ভূমিকা: হজ্জের সফরে নারীর সাথে মাহরাম (স্বামী বা এমন সাবালোক পুরুষ যার সাথে সফরে ইচ্ছুক মহিলার স্থায়ীভাবে বিবাহ হারাম) থাকা শর্ত কিনা এ সংক্রান্ত মাসয়ালাতে পূর্ববর্তী এবং বর্তমান আলেমদের মতভেদ রয়েছে; দলিলগুলো পর্যালোচনা করলে দুটি মত পাওয়া যায়। যেমন:
.
(১). ইমাম মালেক, শাফেয়ি ও ইমাম আওযায়ি (রাহিমাহুল্লাহ) সহ একদল আলেম বলেছেন: রাস্তা নিরাপদ হলে ও সঙ্গিগণ নির্ভরযোগ্য হলে কোন নারী মাহরাম ছাড়াই হজ্জ আদায় করতে পারে। এই মতের পক্ষে দলিল হচ্ছে: প্রখ্যাত সাহাবী আদি বিন হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদিন আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত ছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি এসে তাঁর কাছে দারিদ্রের অভিযোগ করল। কিছুক্ষণ পর আরেক লোক এসে দস্যুতার শিকার হওয়ার অভিযোগ করল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: হে আদি, তুমি কি হেরাত (বর্তমানে ইরাকের কুফা) দেখেছ? আমি বললাম: দেখিনি, তবে শুনেছি। তিনি বললেন: যদি তুমি দীর্ঘদিন বেঁচে থাক তাহলে দেখবে হেরাত থেকে একজন নারী কাবা তাওয়াফ করার জন্য আসবে; কিন্তু সে নারী আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবে না। আদি বলেন: আমি দেখেছি, হেরাত থেকে একজন নারী সফর করে এসে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেছে; কিন্তু আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায়নি।(সহিহ বুখারী হা/৩৪০০) তবে হাদীসটির প্রত্যুত্তর হচ্ছে- এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে এ ধরণের বিষয় ঘটবার সংবাদ। কোন একটি বিষয় সংঘটিত হওয়ার সংবাদ দেওয়ার অর্থ এ নয় যে, এটি জায়েয। বরং হতে পারে, সেটি জায়েয; হতে পারে সেটি নাজায়েয- দলিলের ভিত্তিতে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের আগে মদ্যপান, ব্যভিচার ও হত্যা ব্যাপক হারে সংঘটিত হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন; অথচ এগুলো হারাম, কবিরা গুনাহ। তাই এ হাদিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে- নিরাপত্তা বিস্তার লাভ করবে এমনকি কোন কোন নারী দুঃসাহস করে মাহরাম ছাড়া একাকী সফর করবে। হাদিসের উদ্দেশ্য এটা নয় যে,মাহরাম ছাড়া সফর করা জায়েয। তারা আরো বলেন: জরুরী ক্ষেত্রে যদি এক মাহরাম প্লেনে উঠিয়ে দেন, অতঃপর অপর মাহরাম ইয়ারপোর্ট থেকে তাকে নিয়ে যান যখন প্লেন সেখানে পৌঁছে। তাদের ধারণায় বহু নারী পুরুষ একসাথে থাকার কারণে প্লেন নিরাপদ। যেমন:
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ) এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ,শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে জিবরীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: একজন মহিলার নিজেরাই প্লেনে ভ্রমণ করার বিধান কী, যদি তাঁর মাহরাম তাঁকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয় এবং অন্য মাহরাম তাঁকে অপরপ্রান্তে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যায়?
