যারা কোচিং বা ব্যাচে ছেলে মেয়ে একসাথে পড়ায় তারা টিউশনি করে যা আয় করে তা কি হারামের অন্তর্ভুক্ত হবে

প্রশ্ন: অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তাদের কোচিং বা ব্যাচে ছেলে মেয়ে একসাথে পড়ায়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পড়াশোনা থাকায় ছেলে ও মেয়েদের আলাদা আলাদা পড়ানোর সময় নেই। এক্ষেত্রে তারা টিউশনি করে যা আয় করে তা কি হারামের অন্তর্ভুক্ত হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে একসাথে পড়াশোনা করা বা তাদের একসাথে প্রাইভেট পড়ানো সম্পূর্ণরূপে শরী‘আতবিরোধী কাজ।(সূরা আহযাব ২৪/৫৩)।এছাড়াও এটি মানুষের স্বভাব ধর্মের বিরোধী এবং পারস্পারিক নীতিবোধের জন্য চরম ক্ষতিকর। আধুনিক বংশধরগণের মধ্যে অশ্লীলতা প্রসারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হ’ল প্রচলিত সহশিক্ষা।
.
আর এজন্যই সহশিক্ষা তথা নারী-পুরুষের যৌথ শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলাম সমর্থিত নয়।বরং তা বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুকরণ।এক সময় কলেজ-ভার্সিটিতে এমনি পশ্চিমা দেশেও আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল।কিন্তু পরবর্তীতে ফ্রি মাইন্ডের অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমা দেশে সহশিক্ষা চালু হয় এবং তাদের অন্ধ অনুকরণে পরবর্তীতে আমাদের দেশেও সহশিক্ষা চালু হয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে এ শিক্ষা পদ্ধতি সম্পূর্ণ নাজায়েয এবং ইসলামের মূলনীতি পরিপন্থী।আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-আর তোমরা তাঁর (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর স্ত্রীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তরের জন্য এবং তাঁদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।(সূরা আহযাব- ৫৩;) বিখ্যাত তাফসীরবিদ ইমাম কুরতুবী রাহ. উক্ত আয়াতের আলোচনায় বলেন, উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের কাছে কোনো প্রয়োজনে পর্দার আড়াল থেকে কিছু চাওয়া বা কোনো মাসআলা জিজ্ঞাসা করার অনুমতি দিয়েছেন। সাধারণ নারীরাও উপরোক্ত হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে কুরতুবী ১৪/১৪৬)।
.
ইসালামে সালাত,সিয়াম,হজ্জ,যাকাত যেরকম ফরজ প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষের পর্দা করাও সেরকম ফরজ।যে কোন শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রীদের সাথে ছাত্রদের এবং শিক্ষিকাদের সাথে শিক্ষকদের সহাবস্থান করা হারাম। কেননা তা ফিতনা,যৌন উস্কানি ও অশ্লীলতায় নিমজ্জিত হওয়ার দিকে ধাবিত করে।আর এতে অপরাধ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে এবং বড় বড় অন্যায় সংঘটিত হবে, যখন শিক্ষিকাগণ বা ছাত্রীগণ তাদের শরীরের গোপনীয় বিষয়গুলোর কোনো কিছু প্রকাশ করে। অথবা তারা এমন পাতলা পোশাক পরিধান করে যার কারণে ভিতরের সবকিছু বুঝা যায় অথবা সংকীর্ণ বা টাইট ফিট পোশাক পরিধান করে,যা তাদের অঙ্গগুলোর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সবকিছু বুঝিয়ে দেয়, অথবা তারা ছাত্র বা শিক্ষকবৃন্দের সাথে হাসি, রসিকতা, কৌতুক করে, অথবা এ ধরনের এমন কোনো আচরণ করে,যা সম্মানহানি, ধর্ষণ ও নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত করে। তাই শরীয়তে নারী পুরুষের সহাবস্থান হারাম করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, এ বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য বেশি পবিত্র”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮] মহান আল্লাহ আরো বলেন-“মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। এটিই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।”[সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩০] তিনি আরো বলেন-হে নাবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(সূরাহ আহযাব: ৫৯)।নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীগণ হলেন সকল মুমিনের মা। অথচ তাঁদের সাথেই লেনদেন বা কথা-বার্তা বলতে হলে পর্দার আড়াল থেকে করতে বলা হয়েছে। তাহলে অন্যান্য সাধারণ বেগানা নারীদের ক্ষেত্রে হুকুমটি কত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত তা তো সহজেই অনুমেয়।
