ভূমিকাঃ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের এমন কোন দিক নেই, যার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ইসলাম প্রদান করেনি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক পরিমলসহ সকল ক্ষেত্রেই মেনে চলার জন্য ইসলাম দিয়েছে বিস্তারিত ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধান। পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ মানবজীবনের অন্যতম সুন্নত এবং ফজিলত পূর্ণ আমল হল সালাম আদান প্রদানের পর মুসাফাহ করা।
.
মুসাফাহা শব্দের অর্থ পরস্পরের হাতের তালু মিলানো (إلصاق صفح الكف بالكف)। মুসাফাহার সময় একে অপরের ডান হাতের তালু মিলিয়ে করমর্দন করতে হয়। এটা রাসূল (ﷺ) ও সাহাবীগণের যুগ হ’তে চলে আসা একটি সামাজিক আদর্শগত সুন্নাত (বুখারী হা/৬২৬৩, মিশকাত হা/৪৬৭৭)। মুছাফাহা-এর অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, هِيَ مُفَاعَلَةٌ مِنَ الصَّفْحَةِ وَالْمُرَادُ بِهَا الْإِفْضَاءُ بِصَفْحَةِ الْيَدِ إِلَى صَفْحَةِ الْيَدِ ‘এটা صفحة থেকে বাবে مفاعلة-এর মাছদার বা ক্রিয়ামূল। যার অর্থ হাতের তালুর সাথে হাতের তালু মিলানো’(ফাৎহুল বারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫৪) ইবনুল আছীর (রহঃ) ‘আন-নিহায়া’ গ্রন্থে লিখেছেন,এক হাতের তালুর ভিতরের অংশের সাথে অন্য হাতের তালুর ভিতরের অংশ মিলানো এবং পরস্পরের চেহারা মুখোমুখি করা (ইবনুল আছীর, আন-নিহায়া, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৮৮) মোল্লা আলী ক্বারী হানাফীও মুসাফাহার অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, মুসাফাহ হ’ল হাতের তালুর সাথে হাতের তালু মিলানো’ (মিরক্বাত শরহে মিশকাত, ২য় খন্ড, পৃঃ ৮৪)
.
◾মুসাফাহার সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি:
__________________________________
ইসলামি শরীয়তে সালাম বিনিময় ও মুসাফাহা করা নি:সন্দেহে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতের কাজ। মুসাফাহ হল সাক্ষাৎ ও বিদায়ের সময় বিধেয়। কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতের সময় সালামের পর মুসাফাহা সুন্নাত এবং বিদায়ের সময় মুসাফাহ করা মুস্তাহাব।(সিলসিলাহ সহীহাহ ১/১/৫৩পৃঃ) মুসাফাহার সুন্নাতী পদ্ধতি হল মুসাফাহাকারী ব্যক্তি একে অপরের শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করবে। আর যার সাথে সালাম করা হল তার হাতের তালু সালাম দাতার হাতের তালুতে রাখবে। জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-এর নিকটে মুছাফাহা করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কেবল দু’হাত মিলানোর ব্যাপারে সম্মতি দেন।(তিরমিযী, হা/২৭২৮, হাদীছ হাসান; মিশকাত, হা/৪৬৮০) মুসাফাহা করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যখন কোন মুমিন অপর মুমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং তাকে সালাম করে ও তার একহাত ধরে মুছাফাহা করে, তখন উভয়ের গোনাহ ঝরে পড়ে, যেমন গাছের পাতা ঝরে পড়ে। (ত্বাবারাণী, সিলসিলা সহীহাহ হা/৫২৬)। রাসূল ﷺ আরো বলেন, যখন দু’জন মুসলিম পরস্পরে মিলিত হয়ে মুসাফাহা করে তখন তারা পৃথক হওয়ার পূর্বেই তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয় (আবুদাউদ হা/৫২১৪, মিশকাত হা/৪৬৭৯)।