জবাবে শাইখ বলেন:
لا بأس بذلك عند المشقة على المحرم ، كالزوج أو الأب ، إذا اضطرت المرأة إلى السفر ، ولم يتيسر للمحرم صحبتها ، فلا مانع من ذلك بشرط أن يوصلها المحرم الأول إلى المطار ، فلا يفارقها حتى تركب الطائرة ، ويتصل بالبلاد التي توجهت إليها ، ويتأكد من محارمها هناك أنهم سوف يستقبلونها في المطار ، ويخبرهم بالوقت الذي تَقْدُمُ فيه ورقم الرحلة .. لأن الضرورات لها أحكامها، والله أعلم وصلى الله على محمد وعلى آله وصحبه وسلم ”
“যদি মাহরামের জন্য ভ্রমণে সঙ্গ দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে যেমন তার স্বামী বা পিতা এবং মহিলার ভ্রমণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে তাহলে এই পরিস্থিতিতে কোনো সমস্যা নেই। তবে শর্ত হলো প্রথম মাহরাম তাকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাবে এবং প্লেনে ওঠা পর্যন্ত তার সাথে থাকবেন। এরপর তিনি যে দেশে যাবেন সেখানে উপস্থিত মাহরামের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত করবে যিনি তাকে গ্রহণ করবেন। আগমনের সময় এবং ফ্লাইটের বিবরণও তাদের জানিয়ে দেওয়া হবে। কারণ প্রয়োজন ও বিপদের ক্ষেত্রে আলাদা বিধান থাকে। এ বিষয়ে আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞানী। আল্লাহ আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ), তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীদের ওপর রহমত এবং শান্তি বর্ষণ করুন।(ফাতওয়ায় ইবনু জিবরীন;ও ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১২২৬৩০)
.
(২). অপরদিকে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আহমাদ, হাসান, নাখায়ী, ইসহাক, ইবনুল মুনযিরসহ জমহুর আলেমগনের মতে নারীর জন্য হজ্জের উদ্দেশ্যে কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাকে হেফাযতকারী মাহরাম স্বামী কিংবা অন্য কোন মাহরাম পুরুষের সঙ্গ ছাড়া সফর করা জায়েয নেই…। আর এটিই সহীহ এবং বিশুদ্ধ মত। ইসলাম নারীকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সফরে নারীর সাথে মাহরাম থাকা ওয়াজিব করে দিয়েছে; যাতে করে মাহরাম পুরুষ নারীকে দুশ্চরিত্র ও হীন-উদ্দেশ্য চরিতার্থকারী লোকদের থেকে নিরাপদ রাখতে পারে এবং সফরে নারীর দুর্বলতায় তাকে সহযোগিতা করতে পারে। এটি শরীয়তের পূর্ণতা, মাহাত্ম্য, শরিয়ত কর্তৃক নারীর ইজ্জতের সুরক্ষা দেয়া, নারীকে সম্মান দেয়া, নারীর প্রতি গুরুত্বারোপ করা, নারীকে সুরক্ষিত রাখা এবং ফিতনা ও স্খলনের পথগুলো থেকে আগলে রাখার জন্য শরীয়তের সচেতনতার অন্তর্ভুক্ত; হোক সেই ফিতনা নারীর পক্ষ থেকে কিংবা অন্যদের পক্ষ থেকে। যেহেতু সফর হচ্ছে এক টুকরো কষ্ট। তাই মাহরাম ছাড়া কোন নারীর সফর করা জায়েয নয়। যারা নারীদের গ্রুপের সাথে যারা নারীকে ওয়াজিব হজের অনুমতি প্রদান করেছে তারা সুন্নত পরিপন্থী সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ইমাম খাত্তাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে মাহরাম ব্যতীত সফর করতে নিষেধ করেছেন, অতএব শর্ত ব্যতীত তাকে হজের সফরে বের হওয়ার অনুমতি প্রদান করা সুন্নত পরিপন্থী, যে সুন্নত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাস্তবায়ন করেছেন। মাহরাম ব্যতীত নারীর সফর পাপ তাই তার ওপর হজ ওয়াজিব বলা দুরস্ত নয়। এ আদেশ মানুষকে পাপের দিকে ধাবিত করবে”।(ইমাম নববী, শারহু সহীহ মুসলিম, খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ১০৩) এই মতের পক্ষে দলিল হচ্ছে:
.
যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কোন নারী মাহরাম ছাড়া সফর করবে না। মাহরামের উপস্থিতি ব্যতীত কোন নারীর কাছে কোন পুরুষ প্রবেশ করবে না। তখন এক ব্যক্তি বলল ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি অমুক সেনাদলে যোগ দিতে চাই; কিন্তু আমার স্ত্রী হজ্জ করতে চান। তখন তিনি বললেন: তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে যাও”(সহিহ বুখারী হা/১৭৬৩; ও সহিহ মুসলিম হা/১৩৪১) অপর বর্ননায় প্রখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৫৯ হি.] থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমানদার কোন নারীর জন্য মাহরাম ছাড়া একদিন একরাতের কোন সফরে বের হওয়া বৈধ নয়”(সহিহ বুখারী হা/১০৩৮; ও সহিহ মুসলিম হা/১৩৩) সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে- “দুইদিনের সফরে”। উক্ত হাদীসগুলোতে বলা হয়েছে (لَا تُسَافِرُ امْرَأَةٌ) ‘‘কোন মহিলা সফর করবে না’’। চাই সে সফর হজ্জের জন্য হোক অথবা অন্য কোন কারণে হোক। আর সফর মটর গাড়ীতে হোক, উড়োজাহাজে হোক অথবা রেলগাড়ীতেই হোক, যে কোন পন্থায়ই হোক। মাহরাম ব্যতীত মহিলার জন্য সকল প্রকার সফরই হারাম। আর মহিলা যুবতীই হোক আর বৃদ্ধাই হোক সবার ক্ষেত্রে একই হুকুম প্রযোজ্য। উলামাগণের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে যে, কোন মহিলা যখন সম্পদশালী হয় এবং তার যদি মাহরাম বা স্বামী না থাকে তাহলে তার ওপর কি হজ্জ/হজ ফরয? সঠিক কথা এই যে, কোন মহিলার পক্ষেই কোন সফরের জন্য মাহরাম অথবা স্বামী ব্যতীত সফর করা বৈধ নয়। অতএব যে মহিলার স্বামী বা মাহরাম নেই এ ওজর থাকার কারণে তার উপর হজ্জ ফরয নয়। মাহরামের ক্ষেত্রে আলেমগণ পাঁচটি শর্ত উল্লেখ করে থাকেন। সেগুলো হচ্ছে- পুরুষ হওয়া, মুসলিম হওয়া, বালেগ হওয়া, আকলবান হওয়া এবং এ নারীর জন্য পুরুষ লোকটি চিরস্থায়ীভাবে হারাম হওয়া; যেমন- পিতা, ভাই, চাচা, মামা, শ্বশুর, মায়ের স্বামী, দুধ-ভাই প্রমুখ (অস্থায়ীভাবে হারাম এমন পুরুষ নয়, যেমন- ভগ্নীপতি, ফুফা, খালু প্রমুখ।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইবনু উসাইমীন আশ-শারহুল মুমতি খণ্ড:৭ পৃষ্ঠা;৩৮)
.
হাদিস গুলোর ব্যাখ্যা শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম:৭৭৩ হি: মৃত:৮৫২ হি:] বলেছেন:” وقيده في حديث أبي سعيد فقال : ( مسيرة يومين ) وفي حديث أبي هريرة مقيداً بـ ( مسيرة يوم وليلة ) وعنه روايات أخرى ، وحديث ابن عمر فيه مقيداً بـ ” ثلاثة أيام ” ، وعنه روايات أخرى أيضاً .وقد عمل أكثر العلماء في هذا الباب بالمطلق لاختلاف التقييدات .وقال النووي : ليس المراد من التحديد ظاهره بل كل ما يسمى سفراً فالمرأة منهية عنه إلا بالمحرم ، وإنما وقع التحديد عن أمر واقع فلا يعمل بمفهومه ، وقال ابن المنير: وقع الاختلاف في مواطن بحسب السائلين
“আবু সাঈদ (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে- “দুইদিনের সফরে”। আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে- “একদিন একরাতের সফরে”। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে অন্যরকম বর্ণনাও আছে। ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে- “তিনদিনের সফরে”। তাঁর থেকে আরও বর্ণনা আছে। দিনের সংখ্যা নির্ধারণের এ বিভিন্নতার কারণে অধিকাংশ আলেমের মতে, যে কোন ধরণের সফরের ক্ষেত্রে হাদিসটির বিধান প্রযোজ্য।ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন;“সময়সীমা নির্ধারণ উদ্দেশ্য নয়। বরং সফর বলতে যা বুঝায় নারীর জন্য মাহরাম ছাড়া তাতে বের হওয়া নিষিদ্ধ। সময় নির্ধারণের উল্লেখ এসেছে কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে; তাই সেটা ধর্তব্য নয়। ইবনুল মুনায়্যির বলেন: একাধিক প্রশ্নকারীর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সময়সীমা নির্ধারণের এতরকম বর্ণনা এসেছে।”(ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৭৫)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,