.
তাই কাউকে প্রাইভেট পড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম বা নিরাপদ হল,ছেলে অন্য ছেলেদেরকে প্রাইভেট পড়াবে এবং মেয়ে অন্য মেয়েদেরকে প্রাইভেট পড়াবে। যথাসম্ভব বিপরীত লিঙ্গকে প্রাইভেট পড়ানো থেকে বিরত থাকাই অধিক নিরাপদ। এর বিক্রম হলে এক দিকে যেমন ফরজ পর্দা রক্ষা করা সম্ভব হয়না,অপরদিকে ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে।
.
হাদিসে এসেছে আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন,যদি কোন মুসলমানের কোন নারীর সৌন্দর্যের প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায়, অতঃপর সে নিজ চক্ষু নিচু করে নেয়,তবে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য এমন এক ইবাদতের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন, যাতে সে তার স্বাদ অনুভব করতে পারবে।(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২২৭৮)
.
রাসূল(ﷺ) আলী রাঃ কে বলেন, হে আলী! [সহসা] একবার দেখার পর পুনরায় [কোন বেগানা নারীকে] দেখো না। কারণ, তোমার জন্য প্রথমবারে অনুমতি রয়েছে। [যখন তা অনিচ্ছায় হয়ে যাবে]।কিন্তু দ্বিতীয়বারের অনুমতি নেই।(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২৯৭৪, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২৭৫১, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২১৪৯, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৭৭৭)
.
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,‘কোন পরপুরুষ যদি কোন পরনারীর সঙ্গে নির্জনে মিলিত হয়, তাহ’লে সেখানে তৃতীয়জন উপস্থিত হয়, যার নাম শয়তান।’(তিরমিযী, মিশকাত হা/৩১১৮)।
.
সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটি লাজনা দায়েমায়
বলা হয়েছে:“কোন পুরুষের জন্য মেয়েদেরকে সরাসরি (সামনাসামনি) পাঠদান করা বৈধ নয়। কারণ এতে রয়েছে বিশাল বিপদ ও ভয়াবহ পরিণতি।
”(ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১২/১৪৯)
.
সুতরাং,সকলের কর্তব্য হল নারী-পুরুষ একসাথে প্রাইভেট পড়ানো বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ছেলেরা ছেলেদেরকে প্রাইভেট পড়ানো, কিন্তু কোন ভাবেই নারী পুরুষ একসাথে পড়ানো উচিত নয়।এমন সম্ভব না হলে আপনার উচিত হল বিকল্প পন্থায় হালাল উপায় অনুসন্ধান করা।এতে আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে অভাবমুক্ত করবেন এবং এর উত্তম প্রতিদান দিবেন ইন শা-আল্লাহ।মহান আল্লাহ বলেন,যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ খুলে দেন’।এবং তিনি তাকে রূযী দান করেন এমন পথে, যা সে ধারণাও করতে পারে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হন।(সূরা তালাক ২-৩)
◾কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও বিকল্প কোন উপায় না থাকলে এবং পারিবারিক সমস্যা বা নিজের আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে নারীদেরকে সাময়িকভাবে
প্রাইভেট পড়াতে চাইলে কিছু শর্ত পূরন করলে জায়েজ হতে পারে। যেমন:
___________________________________
▪️(১).ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়ানোর সময় ছেলেদেরকে আলাদা এবং মেয়েকে আলাদা অর্থাৎ
পৃথক পৃথক ভাবে পড়াতে হবে একসাথে নয়।(সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/৩১০০ আবুদাঊদ হা/২১৪৯; মিশকাত হা/৩১১০)।

