স্ত্রী শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম পালনকালে বে-রোজদার স্বামী তার সাথে সহবাস করেছে অথবা সহবাস করতে চাচ্ছে শরীয়তের দৃষ্টিতে এর হুকুম

নফল সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি নিজের উপর কর্তৃত্বশীল। তার জন্য সিয়াম পূর্ণ করা বা ভেঙ্গে ফেলার অবকাশ রয়েছে। তবে সিয়াম পূর্ণ করাটা উত্তম। ইমাম শাফি‘ঈ ও ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনুল কুদামাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যে নফল সিয়াম শুরু করবে, তার জন্য তা পূর্ণ করা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। সুতরাং তা পরিত্যাগ করলে তার ওপর কাযা নেই। ইবনু ‘উমার ও ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তারা দু’জনই সিয়াম অবস্থায় সকাল করলেন, অতঃপর সিয়াম ভঙ্গ করলেন। ইবনু ‘উমার (রাঃ) বলেন, যদি মানতের সিয়াম ও রমাযানের কাযা না হয়, তবে সিয়াম ভঙ্গে কোন সমস্যা নেই। অর্থাৎ- তাতে কোন কাযা নেই। ‘আল্লামা আসকালানী (রহঃ) বলেন, কোন কারণ ছাড়া নফল সিয়াম ভঙ্গ করা জায়িয, এটা জমহূর ‘উলামাগণের মত। আর তারা কাযা ওয়াজিব নয় বরং তা মুস্তাহাব।(মিসকাতুল মাসাবিহ হা/১৯৭৯ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব:)
.
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, একদা আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য খাবার তৈরী করলাম। তিনি তাঁর অন্যান্য সহচর সহ আমার বাড়িতে এলেন। অতঃপর যখন খাবার সামনে রাখা হল, তখন দলের মধ্যে একজন বলল, ‘আমার রোযা আছে।’ তা শুনে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘তোমাদের ভাই তোমাদেরকে দাওয়াত দিয়ে খরচ (বা কষ্ট) করেছে।’’ অতঃপর তিনি তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘‘রোযা ভেঙ্গে দাও। আর চাইলে তার বিনিময়ে অন্য একদিন রোযা রাখ।(বাইহাকী ৪/২৭৯, ত্বাবারানী, মু’জাম,আলবানী ইরওয়াউল গালীল হা/১৯৫২)
.
উম্মু হানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন ফাতিমা (রাঃ) এলেন এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাম পাশে বসলেন। আর উম্মু হানী (রাঃ) ছিলেন তাঁর ডান পাশে। এ সময় একটি দাসী হাতে একটি পাত্র নিয়ে এলো। এতে কিছু পানীয় ছিল। দাসীটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে পান পাত্রটি রাখল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখান থেকে কিছু পান করে তা উম্মু হানীকে দিলেন। উম্মু হানী (রাঃ)-ও ঐ পাত্র হতে কিছু পান করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি তো ইফতার করে ফেলেছি। অথচ আমি সায়িম ছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি রমাযান (রমজান) মাসের কোন সওম বা মানৎ কাযা করছিলে? উম্মু হানী (রাঃ) বললেন, না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন বললেন, নফল সওম হলে কোন অসুবিধা নেই-(তিরমিযী ৭৩১, দারিমী ১৭৭৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৩৫০, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১০৩৫,মুসনাদে আহমাদ হা/ ২৬৮৯৩, সহীহ আল জামি হা/ ৩৮৫৪ সনদ সহীহ)
.