المرأة التي لا محرم لها لا يجب عليها الحج، لأن المحرم بالنسبة لها من السبيل، واستطاعة السبيل شرط في وجوب الحج، قال الله تعالى: ( ولله على الناس حج البيت من استطاع إليه سبيلا ) آل عمران / 97 .ولا يجوز لها أن تسافر للحج أو غيره إلا ومعها زوج أو محرم لها؛ … وبهذا القول قال الحسن والنخعي وأحمد وإسحاق وابن المنذر وأصحاب الرأي، وهو الصحيح ؛ للآية المذكورة مع عموم أحاديث نهي المرأة عن السفر بلا زوج أو محرم، وخالف في ذلك مالك والشافعي والأوزاعي، واشترط كل منهم شرطاً لا حجة له عليه، قال ابن المنذر: تركوا القول بظاهر الحديث، واشترط كل منهم ما لا حجة له عليه ”
“যে নারীর মাহরাম নেই তার উপর হজ্জ ফরয নয়। কারণ নারীর জন্য মাহরাম থাকা সামর্থ্য থাকার পর্যায়ভুক্ত। সফরের সামর্থ্য থাকা হজ্জ ফরয হওয়ার পূর্বশর্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন: “মানুষের মধ্যে যারা বায়তুল্লাতে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্জ আদায় করা ফরজ।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭] নারীর জন্য হজ্জের উদ্দেশ্যে কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে স্বামী কিংবা মাহরামের সঙ্গ ছাড়া সফর করা জায়েয নেই…। এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন- হাসান, নাখায়ী, আহমাদ, ইসহাক, ইবনুল মুনযির ও আসহাবুল রায়। এটি সহিহ অভিমত উল্লেখিত আয়াতের কারণে এবং স্বামী কিংবা মাহরাম ছাড়া নারীর সফর নিষিদ্ধ হওয়া সংক্রান্ত হাদিসগুলোর সাধারণ হুকুমের কারণে। এর বিপরীত রায় দিয়েছেন ইমাম মালেক, শাফেয়ি ও আওযায়ি। তাঁরা প্রত্যেকে এমন একটি শর্ত করেছেন যে শর্তের পক্ষে কোন দলিল নেই। ইবনুল মুনযির বলেন: “তাঁরা হাদিসের প্রকাশ্য ভাবকে বাদ দিয়েছেন এবং প্রত্যেকে এমন একটি শর্ত করেছেন যার সমর্থনে কোন দলিল নেই।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৯০-৯১)
.
তারা আরও বলেছেন:” الصحيح أنها لا يجوز لها أن تسافر للحج إلا مع زوجها أو محرم لها من الرجال ، فلا يجوز لها أن تسافر مع نسوة ثقات غير محارم ، أو مع عمتها أو خالتها أو أمها بل لا بد من أن تكون مع زوجها أو محرم لها من الرجال .فإن لم تجد من يصحبها منهما فلا يجب عليها الحج ما دامت كذلك, “সহিহ হচ্ছে মহিলার জন্য স্বামী ছাড়া কিংবা পুরুষ মাহরাম ছাড়া হজ্জের জন্য সফর করা জায়েয নেই। মাহরাম ছাড়া নির্ভরযোগ্য মহিলা, নিজের ফুফু, খালা, কিংবা মায়ের সাথে সফর করা তার জন্য জায়েয নেই। বরং অবশ্যই নিজের স্বামীর সাথে কিংবা মাহরাম পুরুষদের সাথে সফর করতে হবে। যদি সঙ্গে যাওয়ার মত এমন কাউকে না পায় তাহলে সে নারীর উপর হজ্জ ফরয হবে না।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৯২)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:
لا يجوز للمسلمة أن تحج بدون محرم، النبي ﷺ قال: لا تسافر امرأة إلا مع ذي محرم وقد ذهب بعض العلماء إلى جواز الحج مع ثقات النساء بدون محرم ولكنه قول مرجوح، والصواب: ما قاله النبي ﷺ: لا تسافر امرأة إلا مع ذي محرم لكن لو حجت مع النساء صح حجها، وعليها التوبة إلى الله؛ لأنها أخطأت وأثمت فعليها التوبة إلى الله والندم وأن لا تعود إلى مثل هذا وحجها صحيح إن شاء الله؛ لأنها.. أدت مناسك الحج، فصح مع الإثم في مخالفتها السنة، في حجها بدون محرم، والله ولي التوفيق، وله سبحانه وتعالى الحكمة البالغة وعليها التوبة من ذلك.