▪️(২).প্রাইভেট পড়ানোর সময় বিশেষ করে নারীদের পড়ানোর ক্ষেত্রে নিজেকে পর্দার অন্তরালে রেখে তাদেরকে পড়াতে হবে।যেন তারা আপনাকে সরাসরি দেখতে না পায় এবং আপনিও তাদেরকে দেখতে না পান।(সূরা নূর,৩০-৩১)

▪️(২).এমনকি মেয়েরা হিজাব পরিহিত হলেও সামনাসামনি বসে তাদেরকে পড়ানো জায়েজ হবে না। কেননা এতে পর্দার বিধান লংঘন হবে এবং ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে, আর নারীর ফিতনা বড় কঠিন। (বুখারী হা/৫০৯৬, মুসলিম হা/২৭৪১; মিশকাত হা/৩০৮৫)।

▪️(৩).কোনক্রমেই প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে একাকী পড়ানো যাবে না। বরং মাহরাম সহ অথবা কয়েকজনকে একসাথে পড়াতে হবে। কারণ রাসূল (ﷺ)বলেছেন, ‘কোন পরপুরুষ যদি কোন পরনারীর সঙ্গে নির্জনে মিলিত হয়, তাহ’লে সেখানে তৃতীয়জন উপস্থিত হয়, যার নাম শয়তান।’(তিরমিযী, মিশকাত হা/৩১১৮)।

▪️(৪).প্রাইভেট পড়ার সময় মেয়েরা কোমল কণ্ঠ পরিহার করবে।কেননা কুরআনে নারীদেরকে পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।(সূরা আহযাব: ৩২)
.
◾এক্ষেত্রে প্রাইভেট থেকে প্রাপ্ত আয় কি হারাম হবে?
___________________________________
শরীয়তের দৃষ্টিতে নারী পুরুষ একসাথে প্রাইভেট পড়ানো নিষিদ্ধ হলেও আপনি যদি সহশিক্ষা সম্ভলিত কলেজ/ভার্সিটির নিয়ম অনুসারে কোনো প্রকার অবহেলা-অলসতা না করে তাদের সাথে হওয়া নিদিষ্ট চুক্তি বা শর্ত অনুযায়ী তাদেরকে প্রাইভেট পড়ান,তাহলে আপনার টিউশনি থেকে প্রাপ্ত অর্থ হারাম হবে না।কেননা টিউশনি করাও মৌলিকভাবে হারাম নয় বরং হালাল।কিন্তু শরীয়তী বিধান পর্দা রক্ষা না করার জন্য গুনাহগার হবেন। নারীদেরকে প্রাইভেট পড়িয়ে বেতন নেয়ার অর্থ হালাল হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটির ওলামাগন বলেন:এই কাজের বিনিময়ে আপনি যে অর্থ উপার্জন করবেন, তাতে আপনার লাভবান হওয়াতে দোষের কিছু নেই, কারণ আপনি যে বেতন নিয়েছেন তা পাঠদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহন করেছেন এটি জায়েজ।তবে আপনাকে অবশ্যই এই কাজটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করতে হবে এবং অন্য একটি চাকরির সন্ধান করতে হবে।যাতে আপনি হারাম ও ফিতনায় পড়া থেকে নিরাপদ থাকতে পারেন।(ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা,১২/১৫৬):https:///ar/answers/79549/حكم-تدريس-الرجل-للفتيات-بلا-حاىل
আর মুমিনদের আল্লাহর উপরেই ভরসা করা উচিত
(সূরা আলে ইমরান ৩/১২২)।আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_____________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: