর্কে বলেছেন তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই, তিনি সবকিছু শুনেন ও দেখেন। (সূরা শুরা-,৪২/১১) আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআ‘ত আল্লাহ তা‘আলার জন্যে ঐসব গুণাবলী সাদৃশ্যহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন, যা তিনি স্বীয় কুরআন কারীমে অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহীহ হাদীস সমূহে আল্লাহর জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সদৃশ হওয়া থেকে এমনভাবে পবিত্র রাখেন যার মধ্যে তা‘ত্বীল বা গুণমুক্ত করার কোনো লেশ থাকে না। ফলে তারা পরস্পর বিরোধী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে আল্লাহর গুণাবলীর ওপর ঈমান আনয়ন করে থাকেন।
.
সুতরাং মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে কুদরাতি হাত বা কুদরাতি পা অথবা কুদরাতি চক্ষু ইত্যাদি অর্থ করা আল্লাহর গুণাবলীর বিকৃতি সাধন করার শামিল। এগুলো মূলত ভ্রান্ত আক্বীদা কেননা এতে আল্লাহর সিফাত বাতিল গণ্য হয়। আল্লাহর হাত অর্থ তাঁর কুদরতি হাত বা দানের হাত, কুদরতি পায়ে সিজদা করছি এমন বক্তব্য বা বিশ্বাস পথভ্রষ্ট ফিরকা *ক্বাদরিয়া ও মু‘তাযিলাদের। সুতরাং যারা আমরা দু’আ করার সময় মোনাজাতের মধ্যে বলি, অথবা সালাত আদায়ের সময় মনে করি আল্লাহর পায়ে সিজদাহ করছি অথবা ধারনা ক‌রি আল্লাহর কুদরতি পায়ে সিজদাহ করছি। অথবা অস্তিত্বে সিজদা করছি এগুলো একেবারেই ভুল কথা এবং ভ্রান্ত আক্বীদা। কারণ প্রথম কথা হচ্ছে, আল্লাহর পায়ে কোনো সিজদাহ নেই। কুদরতি পা তো প্রশ্নই আসে না। কুদরতি পা কথাটাই শুদ্ধই না। বাতিল ফিরকা *ক্বাদরিয়া ও মু‘তাযিলারা মনে করে আল্লাহর হাত অর্থ তাঁর কুদরতি হাত বা নেয়ামতের হাত (নাউজুবিল্লাহ) যা কুরআন-সুন্নাহ সালাফদের নীতি বিরোধী। যদি কেউ মনে করে থাকেন, আমরা আল্লাহকে সিজদাহ করছি, অথবা আল্লাহর কুদরতি পায়ে সিজদা করছি তারা ভুলের মধ্যে রয়েছেন। আমরা কখনোই আল্লাহকে অথবা আল্লাহর কুদরতি পায়ে সিজদা করছি না। বরং আমরা সিজদাহ করছি আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের জন্য। তার হুকুম অনুসরণ করে। এই সিজদাহটি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কুদরতি পায়ে নয়, এমনকি আমরা এটাও জানিনা মহান আল্লাহর সুরত কী।তিনি আমাদেরকে রুকু-সিজদাহ করার হুকুম করেছেন। তাই আমরা মহান রবের হুকুমের অনুসরণ করছি। যদি আল্লাহ তায়ালা আমাদের রুকু ও সিজদাহ করতে হুকুম না দিতেন, তাহলে আমরা আল্লাহ তায়ালার সিজদাহ করতাম না। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করছি। আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে আমরা মাথা নত করছি, সিজদাহে যাচ্ছি। তাছাড়া শুধু আমরা কেন? গোটা সৃষ্টিজগৎ আল্লাহকে সিজদা করে, পৃথিবীর সব কিছুই মহান আল্লাহর জন্য সিজদা করে। মহান আল্লাহ বলেন, আর আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে এবং তাদের ছায়াসমূহও (সিজদা করে) সকালে ও সন্ধ্যায় ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায়।’(সুরা রাদ;১৩/১৫) অর্থাৎ সিজদা মানে আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য ঝুঁকে পড়া, আদেশ পালন করা এবং পুরোপুরি মেনে নিয়ে মাথা নত করা।পৃথিবী ও আকাশের প্রত্যেকটি সৃষ্টি আল্লাহ্‌র আইনের অনুগত এবং তাঁর ইচ্ছার চুল পরিমাণও বিরোধিতা করতে পারে না -এ অর্থে তারা প্রত্যেকেই আল্লাহকে সিজদা করছে। মুমিন স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে তাঁর সামনে নত হয় কিন্তু কাফেরকে বাধ্য হয়ে নত হতে হয়। কারণ আল্লাহ্‌র প্রাকৃতিক আইনের বাইরে চলে যাওয়ার ক্ষমতা নেই।

অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন, ‘তুমি কি দেখো না যে আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও বহু মানুষ। আর বহু মানুষ (যারা সিজদা করতে অস্বীকার করেছে) তাদের ওপর শাস্তি অবধারিত হয়েছে। বস্তুত আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন তাকে সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা চান তা-ই করেন।’(সুরা হজ্জ;২২/১৮)
.
এমনকি শুধু নিম্নজগতে নয়, সিজদার এই নিয়ম রয়েছে ঊর্ধ্বজগতেও। সেখানে ফেরেশতা মহান আল্লাহর উদ্দেশে সিজদা করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুসমূহের প্রতি লক্ষ করে না। তাদের ছায়া ডানে ও বাঁয়ে ঢলে পড়ে আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় বিনীতভাবে? আসমান ও জমিনে যত প্রাণী আছে, সবই আল্লাহকে সিজদা করে এবং ফেরেশতারাও। আর তারা অহংকার করে না।’ (সুরা নাহল;১৬/৪৮-৪৯)
.