“কোনও মুসলিম নারীর জন্য মাহরাম পুরুষ (যাদের সাথে স্থায়ীভাবে বিয়ে হারাম) ছাড়া হজ করা জায়েজ নাই। নবী ﷺ বলেছেন;“কোন মহিলা মাহরাম পুরুষ ছাড়া সফর করবে না।” [সহিহ মুসলিম] কতিপয় আলেম মাহরাম পুরষ ছাড়া বিশ্বস্ত মহিলাদের সাথে হজ করা বৈধ বললেও তা অ আগ্রাধিকারযোগ্য মত নয়। বরং সঠিক কথা হল, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কোন মহিলা মাহরাম পুরষ ছাড়া সফর করবে না।” তবে কেউ যদি একদল মহিলার সাথে হজ করে তাহলে তার হজ সহিহ হয়ে যাবে। কিন্তু সে ভুল কাজ করবে। এতে সে গুনাহগার হবে। তাই তার জন্য লজ্জিত অন্তরে তওবা করা আবশ্যক এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এমনটি করবে না। কিন্তু ইনশাআল্লাহ তার হজ বিশুদ্ধ হবে। কারণ সে হজের কার্যাবলী আদায় করেছে। সুতরাং মাহরাম পুরুষ ছাড়া হজ করার কারণে গুনাহ এবং সুন্নতের বিরুদ্ধাচরণ সহকারে তার হজ সঠিক হবে। আল্লাহ তওফিক দানকারী এবং সুনিপুণ কৌশলের অধিকারী। ওই মহিলার কর্তব্য, এ কাজের জন্য তওবা করা।” [সূত্র: binbaz.অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-৭২৭১)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] মাহরাম ছাড়া হজ করা সম্পূর্ণ হারাম ও ইসলামি শরী‘আতের পরিপন্থী উল্লেখ করে বলেছেন:
وقد تساهل بعض الناس في وقتنا الحاضر فسوَّغ أن تذهب المرأة في الطائرة بدون محرم ، وهذا لا شك أنه خلاف النصوص العامة الظاهرة ، والسفر في الطائرة كغيره تعتريه الأخطار .فإن المسافرة في الطائرة إذا شيعها محرمها في المطار فإنه ينصرف بمجرد دخولها صالة الانتظار ، وهي وحدها بدون محرم وقد تغادر الطائرة في الوقت المحدد وقد تتأخر . وقد تقلع في الوقت المحدد فيعتريها سبب يقتضي رجوعها ، أو أن تنزل في مطار آخر غير المطار المتجهة إليه ، وكذلك ربما تنزل في المطار الذي تقصده بعد الوقت المحدد لسبب من الأسباب ، وإذا قُدِّر أنها نزلت في وقتها المحدد فإن المحرم الذي يستقبلها قد يتأخر عن الحضور في الوقت المعين لسبب من الأسباب ، إما لنوم أو زحام سيارات أو عطل في سيارته أو لغير ذلك من الأسباب المعلومة ، ثم لو قدر أنه حضر في الوقت المحدد واستقبل المرأة فإن من يكون إلى جانبها في الطائرة قد يكون رجلا يخدعها ويتعلق بها وتتعلق به .والحاصل أن المرأة عليها أن تخشى الله وتخافه فلا تسافر لا إلى الحج ولا إلى غيره إلا مع محرم يكون بالغًا عاقلا . والله المستعان
“বর্তমানে কিছু লোক শিথিলতা প্রদর্শন করে থাকেন, তারা বলেন যেসব মহিলা মাহরাম ছাড়া বিমানে সফর করবেন, তাদের জন্য এ সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এ মত সুস্পষ্ট অনেকগুলো দলীলের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিমানের সফরেও অন্যান্য সফরের মত নানাবিদ সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ, তাকে বিমানে তুলে দেওয়ার পর, সে একা তার সাথে কোনো মাহরাম