সুতরাং যে ব্যক্তি শাওয়ালের ছয় রোজা রেখেছে সে যদি রোজাটি ভেঙ্গে ফেলতে চায় ভেঙ্গে ফেলতে পারে। ভেঙ্গে ফেলাটা আহার করার মাধ্যমে হতে পারে; সহবাসের মাধ্যমেও হতে পারে; অন্য কোন ভাবেও হতে পারে।এ নারী যদি স্বামীর বিনা অনুমতিতে রোজা রেখে থাকেন তাহলে স্বামীর অধিকার রয়েছে তাকে বিছানায় ডাকার এবং স্বামীর ডাকে সাড়া দেয়া তার উপর অনিবার্য। আর যদি স্ত্রী অনুমতি নিয়ে রোজা রেখে থাকে তাহলে স্ত্রীর রোজা নষ্ট করার অধিকার স্বামীর নেই। তবে স্বামী যদি সেটা চান তাহলে স্ত্রীর জন্য উত্তম হলো স্বামীর আহ্বানে সাড়া দেয়া। আবূ হুরাইরা কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘মহিলা যেন স্বামীর বর্তমানে তার বিনা অনুমতিতে রমাযানের রোযা ছাড়া একটি দিনও রোযা না রাখে। (মুসনাদে আহমদ ২/২৪৫, ৩১৬,সহীহ বুখারী হা/ ৫১৯৫ সহীহ মুসলিম হা/ ১০২৬, আবূ দাঊদ হা/২৪৫৮, তিরমিযী হা/৭৮২,ইবনে মাজাহ হা/ ১৭৬১, সহীহ ইবনে হিববান, হা/৯৫৪)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন: যদি কোন নারী স্বামীর অনুমতি নিয়ে রোজা রাখে তাহলে স্বামীর পক্ষে স্ত্রীর রোজা নষ্ট করা জায়েয হবে না। কারণ সে-ই তো রোজা রাখার অনুমতি দিয়েছে। তবে স্ত্রী যখন স্বামীর অনুমতি নিয়ে নফল রোজা রাখে এরপর স্বামী স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে এমতাবস্থায় স্ত্রীর জন্য কোনটা উত্তম: রোজা পালন করা; নাকি স্বামীর ডাকে সাড়া দেয়া? দ্বিতীয়টি অর্থাৎ স্বামীর ডাকে সাড়া দেয়া উত্তম। কারণ স্বামীর ডাকে সাড়া দেয়া মূলতঃ ফরজ পর্যায়ের আমল। আর নফল রোজা পালন করা মুস্তাহাব পর্যায়ের আমল। তাছাড়া স্বামীর তীব্র ইচ্ছা সত্ত্বেও স্ত্রী যদি এতে সাড়া না দেয় তাহলে তাদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড:২১ পৃষ্ঠা:১৭৪ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১১০০৫৯)
.
এমনকি নফল সিয়াম রাখা অবস্থায় কেউ অসুস্থতা অনুভব করলে তিনিও সিয়াম বঙ্গ করতে পারেন। এবং তারও পরবর্তীতে এই সিয়ামের কাযা আদায় করতে হবেনা।
.
নফল রোজা রাখতে গিয়ে কষ্ট হলে রোজা পূর্ণ করা উত্তম; নাকি ভেঙ্গে ফেলা উত্তম? এমন প্রশ্ন সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ কে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেছেন,নফল রোজাপালনকারীর জন্যে রোজা পূর্ণ করা অথবা ভেঙ্গে ফেলা উভয় সুযোগ রয়েছে। তবে কষ্টকর না হলে রোজা পূর্ণ করাই উত্তম। আর কষ্টকর হলে শরিয়তের সহজতা গ্রহণ করে ভেঙ্গে ফেলা উত্তম।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড:৯; পৃষ্ঠা: ২৯৯)
.
শাইখ উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) অপর ফাতওয়ায় বলেন: “যদি কোন লোক রোজা রাখে, এরপর এমন কিছু হয় যাতে করে তার রোজা ভাঙ্গাটা পরিস্থিতির দাবী হয়; তাহলে সে রোজা ভেঙ্গে ফেলবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল থেকে এটি জানা যায়। একবার তিনি মুমিনদের মা আয়েশা (রাঃ) এর কাছে এসে বললেন: তোমাদের কাছে কোন খাবার আছে? আয়েশা (রাঃ) বললেন: আমাদেরকে হাইস (একজাতীয় খাবার) হাদিয়া দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন: ‘আমাকে দেখাও তো; আমি তো রোজা রেখে ভোর করেছি’। এরপর তিনি খেয়েছেন। এটি নফল রোজার ক্ষেত্রে; ফরজ রোজার ক্ষেত্রে নয়।”(উসামীন ফাতওয়া সমগ্র, পৃষ্ঠা-২০) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: