প্রশ্ন: সালাতুল হাজত বা প্রয়োজন পূরণের সালাত আদায়ের বিধান ও পদ্ধতি কি?
▬▬▬▬▬▬▬🔰❂🔰▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সালাতুল হাজত বা প্রয়োজন পূরণের সালাত আদায়ের বিধান ও পদ্ধতি এবং এই সংক্রান্ত সংশয় নিরসন বিস্তারিত বর্ননাসহ আজ আলোচনা করবো ইন শাহ্ আল্লাহ। বিশেষ কোন বৈধ চাহিদা পূরণের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে দু’রাক‘আত নফল সালাত আদায় করা মুস্তাহাব, আর উক্ত সালাতই সমাজে সালাতুল হাজত নামে পরিচিত। (ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৫, সালাত অধ্যায় ২, অনুচ্ছেদ ১৮৯)।
.
নবী ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী সারাকে নিয়ে সফর করছিলেন। তৎকালীন মিসরের লম্পট শাসক সারাকে তার দরবারে ডাকে। শাসকের লাম্পট্য সম্পর্কে সবাই জানতো। তাই, সারা সেখানে গিয়ে প্রথমেই অজু করে সালাত আদায় করেন। এরপর এই বলে দু‘আ করেন, ‘‘হে আল্লাহ! এই কাফেরকে তুমি আমার উপর বিজয়ী করো না।’’একটু পর লম্পট বাদশাহ সারার দিকে কুদৃষ্টি দেয় এবং লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তার দিকে এগিয়ে আসে। সাথে সাথে লম্পট বাদশাহ’র হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে। তিন-তিন বার ব্যর্থ হয়ে অবশেষে সারাকে সে স্বসম্মানে মুক্তি দেয়। এছাড়া বহু মূল্যবান উপঢৌকনসহ তার খেদমতের জন্য হাজেরাকে তার সাথে পাঠিয়ে দেয়। (সহীহ বুখারি ২২১৭ অধ্যায় ৩৪, অনুচ্ছেদ ১০০ মুসনাদে আহমাদ হা/৯২৩০, সনদ সহীহ)।
অতএব, আমরা জানলাম বিশেষ সালাত ও দু‘আর ফলে আল্লাহ্ সারাকে হেফাজত করেছিলেন। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, ওহে, যারা ঈমান এনেছো! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করো। (সুরা আল বাকারাহ: ১৫৩)।
যেকোন বিপদে বা প্রয়োজনে আল্লাহর সাহায্য কামনার উদ্দেশ্যে ওযূ করে নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি কিংবা বিশেষ কোন দো‘আ ব্যতীত সাধারণ পদ্ধতিতে দুই রাকাত নফল সালাত পড়ে দু‘আ করা জায়েজ মর্মে পৃথিবীর কোনো আলেমের মধ্যে দ্বিমত নেই সবাই একমত এটি জায়েজ। মহান আল্লাহ বলেন, আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো (সূরা বাক্বারাহ ২/৪৫)।
এক অন্ধ ব্যক্তি নবী (ﷺ) এর নিকট এসে বলল, ‘আপনি আল্লাহর নিকট দুআ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করেন।’ তিনি বললেন, “যদি তুমি চাও তোমার জন্য দুআ করব। নচেৎ যদি চাও ধৈর্য ধর এবং সেটাই তোমার জন্য শ্রেয়।” লোকটি বলল, ‘বরং আপনি দুআ করুন।’ সুতরাং তিনি তাকে ওযু করতে বললেন এবং ভালরুপে ওযু করে দু’ রাকআত নামায পড়ে এই দুআ করতে আদেশ দিলেন: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি। তোমার নবী, দয়ার নবীর সাথে তোমার অভিমুখ হচ্ছি। হে মুহাম্মদ! আমি আপনার সাথে আমার প্রতিপালকের প্রতি আমার এই প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে অভিমুখী হয়েছি। হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তুমি এর সুপারিশ গ্রহণ কর এবং এর ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’ বর্ণনাকারী বলেন যে, অতঃপর ঐ ব্যক্তি ঐরুপ করলে সে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল। (মুসনাদে আহমেদ ১৭২৪০ তিরমিযী:৩৫৭৮, ইবনে মাজাহ্ ১৩৮৫ সহিহ আত তারগিব ৬৭৮ সহীহুল জামে১২৭৯)।
.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ ভীতি অনুভব করলেই দু’রাক‘আত সালাত আদায় করতেন (সহীহ ইবনু হিববান হা/১৯৭৫; আহমাদ হা/২৩৯৭২; সহীহাহ হা/৩৪৬৬) তবে এটি নফল সালাত হওয়ায় এর জন্য কোন নিষিদ্ধ সময় নেই বরং আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে যে কোন সময় পড়া যাবে। (আল মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ ২৭/২১১-১৫)।