◾ কয় হাতে মুসাফাহা করবেন:
______________________________
মুসাফাহা কয় হাতে করতে হবে এ ব্যাপারে আহালুল ইমামগনের মধ্য থেকে দুটি মত পাওয়া যায়। একটি হল এক হাতে মুসাফাহা করবে। অর্থাৎ শুধু ডান হাত দিয়ে মুসাফাহ করবে। দ্বিতীয় মতটি হল মুসাফাহা দুই হাতে হবে। অর্থাৎ ডান হাতের সাথে বাম হাতও যোগ করা হবে তবে এই মর্মে দলিলগুলো দুর্বল। তাই মতানৈক্য থাকলেও একাধিক হাদীসের আলোকে বিশুদ্ধ মত হল এক হাতে মুসাফাহ করা। কারণ, মুসাফাহ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এটি একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ হল, “এক হাতের তালুকে অপর ব্যক্তির হাতের তালুতে রাখা।”(মু’জামু মাকায়ীসিল লুগাহ ৩/২৩৯ ইত্যাদি।) এবং যে সব হাদিসে মুসাফাহ আলোচনা এসেছে সেগুলো থেকে বাহ্যিক অর্থ এটাই বুঝা যায়। অর্থাৎ সাক্ষাতের সময় হোক বা কেনা-বেচার সময় হোক দুই জনের দুই হাত দ্বারা মুসাফাহ করা সুন্নাত। হানাফী, শাফি‘ঈ ও হাম্বালী ‘আলিমগণ এ ব্যাখ্যা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন। ফকীহ শায়খ মুহাম্মাদ আমীন ওরফে ইবনু আবিদীন স্বীয় رد المختار على الله المختار নামক গ্রন্থে বলেনঃ উত্তম হল ডান হাতে মুসাফাহ করা। কারণ ভাল কাজে ডান পক্ষই অবলম্বন করা শ্রেয়। সে কারণ ‘‘বাহরুল আমীন’’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, হাজরে আসওয়াদ হলো আল্লাহর ডান পক্ষ। এর দ্বারা আল্লাহ তার বান্দার সাথে মুসাফাহ করেন। আর মুসাফাহ ডানই হয়। শায়খ জিয়াউদ্দীন হানাফী নকশবন্দী তাঁর শারাহ لوامع العقول নামক গ্রন্থে বলেন, শারী‘আতে সুন্নাত পালনের আদাব হল, উভয় পক্ষের ডান হাতকে নিযুক্ত করা। সুতরাং সেটা বাম হাতের দ্বারা বাম হাতের অথবা ডান হাতে বাম হাতে সমাধা করলে হবে না। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) ডান হাতে মুসাফাহ্ করাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছেন। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৭ম খন্ড, হাঃ ২৭২৭ মিশকাতুল মাসাবিহ ৪৬৭৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.
আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) বলেন, তোমরা আমার এই হাতের তালু দেখছ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি এই হাতের তালুকে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর হাতের তালুতে রেখেছি’ (মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৭২৬, ৪/১৮৯; মাওয়ারিদুয যামআন হা/৯৪০; আরনাউত্ব বলেন, হাদীছটির রাবীগণ ছিকাহ (বিশ্বস্ত)। তবে এর সনদ ইযত্বিরাবের দোষে দুষ্ট) মুসাফাহ কয় হাতে হবে এ নিয়ে শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদকে প্রশ্ন করা হলে, তিনি জবাবে বলেছেন, মুসাফাহ সংঘটিত হয় ব্যক্তি তার হাতের তালু অপর ব্যক্তির হাতের তালুতে রাখার মাধ্যমে। এটাই আরবী ভাষার দাবী। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯২৮০৬) সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,“দুই হাতে মুসাফাহা করার ব্যাপারে আমরা কোন কিছু জানি না। তবে এভাবে করাটা অনুচিত। উত্তম হল এক হাতে মুসাফাহ করা (ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, ফাতওয়া নং:২৪/১২৫)
.