ইনশাআল্লাহ আখিরতে মুমিন নর-নারী আল্লাহকে তাঁর স্বরূপে দেখবেন। আর সেটাই হবে তাদের জন্য সবচাইতে আনন্দঘন মুহূর্ত।তিনি বলেছেন-‘সেদিন অনেক চেহারা উজ্জ্বল হবে।’‘তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকব’(সূরা ক্বিয়ামাহ ৭৫/২২-২৩)। হাদীসে এসেছে, আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আমি নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, আমাদের প্রতিপালক যখন তাঁর পায়ের গোড়ালির জ্যোতি বিকীর্ণ করবেন, তখন ঈমানদার নারী ও পুরুষ সবাই তাকে সাজ্দাহ করবে। কিন্তু যারা দুনিয়াতে লোক দেখানো ও প্রচারের জন্য সাজ্দাহ করত, তারা কেবল বাকী থাকবে। তারা সিজদা করতে ইচ্ছে করলে তাদের পিঠ একখন্ড কাঠের ন্যায় শক্ত হয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী: ৪৯১৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৫৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৫৫৪)
.
জেনে রাখা ভাল, মহান আল্লাহর জাত বা সত্তা যেমন তুলনাহীন তেমনিভাবে তাঁর গুণাবলির ক্ষেত্রেও তিনি অতুলনীয়। এটাই সালাফদের ‘আক্বীদাহ্ বা বিশ্বাস। অপরদিকে যারা আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস করে অর্থাৎ এ কল্পনা বা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলার হাত, চেহারা, চোখ অথবা নলা হল কুদরতি বা কোন সৃষ্টির হাত, চেহারা ও চোখের মতো তারা মুমিন নয়। বরং এসব তাদের ভ্রান্ত ধারনা। তাদের ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণার্থে মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাঁর পবিত্র সত্তার বর্ণনা দ্বারা মানুষের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটিয়েছেন। অপরদিকে যারা আল্লাহকে না দেখেই তাঁর সত্তায় বিশ্বাস স্থাপন করে তারা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ পূর্বক নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করে।তাই আল্লাহ তাআলা যে সব বস্তু নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন সেগুলো সবই সত্য এবং প্রকাশ্য অর্থেই গণ্য অর্থাৎ কুরআন সুন্নায় যেভাবে এসেছে সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। যেমন আল্লাহ তাআলার সুরতের হাকীকাত, কোন মানুষের জানা নেই। তেমনি এসবের কোনো রূপক অর্থ বা ব্যাখ্যা দেওয়ার অবকাশ নেই। এসবের উপর ঈমান আনা ওয়াজিব। আর এসবের আকৃতি-প্রকৃতির ব্যাপার আল্লাহর নিকট সোপর্দ করতে হবে। উপমা ও তুলনা ও ভুল ব্যাখ্যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।(সূরা শুরা,৪২/১১)।
.
পরিশেষে পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবো, একটি দালান যেমন ভিত্তি স্থাপন করা ব্যতীত দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তেমনি ভিত্তি ব্যতীত ইসলামের উপর টিকে থাকাও সম্ভব নয়, আর ইসলামের মৌলিক ভিত্তিই হল বিশুদ্ধ আক্বীদা। মানুষ তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সেই মৌলিক ভিত্তির উপরেই টিকে থাকবে। মুসলিম জীবনে বিশুদ্ধ আক্বীদাই মূল। কারণ আমলের চেয়ে আক্বীদার গুরুত্ব অনেক বেশী। আর ব্যক্তির আক্বীদা যদি সকল নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালামদের, বিশেষত শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাপ্ত ওহী অনুযায়ী বিশুদ্ধ না হয়, তাহলে কোন আমলই আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। যদিও উক্ত ব্যক্তি একনিষ্ঠতার সাথে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমল করুক না কেন। কেননা আল্লাহ তাআলা শুধু তারই সন্তুষ্টির জন্য ও তাঁর রাসূলের পদ্ধতি অনুযায়ী হওয়া ছাড়া কোনো আমল গ্রহণ করেন না। (সূরা যুমার: ৩৯/৩, সহীহ বুখারী হা/১)। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তর ও আমলের উপর ভিত্তি করে বিচার-ফায়সালা করবেন। (সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪)। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশিত পদ্ধতিতে ইবাদত করলে তাকে জান্নাতী বলে আখ্যায়িত করেছেন। (সহীহ বুখারী, হা/১৩৯৭; মিশকাত, হা/১৪)।
.
সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের মুক্তি ও তার আমলের কবুল হওয়া কামনা করে এবং প্রকৃত মুসলিম হতে চায় তার উচিত হবে, আক্বীদার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া, সহীহ আক্বীদা ও আক্বীদা বিরোধী বিষয়াবলি সম্পর্কে জানা, যাতে তার আমল বিশুদ্ধ আক্বীদা অনুযায়ী হয়। তবে এটা একমাত্র আলেম ও বিজ্ঞ লোকদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই সম্ভব, যারা উম্মাহর সালাফে-সালেহীনের নিকট থেকে ইলম অর্জন করেছেন। তাই আল্লাহর সাথে যেহেতু সাক্ষাৎ হবে এবং পার্থিব জীবনের কর্মের হিসাব দিতে হবে, সেহেতু প্রত্যেক বিশ্বাসী-মুমিন বান্দাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সৎকাজ করতে হবে। জীবনের সবকিছুকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করবে। যেমনটা আল্লাহ বলেছেন- “বল! আমার সালাত, আমার ইবাদত,আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎ সমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোন শরীক নাই এবং আমি এর জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।”(সূরা আন‘আম;৬/১৬২- ১৬৩) আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।