কিন্তু দুই রাকাত বা চার রাকাত অথবা বার রাকাত নামাজকে বিশেষভাবে ‘সালাতুল হাজত’ নামকরণ করা এবং সালাত শেষে বিশেষ কোনো দু‘আর মাধ্যমে প্রার্থনা করা এসব ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদিস নেই। সালাতুল হাজত ও তাতে পঠিতব্য দো‘আ সম্পর্কে যে চারটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার একটিও সহীহ নয় সবগুলোই জাল জয়ীফ। মুহাদ্দিসগণ বলেন, চারটি হাদীসের মধ্যে একটিতে বিশেষ পদ্ধতি ১২ রাকাআত আদায় করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটি মওযু বা বানোয়াট। আর দু রাকাআত আদায় করার কথা বলা হয়েছেে বাকি ৩টি হাদীসে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে ১টি বানোয়াট (موضوع), একটি অত্যন্ত দুর্বল (ضعيف جداً) আর আরেকটি শুধু দুর্বল (ضعيف)। (দেখুন যঈফুত তারগীব হা/৪১৬, ৪১৮; যঈফুল জামে‘ হা/৫৮০৯; মিশকাত হা/১৩২৭)।
অতএব, ‘সালাতুল হাজত’ নাম নিয়ে, নির্দিষ্ট একটি দু‘আর মাধ্যমে সালাতুল হাজত পড়া সম্পর্কে যেহেতু সবগুলো হাদীস জাল জয়ীফ তাই এভাবে না পড়ে (তবে সাধারণভাবে দুই রাকাত সালাত পড়ে সাহায্য চাইতে অসুবিধা নেই); সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ড লাজনাহ দায়িমা এই মত দিয়েছে। (দেখুন ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৮/১৬২)।
.
আমরা উপরে সহীহ হাদীস ও কুরআনের আয়াত দ্বারা জেনেছি যে, বিপদে বা প্রয়োজন পূরণে সাধারণভাবে নফল নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া বৈধ এবং উত্তম, তাই সালাতুল হাজত নাম নিদিষ্ট না করে যে কোন বিপদে আপদে দুই রাকাত সালাত আদায় করা যাবে হুযাইফা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন সংকটে পড়তেন, তখন নামাজে দাঁড়াতেন।’ (আবু দাউদ ১৩১৯, সহীহুল জামে ৪৭০৩, মিশকাত হা/১৩১৫ সনদ সহীহ)।
🔰উক্ত নফল সালাত আদায়ের পদ্ধতি:
____________________________________
আগেই বলেছি কোনো বিশেষ নাম (যেমন: সালাতুল হাজত) বা নির্দিষ্ট দু‘আকে জরুরি না মনে করে, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য সাধারণভাবে নফল নামাজ পড়া। সিজদায় বেশি বেশি দোয়া পড়া এরপর নিজের মতো করে দু‘আর আদব ও নিয়ম অনুসরণ করে দু‘আ করা। দু‘আর অন্যতম আদব হল: প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করা, এরপর দরুদ পড়া এবং এভাবেই দু‘আ সমাপ্ত করা। এই পদ্ধতিতে সালাত পড়া ও দু‘আ করা সর্বসম্মতভাবে জায়েয। ওবায়দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে সালাত আদায় করল। এরপর দো‘আ করল, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মাফ করে দাও, তুমি আমাকে দয়া কর। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে মুছল্লী! তুমি বেশ তাড়াহুড়া করে ফেললে। তুমি ছালাত আদায় করে যখন বসবে তখন আগে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করবে, আমার ওপর দরূদ পড়বে। এরপর আল্লাহর কাছে দো‘আ করবে [তিরমিযী হা/৩৪৭৬; নাসাঈ হা/১২৮৪, সনদ সহীহ]।
তাছাড়া সিজদায় দোয়া কবুল হয় মর্মে একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস রয়েছে যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমরা এ ব্যাপারে সজাগ হয়ে যাও যে, আমাকে রুকূ’ ও সাজদাহর অবস্থায় কুরআন পাঠ করতে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব তোমরা রুকু’তে তোমাদের প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব বর্ণনা কর এবং সাজদাহতে গিয়ে আকুল প্রার্থনা কর, তাতে তোমাদের দু’আ যথার্থ কবুল করা হবে। [সহীহ মুসলিম ৪৭৯, ৪৮১, নাসায়ী ১০৪৫, ১১২০, আবু দাউদ ৮৭৬, ইবনু মাজাহ ৩৮৯৯, আহমাদ ১৯০৩, দারেমী ১৩২৫, ১৩২৬ বুলুগুল মারাম, হাদিস নং ২৯৩]।
উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে ‘সালাতুল হাজাত’ নামে অনেক বানোয়াট পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যেমন: ‘‘হাজতের (খিজির আ.) এর নামাজ। এ নামাজ ২ রাকাত। মনের বাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য খিজির (আঃ) জনৈক বোজর্গ ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়াছেন। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা কাফেরুন দশবার ইত্যাদি।’’ এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। (মো.বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮)। আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।