◾কাদের সাথে মুসাফাহ করা জায়েজ:
______________________________________
ইসলামী শরীআত বিধান হল পুরুষরা পুরুষদের সাথে নারীরা নারীদের সাথে মুসাফাহ করবে কেননা কোনো পুরুষ পরনারীর সাথে এবং কোনো নারী পরপুরুষের সাথে মুছাফাহা করা জায়েজ নয় বরং হারাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুকরণ,ইয়াহূদী-
খ্রিষ্টানদের কৃষ্টি-কালচার যেভাবে দ্রুতগতিতে মুসলিম সমাজে সংক্রমিত হচ্ছে, মুসলিমরা নিজেদের সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে ইয়াহূদী-নাছারাদের পদাঙ্ক অনুসরণে পরপুরুষ ও পরনারীর সাথে উদারতা ও আধুনিকতার নামে যেভাবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করছে, তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য। রাসূল (ﷺ) বলেছেন তোমাদের কারোর মাথায় লোহার সুই দিয়ে আঘাত করা তার জন্য অনেক শ্রেয় বেগানা কোন নারীকে স্পর্শ করার চাইতে (সহীহ আল-জা’মি/৯২১) আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! রাসূল (ﷺ)-এর হাত কখনই কোনো নারীর হাত স্পর্শ করেনি।(সহীহ বুখারী হা/৫২৮৮; সহীহ মুসলিম হা/১৮৬৬) বিশিষ্ট ফক্বীহ আল্লামা রিয়াজ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মুসাইমিরী বলেন, উম্মতের পূর্ববর্তী-পরবর্তী সকল আলেম ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, পরনারীর সাথে পুরুষের মুছাফাহ করা হারাম (ইতহাফুল ইখওয়ান ফী হুকমি মুসাফাহাতিল নিসওয়ান, পৃ. ৪)
এ ব্যপারে শাইখুল ইসলাম,ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.]-এর অভিমত প্রণিধান যোগ্য। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মেহরান বলেন, পুরুষ নারীর সাথে মুসাফাহ করতে পারবে কিনা? ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাবে বলেন, না। এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করেন। আমি বললাম, কাপড়ের সাহায্যে পুরুষ নারীর সাথে মুসাফাহা করতে পারবে কিনা? তিনি জবাব দিলেন, পারবে না; বরং পুরুষ নারীর সাথে যেকোনো মাধ্যমেই মুসাফাহা হারাম। (ইতহাফুল ইখওয়ান ফি হুকমি মুসাফাহাতিল নিসওয়ান, পৃ. ৫)
.
পরিশেষ জেনে রাখা ভাল যে, দুইজনের চার হাত মিলানো ও বুকে হাত লাগানোর প্রচলিত প্রথা সুন্নাত বিরোধী আমল (ইবনু মাজাহ হা/৩৭০২; তিরমিযী হা/২৭২৮; মিশকাত হা/৪৬৮০)। এছাড়া হাতে বা কপালে চুমু খাওয়া, পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করা সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসটি যঈফ (তিরমিযী হা/২৭৩৩; ইবনু মাজাহ হা/৩৭০৪-০৫; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৯৭৫-৭৬, আলবানী সনদ যঈফ)। পাশাপাশি মুসাফাহ করার সময় সমাজে যে দোয়াটি চালু আছে অর্থাৎ يَغْفِرُاللهُ لَنَا وَلَكُمْ উচ্চারণঃ ইয়াগফিরুল্লাহু-লানা ওয়ালাকুম এটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয় বরং কারো সাথে সাক্ষাত হলে সালাম দিবে তারপর মুসাফাহ করবে, মুসাফাহ করা নবী করীম (ﷺ) -এর সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, সালামের পরে মুসাফাহ করা সালামের পূর্ণতা (আদাবুল মুদরাদ হা/৯৬৮; সনদ সহীহ)। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হক্ব বুঝার ও তা মানার তাওফীক দিন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।