নেই। আর বিমান নির্দিষ্ট সময়ে কখনো ছাড়ে আবার কখনো ছাড়ে না; বরং দেরীতে বা একদিন বিলম্বে ছাড়ে, তখন তাকে আবার ফিরে যেতে হয়। আবার কখনো এমন হয়, যেখানে অবতরণ করার কথা ছিল, সেখানে না নেমে অন্য কোনো বিমান বন্দরে অবতরণ করে অথবা এমনও হতে পারে, যে বিমান বন্দরে অবতরণ করার কথা সেখানে অবতরণ ঠিকই করে, তবে অনেক দেরীতে করে। আবার এও হতে পারে, নির্দিষ্ট সময়ে বিমান অবতরণ করেছে কিন্তু যে তাকে রিসিভ করবে, সে কোনো কারণে (যেমন অলসতা, ঘুম, রাস্তায় ভিড় ও পথে গাড়ী নষ্ট ইত্যাদি কারণে) সময় মতো বিমান বন্দরে উপস্থিত হতে পারে নি। তখনতো সে একা, যে কোনো সমস্যায় পড়তে পারে। তারপরও যদি ধরে নেওয়া যায়, সে নির্দিষ্ট সময়ে পৌছেছে এবং তাকে রিসিভও করেছে; কিন্তু বিমানের মধ্যে সে যার পাশে বসবে সে পুরুষ সে তাকে ধোকায় ফেলতে পারে এবং তাদের উভয়ের মাঝে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, যেমনটি বর্তমানে হয়ে থাকে। মোটকথা: নারীর জন্য উচিত হলো, সে আল্লাহকে ভয় করবে এবং তার অন্তরে একমাত্র আল্লাহরই ভয় থাকবে। আর তারা কখনোই চাই হজের সফর হোক অথবা অন্য কোন সফর মাহরাম ছাড়া কোথাও যেন সফর না করে, প্রাপ্ত বয়স্ক ও জ্ঞানী মাহরাম ছাড়া তার জন্য সফর করা বৈধ নয়। আল্লাহই ভালো জানেন।( ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৪৩৮০)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে এমন মহিলার প্রতি হজ্জ ফরয নয় যার কোন মাহরাম সফর সঙ্গীর ব্যবস্থা হবে না। কারণ মহিলার জন্য বিনা মাহরামে সফর করা ইসলামী বিধানে নিষিদ্ধ। তাই কোন মহিলার জন্য বিনা মাহরামে হজ্জ বা অন্য কোন সফরে ভ্রমণ করা জায়েয নয়,সে সফর দূরের হোক কিংবা কাছের, তার সঙ্গে আরো অন্যন্য মহিলারা থাক বা না থাক, উক্ত মহিলা যুবতী, সুন্দরী হোক অথবা বৃদ্ধা ও কুৎসিত। আর সে সফর বিমানে হোক কিংবা অন্য কোন যানবাহনে হোক। মাহরাম পুরুষ হচ্ছে স্বামী অথবা এমন কোন পুরুষ যার সাথে বিবাহ-বন্ধন চিরতরে হারাম ঔরসজাত কারণে অথবা দুগ্ধপানের কারণে অথবা বৈবাহিক আত্মীয়তার কারণে। জেনে রাখা ভাল যে,বোনের স্বামী (দুলাভাই), খালার স্বামী (খালু), ফুফুর স্বামী (ফুফা) মাহরাম নয়। কিছু কিছু নারী এ ব্যাপারে শিথিলতা করে বোন ও বোন জামাই এর সাথে সফর করেন অথবা খালা-খালুর সাথে সফর করেন– এটি হারাম। যেহেতু বোন জামাই বা খালু মাহরাম নয়। তাই এদের সাথে সফর করা জায়েয নয় এবং এভাবে হজ্ব করলে হজ্ব মাবরুর না হওয়ার আশংকা অধিক। কারণ মাবরুর হজ্ব হচ্ছে- যে হজ্বের মধ্যে কোন পাপ সংঘটিত হয় না। এই নারী তার গোটা সফরেই গুনাতে লিপ্ত। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাকে এবং আপনাদেরকে সমস্ত কল্যাণের তৌফিক দান করেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)। ▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.
অধ্যয়নরত, কিং খালেদ বিশ্ববিদ্যালয় আবহা, সৌদি আরব।